সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
রেজানুর রহমান
দুই যোদ্ধা’ নামে রাবেয়া খাতুনের একটি ছোটগল্প আছে। গল্পের শুরুটা এরকমÑ
আজও পথে উপচানো মানুষ। ভয়ার্ত, আতংকিত। এই আছে এই নেই। কে যে কোন দিকে চলে যাচ্ছে, কোথায়Ñ কেউ কাউকে বলে না। আসলে নিজেরাও জানে না। জানে শুধু এই অভিশাপ্ত শহর ছেড়ে যেতে হবে।
আজ উনত্রিশে মার্চ ১৯৭১, সোমবার। পরশু কিছু সময়ের জন্য কারফিউ ব্রেকে প্রতিবেশিদের অনেকেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। সেই থেকে পেয়ে বসেছে নিদারুন অসহায় অস্থিরতায়। ঢাকার বাঙ্গালী ব্যবসায়িদের বাজার পাকিস্তানি ঘাতক জঙ্গি সৈন্যরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। শাখারি বাজার, রেল লাইনের বস্তি, রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ি থেকে এখনও ধোঁয়া উড়ছে। আকাশ কালো হয়েছিল বিকাল থেকে। সন্ধ্যার পর প্রবল গর্জনে বৃষ্টি এলো। বিদ্যুতে নয় যেন জলন্ত আজদাহারা নামছিল আকাশ থেকে। মনার মা পাগলের মতো চেচিয়ে বলছিল, এগুলান গায়েবি গজব। আল্লাহর আরস থিকা পড়ত্যাছে। ঐ হারামজাদা বেজম্মা টিক্কা আর অর খাকি কুত্তাগুলার লাইগা… পড় ঠাটা পড়। ছাই কর ইবলিশের ছাওয়ালগো…
ঘন ঘন বাজের পর নামলো বৃষ্টি। এত জোরে, এতক্ষণ ধরে। মনার মা তার সঙ্গে চোখের পানি মিশিয়ে দিয়ে মন্তব্য করল, আমগো এইটা রহমতের ম্যাগ। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, বন জঙ্গল শহীদগো খুনে রাঙা হইয়া আছে। সেই খুন ধোয়া হইতেছে গায়েবী চোখের পানিতে। আপাগো…
মনার মা চোখ মুছতে মুছতে কথা শেষ না করে ফিরে গেছিলো রান্না ঘরে।
মারুফ বেডরুমে ঢুকলো উত্তেজিত ভঙ্গিতে, অ্যাই শুনছো?
মৃত্তিকা ঘাড় গোজা থেকেই বলল, কি আর শোনাবে। খালি তো খারাপ খবর।
না তা নয়। শুনে খুব খুশি হবে। আমায় দুটো চুমু বাড়তি বকশিস দেবে।
বকশিস দেবো? এই ঘোর দুঃসময়ে এমন কী খবর?
ড্রয়িংরুমে ট্রানজিস্টারের নব ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ করে পেয়ে গেলাম জয় বাংলা সেন্টার। বলা হলো, এটি মুক্তিবাহিনীরা পরিচালনা করছে। কারও কারও গলা খুব চেনা মনে হলো। দেশের গান গুলোতে এই মাসের শুরুতে ঢাকা টিভি, রেডিও, ঘরে-বাইরে-মার্কেটে, আমজনতার মুখে মুখে ছিল।
স্বাধীন বালা বেতার কেন্দ্রে। জয়বাংলা স্টেশন। নিজেদের মধ্যে যা নিয়ে আলোচনা হতো। সত্যি তা সম্ভব হয়েছে?
