সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
রেজানুর রহমান
বাংলাদেশে সার্বজনীন এতবড় আনন্দ উৎসব বছরে একবারই আসে। বাংলা নববর্ষ পালনের দিন গোটা দেশের মানুষ যেন দাঁড়িয়ে যায় একই মোহনায়। সবার কণ্ঠে একই সুর ও প্রত্যাশার পংতিমালা উচ্চারিত হয়। প্রথমে ঘর থেকে অর্থাৎ পরিবার থেকে আনন্দ উৎসবের ঢেউ উছলে পড়ে সামাজিক আঙিনায়। তারপর সেই ঢেউ ছটে চলে পাড়া, মহল্লা থেকে থানায়। থানা থেকে জেলায় জেলায়… তারপর গোটা বাংলাদেশে। যেন জাদুঘরের ছুঃ মন্তর ছুঃ এই মন্ত্রেই জেগে ওঠে গোটা বাংলাদেশ। মেলায় যাইরে, মেলায় যাইরে… এই আনন্দে উদভাসিত হয়ে ওঠে দেশের হাজার বছরের সংস্কৃতি।
একটা সময় ছিল যখন পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান সীমাবদ্ধ থাকতো গ্রাম-গঞ্জের বিস্তৃত প্রান্তরে। বৈশাখী মেলা, সার্কাস অথবা যাত্রা পালার মাধ্যমে কোথাও কোথাও মাসব্যাপি চলতো বৈশাখি উৎসব। শহুরে মানুষেরা তখন ছুটে যেতেন গ্রামে। আর এখন গ্রাম-শহরের তেমন কোনো পার্থক্য নাই। বরং পহেলা বৈশাখ পালনের ক্ষেত্রে এখন গ্রামের চেয়ে শহরেই জাকজমক বেশি দেখা যায়। কর্পোরেট কালচার ঢুকে পড়েছে বৈশাখ পালনের আনুষ্ঠানিকতায়। যার ফলে গ্রামের চেয়ে কোনো কোনো শহরে পহেলা বৈশাখ পালনের বাহারি অনুষ্ঠান বেশী চমক সৃষ্টি করছে। প্রতি বছর ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের নানামুখি আয়োজন বিশেষ করে চারুকলার মঙ্গল শোভা যাত্রা বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। আর তাই চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতি দেশের মানুষের আলাদা একটা আগ্রহ থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আইন শৃঙ্খলা জনিত কারণে এবার মঙ্গল শোভা যাত্রার গতিপথ অনেকটা ছোটো করে দেওয়া হয়েছিল। তা সত্বেও হাজার হাজার মানুষ চারুকলার ঐতিহাসিক মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিদেশীদের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মতো। বাঙ্গালীর ঐতিহ্যবাহী পোশাক পাঞ্জাবি-পায়জামা ও সালোয়ার কামিজ পড়েই অনেক বিদেশী মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেন। বর্ষ বরণের এতবড় নান্দনিক আয়োজন দেখে সকলেই মুগ্ধ।
ঢাকায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ছায়ানটের যুগান্তকারী ভ‚মিকা সবার জন্য। একদা শাসক গোষ্ঠীর রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে রমনার বটমূলে বহু বছর আগে ওই যে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল আজও তা চলছে স্বমহিমায়। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এবারও রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মতো। অনুষ্ঠানের শুরুতে ছায়ানটের অধ্যক্ষ সনজিদা খাতুন সমবেত সকলের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। ছায়ানটের উদ্যোগে এতিহ্যবাহী বর্ষবরণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই রমনার বটমূলে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষ হবার পরও রমনাপার্ক এলাকায় মানুষের ঢল ছিল উল্লেখ করার মতো।
ঢাকায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেছে দেশের অগ্রগন্য টিভি মাধ্যম চ্যানেল আই ও সঙ্গীত শিক্ষার বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান সুরের ধারা। আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের আঙিনায় আজ থেকে ৭ বছর আগে ‘হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ পালন’ শীর্ষক নান্দনিক এক অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এবারও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের আঙিনায় চ্যানেল আই ও সুরের ধারার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয়েছে। ‘লিভার আয়ুষ চ্যানেল আই সুরের ধারা হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ’ শীর্ষক এই আয়োজনটি ছিল এবার সবচেয়ে আলোচিত এবং আলোকিত আয়োজন।

