Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

এখন তো যে কেউ অভিনেতা যে কেউ নির্মাতা… জাহিদ হাসান

ধানমন্ডির এই সড়কটি এলাকার মানুষের জন্য একটু আলাদাই বটে। এই সড়কের আশে পাশের ভদ্রজনেরা তো বটেই ছোট্ট পানের দোকানদারও জানে সড়কটা আলাদা কেনো? সড়কটি আলাদা এই জন্য যে এই সড়কের ধার ঘেষে একটি বাড়িতে দেশের জনপ্রিয় একজন অভিনেতা বাস করেন। সকাল-বিকাল বা সন্ধ্যায় সেখানকার মানুষজন সেই অভিনেতাকে দেখেন, কথা বলেন, কুশলাদি জিজ্ঞাসা করেন। কেউ কেউ সেলফিও তোলেন। আর সেই অভিনেতাও সব মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলেন, গল্পও করেন। পাঠক, এই গুণী অভিনেতার নাম জাহিদ হাসান। নব্বই দশক থেকে যিনি আমাদের মিডিয়ায় অভিনয়ে দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন। শুরুতে যে পরিমান জনপ্রিয়তা তিনি পেয়েছেন ঠিক ততোটাই জনপ্রিয়তা রয়েছে এখনো। বহুমাত্রিক চরিত্রে অভিনয় করে তিনি নাটক ও সিনেমার দর্শকদের হৃদয় জয় করেছেন অনেক আগেই। ঢাকার মঞ্চে বহুল আলোচিত ‘বিচ্চু’ নাটকে অভিনয় করে তিনি পেয়েছিলেন তমুল জনপ্রিয়তা। মঞ্চ নাটক করে কেউ এতোটা জনপ্রিয়তা এখন পর্যন্ত পেয়েছেন কিনা সন্দেহ আছে। আর টিভি নাটকে ভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে একটি চরিত্রের মাধ্যমে দর্শকদের ভালোবাসা পাওয়া যায়। আজ রবিবার, নক্ষত্রের রাত, সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড, সবুজ সাথি, মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন, আরমান ভাই, গ্র্যাজুয়েট, লাল নীল বেগুনী সহ অসংখ্য জনপ্রিয় ধারাবাহিক ও খন্ড নাটক তিনি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। অভিনয়ের ক্ষেত্রে এক অবাক করা যাদু যেনো তার মধ্যে রয়েছে। যেকোনো চরিত্রেই যখন জাহিদ হাসানকে অভিনয় করতে দেখা যায় তখন মনে হবে চরিত্রটি যেনো তার জন্যই তৈরি হয়েছে। এটাই আসলে জাহিদ হাসানের অভিনয়ের কারিশমা। এই যে অভিনয়ের এতো দক্ষতা, এতো বছরেও তার জনপ্রিয়তায় এতোটুকু ভাটা পড়েনি। সবমিলিয়ে ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে তিনি কি ভাবছেন! ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাই বা কী? এমন নানান কথা তিনি বলেছেন আনন্দ আলোর সঙ্গে। কিছুদিন আগে জাহিদ হাসান ভারতের ‘সিতারা’ ছবিতে অভিনয় করেন। যে ছবিটি তেলেগু, বাংলা ভাষা সহ ভারতের ৩টি ভাষায় কয়েকটি রাজ্যে মুক্তি পায়। এসব বিষয় নিয়েও কথা হলো তার সঙ্গে। এক সকালে ধানমন্ডিস্থ বাসায় বসে বসে তিনি আনন্দ আলোর সাথে শেয়ার করেছেন অনেক কথা। লিখেছেন সৈয়দ ইকবাল
আনন্দ আলো: প্রথমেই ‘সিতারা’ সিনেমা সম্পর্কে জানতে চাই এই সিনেমায় যুক্ত হলেন কিভাবে?