শেষের দিকে মৃত্তিকার কণ্ঠস্বর কাঁপতে কাঁপতে বুজে এলো।
মারুফের বুকের সঙ্গে যখন ঘনিষ্ঠ হলো, দুগাল বেয়ে পানি ঝরছে।
কিন্তু এই সময় কেউ কথা বলল না। বাইরে ধমাধম বৃষ্টি। বাইরে রাত ভর লাগাতার বøক আউট, কারফিউ। অকারণে অনর্গল মটরের মতো, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো বাজতে থাকা খান সেনাদের চাইনিজ রাইফেল বা স্টেনগানের শব্দ নেই। ওরা বর্ষাকে খুব ভয় পায়। আকাশ মেঘলা হতেই ভীত মুষিকের মতো কে কোথায় ঢুকেছে কে জানে…

‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ নামে সবসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের একটি উপন্যাস আছে। উপন্যাসের শুরুর দিকের একটি অংশ তুলে ধরছিÑ
মহিউদ্দিন শুকনো একটি কঞ্চি কুড়িয়ে নেয়, ভেঙ্গে সেটা ছোট করে এবং পা দিয়ে পায়ের নিচে মাটি থেকে পাতা-পত্তর সরিয়ে উবু হয়ে বসতে বসতে সেই কঞ্চি দিয়ে একটি নকশা রচনা করতে থাকে। তার সঙ্গীরাও ক্রমশ তাকে ঘিরে বসে পড়ে, ঘন বাঁশবনের পাশে, পরিত্যক্ত এই গৃহস্থ বাড়িটির বাহির প্রাঙ্গণে।
মহিউদ্দিন প্রথমে একটি ঘোড়ার নাল আঁকে, এবং অচিরেই নালের খোলা দুই মুখের দুই দিকে লম্বা করে লাইন টেনে দিয়ে স্মিথমুখে সঙ্গীদের দিকে তাকায়।
মহিউদ্দিন প্রশ্ন করে, ‘কি এটা?’
কেউ কেউ অনুমান করতে পারলেও মুখে কিছু বলে না, মহিউদ্দিনও সত্যি সত্যি এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আশা করে না, কারণ এ প্রশ্ন তার বক্তব্যের ভ‚মিকা সূচক অলংকার মাত্র।
মহিউদ্দিন দাগের ওপর কঞ্চি আরেকবার বুলিয়ে বলে, ‘এই হচ্ছে আধকোশা নদী, এই হচ্ছে নদীর গতিপথ।’ সে তার বাঁ দিকের সরল রেখাটির বাইরে প্রান্ত থেকে আবার শুরু করে দেখাতে। ‘এখানে কাঁঠালবাড়ি। এই কাঁঠালবাড়ি ছেড়ে, পলাশবাড়ি ছেড়ে, এই এসে বল্লার চরে থামলাম। এটা বল্লার চর।’ মহিউদ্দিন কঞ্চি বুলিয়ে ঘোড়ার নালের বাঁ দিকের মুখে এসে থামে এবং জায়গাটিতে কয়েকবার কঞ্চির আছাড় মারে। বলে, ‘বল্লার চর এইখানে। এবার এই নদী উত্তর দিকে উঠছে, এই নেমে এসে পুরো জলেশ্বরী ঘুরে আবার দক্ষিণ দিকে বাঁক নিল।’ মহিউদ্দিন কঞ্চি বুলিয়ে সম্পূর্ণ ঘোড়ার নালটি আবার দেখায়। ‘এই জলেশ্বরী ছেড়ে দিয়ে সোজা পূর্ব দিকে মান্দারবাড়ি পর্যন্ত আধকোশা নদী চলে গেছে।’ মহিউদ্দিনের কঞ্চি এখন ঘোড়ার নালটির ডান দিকের সরল রেখার শেষ প্রান্তে এসে বাতাসে উঠে যায়। ‘মান্দারবাড়ির পরে নদী আবার দক্ষিণ দিকে খাড়া নেমে গেছে, কিন্তু সে আমাদের দরকার নেই। আমাদের দরকার জলেশ্বরী, যে জলেশ্বরী ঘিরে আধকোশা নদী বেরিয়ে গেছে।’
সঙ্গীরা মনোযোগের সঙ্গে নকশাটি দেখতে থাকে। তাদের সবারই জন্ম জলেশ্বরীতে, এই আধকোশ নদী কতবার তারা দেখেছে, কতবার এ নদীতে সাঁতার কেটেছে, এর ঝাউবনের ভেতরে কতদিন তারা বনভোজন করেছে, সেসব আরেক জীবনের কথা; আধকোশাকে এখন তাদের প্রত্যেকের কাছেই নতুন এক নদী মনে হয়। মনে হয়, এ নদী তারা কখনো দেখেনি, এবং এই প্রথম তারা এর পরিচয় পাচ্ছে।