ভুটানের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং সহ তাঁর দেশের একাধিক মন্ত্রীকে সাথে নিয়ে এবার বাংলাদেশে হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ফলে এবারের আয়োজনের প্রতি গোটা দেশের মানুষের ব্যাপক আগ্রহ দেখা দেয়। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং প্রায় একঘণ্টা হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন। অনুষ্ঠানে তাকে স্বাগত জানান চ্যানেল আই এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ এবং সুরের ধারার অধ্যক্ষ বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। অনুষ্ঠানে চ্যানেল আই এর পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং এর হাতে স্মারক স্মৃতি হিসেবে ক্রেস্ট ও ফটো ফ্রেমে বাধানো অনুষ্ঠানের একটি তাৎক্ষনিক ছবি উপহার দেন। উল্লেখ্য, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং যখন অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন তখনই চ্যানেল আই এর ফটোগ্রাফার এই ছবিটি তুলেছিলেন। লোটে শেরিং চ্যানেল আই সুরের ধারার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি প্রায় একঘণ্টা উপভোগ করেন। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠানে আসার সময় লোটে শেরিং এর যে ছবিটি তোলা হয়েছিল সেটি ল্যাবে প্রিন্ট করে ফটোফ্রেমে বাধাইয়ের কাজটি সম্পন্ন করা হয়। এজন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই আগে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আনা হয়েছিল। মঞ্চে বাঁধানো ফ্রেমে তাৎক্ষনিকভাবে নিজের ছবি দেখে লোটে শেরিং বেশ খুশি হয়েছেন। অনুষ্ঠানে বাংলায় তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন লোটে শেরিং। আপনারা কি পান্তা খেয়েছেন? তাঁর এই প্রশ্নটি ছিল অনেক আনন্দের।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের আঙিনায় লিভার আয়ুষ চ্যানেল আই সুরের ধারা হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণের এই অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিল আগের দিন সন্ধ্যায় চৈত্র সংক্রান্তি অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে। সুরের ধারা বর্ষ বিদায় উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পরে রাতভর অনুষ্ঠানস্থলে দেশের গান পরিবেশ করেন দেশের বিশিষ্ট শিল্পীবৃন্দ। পরের দিন ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই ঐতিহ্যবাহী হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের শুভ সুচনা হয়। চ্যানেল আই এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ স্বাগত বক্তব্য রাখেন। সকাল ৬টায় ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং সহ অন্যান্য অতিথিরা অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। এপর্যায়ে বক্তব্য রাখেন সুরের ধারার অধ্যক্ষ রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে এম আব্দুল মোমেন, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী একে এম খালিদ, ভুটানের একাধিক মন্ত্রী সহ বিশিষ্ট অতিথিবর্গ এই সময় উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, চ্যানেল আই, একাত্তর টেলিভিশন ও ভারতের একটি টিভি চ্যানেল সুরের ধারা ও চ্যানল আই বর্ষবরণের এই ঐতিহ্যমন্ডিত আয়োজনটি সরাসরি সম্প্রচার করে।
বর্ষবরণ উপলক্ষে ঢাকায় প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ব্যাপক অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করে। শাহবাগ সংলগ্ন শিশুপার্কে ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি ছিল বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মতো। শিল্পকলা একাডেমিতে দিনভর নানামুখি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলা একাডেমিতে বৈশাখী মেলায় বিপুল সংখ্যক ক্রেতা-দর্শকের সমাগম ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষককেন্দ্র অর্থাৎ টিএসসি প্রাঙ্গনে দিনভর নানামুখি আয়োজনে আনন্দ উৎসবের ঢেউ খেলে যায়। ধানমন্ডি লেকের ধারে উম্মুক্ত মঞ্চে বৈশাখী অনুষ্ঠানের ঢেউ তো লেগেই ছিল। মীরপুর, যাত্রাবাড়ি, পুরানোর ঢাকার বিভিন্ন স্থানেও বর্ষবরণের নানামুখি আয়োজন ছিল। নগরীর বিভিন্ন হোটেলেও বর্ষবরণের নানামুখি অনুষ্ঠান এবং খাওয়া-দাওয়ার বিশেষ আয়োজনে ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল।