Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আমাদের শক্র মিত্র

রেজানুর রহমান ও সৈয়দ ইকবাল : শত্রু মিত্র না চিনলে কোনো সংগ্রামেই জয়লাভ করা যায় না। সেটা পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত প্রযোজ্য। অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন পরিবারের আবার শত্রু-মিত্র কী? বাবা-মা, ছেলে মেয়ে মিলেই তো পরিবার। সেখানে শত্রু-মিত্র কারা? আছে এখানেও শত্রু-মিত্র আছে। বাবা-মা কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করলেন। কত স্বপ্ন, কত আশা ছেলে একদিন অনেক বড় হবে। বড় চাকরি করবে। তারপর আর কোনো দুঃখ থাকবে না। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক পরিবারে বাবা-মায়ের এই প্রত্যাশা পুরণ হয় না। বাবা-মা হয়তো অনেক কষ্ট করে ছেলে-মেয়েকে মানুষ করেন। তারা বড় হয়। বিয়ে করার পর হঠাৎ করেই যেন কেউ কেউ বদলে যায়। তখন সংসারে দেখা দেয় নানা সমস্যা। সুখের সংসারে হঠাৎ করেই এই যে একটা অসুখ দেখা দেয় তার জন্য দায় কার? নতুন বউয়ের? নাকি ছেলের? কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাবা-মা নতুন বউকেই শত্রু ভেবে ফেলেন। কারণ নতুন বউ সংসারে আসার পরই সংসারটা যেন কেমন হয়ে গেল। যে ছেলে এক সময় বাবা-মায়ের একান্ত অনুগত ছিল সেই ছেলেই বাবা-মাকে আর পছন্দ করে না। বউয়ের কথায় চলে। বউ হ্যা বললে সেটাই হ্যা। বউ না বললে সেটাই না। ফলে একটা সংসারেও শত্রু-মিত্র দাঁড়িয়ে যায়। বাবা-মা সহ সংসারের অন্য সদস্যদের অনেকেই নতুন বউকে সংসারের শত্রু ভেবে ফেলে। অথচ একথা কেউই ভাবতে চায় না যে, নতুন বউ সংসারে নতুন। চিরচেনা একটা জগৎ ছেড়ে সে একা একটা নতুন জগতে এসেছে। সঙ্গত কারনেই স্বামী হয়ে ওঠে তার সুখ দুঃখের অবলম্বন। দেখা গেল স্বামী হয়তো বউয়ের প্রতি অধিক মনযোগ দিচ্ছে। আগে বাসা থেকে বেড়িয়ে যাবার সময় মাকে বলে যেত-মা আমি গেলাম। আবার বাসায় ফিরে মায়েরই খোঁজ-খবর নিত। বিয়ের পর এটা সে আর করে না। বাসা থেকে বেড়িয়ে যাবার সময় হয়তো বউকেই বলে যায়। ফিরে এসে বউকেই খোঁজে। এই নিয়েই অধিকাংশ সংসারে শুরু হয়ে যায় খুটখাট… মনোমালিন্য। সুখের সংসারে অজান্তে শত্রু-মিত্র গজিয়ে যায়। এই শত্রু-মিত্রের তালিকায় পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি পাড়া প্রতিবেশি সহ আত্মীয় স্বজনের অনেকেই যুক্ত হন। আর তখনই শত্রু-মিত্রের খেলায় তুষের আগুনের মতো একটা সুখের সংসার পুড়ে যায়। সংসার ভেঙ্গে যায়। স্বাভাবিক নিয়মে অর্থাৎ খালি চোখে হয়তো অনেকেই সংসারে আসা নতুন বউকেই দোষারোপ করেন। আদতে অনেক ক্ষেত্রে তা সত্য হয় না। কারণ একা নতুন বউ সংসারের শত্রু হয় কী করে? সংসারের আর সবাই কি তাহলে মিত্র? যদি তাই হয় তাহলে তো সংসার ভাঙ্গার কথা নয়। কিন্তু আমরা অনেকেই বোধকরি একটা ভুল করেই যাই। সংসারে আসা নতুন সদস্যকে যথার্থ অর্থে যোগ্য সম্মান অথবা গুরুত্ব দিতে ভুল করি। নতুন বউ সংসারে এলে সংসারের একটা পরিবর্তন ঘটবেই। ছেলে বউয়ের ন্যাওটা হবে। বউয়ের কথাকেই গুরুত্ব দিবে। এটাই স্বাভাবিক। বাবা-মায়ের মধ্যে যারা একটু চালাক তারা কিন্তু ব্যাপারটা সহজেই বুঝে ফেলে এবং হাসি মুখে যে কোনো পরিবর্তন মেনে নেয়। তখন আর সংসারে শত্রু-মিত্র সৃষ্টি হতে পারে না।