সুলতান হঠাৎ খুকখুক করে হেসে ওঠে; মহিউদ্দিন তার দিকে স্মিত চোখে তাকায়। সুলতানের স্বভাব এই যে, যখনই সে কিছু একটা অনুমান করে নেয় এবং অনুমানটি যখন তার বেশ মনঃপূত হয়, সে খুকখুক করে হাসে, বারবার সকলের মুখের দিকে তাকায় আর হাসে, হাসতে থাকে।
মহিউদ্দিন সুলতানের কাঁধে কঞ্চির ছোট একটি আঘাত করে, ফলে হাসিটা আরো বেড়ে যায় সুলতানের। মহিউদ্দিনও হাসতে থাকে তখন।
হাসতে হাসতেই মহিউদ্দিন বলে, ‘সুলতান ঠিক বুঝতে পেরেছে আমাদের কৌশলটা কি হবে। ঘোড়ার নালের দুই মুখে আছে, পশ্চিমে বল্লার চর, পূর্বে হাগুরার হাট, আর নালের পেটের ভেতর জলেশ্বরী। আমরা জানি আধকোশা নদী বয়ে এসে এই বল্লার চরে ধাক্কা মারে, তারপর পথ বন্ধ দেখতে পেয়ে উত্তরে বাঁক নেয়, বল্লার চরে ধাক্কা মারতে মারতে সেখানে একদিকে পড়েছে চর, আরেক দিকে হয়ে গেছে একটা খাত, যে খাত দিয়ে নদী কিছুদূর এগিয়ে আবার ঘুরে যায়। বল্লার চরের এই খাতটি, আমরা যারা বল্লার চর চিনি, আমরা জানি, প্রায় সিকি মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সিকি মাইলের পর সোজা আর এক মাইল হেঁটে গেলেই আমরা পৌঁছে যাই হাগুরার হাটে, যেখানে নদী জলেশ্বরী বেড় দিয়ে এসে পুবে বেরিয়ে গেছে। এখন এই বল্লার চরের কাতটি যদি লম্বা হয়ে হাগুরার হাট পর্যন্ত যায়, আধকোশা তাহলে আর জলেশ্বরী বেড় না দিয়ে, সোজা উত্তর থেকে নেমে বল্লার চর-হাগুরার হাট যোগ করে পুবে চলে যেতে পারে।’
আলম প্রশ্ন করে, ‘তাতে আমাদের কি হবে?’
‘এখনো বুঝতে পারছিস না?’
আলম হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। সুলতান আবার খুকখুক করে হেসে ওঠে, আলমের পাঁজরে খোঁচা দেয়।
আলম ক্ষেপে গিয়ে বলে, ‘খুব চালাক মনে করিস নিজেকে, না?’
মহিউদ্দন বলে, ‘ডিসিপ্লিন, সুলতান। ডিসিপ্লিন, আলম। আমরা এখন সকলেই সৈনিক, আমরা এখন জরুরি একটা পরামর্শে বসেছি, সৈনিকের ডিসিপ্লিন আমাদের না থাকলে আমরা কোনো কাজেই সফল হতে পারব না। আমরা সবাই এখন একসঙ্গে বসেছি একটা কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে। আমি আমার বক্তব্য শেষ করার পর, সবাই মিলে দেখব কৌশলটি বাস্তব কি না, কৌশলটি প্রয়োগ করবার মতো শক্তি আমাদের আছে কি না, কিংবা এর চেয়ে ভাল কৌশল কারো মাথায় আসে কি না। আমাদের এই কৌশলের ওপর নির্ভর করছে জলেশ্বরীকে শত্রæর কবল থেকে আমরা মুক্ত করতে পারব কি না। অতএব সুলতান, তোমার হাসি বন্ধ করো, ভাই। হাসবে তো তখন, যখন জলেশ্বরীতে আমরা জয়বাংলার নিশান ওড়াতে পারব।’
সকলের মুখ একসঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ঝুঁকে পড়ে সকলেই এখন মাটিতে আঁকা নকশাটির দিকে মনোযোগ দেয়।
