Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

পে চ্যানেলের দাবী তুললেন তরুণ নির্মাতারা

রেজানুর রহমান ও সৈয়দ ইকবাল
আনন্দ আলো কার্যালয়ে হঠাৎই একধরনের হই চই শুরু হয়ে গেল। একটি পরিবারে এক সাথে অনেক প্রিয় মানুষ এলে যা হয় আর কী। প্রিয় মানুষগুলো নাটকেরই মানুষ। দেশের টিভি নাটকের ক্ষেত্রে এক একজন তুর্কী তরুণ নির্মাতা। এক নামেই যাদের ব্যাপক পরিচিতি। তারা এসেছিলেন আনন্দ আলোয় আড্ডা দিতে। আডড্ডা দিতে দিতেই টেলিভিশন নাটক নিয়ে অনেক কথা বললেন। অভিযোগ করলেন। অনুযোগও শোনালেন। ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা বললেন। সকলের অভিন্ন বক্তব্যÑ দেশের টেলিভিশন নাটককে বাঁচাতে হলে ‘পে চ্যানেল ব্যবস্থা’ চালু করা সময়ের দাবী। দর্শক বাৎসরিক একটা ফি দিয়ে পছন্দের টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখবেন। এর ফলে প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেলে মানসম্পন্ন ভালো অনুষ্ঠান নির্মাণের প্রতিযোগিতা শুরু হবে। যে টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ভালো হবে দর্শক সেই টিভি চ্যানেলের প্রতিই আগ্রহ দেখাবে। তখন মান সম্পন্ন অনুষ্ঠান প্রচারকারী টেলিভিশন চ্যানেলকে বিজ্ঞাপন প্রদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতি নির্ভরশীল হতে হবে না। এখন যেমন কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপনের জন্য নাটক প্রচার হয়। অর্থাৎ নাটক প্রচারের আগে বিজ্ঞাপন প্রচার চলছে তো চলছে। ‘পে চ্যানেল’ ব্যবস্থা চালু হলে যোগ্য টিভি চ্যানেল গুলোকে আর হয়তো বিজ্ঞাপনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। দর্শকের টাকায় যেহেতু টেলিভিশন চ্যানেল চলবে, কাজেই দর্শকের কথা ভেবেই টিভি চ্যানেল গুলো তাদের অনুষ্ঠান নির্মাণে তৎপর হবে। তখন যোগ্য নির্মাতারাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। এখন যেমন অনেক ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্ব ভোগীরাই দেশের টেলিভিশন মিডিয়ায় দাপট দেখাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো অনুষ্ঠানের প্রয়োজন পড়ে না। হাতে গোনা কয়েকজন অভিনেতা, অভিনেত্রী নাটকে থাকলেই হয়। নাটকের ভালো-মন্দ বিচার না করেই তা প্রচারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। ফলে নাটক নির্মাণে এখন নির্মাতার যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে না। যে কোনো মূল্যে তথাকথিত জনপ্রিয় কয়েকজন তারকাকে নাটকে নিতে পারলেই কেল্লাফতে। যে কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারের নিশ্চয়তা শতভাগ। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুটি কয়েক জনপ্রিয় তারকাই টেলিভিশন মাধ্যমে অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। নাটকের বিষয় বস্তুর ওপর সংশ্লিষ্টদের তেমন কোনো নজর নাই। জনপ্রিয় কয়েকজন তারকা থাকলেই হল। সে কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনপ্রিয় তারকারাই নির্ধারণ করে দিচ্ছে কোন নাটকে কে থাকবেন। কোন নাটকটি কোন পরিচালক বানাবেন। কখনও কখনও অনেক শিল্পী নাটকের সেটেও পরিচালকের ভ‚মিকাও পালন করছেন। তার মতো স্ক্রিপ্টও করে থাকেন। ফলে টেলিভিশন মিডিয়ায় এখন ডিরেকটরের তেমন কোনো ভ‚মিকা নাই। টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র নির্মাণ ব্যবস্থাকে বলা হয় ডিরেকটরস মিডিয়া। এখন সেটা হয়েছে আর্টিস্ট মিডিয়া। এমনটাই অভিযোগ সংকটের সুর নির্মাতাদের কণ্ঠে।