জাহিদ হাসান: আমি তখন পূবাইলে একটি নাটকের শুটিং করছিলাম। হঠাৎ দেখি আমার মোবাইলে বার বার কলকাতার একটি নাম্বার থেকে কল আসছে। শুটিং ব্যস্ততার কারণে ফোন ধরতে পারিনি। অবসর পেয়ে আমিই কল ব্যাক করলাম। তখন লাইনটি ব্যস্ত পেলাম। এভাবে কয়েকবার ট্রাই করার পর আমার সাথে কথা শুরু হয়। যিনি ফোন করছিলেন তার নাম আশীষ রায়। তিনি বললেন ‘সিতারা’ নামের একটি সিনেমা বানাতে চান। সিনেমার গল্পটা আবুল বাশার এর ‘ভোরের প্রসূতি’ অবলম্বনে নেওয়া। আমি তখন জিজ্ঞেস বললামÑ আপনি আমাকে চিনেন কিভাবে? এই কথা বলার কারণ হলো, আমি বানিজ্যিক ঘরানার সিনেমার নায়ক না। তার ওপর ভারতের মানুষ আমাদের এখানকার নায়ক-নায়িকা কিংবা পরিচালকদের কম চিনেন। আমার ব্যক্তিগত একটা ধারনা ছিলো তারা আমাদের এখানকার কাজকে বা শিল্পী কলাকুশলীদের তেমন একটা পাত্তা দিতে চান না। এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত ধারনা। যাই হোক অনেক কথা হল। শেষে তিনি আমাকে বললেনÑ ‘ভাই আমি বাংলাদেশরই মানুষ’। তার কথা শুনে যা বুঝলাম আমাদের অনেক কাজ তার দেখা এবং তিনি ব্যক্তিগত ভাবে আমার অভিনয় দেখেছেন। আমার অভিনয় তার ভালো লাগে।
আমি অনেক আগেই ‘ভোরের প্রসূতি’ উপন্যাসটা পড়েছিলাম। সে কারণে গল্পটা আবছা আবছা মনে আছে। আবারো বইটা অনেক কষ্টে যোগাড় করে পড়া শুরু করি। বইটা পড়ার পর দেখলামÑ অনেকগুলো বেড সিন আছে। যা আমার সাথে যায় না বলে মনেকরি। কেননা আমি অভিনয় পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের জন্য। এমনকিছু করতে চাইনা যা একটি পরিবারের সবাই দেখতে পারবে না। এখন অনেকে এ ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে সেটা তাদের ব্যাপার। আমি অভিনয়ের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একটা আইডলজি মেনটেইন করে চলি। উনি যখন আমাকে মেইলে ক্যারেক্টার অ্যানালাইসিসটা পাঠালেন সেখানে দেখলাম আমার চরিত্রটির নাম ‘দিলু’। সব ঠিক আছে। কিন্তু আমার আপত্তি ছিলো সেই বেড সিনগুলোর বিষয়ে।
তখন উনি আমাকে জানালেন যে, উপন্যাসে অনেক কিছুই থাকে সেটা সিনেমায় ভিজুয়ালাইজেশনে আনা যায় না। তারপর উনি আমাদের এখানে আসলেন। কথাবার্তা হলো। এগ্রিমেন্ট করলেন। টাকা-পয়সাও দিলেন। তখন আমি আশীষ রায়কে গল্পের একটি চরিত্রের কথা উল্লেখ করে ওই চরিত্রে বাবু ভাইকে নেয়ার জন্য পরামর্শ দিলাম। তখন উনি বললেন তার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করবো? সেই দায়িত্বও আমি নেয়ার কথা বলে বাবু ভাইকে এই সিনেমায় সম্পৃক্ত করি। আমার ব্যক্তিগত চরিত্রের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে কোথাও কখনো একা থাকতে পারিনা। আমি খুব আড্ডাপ্রিয় একজন মানুষ। তার ওপর দেশের বাইরে সিনেমার শুটিংয়ে যাবো সেখানে কাউকে তেমন চিনি না, সম্পর্কও নাই। একা একা ভালো লাগবে না। সব মিলিয়ে চিন্তা করে আমি বাবু ভাইকে সঙ্গী করে নেই। আমার দেশের আরেকজন ভালো অভিনেতা সম্পর্কে ওরা জানালো এটা কী কম কথা। এই ছবিতে আরেকজন বাংলাদেশী অভিনেতা অভিনয় করেছে সে হলো শাহেদ আলী। শাহেদ আলীর সাথে আগেই ওদের চেনা-পরিচয় ছিলো তা জানতাম না। যাই হোক শুরু হয়ে গেলো আমার ‘সিতারা’র যাত্রা।
আনন্দ আলো: ছবিতে শুটিংয়ের সময়কার অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন। আমাদের কাজের সাথে ওদের কাজের মিল অমিল গুলো কেমন?