মহিউদ্দিন বলে, ‘আমরা জানি, বৃষ্টির মৌসুমে আমাদের এই আধকোশা নদী কি ভীষণ মূর্তি ধারণ করে। রাতারাতি নদী ফুলে ওঠে, চওড়া হয়ে যায়, প্রায় এক মাইল চওড়া হয়ে যায় বলেই এই নদীর নাম আধকোশা, আর সেই এক মাইল চওড়া নদী গিয়ে কলকল খলখল করে বয়ে যেতে থাকে প্রচÐ সব ঘূর্ণি বুকে নিয়ে বৃষ্টির পানি; সেই ¯্রােতের মুখে সমস্ত কিছু ডুবে যায়, ভেসে যায়, সবকিছু ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে ধসিয়ে দিয়ে নদী বয়ে যায়। আধকোশা নদীর এই চেহারার কথা শত্রæরা জানে না, তারা এদেশের নয় বলেই তাদের জানবার কথা নয়। তাছাড়া আধকোশা নদী এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ নদী নয় বলেই, আমার মনে হয় না, পাকিস্তানী মিলিটারিরা এর তেমন খোঁজ রাখে, বা হিসাবের মধ্যে রাখে। বছরের যে দশটি মাস আধকোশা শুকিয়ে সুতোর মতো পড়ে যায়, আমার অনুমান, ওরা সেটাকেই বরাবরের চেহারা বলে মনে করে।’
আলম বলে, ‘কিন্তু মিলিটারি বাইরের হলেও আমাদের দেশের লোক তো কিছু কিছু তাদের সঙ্গে আছে, তাদের দালালী করছে, সেই দালালগুলো তো আধকোশার চেহারা বর্ষার কি হয় জানে।’
উনিশ শ’ একাত্তর নামে হুমায়ূন আহমেদ একটি ছোটগল্প লিখেছিলেন। গল্পের শুরুটা এরকমÑ
তারা এসে পড়ল সন্ধ্যার আগে আগে। বিরাট একটা দল। মার্চ টার্চ কিছু না। এলোমেলো ভাবে হেঁটে আসা। সম্ভবত বহুদূর থেকে আসছে। ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়ছে একেক জন। ঘামে মুখ ভেজা। ধুলি ধুসারিত খাকি পোশাক।
গ্রামের লোকজন প্রায় সবাই লুকিয়ে পড়ল। শুধু বদি পাগলা হাসি মুখে এগিয়ে গেল। মহানন্দে চেচিয়ে উঠলো, বিষয় কী গো?
পুরো দল থমকে দাঁড়াল মুহূর্তে। বদি পাগলার হাতে একটা লাল গামছা। সে গামছা নিশানের মতো উড়িয়ে চেঁচাল, কই যান গো আপনেরা? এমন অদ্ভুত ব্যাপার সে আগে দেখেনি।
মেজর সাহেবের চোখে সানগøাস। তিনি সানগøাস খুলে ফেলে ইংরেজিতে বললেন, লোকটা কি বলছে? রফিক উদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বলল, লোকটা মনে হচ্ছে পাগল। আমাদের সবগ্রামে একটা করে পাগল থাকে।
তাই নাকি?
জি স্যার।
বুঝলে কী করে এ পাগল?
রফিকউদ্দিন চুপ করে গেল। মেজর সাহেবের খুব পেঁচানো স্বভাব। একটি কথার দশটি অর্থ করেন। বদি পাগলাকে দেখা গেল ছুটতে ছুটতে আসছে। তার মুখ ভর্তি হাসি। রফিক ধমকে উঠল, ‘এ্যাই, কী চাস তুই?’ বদি পাগলার হাসি আরো বিস্তৃত হলো। রফিক কপালের ঘাম মুছল। সরুর গলায় বলল, ‘লোকটা স্যার পাগল। আমাদের সব গ্রামে একটা করে…।’
এই কথা তুমি আগে একবার বলেছ। একই কথা দু’তিনবার বলার প্রয়োজন নেই।
রফিক ঢোক গিলল। মেজর সাহেব ঠাÐা গলায় বললেন, ‘এ জায়গাটা আমার পছন্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করা যাক। সবাই টায়ার্ড।’
মাইল পাঁচেক গেলেই স্যার নবীনগর। খুব বড় বাজার, পুলিশ ফাঁড়ি আছে। সন্ধ্যা নামার আগে আগে স্যার নবীনগর চলে যাওয়া ভালো
কেন? তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
জি না স্যার, ভয় পাব কেন?