আমাদের চলচ্চিত্রও এক অর্থে একটি বড় সংসার। সে কারণে আমরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে ‘চলচ্চিত্র পরিবার’ বলে একটা আদুরে বাক্য ব্যবহার করি। হ্যা আমাদের চলচ্চিত্র এক সময় পরিবারই ছিল। যে সময়ের কথা বলছি তখনকার দিনে চলচ্চিত্র নামের এই পরিবারটা অনেক ধনার্ঢ্য ও ঐক্যবদ্ধ ছিল। শুধু আর্থিক অর্থে ধর্নাঢ্য নয়, মন-মানসিকতায়ও অনেক ধনার্ঢ্য ছিল। চলচ্চিত্রের মানুষেরা একে অন্যকে বেশ সম্মান করতেন, ভালো বাসতেন। হঠাৎ কি যে হল, ভালোবাসার এই মানুষ গুলো বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করলো। একজন অন্যজনকে শত্রু ভাবতে শুরু করলো। চলচ্চিত্র নামের সংসারটা শত্রু-মিত্রের খেলায় এখন এতটাই অস্থির যে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশংকা দেখা দিয়েছে।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম আচ্ছা, বলুন তো এই মুহর্তে আমাদের চলচ্চিত্রে শত্রু কে? মিত্রই বা কে? তিনি সাথে-সাথেই উত্তর দিলেন, আমাদের সিনেমার শত্রু-মিত্র ওই একজনই-দর্শক। দর্শকই হলো আমাদের সিনেমার শত্রু-মিত্র। কারণ দর্শক ছাড়া তো সিনেমা চলবে না। এই যে দীর্ঘ বছর ধরে সিনেমার ব্যবসায় ধস নেমেছে এর জন্য তো দর্শকই দায়ী। কারণ দর্শক সিনেমা দেখতে আসতো বলেই প্রযোজকের লগ্নিকৃত অর্থ ফিরে আসতো। এই সিনেমার সাথে যুক্ত থেকেই না অনেকে বাড়ি গাড়ি সহায় সম্পত্তি বানিয়েছেন। কার টাকায় এটা সম্ভব হয়েছে? অবশ্যই দর্শকের টাকায়। এখন যেহেতু দর্শক তেমন একটা সিনেমা হলে আসে না কাজেই সিনেমার শত্রু-মিত্র দুটোই হল দর্শক।
সহজ কথায় কথাটা হয়তো সত্য। কথায় আছে না যত দোষ নন্দ ঘোষের। ধরা যাক, আপনি বাঁশ বাগানে বাঁশ কাটতে গেছেন। প্রথমেই আপনি করবেন কী সবচেয়ে সহজ অর্থাৎ লম্বা বাশটা কাটার জন্য তৎপর হয়ে উঠবেন। কারণ লম্বা বাশটি কেটে বের করে আনতে তেমন কষ্ট হবে না। অর্থাৎ লম্বা গাছই কাটা পড়ে প্রথম। কারণ এই গাছ কাটায় কোনো ঝাক্কি ঝামেলা নাই। কাটলাম, টান দিলাম। বাশটা সুর সুর করে বেড়িয়ে এলো। সিনেমার দর্শকও তেমনি। সোজা বাঁশের মতো। সিনেমার দর্শকই হলো সিনেমার প্রাণ। কাজেই দর্শক যেহেতু সিনেমা দেখতে আসছে না…. দর্শকই সিনেমার মূল শত্রু। দর্শক সিনেমা হলে ফিরে এলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু দর্শক কেন সিনেমা হলে আসছে না? কেন সিনেমা দেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে? আগে ছিল সিনেমার বন্ধু এখন কেন শত্রু হয়ে গেল একথা কি আমরা একবারও ভেবেছি? অপরাধীর তালিকায় অন্যের দিকে আঙ্গুল দেখানোর আগে নিজে কতটা দায়ী সে কথা কি একবারও ভেবেছি? এই যে আমরা সিনেমা নষ্ট হওয়ার জন্য দর্শকের ওপর দায় চাপাচ্ছি সেটা কি আদৌ সত্যি? আমাদের সিনেমার আজকের দুরাবস্থার জন্য দর্শকই কি দায়ী? সিনেমা নির্শাণ একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় অনেক স্তর পেরিয়ে দর্শকের কাছে আসতে হয়। একটি সিনেমা বানানোর জন্য প্রথমে একটি স্ক্রীপ্টের প্রয়োজন হয়। স্ক্রীপ্ট অর্থাৎ কাহিনী নির্বাচনের পর আসে পরিচালক নির্বাচনের পালা। পরিচালককে বলা হয় ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ।
