Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

কাঠ গড়ায় ঈদের নাটক!

সৈয়দ ইকবাল : এবার ঈদুল-ফিতর এ অনুষ্ঠানভিত্তিক টিভি চ্যানেলগুলো তাদের আয়োজনে বেশ বৈচিত্র্যতা আনার চেষ্টা করেছে। বর্তমান সময়টা ইউটিউব ও অ্যাপ ভিত্তিক হওয়ায় বেশ কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেল তাদের নিজস্ব চ্যানেলের জন্য বিগ বাজেটের বেশ কিছু নাটক নির্মাণ করেন। সব মিলিয়ে কেমন হয়েছে ঈদের নাটকগুলো? নাটকের নাম থেকে শুরু করে পোস্টার এবং প্রচার-প্রচারণায় তা পরিলক্ষিতও হয়। কয়েক বছর আগেও টিভি চ্যানেলে ঈদের নাটকে কমেডি গল্পের প্রভাব ছিলো বেশি। তখন টিভি চ্যানেল খুললেই মনে হতো অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সবাই যেন ভাঁড় হয়ে গেছেন। তারা কারণ ও যুক্তি ছাড়াই জোর করে কাতুকুতু দিয়ে দর্শক হাসানোর বৃথা চেষ্টায় সংলাপ দিতেন। নাটকের নাম থেকে শুরু করে পোস্টার, প্রচারণা সবকিছুতেই থাকতো কমেডির ছাপ। জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরীর মতো জাঁদরেল অভিনেতারা সেই কমেডির সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন। এসব নিয়ে সমালোচনাও ছিলো। বিরক্ত দর্শক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিভি নাটক নিয়ে তাদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। বেশ ক’জন নির্মাতা এই ধারা বদলে দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
তবে মজার ব্যাপার হলো পরিবর্তন যা এসেছে সেটা নিয়েও এখন মহা বিরক্ত দর্শক। কারণ হাসির বদলে টিভি নাটককে পেয়েছে এবার কান্নার অসুখে। আগে যেখানে কারণ ও যুক্তি ছাড়াই হাসানো হতো সেখানে এখন কাঁদানো হচ্ছে। গল্পের সাথে সামঞ্জস্য না রেখেই নাটক-টেলিফিল্মগুলোতে আবেগ ঢেলে দেয়া হচ্ছে। কোনো একটা ক্লু নিয়ে গল্পে বিষাদ-বেদনা যোগ করে মিনিটের পর মিনিট নায়িকাদের কাঁন্নার দৃশ্যে অভিনয় করানো চলছেই। বিশেষ করে অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী ও তানজিন তিশা কান্নার দৃশ্যে আলাদা পরিচিতি পেয়ে গেছেন।
অনেকে তাদেরকে ‘কান্নার অভিনেত্রী’ বলেও ডাকা শুরু করে দিয়েছেন। নাটকে তাদের উপস্থিতি মানেই দর্শক ধরে নিচ্ছেন ৪৫ মিনিটের গল্পে ১৫ মিনিট কাঁদবেন তারা, এমনই মন্তব্যে সয়লাব ফেসবুক। নানারকম ট্রলও হচ্ছে।
অপূর্ব ও মেহজাবীনের ‘বড় ছেলে’ নাটক দিয়ে কমেডি সা¤্রাজ্যে ধস নামিয়ে একটা ইউটার্ন পেয়েছিলো বাংলা নাটক। ভাবা হচ্ছিলো জীবনের বাস্তবতা, পারিবারিক মূল্যবোধ ও মানবিক সম্পর্কের দায়বোধ নিয়ে বৈচিত্রময় হয়ে উঠবে নাটক-টেলিছবির গল্প ও নির্মাণ।