মেজর সাহেব দলটির দিকে তাকিয়ে কিছু-একটা বললেন। মৃদু সাড়া জাগল। নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ল সবাই। মাথা থেকে ভারী হ্যালমেট খুলে ফেলতে লাগল। মেজর সাহেব নিচু স্বরে বললেন, পাগলটাকে বেঁধে ফেলতে হবে। তিনি কাঠের একটি বাক্সের উপর বসে পাইপ ধরালেন। খাকি পোশাক পরা কারো মুখে পাইপ মানায় না। কিন্তু এই মেজর সাহেব অসম্ভব সুপুরুষ। তাঁর মুখে সবকিছুই মানায়।
পালগাটাকে আমগাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হলো। তার কোনো আপত্তি দেখা গেল না। বরং কাছাকাছি থাকতে পারার সৌভাগ্যে তাকে আনন্দিতই মনে হলো। কেউ তার দিকে তেমন নজর দিল না। এরা অসম্ভব ক্লান্ত। এদের দৃষ্টি নিরাসক্ত ও ভাবলেশহীন।
মেজর সাহেব পানির বোতল থেকে কয়েক চুমুক পানি খেলেন। বুটজুতা জোড়া খুলে ফেললেন। তাঁর বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ফোষ্কা পড়েছে। রফিক বলল, ‘ডাব খাবেন স্যার।’
মেজর সাহেব সে-কথার জবাব না দিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, আগে আমরা কোনো গ্রামে গেলেই ছোটখাট একটা দল পাকস্তানি পতাকা হাতে নিয়ে আসত। এখন আর আসে না। এর কারণ কি জান?
জানি না স্যার।
ভয়ে আসে না। এই গ্রামের সব ক’টি লোক এখন জঙ্গলে লুকিয়ে আছে। ঠিক না?
রফিক জবাব দিল না। বদি পাগলা বলল, একটু বোতলের পানি খাইতে মন চায়।
ও কী চায়?
ওয়াটার বটল থেকে পানি খেতে চায় স্যার।
গ্রামের সবাই পালিয়ে গেলেও আজিজ মাস্টার যেতে পারেনি। কারণ, সোনাপোতা থেকে তার ছোট বোন এসেছিল। আজ সকাল থেকেই তার প্রসবব্যথা শুরু হয়েছে। এ-রকম একজন মানুষকে নিয়ে টানাটানি করা যায় না। তবু আজিজ মাস্টার দু’বার বলল, ধরাধরি কইরা নাওডাত নিয়া তুলতে শ্যামগঞ্জ লইয়া যাওন যায়। তার জবাবে আজিজ মাস্টারের মা তার কাপুরুষতা নিয়ে কুৎসিত একটা গাল দিয়েছেন। পা ভাঙা বিড়ালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আজিজ মাস্টার প্রতিবাদ করেনি। কারণ, কথাটি সত্যি। সে বড়ই ভীতু। গ্রামে মিলিটারি ঢুকেছে শোনার পর থেকে তার ঘনঘন প্র¯্রাবের বেড় হচ্ছে। সে বসে আছে উঠোনে। এবং সামান্য শব্দেও দারুণভাবে চমকে উঠছে।
মাস্টার বাড়িত আছ?
কেডা?
আমরা। খবর হুনছ? বদি পাগলারে বাইন্ধা রাখছে আমগাছে।
হুনছি।
নীলগঞ্জের মুরব্বিদের কয়েক জন শঙ্কিত ভঙ্গিতে উঠে এল উঠোনে।
তোমার তো একটু যাওন লাগে মাস্টার।
কই যাওন লাগে?
দবীর মিয়া তার উত্তর না দিয়ে নিচু গলায় বলল, তুমি ছাড়া কে যাইব? তুমি ইংরেজি জান। শুদ্ধ ভাষা জান।
মিলিটারির কাছে যাইতে কেন?
হ।
আমি গিয়া কী করতাম?
গিয়া কইবা এই গেরামে কোনো অস্বিধা নাই। পাকিস্তানের নিশানটা হাতে লইয়া যাইবা। ভয়ের কিছু নাই।
মাস্টার অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। দবীর মিয়া বিরক্ত হয়ে বলল, কথা কওনা যে?
আমি যাই ক্যামনে? বাড়িত অত বড় বিপদ। পুতির বাচ্চা অইব।
তোমার তো কিছু করণের নাই মাস্টার। তুমি ডাক্তারও না, কবিরাজও না।
মাস্টার ক্ষীণস্বরে বলল, পাকিস্তানের পতাকা পাইয়াম কই?
ক্যান ইস্কুলের পতাকা কী করলা?
ফালাইয়া দিছি।
ফালাইয়া দিছ? ক্যান?
মাস্টার জবাব দেয় না। দবীর মিয়া রাগী গলায় বলে, আই.এ.পাশ করলে কি হইব মাস্টার, তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি অয় নাই। পতাকাটি তুমি ফালাইয়া দিলা কোন আক্কেলে? অখন কি আর করবা। যাও খালি হাতে।
আমার ডর লাগে চাচাজী।
ডরের কিছু নাই। এরা বাঘও না, ভাল্লুকও না। তুমি গিয়া খাতির-যতœ কইরা দুইটা কথা কইবা। এক মিনিটের মামলা। কি কও আসমত?