পরিচালকই নির্ধারণ করেন কে বা কারা হবেন তার ছবির পাত্র-পাত্রী? তারপর শুরু হয় ছবির নির্মাণ যজ্ঞ। এরপর সিনেমা হলে ছবিটি মুক্তি পেলেই না আসে দর্শকের প্রশ্ন। এখন কথা হলো আমরা কি দর্শকের পছন্দমতো সিনেমা বানাতে পারছি? অনেকেই কথায় কথায় সিনেমার সোনালী যুগের কথা বলি। এই ছিল ওই ছিলো… কত কথা যে বলি। কিন্তু একথা বলি না সময় পাল্টে গেছে। সিনেমার স্বর্ণযুগে দেশে পারিবারিক বিনোদনই ছিল সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। এজন্য আগাম টিকেট কিনতে হতো। নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির ক্ষেত্রে প্রথম সপ্তাহে টিকিট পাওয়াই ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। প্রায় প্রতিটি শহরে সিনেমা হলের ম্যানেজার ছিলেন অতি গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তি। কারণ তার সাথে সখ্যতা থাকলেই ঝক্কি ঝামেলা ছাড়াই সিনেমা দেখার টিকেট পাওয়া যাবে। একটা সময় ছিল যখন সিনেমার টিকিটও কালো বাজারিরা নিয়ন্ত্রণ করতো। ব্লাকে চড়াদামে টিকিট বিক্রি হতো। ঢাকা সহ দেশের বড় বড় শহরে এমন অনেকে আছেন যারা সিনেমার টিকেট ব্লাকে, বিক্রি করে বাড়ি, গাড়িও করেছেন। বর্তমান সময়ে এই গল্প গুলো হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবেন না। আগেকার দিনে সিনেমাকে ঘিরেই দেশের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতো। মর্নিং শো, স্পেশাল শো, ম্যাটিনি শো, ইভিনিং শো এবং নাইট শো নামে সিনেমার এই আদুরে বাক্য গুলোর গুরুত্ব বর্তমান সময়ে অনেকের কাছেই নেই। অতীতকালে নির্ধারিত শোয়ের বাইরে আরও এক বা একাধিক শো টাইম বের করা যায় কিনা সেই চেষ্টাই করতেন অনেক হল মালিক। আর এখন হলের দরজা খুলে রাখার পরও দর্শক আসে না। কিছুদিন আগে ঢাকার একটি সিনেমা হলে কৌতুহলবশত সিনেমা দেখতে ঢুকেছিলাম। শুরুতে অন্ধকারে দর্শক সংখ্যা বোঝা যাচ্ছিলো না। পরে আশে পাশে তাকিয়ে দেখি ডিসি গ্যালারীতে আমি সহ ৭জন দর্শক বসে আছি। ওই শোতে পুরো হল জুড়ে মাত্র ১৭ জন দর্শক সিনেমাটি দেখেছে। হলের দায়িত্বরত কর্মীরা জানালেন এর চেয়ে আর বেশি দর্শক হয় না। প্রতিদিন সিনেমা প্রদর্শন বাবদ যে বিদ্যুৎ খরচ হয় টিকিট বিক্রির টাকায় তাও উঠে আসে না। তবুও কেন হলটি চলছে? প্রশ্ন করতেই একজন বললেন, ঐতিহ্য ধরে রাখতে হল মালিক এখনও হলটি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