তারা আনন্দ আলোর আড্ডা অনুষ্ঠানে দৃঢ়তার সাথে এই সংকটের কথা গুলো তুলে ধরে প্রিয় নির্মাতারা অনেকটাই অভিন্ন সুরে বললেন, দেশের টেলিভিশন নাটককে বাঁচাতে হলে তথাকথিত আটিস্টের প্রতি জোর না দিয়ে কনটেন্ট এর প্রতি জোর দেওয়া সময়ের দাবী। নির্মাতাদেরকে তথাকথিত ১০/১২ জন আর্টিস্টকে নাটক বা অনুষ্ঠানে রাখতেই হবে এই চাপ না দিয়ে ভালো অনুষ্ঠান অথবা নাটক বানানোর প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেওয়া উচিৎ। এর ফলে নির্মাতারাই ভালো কনটেন্ট এর দিকে ঝুকবে। যে কোনো মূল্যে ভালো নাটক বা অনুষ্ঠান বানানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে।
আনন্দ আলোর এই আড্ডায় এসেছিলেন প্রিয় নির্মাতা মোস্তফা কামাল রাজ, শাফায়েত মনসুর রানা, আশফাক নিপুন, ইফতেখার আহমেদ ফাহমি, সাজ্জাদ সুমন, মাবরুর রশীদ বান্নাহ, রাজিবুল ইসলাম রাজিব, তুহিন হোসেন, ইমরাউল রাফাত, আবু হায়াত মাহমুদ এবং মহিদুল মহিম। ওরা সংখ্যায় ১১ জন। যোগ্যতার নিরীখে যে কোনো মূল্যে দেশের টেলিভিশন নাটককে এগিয়ে নিতে চান। সবাই নাটকের কনটেন্ট এর দিকেই জোর দিলেন। অভিন্ন সুরে বললেন, টিভি নাটককে বাঁচাতে হলে বিশেষ তালিকার শিল্পীকে অভিনয়ে রাখতেই হবে এমন চাপ না দিয়ে বলা উচিৎ আমরা একটি ভালো নাটক চাই। সে ক্ষেত্রে আর্টিস্ট কে সেটা জরুরি না। জরুরি হওয়া উচিৎ কনটেন্ট এবং ভালো অভিনয়। নির্মাতাদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতাটা শুরু করে দিতে পারলেই তারা ভালো কনটেন্টের দিকে ঝুকবে। তখন আর কথাকথিত জনপ্রিয় আর্টিস্ট এর পিছনে দৌঁড়াতে হবে না। নতুন যোগ্য অভিনেতা অভিনেত্রী খোঁজারও প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। প্রসঙ্গক্রমে তরুণ নির্মাতারা বললেন, ঈদ সহ বিভিন্ন উৎসবেই মূলত টিভি নাটক নিয়ে হই চই শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে একটা ফরমেট দাঁড় করানোই থাকে। জনপ্রিয় ১০/১২ জন তারকার অভিনয় করা নাটক থাকতেই হবে। ক, খ, গ, ঘ, ঙ… এমন তারকাকে চাই-ই-চাই। ফলে দেশের শত শত অভিনয় শিল্পীদের প্রতি নির্মাতাদের নজর দেয়ার সুযোগ থাকে না। ১০/১২ জন জনপ্রিয় তারকার দিকেই প্রায় সকলে দৌড় ঝাপ শুরু করে দেয়। এই সুযোগে তথাকথিত জনপ্রিয় শিল্পীদের কেউ কেউ পরিচালকের ভ‚মিকাও অবতীর্ন হন। শিল্পীরাই পরিচালককে প্রভাবিত করতে শুরু করেন। ‘না না আমিতো ভাই এভাবে পারবো না। আমার সিডিউল নাইরে ভাই।’

আড্ডায় একজন নির্মাতা বললেন, এবার ঈদের নাটকের ক্ষেত্রে কোনো কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রী রাত দিনের ২৪ ঘণ্টাকে ৩ ভাগে বিক্রি করেছেন। সকালে হয়তো একজনকে ডেট দিয়েছেন। বিকেলে অন্যজনকে ডেট দিয়েছেন। রাতে তারই ডেট পেয়েছে আরেকজন। রসিকতার ভঙ্গিমায় একজন নির্মাতা বললেন, রাতে নাটকের শুটিং করছিলাম। হঠাৎ দেখি একজন পরিচালক আমার সেটে হাজির। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই ঘটনা কী? বন্ধু পরিচালক বিব্রত কণ্ঠে আমার নাটকে অভিনয় করা একজন অভিনেতার নাম উল্লেখ করে বললেন, “ভাইরে নিতে আসছি। আজ সারা রাত শুটিং করব। প্রসঙ্গ ক্রমে একজন নির্মাতা বললেন, ‘এজেন্সির চাপ ছিল বিশেষ একজন তারকাকে নাটকে নিতেই হবে। আর তাই নাটকের কাহিনী পরিবর্তন করতে হয়েছে। দিনের কাহিনীকে রাতে নিয়ে আসতে হয়েছে। এভাবে ভালো নাটক বানানো সম্ভব? আরেকজন নির্মাতা বললেন, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, অনেকেই কলটাইমে সেটে আসেন না। কিন্তু যখন আসেন তখন থেকেই কেউ কেউ চাপ দিতে শুরু করেন আমাকে কিন্তু ১১টার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। আমি ১১টার পর শুটিং করতে পারব না। তিনি যে সকাল ৯টার কলটাইমে এলেন না, এব্যাপারে হয়তো কোনো কথাও বলেন না। হয়তো ১২টা ১টায় বা ২টায় শুটিং স্পটে হাজির হলেন। এসেই শুরু করে দেন যাবার তাড়া। এর ফলে হয় কী, পরিচালকের মাথা ঠিক থাকে না। প্লানিং এ গড় বড় হয়। এ ধরনের অনেক অভিযোগ ও অনুযোগের কথা তুলে তরুণ এই নির্মাতারা একটা প্রস্তাব তুললেন আনন্দ আলোর আড্ডায়।