জাহিদ হাসান: এখানে আমি একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই তা হলো তাদের একটা ইউনিটে কাজ করে আমি যেমনি পুরো ইন্ডাস্ট্রির কথা বলতে পারবো না তেমনি তারাও আমাদের দুই একজনের সাথে কাজ করে আমাদের সব অভিনেতা, অভিনেত্রী সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারবেন না। ভারতের অনেক নির্মাতাই আছেন যারা বিশ্বমানের। যেমন সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে ঋত্বিক ঘটক, মৃনাল সেন, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণা ঘোষ, হালের সৃজিত মুখার্জী সহ অনেক ভালো ভালো পরিচালক আছেন। আবার আমাদের এখানেও অনেক ভালো ভালো নির্মাতারা আছেন যাদের কাজ আন্তর্জাতিক ভাবে নানান উৎসবে গিয়েছে। জহির রায়হান, আলমগীর কবীর, কাজী জহির, সুভাষ দত্ত, আমজাদ হোসেন, পরবর্তী কালে তারেক মাসুদ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা সহ একঝাঁক তরুণ নির্মাতার কথা তো বলাই যায়।
এদের প্রত্যেকের কাজের ধরন গল্প বলার ধরন, সিনেমা দিয়ে দর্শক ধরে রাখার যে সৃজনশীলতা তা অবশ্যই প্রশংসা করার মতো। তাই আমি যেমনি এক আশীষ রায়ের কাজের হিসাব করে তাদের পুরো ইন্ডাস্ট্রির কাজের মূল্যায়ন করতে পারবো না। তেমনি আমাদের ক্ষেত্রেও একজন দুজনের অভিনয় কিংবা আমার কাজের নানান দিক নিয়ে আমাদের সবকিছু বোঝানো সম্ভব না। আমাদের দেশে আমার চাইতেও অনেক গুণী অভিনেতা আছেন। তাদের নিলে হয়তো আরো ভালো করতো। আবার ঠিক তেমনি উনাদের দেশেও আশীষ রায়ের চেয়েও ভালো অনেক নির্মাতা আছেন। তবে দু’ একটি বিষয় আমার খুব চোখে পড়েছে। যেমনÑ দেখা গেলো আমি শর্ট দিচ্ছিলাম তখন আমার পেছনের সেট থেকে একটা সুতা বেরিয়ে পড়েছে। তখন পরিচালক প্রোডাকশন ম্যানেজারকে ডাকলো, প্রোডাকশন ম্যানেজার আরেকজনকে ডাকলো, সে গিয়ে আর্টের লোককে নিয়ে এলো তারপর সেই সুতাটা ঠিক করা হলো। ওরা যার কাজ সেই করে থাকে। এটা ভালো। তবে আমি দেখলাম কাজে অনেক টাইম ‘কিল’ হয়। তাই পরবর্তীতে আমি নিজেই এমন অনেক কিছু ঠিক করে নিয়েছিলাম। কাজের সিস্টেম অনেক ভালো। টাইমটা খুব মেনটেইন করে ওরা।

আনন্দ আলো: একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। এবারের ঈদে কেমন কাজ করেছেন?