এই ঘটনা থেকে সহজেই প্রমানিত যে হল মালিকরা সত্যিকার অর্থে দুরাবস্থায় আছেন। কিন্তু এর চেয়েও কঠিন দুরাবস্থায় আছেন প্রযোজকরা। যারা চলচ্চিত্রের জন্য অর্থ লগ্নি করেন। গত কয়েক বছরে অধিকাংশ প্রযোজক ছবি নির্মাণ বাবদ লাভ তো দূরের কথা লগ্নিকৃত অর্থ ফেরৎ পাননি। ছবি বানানোর পর হলে চালানোর ক্ষেত্রে হল মালিক ও প্রযোজকদের মধ্যে এক ধরনের শত্রু-মিত্র খেলা চলছে। লাখ লাখ টাকা লগ্নি করে ছবি বানান প্রযোজক। অথচ হলে তা প্রদর্শন করতে গেলে প্রযোজকদের যেন কোনো গুরুত্বই নাই। নানা খাত দেখিয়ে টিকিট বিক্রির বড় অংশই নিয়ে নেন হল মালিকরা। ফলে দেশের সিনেমা শিল্পে একটা অস্থির পরিস্থিতি চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। দর্শককে সিনেমার শত্রু-মিত্র ভাবা হলেও বাস্তবতা হল আমাদের সিনেমা পরিবারের সদস্যরাই শত্রু-মিত্র খেলায় লিপ্ত। একটা পরিবার চালাতে গেলে কারও না কারও নেতৃত্বের প্রয়োজন পড়ে। একজন অভিভাবকের প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনে সর্বজন গ্রাহ্য কোনো অভিভাবক নাই। ভাবটা এমন সবাই অভিভাবক, সবাই নেতা। ১০টিরও বেশী চলচ্চিত্র বিষয়ক সংগঠন চলচ্চিত্র পাড়ায় তাদের অস্থিত্ব জানান দিলেও চলচ্চিত্রের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কারও কোনো সুদুর প্রসারী পরিকল্পনা নাই। প্রায় প্রতিটি সংগঠন চলচ্চিত্রের উন্নয়নের চেয়ে দলবাজিতে ব্যস্ত। একই সংগঠনের এক নেতা হয়তো অন্য নেতাকে মানেন না। ফলে চলচ্চিত্রের উন্নয়ন ভাবনার চেয়ে সাংগঠনিক দলাদলিতেই সংগঠনগুলোকে ব্যস্ত থাকতে হয়।

কথা হলো বিশিষ্ট অভিনেতা, চিত্র পরিচালক সোহেল রানার সাথে। চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ তুলতেই কিছুটা অভিমানের সুরে বললেন, “ফিল্মের ব্যাপারে আমি আর কথা বলতে চাই না। কথা বলে কি কোনো লাভ হয়? তাছাড়া বলতে গেলে ৫/৬ বছর ধরে আমি ফিল্মের সাথে নাই। অর্থাৎ সেভাবে অভিনয়ও করছি না। আমরা যে পরিবেশে, যে ধারায় চলচ্চিত্রে অভিনয় করতাম সেই পরিবেশ, সেই ধারাতো এখন নাই। সব কিছুই বদলে গেছে। কাজেই কিছু বলতে গেলেও সংকোচ বোধকরি। ভাবি, আমার কি এসব বলা উচিৎ? আবার পরক্ষনেই মনে হয়, কেন বলব না? এই চলচ্চিত্রেই তো কাটিয়ে দিলাম জীবনটা”।
মোদ্দা কথা হলো, চলচ্চিত্রকে আমরা একটা পরিবার বলি। আসলে এটা আর সেই অর্থে পরিবার নাই। ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। কেউ কারও কথা শোনে না। পরিবার চালাতে গেলে কারও না কারও কথা তো শুনতেই হবে। বর্তমান সরকারের উপর আমাদের অনেক ভরসা। কিন্তু সরকার কি যথার্থ অর্থে চলচ্চিত্রের প্রতি নজর দিচ্ছে? তবে হ্যা, একথাও সত্যি বর্তমান সরকারই অতীতে চলচ্চিত্রের উন্নয়নে ব্যাপক অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। এফডিসির একজন সাবেক এমডি’র আমলে চলচ্চিত্রের উন্নয়নে অনেক টাকার প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছিল। এখন শুনি এব্যাপারে অনেক দূর্নীতি হয়েছে। দূর্নীতি করে তো চলচ্চিত্রের উন্নয়ন করা যাবে না। আবার দেখেন, মাত্র ৪৭ বছরে এফডিসিতে ৩৫/৪০ জন এমডি এসেছেন আবার চলেও গেছেন। তারা হঠাৎই আসেন আবার হঠাৎই চলে যান। একজন এমডিকে তো সময় দিতে হবে। সময় না পেলে তিনি চলচ্চিত্রের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবেন কি ভাবে? আর আমরা চলচ্চিত্রের মানুষেরা যতদিন না একটা পরিবার হতে পারব ততদিন পর্যন্ত বোধকরি চলচ্চিত্রের উন্নয়ন আশা করা যাবে না।