বিশেষ বিশেষ অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নাটক, টেলিফিল্মে রাখতেই হবে এই বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দিয়ে আমদেরকে বলা হোক ‘ভালো কনটেন্ট এর ভালো নাটক চাই।’ সেখানে জনপ্রিয় ধারার অভিনেতা, অভিনেত্রীকে রাখতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নাই। অখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীকে দিয়েও নাটকটি নির্মাণ করা যেতে পারে। আমরা চাই ভালো কনটেন্টে একটি ভালো নাটক… “নির্মাতাদেরকে এই স্বাধীনতা দিলে আমাদের টিভি নাটকের গুণগত পরিবর্তন আসতে বাধ্য” এই মন্তব্য করে সকলে অভিন্ন সুরে একটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা শোনালেন। “আগামী ঈদে আমরা জনপ্রিয় ধারার কোনো অভিনেতা, অভিনেত্রীকে নিয়ে নাটক বানাতে চাই না। একে বারেই নতুন শিল্পীদের নিয়ে নাটক বানাতে চাই। যেখানে প্রতিযোগিতা থাকবে কনটেন্ট এর। প্রতিযোগিতা থাকবে ভালো অভিনয়ের। সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলের প্রিভিউ কমিটি নাটকের গুণগত মান যাচাই করে অন এয়ারের সিদ্ধান্ত নিবেন। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের টিভি নাটকে নতুন প্রতিভাবান অভিনেতা-অভিনেত্রীর আবির্ভাব ঘটবে। তখন টেলিভিশন নাটকে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে বাধ্য”।
আনন্দ আলোর এই আড্ডায় নির্মাতারা বললেন, আমাদের দেশে অনেক সময় বিশেষ বিশেষ ঝোকের ওপর টিভি নাটকের গতিপথ নির্ধারণ করা হয়। যেমন এক সময় সালাহ উদ্দিন লাভলুর পরিচালনায় শুরু হলো গ্রামীণ পটভ‚মির ধারাবাহিক ‘রঙের মানুষ’। ব্যস ‘রঙের মানুষ’এর স্টাইলে নাটক নির্মাণের হিড়িক শুরু হয়ে গেল।
হুমায়ূন আহমেদের নাটকের একটি বিশেষ স্টাইল আছে। দর্শকের পছন্দের কথা ভেবে অনেকেই হুমায়ূন আহমেদের স্টাইলে নাটক বানানো শুরু করলেন। হঠাৎ শুরু হলো বড় ছেলের যুগ। ব্যস সবারই চাই বড় ছেলের মতো কান্নাকাটির নাটক। হাসির নাটক নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে। অনেক সময় বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও এজেন্সির পক্ষ থেকে হাসির নাটক বানানোর চাপ দেওয়া হয়। ‘অমুক টাইপের একটা হাসির নাটক দেন’। ফলে দেশে হাসির নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
তরুণ নির্মাতারা নিজেদেরও সমালোচনা করলেন। কেউ কেউ বললেন, আমাদের দেশে টেলিভিশন নাটকের ক্ষেত্রে নির্মাতার সংখ্যায় ৫০০’রও অধিক। এতো নির্মাতারা কী আদৌ প্রয়োজন আছে? পরিবেশ, পরিস্থিতি দেখে কখনও কখনও মনে হয় টিভি নাটক বানানোই বোধকরি সহজ কাজ। আসলে তো টিভি নাটক বানানো সহজ কাজ নয়। এখানে মেধার প্রয়োজন বেশি। অথচ মেধাবীদের গুরুত্ব কম। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে দেশের টেলিভিশন নাটককে বাঁচাতে চাই তাহলে “তথাকথিত অভিনেতা, অভিনেত্রীকে নাটকে রাখতেই হবে” এই ধরনের বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়ে বলা হোক আমরা ভালো কনটেন্টের ভালো নাটক চাই। তাহলেই টিভি নাটকের ক্ষেত্রে একটা গুণগত পরিবর্তন আসতে বাধ্য।
প্রায় দুই ঘণ্টা ব্যাপি এই আড্ডায় দেশের টেলিভিশন মাধ্যম নিয়ে অনেক স্বপ্নের কথা বললেন প্রিয় নির্মাতারা। সবার অভিন্ন বক্তব্য, এখন চলছে মেধাবীদের যুগ। কাজেই মেধাবীদের যোগ্য সম্মান দিন। যোগ্য দেখে পক্ষ নিন। কাঙ্খিত পরিবর্তন আসবেই আসবে…