জাহিদ হাসান: ঈদে তো অনেক কাজের প্রস্তাব আসে। সব কাজ তো করা সম্ভব হয়না। আর আমাদের এখানে কিছু জিনিসের হিসাব মিলাতে পারি না। আমার কথা হচ্ছে শেষ মুহূর্তে কেনো এতো দৌঁড়াদৌঁড়ি করি আমরা? বছর ব্যাপী একটা ক্যালেন্ডার মেনটেইন কেন করা হয় না? ঈদ উৎসব সহ সব ধরনের উৎসব তো বছর বছর আসবেই। তাই সময়কে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা করলে সবকিছুই অনেক সুন্দর এবং ভালো হয়। একজন অভিনেতাকেও শেষ মুহূর্তে কোনো চরিত্র করতে বলা হলে তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। চরিত্রটি ধারণ করা এবং কাজ করতে। আরেকটি বিষয় না বললেই নয় তা হলোÑ লাস্ট মুহূর্তে কাজের হিসাবটা আমাদের বাদ দিতে হবে। তাড়াহুড়া করে কোনো কাজই ভালো হয় না। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই পলিসিগত ভাবে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। তাই আমাদের এতো বড় মিডিয়া অবশ্যই সবকিছু সিস্টেমে আসা উচিৎ। আমার কাছে কাজের প্রস্তাব দেখা যায় একই ধরনেরই। যা আমার ভালো লাগে না। দেখা গেছে কোনো একটি চরিত্র বা কাজ হয়তো ভালো গেছে এবং দর্শক তা বেশি পছন্দ করেছিল। পরবর্তীতেও অনেক পরিচালক ঐ ধরনেরই আরেকটি চরিত্র নিয়ে আসে আমার কাছে। অনেকে আবার বলে থাকে ঐ রকম চরিত্র করেন। ঐরকম গল্পের মতো আরেকটা করেন। বিভিন্ন চ্যানেলও অনেক সময় বলে থাকে এই ধরনের কথা। আমি তখন না করতে চাইলেও দেখা গেছে নানান রিক্যুয়েস্ট এবং কারো কারো জীবন জীবিকার কথা চিন্তা করে কাজটি করতে হয়। কেউ কেউ তো এভাবেও বলেÑ ভাই আপনি কাজটা না করলে আমি বাসা ভাড়া দিতে পারবো না। আমার ঈদ হবে না ইত্যাদি, ইত্যাদি। আসলে এভাবে তো আর অভিনয় হয় না। মোটকথা স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নাই। আমাদের এখানে যে কেউ অভিনেতা। যে কেউ ডিরেক্টর, যে কেউ নাট্যকার হয়ে যাচ্ছেন। কোনো সিস্টেম নাই।
আমরা যখন মঞ্চ নাটক শুরু করি তখন কি আসার সাথে সাথেই মঞ্চে উঠিয়ে দিয়েছিল? অবশ্যই না। আমার মনে আছে যখন প্রথম থিয়েটার করতে যাই প্রথমে মহড়ার জায়গা ঝাড়– দিতাম, এরপর শো-এর দিন টিকিট বিক্রি করতাম, চা পরিবেশন করতাম সবাইকে। তারপর আস্তে আস্তে নাটকে ছোট খাটো দু’ একটা চরিত্র পাওয়া শুরু করলাম। মঞ্চে এসেই তো আর ‘বিচ্চুর’ মতো নাটকে অভিনয় করার সুযোগ পাই নাই। এটাই সিস্টেম। কতো পরে এবং কত কষ্ট করে যে টিভি নাটকে কাজ শুরু করি তা আমি জানি। এখন তো যিনি প্রোডিউসার তার শালি হয়ে যাচ্ছে নায়িকা। যেমন আমার কাছে এমন অনেক প্রস্তাব এসেছে নায়িকা অমুককে নিতে হবে। সে নাটকে থাকা মানে স্পন্সর কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিবে। কারণ সেই নায়িকার সাথে সেই কোম্পানির মালিকের সম্পর্ক ভালো। ভাবটা এমন আমার ওপর সওয়ার হয়ে উনি উনার পারপাস সার্ভ করতে চান। এরকম অনেক জটিলতা আছে আমাদের টিভি মিডিয়ায়। সবকিছু কেমন যেন হয়ে গেছে। জগৎটাকে অনেক সময় অচেনা মনে হয় তাই মাঝে মাঝে সত্যিই খুব খারাপ লাগে।