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বললেন, আমরা নিজেরাই চলচ্চিত্রের শত্রু আবার নিজেরাই মিত্র। একটা সহজ কথা বলি। চলচ্চিত্র হল একটি সমন্বিত কার্যক্রম। এখানে শুধুমাত্র প্রযোজক, পরিচালক, ক্যামেরাম্যান এ্যাকটিভ হলে তো চলবে না। অভিনয় শিল্পীদেরও আন্তরিকতা দরকার। ধরা যাক তারাও আন্তরিক হলেন। একটি ছবি বানানো হলো। সেটা প্রদর্শনের জন্য যদি হল না থাকে তাহলে সেই ছবির ভভিষ্যৎ তো আমরাই নষ্ট করলাম। কাজেই একটি ছবি বানানো থেকে শুরু করে তা প্রদর্শন পর্যন্ত আমরা যদি সৎ এবং আন্তরিক ভূমিকা পালন না করি তাহলে আমাদের চলচ্চিত্রকে বাঁচানো যাবে না।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু চলচ্চিত্রের ‘শত্রু মিত্র’ প্রসঙ্গে চমৎকার একটি ব্যাখ্যা দিলেন। খসরু বললেন, মোটা দাগে যদি বলি তাহলে আমাদের চলচ্চিত্রের শত্রু অনেক। যেমন ধরেন পাইরেসি একটা শত্রু। অশ্লীলতা এক সময় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই শত্রু যে এখনও নাই সেটা বলা যাবে না। যুগ পাল্টেছে। ই-টিকেটিং ব্যবস্থার প্রচলন করতে পারি নাই। আমাদের চলচ্চিত্রে ভালো কোনো কনটেন্ট নাই। গল্পের ক্ষেত্রে প্রেম ভালোবাসা তারপর মারামারি, খুন এই জাতীয় একই ফর্মুলার বাইরে তো আমরা যেতে পারছিনা। মৌলিক গল্পের অভাব প্রকট। চলচ্চিত্রের সব চেয়ে বড় শত্রু হল সময়। ‘কলটাইম’ বলে একটা কথা আছে। সেটা এক সময় আমাদের চলচ্চিত্রে অত্যন্ত আদরনীয় ও মর্যাদাবান শব্দ ছিল। এখন শব্দটা অনেক অবহেলিত। নামী-দামী অভিনেতা, অভিনেত্রীদের অনেকেই কলটাইমের তোয়াক্কাই করেন না। সকাল ১০টায় শুটিং এ আসার কথা থাকলেও আসেন বিকেলে। এটাকে আপনি কি বলবেন? এই ধরনের মানসিকতা কি চলচ্চিত্রের জন্য অন্যতম অন্তরায় নয়?
আমাদের চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে হলে সময়কে প্রথমে গুরুত্ব দিতে হবে। ভালো কনটেন্ট না হলে চলচ্চিত্রের গতি ফেরানো মুশকিল। সব চেয়ে বড় কথা লগ্নি কারকদেরকেও আধুনিক হতে হবে। ধার করে টাকা এনে চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো যুক্তি দেখিনা। নির্মাতাদেরকে সবল হয়েই চলচ্চিত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। অনেকে দর্শকদের দোষারোপ করেন। আমি বলি দর্শকই হলো লক্ষ্মী। তাদেরকে হলে ফেরানোর দায়িত্ব আমাদের।
আমরা আনন্দ আলো পরিবার মনে করি চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে হলে এক সময় আমাদের চলচ্চিত্রের যে বিরাট একটা পবিরার ছিল সেটাকে উজ্জীবিত করতে হবে। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সংগঠন গুলোর আন্তরিক ভূমিকা খুবই জরুরি। মতাদর্শ গত পার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু চলচ্চিত্রের স্বার্থে আমরা তো এক হতে পারি। এই যে এতো সংগঠন, এই যে এতো দলাদলি… শেষ পর্যন্ত যদি চলচ্চিত্রই না থাকে তাহলে দলাদলি করে কি হবে?