কিন্ত সে আশায় গুড়ে বালি। ‘বড় ছেলে’ ইউটার্ন দিলেও সেটা ধারাবাহিক থাকেনি। কেবল ধারাবাহিক থেকেছে ‘বড়ে ছেলে’র আদলে নির্মাণ ও কেঁদে জনপ্রিয়তা পাওয়া মেহজাবীনের কান্নার দৃশ্য। যোগ হয়েছে অপূর্বর সঙ্গে আফরান নিশো ও মেহজাবীনের সঙ্গে তানজিন তিশাসহ আরও কয়েকজন অভিনেত্রীর ন্যাকা ন্যাকা প্রেমিকা ও তরুণী বউ চরিত্রের অভিনয়। শুধু তাই নয়- একটা পরিবারের বউ হতে হলে যে একটা মেয়ের পরিণত বয়স লাগে সেটাও বোধহয় পরিচালকরা বোঝেন না। ছোট ছোট মেয়েদের দিয়ে দিচ্ছে- অপূর্ব আর নিশোর বউয়ের চরিত্রে। এগুলা নিয়ে ফেসবুক থেকে শুরু করে ইউটিউবে নাটকের লিংকে মুখরোচক সমালোচনা হচ্ছে।
আর গল্পের কমন ফর্মুলা দুইজন মানব-মানবীর প্রেম অথবা দাম্পত্য। সেখানে না থাকছে গল্পের বৈচিত্রতা, না থাকছে চরিত্রের বৈচিত্রতা, না থাকছে লোকেশনের বৈচিত্র্যতা। থাকছে না অভিনয়শিল্পীদের বৈচিত্র্যতাও।
ঘুরে ফিরে অপূর্ব-নিশোর সঙ্গে মেহজাবীন-তানজিন তিশাকে নিয়ে নির্মিত হচ্ছে নাটক। কখনো কখনো সাফা কবির, নুসরাত ইমরোজ তিশা, মমরা আসছেন। সাথে আছেন মোশাররফ করিম আপন ভঙ্গিমায়… গেল ঈদে এই ক’জন তারকাকেই ঘুরে ফিরে দেখা গেল বিভিন্ন টিভি নাটকে। যার ফলে একঘেয়েমিতে আক্রান্ত দর্শক মুখ ফিরিয়ে ছিলেন টিভি নাটক থেকে।
ইদানিংকার টিভি নাটকে কমন সংলাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘বাবু’ ও ‘সোনা’। নাটকগুলোতে কমন একটি অনুষঙ্গ হয়ে গেছে অপ্রয়োজনীয় গান। যা কেবলই নাটকের সময়কে দীর্ঘ করা ছাড়া আর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, নাটক এখন গানকে সাপোর্ট দিচ্ছে মিউজিক ভিডিও হিসেবে। যা অত্যন্ত হতাশার ও টিভি নাটকের মহামারী হিসেবে রুপ নিচ্ছে দিনে দিনে। শুধু তাই নয়- অনেক নাটকে অশালীন দৃশ্যের সাথে সাথে অশালীন সংলাপও থাকছে। পরে দেখা গেছে সেসব নাটকের মিউজিকে টুট টুট শব্দ থাকে। মানে বোঝা যাচ্ছে সেখানে গালি দিয়েছে। তাই তো বিরক্তির মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে নাটকগুলোতে অশ্লীল সংলাপ, গালাগালি ও ইশারা ইঙ্গিত। তানজিন তিশা ও আফরান নিশোর মতো তারকাদের দেখা গেছে গলা ফাটিয়ে গালি দিয়ে যাচ্ছেন মিনিটে মিনিটে! যার ফলে টিভি ও ইউটিউবের জন্য নির্মিত নাটকেও সেন্সর বোর্ডের নজরদারির প্রয়োজন আছে বলে দাবি উঠেছে।

অনেকে মনে করছেন ইউটিউব এখন টিভি চ্যানেলকে শাসন করছে, প্রভাবিত করছে। টিভিকে পাশ কাটিয়ে ইউটিউবের জন্যও নাটক নির্মাণের হিড়িক বেড়েছে। নাটক প্রযোজনায় আসছে মিউজিক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো। সেখানে ভিউকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে এখন। আর ইউটিউবের জনপ্রিয়তার চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়েই অল্প ক’জন তারকায় আটকে গেছে নাটক নির্মাণের ভাবনা। এইসব নাটকে একটা-দুইটা গান ভিডিও আকারে প্রকাশ করার আলাদা ব্যবসাও চোখে লাগছে।
অন্যদিকে ইউটিউবের আধিপত্যে নির্মাতারা নিজেদের যোগ্যতা-মেধা ও নির্মাণের মুন্সিয়ানার চেয়ে, গল্পের চেয়ে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন ‘ভিউ’ আনা তারকাদের উপর। চটকদারি প্রচারণায় ইউটিউবে খানিক সময়ের জন্য ঢুঁ মেরে হয়তো ভিউ বাড়ছে। কিন্তু অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে টিভি চ্যানেলগুলো। ইউটিউবের ভিউয়ের জন্য একই তারকা, সস্তা গল্প ও সংলাপকে প্রাধান্য না দিয়ে দেশ ও সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে, দেশের বিভিন্ন সাফল্য নিয়ে বৈচিত্রময় নাটক নির্মাণের পরামার্শ দিচ্ছেন বিশিষ্টজনেরা।
তবে আশার কথা একঘেয়েমি নাটকগুলোর ভিড়ে ঠিকই টিভিতে আলোচনায় এসেছে আফজাল হোসেন, জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, মীর সাব্বিরদের নাটকগুলো। চাকচিক্যের প্রচারণা ছাড়াই ঈদের সেরা অনুষ্ঠান হিসেবে দর্শকের মনে দাগ কেটেছে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ ও হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’। আফজাল হোসেন ও ফরিদুর রেজা সাগরের যৌথ প্রয়াস ছোটকাকু সিরিজের এবারের আয়োজনও ছিল বেশ চমকপ্রদ। এই অনুষ্ঠানগুলো টিআরপি রেটিংয়ে যেমন ছিলো সবার শীর্ষে তেমনি ইউটিউবেও পেয়েছে অভাবনীয় সাফল্য।