আনন্দ আলো: বর্তমান সময়কে ইউটিউব-এ নাটকের একটা ‘ভিউ’-এর যুগ বলছেন কেউ কেউ। ঐ শিল্পীর ভিউ আছে। অমুকের ভিউ নাই বলা হচ্ছে। এই বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
জাহিদ হাসান: ইউটিউব একটা নতুন মাধ্যম। এই সময়ে মানুষজন ইউটিউব-এ নাটক দেখছেন এটা অবশ্যই ভালো খবর। কিন্তু আমরা এটাকে যেভাবে ব্যবহার করছি সেটা কী সঠিক নিয়ম? এখন তো একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। যার যাকে ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা কাজ করাচ্ছে। দর্শকদের দোহাই দিয়ে যেমন-তেমনও কাজ হয়। আমি সেদিকে না-ই গেলাম। তবে এগুলো হবেই। সেদিন কে জানি আমাকে বলছিলÑ অমুক-তমুকরা মিলে একটা সিন্ডিকেট হয়েছে। তারা তাদের বাইরে কাজ করছেনা। শুনে আমি হেসে ফেলি। এগুলো হবেই। নতুন নতুন কতো কিছুই হবে। একটা কথা এখানে উল্লেখ করছি। যেমন আমার ছেলে হয়তো দুপুর বেলা ভাত না খেয়ে চিপস খেয়ে পেট ভরে আর ভাতই খাচ্ছে না। এখন চিপস দিয়ে হয়তো সাময়িক ভাবে তার পেট ভরছে। কিন্তু তাকে পরের বেলাতে হলেও ভাত খেতে হবে। বিয়ে বাড়িতে পোলাউ-রোস্ট লাগবেই। সেখানে আবার ভাত দিলে হবেনা কিন্তু। বেসিক কিছু ব্যাপার আছে। কোনো কিছু দিয়েই এই হিসাব মিলানো যাবে না।
আনন্দ আলো: সেই সিরাজগঞ্জ থেকে আসা একজন অপরিচিত তরুণ আজকের সুপারস্টার জাহিদ হাসান। কখনো কী পেছনে ফিরে যান? ফিরে গেলে সেই অনুভ‚তিটা কেমন হয়?
জাহিদ হাসান: আমার ছেলে বেলাটা অনেক বিচিত্র ঘটনার মধ্য দিয়ে কেটেছে। আমি ছোটবেলা থেকেই একা থাকতে পছন্দ করিনা। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগে। আজকের জাহিদ হাসান যখন সেই সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসে তখন পকেট ফাঁকা ছিলো। শুধু দু চোখে স্বপ্ন ছিলো। ইচ্ছা ছিলো। অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা ছিলো আর মনের মধ্যে একটাই প্রত্যাশা ছিলো তা হলোÑ আমার হবে। আমি কখনোই কোনো কিছুতে হতাশ হয়নি। মনে আছে, আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন স্কাউটের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। তখন আমি সিরাজগঞ্জের তরুণ নাট্য দলে যোগ দেই। তখন থেকেই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতাম। পরবর্তীকালে একটা সময় আমি ‘সাত পুরুষের ঋণ’ নামের একটি মঞ্চ নাটক অভিনয় করেছিলাম। সেটি ১৯৮৪ সালে বিটিভিতে প্রচার হয়েছিল। সেইদিনের সেই অনুভ‚তি আমার কাছে আজো প্রাণবন্ত হয়ে আছে। সেই দিনগুলোর কথা আমি কখনোই ভুলবনা। আর ভুলিনি বলেই হয়তো আমি আজকের জাহিদ হাসান। শেকড় কখনো আমি ভুলিনি। তাই তো মাঝে মাঝেই আমি ছুটে যাই সিরাজগঞ্জে। শুধু তাই নয় আমি আজো কখনো ঢাকার বাইরে কিংবা দেশের বাইরে শুটিংয়ে গেলে আমার এলাকার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আসি। ওদের সাথে আড্ডা দেই, গল্প করি এবং সময় কাটাই। আমার ভালো লাগে, আনন্দ লাগে এতে এবং আমি নিজেকে খুঁজে পাই। আমি আসলেই কোনো কিছু ভুলিনি। ১৯৮৬ সালে আবদুল লতিফ বাচ্চুর পরিচালনায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘বলবান’-এ অভিনয় করেছিলাম। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার অভিনয় জীবন শুরু হয়। অভিনয়ের শুরুর দিকে রেজানুর রহমানের পরিচালনায় ‘ঠিকানা’ নামে একটি শর্ট ফিল্মে অভিনয় করেছিলাম। এটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল। ঠিকানাও আমাকে পরিচিতি দিয়েছে।