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন উপলক্ষে চলচ্চিত্র পাড়া বিশেষ করে এফডিসি প্রাঙ্গন এখন বেশ সরগরম। মিশা সওদাগর ও জায়েদ খানের নেতৃত্বে একটি এবং মৌসুমী ও ডি এ তায়েবের নেতৃত্বে অন্য একটি প্যানেল এবার নির্বাচেন প্রতিদ্বন্দিতা করার কথা থাকলেও মৌসুমীর প্যানেলের সাধারন সম্পাদক পদ-প্রার্থী ডি এ তায়েব মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা সত্বেও শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পত্র জমা দেননি। আনন্দ আলোকে তিনি জানান নির্বাচন করবেন না। অন্যদিকে মৌসুমী জানান তিনি সভাপতি পদে স্বতন্ত্র প্রাত্রী হিসেবেই নির্বাচন করবেন। এদিকে মিশা সওদাগর ও জায়েদ খানের পুরো প্যানেল মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছে।
আমরা মনে করি চলচ্চিত্রের উম্মেষ ধারায় একজন শিল্পীর ভূমিকা অনেক গুরুত্বপুর্ণ। বেশী না দেশের ১০ জন জনপ্রিয় শিল্পীও যদি মনে করেন যে তারা আন্তরিকভাবে চলচ্চিত্রের উন্নয়ন চান। তাহলেই আমাদের চলচ্চিত্রের কাঙ্খিত উন্নয়ন সম্ভব। বাংলা চলচ্চিত্রের জয় হোক।
তাহলে কি চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরবে না? এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন একজন দর্শক। তিনি বললেন, ভাই আমি নিয়মিত বিভিন্ন হলে গিয়ে সিনেমা দেখি। প্রথম কথা হলো আমাদের সিনেমায় ভালো গল্পের অভাব প্রকট। দুই একটি ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ সিনেমার কাহিনী কোনো না কোনো হিন্দী অথবা ইংরেজি ছবি থেকে নেয়া। আমরা নতুন সিনেমা দেখলেই সেটা বুঝতে পারি। ধার করা কাহিনীতো ভাই দর্শক দেখবে না। অথচ এক্ষেত্রে আমাদের নির্মাতাদের অনেকেরই কোনো তাড়না নাই। এবার আসি সিনেমার কারিগরি দক্ষতা প্রসঙ্গে। মূলত তথ্য প্রযুক্তির আধুনিক ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে উন্নত দেশে সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। ওই সব সিনেমা মুক্তি পাবার সাথে সাথেই ইউটিউব সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অন্যান্য শাখায় ব্যাপক আয়োজনের নতুন ছবি দেখার সুযোগ পাচ্ছি আমরা। সেই তুলনায় বাংলাদেশের ছবিতে তথ্য প্রযুক্তির কোনো ব্যবহার নেই। কোনো কোনো সিনেমা দেখে মনে হয় যেন টিভি নাটক দেখলাম। এই সব কারণে অনেকেই দেশের সিনেমা নিয়ে ভাবেন না।
প্রিয় পাঠক, জানিনা আমাদের সিনেমার শত্রু-মিত্র ব্যাপারটা পরিস্কার হলো কিনা। তবে দর্শককে সিনেমার শত্রু ভাবা ঠিক হবে না। আমরা যদি ভালো সিনেমা বানাতে পারি তাহলে দর্শক হলে ফিরে আসবেই। এখন প্রশ্ন হলো ভালো সিনেমার সংজ্ঞা কি? দশটার মধ্যে কোনটা ভালো সিনেমা? এনিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে আমরা মনে করি ভালো গল্পই একটি ভালো সিনেমার জন্ম দিতে পারে। তার আগে অবশ্য সিনেমার মানুষগুলোকে সত্যিকার অর্থে ভালো হতে হবে। ভালো মনের ভালো মানুষ। বাংলা সিনেমার জয় হোক।