১৯৮৯ সালে অডিশন দিয়ে ১৯৯০ সালে ‘জীবন যেমন’ নাটকে অভিনয় করি। একই বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবলম্বনে ‘সমাপ্তি’ টেলিফিল্মে অভিনয় করি। এটির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সুবর্না মুস্তাফা। মনে পড়ে নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের সাথে কাজ করার কথা। গুণী এই নির্মাতার পরিচালনায় ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘আজ রবিবার’, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন’, ‘সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড’-এর মতো নাটকগুলো আমাকে জাহিদ হাসান বানিয়েছে। মাঝে মাঝেই মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা। তখন ভাবি আগের সময়টা কতো সুন্দর ছিলো। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম…।
আমি আল্লাহপাকের কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করি যে, তিনি আমাকে দয়া করেছেন বলেই আমি এতো মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আমি অনেক ভালো আছি। আমার দুই সন্তান একটা ছেলে আর একটা মেয়েÑ আল্লাহ আমার জন্য এতোটা সহায় হবেন আমি জানতামনা। আমি পরিবার পরিজন নিয়ে ভালো আছি। এটাই আমার কাছে শান্তি। আমি সাধারন পরিবারের একজন মানুষ মাত্র। যার চোখে স্বপ্ন ছিলো, পরিশ্রম করার মানসিকতা ছিলো আর নিজের ইচ্ছা শক্তিই আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে। আমি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের একটা কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, তা হলো ‘কোনো কিছু হওয়াটা কোনো বড় ব্যাপার না। কিছু হয়ে থাকাটা বড় ব্যাপার’ তাই আমার কাছে টিকে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।
আনন্দ আলো: আপনি হুমায়ূন আহমেদের অনেক নাটক টেলিফিল্ম ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর লেখা অনেক ধরনের চরিত্রে দর্শকদের সামনে হাজির হয়েছেন। এব্যাপারে কিছু বলুন…
জাহিদ হাসান: হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার তিন ধরনের সর্ম্পক ছিল। হুমায়ূন আহমেদ আমার বন্ধু ছিলেন, বাবা ছিলেন, আমার বড় ভাই ছিলেন। তাকে সবাই স্যার বলতেন, আমি বলতাম হুমায়ূন ভাই। উনি যখন মারা যান তখন আমি দেশে ছিলাম না। আমি তখন সৌদি আরবে ছিলাম। ওমরা হজ্জ্ব করতে গিয়েছিলাম। সেখানে যাওয়ার পর শুনতে পাই তিনি মারা গেছেন। আমি খবরটি শোনার পর পুরো রাত মদিনা শরীফে ফজরের আগ পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করি। এটা এক ধরনের ভক্তি শ্রদ্ধার জায়গা থেকেই আমি করেছিলাম।
হুমায়ূন আহমেদ আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছেন সেটা আমার কাছে অনেক মূল্যবান। উনি আমার জন্য যখন কোনো চরিত্র লিখতেন তখন জানতেন সেটা আমি কিভাবে ডেলিভারি দিবো। অন্য অনেকের স্ক্রীপ্টের সময় পাশে কিছুনা কিছু লিখে রাখতেন। কিন্তু আসাদুজ্জামান নূর ভাই ও আমার বেলায় দেখতাম কিছুই লিখতেন না। এটা সত্যিই অনেক বড় পাওয়্ াআমার জীবনে। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলে বিষয়টা আরো পরিস্কার হবে। তাঁর ভালোবাসাটা যে আমার জন্য কি ছিলো সেটা উল্লেখ করছি। একটা সময় হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে আমার একটা গ্যাপ দেখা দিয়েছিল। সেটা মানুষের কান কথা। উনি আবার মানুষের কান কথা বিশ্বাস করতেন। এটা এক প্রকার বাচ্চা সুলভ আচরণ উনার বলা যায়। যাই হোক সেই খারাপ সম্পর্কের সময় উনার সাথে আমার একটা জায়গায় দেখা হয়। তখন উনি আমাকে বলেন, কালকে আমার বাসায় আয়। আমার আবার পরের দিন শুটিং ছিলো। তাই আমি বলেছিলাম আমার তো শুটিং আছে। তখন উনি ধমক দিয়ে বলেন, তোকে আসতে বলছি আয়। যাই হোক গেলাম পরের দিন উনার বাসায়। গিয়ে দেখি অনেকে আছেন। রিয়াজ, মাহফুজ আহমেদ থেকে শুরু করে আরো অনেকে। আমাকে দেখে হুমায়ূন ভাই টিটকারীর ছলে নানান কথা বলা শুরু করলেন। আমাদের মাঝে এসেছেন দেশের বড় তারকা নায়ক রাজ জাহিদ হাসান। এই সময়ের ব্যস্ত অভিনেতা ইত্যাদি, ইত্যাদি…। আমি তো অবাক। কিছ্ইু বলছি না। একদম চুপচাপ বসে আছি। একটা সময়ে উনি একটি নাটকের বিষয়ে আলাপ শুরু করলেন। নাটকে কে কোন চরিত্র করবেন সেটা বললেন। ঈদের নাটক। নাটকের নাম ‘মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম’। নাটকে মন্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করবেন চ্যালেঞ্জার, মাহফুজ আহমেদ করবে সেক্রেটারির চরিত্র, রিয়াজ করবে একটা চরিত্র। সবার চরিত্র সবাইকে ভাগ করে দিলেন। আমি পড়ে গেলাম মহা এক ফাফড়ের মধ্যে। আমার চরিত্র কোনটা? কিচ্ছু বলছিনা। চুপচাপই বসে আছি। এক সময় আমাকে তিনি জানালেনÑ আমি জনৈক গ্রামবাসীর চরিত্রে অভিনয় করবো। মনটা তো ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। এতোদিন পর ডাকলো এই চরিত্রে কাজ করার জন্য? যাই হোক শুটিংয়ে গেলাম। শুটিং শুরু হলো। একটার পর একটা দৃশ্য হচ্ছে আমাকে ডাকছেন না। ছোটখাটো দু’একটি সিন করেছি। মন তো খারাপ। এমনও সিদ্ধান্ত নিলাম এটাই শেষ নাটক করা। আর অভিনয় করবো না। যেহেতু এসেছি কাজটা করেই যাই। তিনদিন শুটিং শেষে নাটকটি এডিটিং-এ গেলো। এডিটিং শেষে আবার সবাইকে ডেকে নিয়ে নাটক দেখাতেন তিনি। নাটক দেখার পর আমি অবাক হয়ে গেলাম। নাটকের প্রধান চরিত্র ছিলাম আমি। সেই জনৈক গ্রামবাসীই নাটকের মূল চরিত্র। এই ছিলো আমার প্রতি মানুষটার ভালোবাসা। এরকম আরো অনেক ঘটনা আছে। যা এই অল্প সময়ে বলে শেষ করা যাবে না।
আনন্দ আলো: এই যে নির্মাতা আর অভিনয়শিল্পীর মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক এটা তো এখন নেই বললেই চলে…

জাহিদ হাসান: এটা সত্যি কথা। আর থাকবেই বা কিভাবে। এখন যে কেউ অভিনেতা, যে কেউ নির্মাতা, ইউটিউবের কল্যাণে সবাই এখন আর্টিস্ট, সবাই শিল্পী। পিতা সমতুল্য, শিক্ষক সমতুল্য এবং বড় ভাই সমতুল্য নির্মাতা এখন কোথায়?
নওয়াজীশ আলী খান, আবদুল লতিফ বাচ্চু, মোস্তফা কামাল সৈয়দ বিটিভির সময়ে এদের মতো বাঘা বাঘা মানুষের আন্ডারে কাজ করেছি। যাদেরকে দেখা মাত্রই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসতো। এই লেভেলের নির্মাতা এখন নেই। এখন নির্মাতারা বলে দেয় ভাই আপনি দুই মিনিটের সিন দিয়ে দেন। আব্দুল্লাহ আল মামুন ছিলেন আমার কাছে বাবার মতো। এরকম মানুষ ছিলেন আরো যেমনÑ মমতাজ আলী, কাজী জহির, আমলগীর, কুমকুমÑ সিনেমায় এই লেভেলের নির্মাতাদের যারা কাজ করেছেন তারা সবাই বড়, শিক্ষক আর পিতার সমতুল্যের নির্মাতা ছিলেন।
আনন্দ আলো: আপনি মঞ্চে একজন দাপুটে অভিনেতা ছিলেন। আপনি টেলিভিশনের আগেই মঞ্চে অনেক বড় তারকা হয়েছিলেন? এখনকার সময়ে একজন তরুণের কাছে এমন অধ্যাবসায় ও ডেডিকেশন পাওয়া যায় না…
জাহিদ হাসান: আসলে তরুণদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এখন আসলে মিডিয়ার ভাষাটাই বদলে গেছে। আমাদের ছোটবেলায় ঘুম ভাঙ্গতো বাড়ির পাশের হিন্দু বাড়ি থেকে আসা কীর্তনের শব্দ শুনে, বাবা-মায়ের কোরআন তেলওয়াতের মধুর আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙ্গতো। এখন সিস্টেমটা পরিবর্তন হয়েছে। আগে একটা রেডিওতে কেউ গান করলে কিংবা অনুরোধের আসরে চিঠি পড়ার সময় নাম বললে পরেরদিন সে এলাকায় সেলিব্রেটি হয়ে যেতো। ভাবটা এমন ছিলো সে একটা কিছু করেছে। এখন তো সেই সময়টা নেই। শুধু কথায় কথায় তরুণদের দোষ দিলে তো হবে না। সময়টা অনেক বদলেছে। পরিবেশটাও অনেক বদলেছে। এখনকার সময়ে কেউ রেডিওতে গান গাইবে, সঙ্গীত চর্চা করবে এটা ভাবাই যায় না। কারণ এখন কেউ গান গাইলেই আগে চিন্তা করবে একটা মিউজিক ভিডিওর কথা। অথচ ছোটবেলায় সকাল হলেই অনেকের রেওয়াজ শুনতাম। মিডিয়ার ভাষাটা অনেক বদলে গেছে। এখনকার সবকিছু অন্য জায়গায় চলে গেছে। ঠিক আগে যেমন একটি ছেলে বা মেয়ে মঞ্চে অভিনয় করতো, তারপর বিটিভিতে অডিশন দিতো তারপর আস্তে আস্তে টিভি পর্দায় আসতো এবং ধীরে ধীরে অভিনেতা হয়ে উঠতো। এখন কী সেই অবস্থা আছে? অবশ্যই নাই।
জব সেটিসফেকশন বলতে একটা কথা আছে। কোনো অফিসে যদি একজন কর্মকর্তা দশ বছর পনের বছর কাজ করার পরও তার প্রমোশন না হয় এবং কোনো মন্ত্রী বা উচ্চ পর্যায়ের কারো সুপারিশে অন্য আরেকটি জুনিয়র ছেলের প্রমোশন হয়ে যায় তাহলে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ছেলেটির কেমন লাগবে? এখন অভিনয়ের বিষয়টাও তাই। দেখা গেছে মঞ্চ করে অনেক কষ্ট করে একটা ছেলে অভিনয় করছে এবং সে অভিনয়ের সব ছলাকলা রপ্ত করার পরও কোনো ইউটিউবার এসেই যদি ভালো পারিশ্রমিক পেয়ে যায়, পজিশন পেয়ে যায় এবং ফ্ল্যাট, গাড়ি, বাড়ি করে ফেলে তাহলে মঞ্চ করার ছেলেটির কেমন লাগবে? তার কাছে তখন সততা, অধ্যাবসায় আর অভিনয় শেখার কি দাম থাকলো? এখনকার সময়টাই তাই। এখন কে কিভাবে কতো দ্রæত অনেক বড় হবে সেটা সবার মধ্যে কাজ করে। তাই সমস্যাটা থিয়েটারের না। সমস্যাটা হলো মিডিয়ার। সিস্টেম ঠিক নাই। তাই আগে সিস্টেম ঠিক করতে হবে। তবেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।