নেয়্য কথা।
দেরি কইরো না। আন্ধাইর হওনের আগেই যাও।
একলা?
একলা যাওনই বালা। একলাই যাও। তিনবার কুলহু আল্লাহ কইরা ডাইন পাওডা আগে ফেলবা। পাঁচবার মনে-মনে কইবা, ইয়া মুকাদ্দেমু। ভয়-ডরের কিছুই নাই মাস্টার। আল্লাহর পাক কালাম। এর মরতবাই অন্য রকম।
আজিজ মাস্টার মাথা নিচু করে বসে রইল। তার আবার প্রসাবের বেগ হয়েছে। ঘরের ভেতর থেকে পুতি কুঁ কুঁ করছে। প্রথম পোয়াতি। খুব ভোগাবে।
ভইনটারে এমনু অবস্থায় ফালাইয়া ক্যামনে যাই?
এইটা কী কথা! তুমি ঘরে থাক্যা করবাটা কী? বেকুবের মতো কথা কও খালি। উঠ দেহি।
আজিজ মাস্টার উঠল।

একটি মুখের হাসির জন্য’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি সময়ের একটি গল্প লিখেছেন ইমদাদুল হক মিলন। গল্পের শুরু এরকমÑ
আপনে আসছেন কই থিকা?
বারবাড়ির সামনে দুটো জামগাছ। জামগাছের গা ঘেঁষে পাটখড়ির বেড়া। বারবাড়ির সঙ্গে ভেতর বাড়ি আলাদা করার জন্য এই ব্যবস্থা।
শিরিন দাঁড়িয়ে আছে বেড়ার সামনে। অচেনা মানুষের গলা শুনে মাথায় ঘোমটা দিয়েছিল। এখন একপলক মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে অকারণেই ঘোমটা আরেকটু টেনেটুনে ঠিক করল।
সকাল দশটা এগারোটার রোদ বেশ ভালোই তেজালো হয়েছে। জামগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়েও গরম খুব একটা কম লাগছিল না ইউসুফের। কিন্তু গরমের তোয়াক্কা করল না সে। হাসিমুখে বলল, আমি এসেছি ঢাকা থেকে।
চান কারে?
এটা নাসিরের বাড়ি না? মুক্তিযোদ্ধা নাসির হোসেন? স্বাধীনতার পর পর শুনেছিলাম এলাকার সবাই তাকে নাসির কমান্ডার নামে চেনে। যদিও সে কমান্ডার ছিল না। ছিল সাধারণ একজন মুক্তিযোদ্ধা।
ইউসুফের কথা শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল শিরিন। কোনও রকমে বলল, আপনে এত কথা জানলেন কেমনে?
আমরা একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। মানে সহযোদ্ধা ছিলাম। যদিও নাসির বয়সে আমার চে’ ছোট। মুক্তিযুদ্ধের সময় একুশ বাইশ বছর বয়স ছিল। দুর্দান্ত সাহসী, টগবগে দূধর্ষ ধরনের তরুণ। মৃত্যুভয় কাকে বলে জানত না। গোয়ালিমান্দ্রার অপারেশানে দারুণ সাহস দেখিয়েছিল নাসির। যে কোনও অপারেশানে যেতে একপায়ে খাড়া। নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে দুতিনবার। লোকে নাসিরকে কমান্ডার বলত, আসলে কমান্ডার ছিলাম আমি। আমার নাম ইউসুফ, ইউসুফ মির্জা।
নামটা শুনে আপাদমস্তক কেঁপে উঠল শিরিন, দিশেহারা হলো। কন কী? আপনে ইউসুফ ভাই? আপনের কথা কত শুনছি তার কাছে। আসেন ভিতরে আসেন।
শিরিনের পিছু পিছু ভেতর বাড়িতে ঢুকল ইউসুফ।
বাড়িটি অতি দীনদরিদ্র ধরনের। দোচালা জীর্ণ একখানা টিনের ঘর, রান্নাচালা আর একচিলতে উঠোন। উঠোনের একপাশে ভাঙাচোরা হাঁসমুরগির খোঁয়াড়ের লাগোয়া পাতিলেবুর ঝাড়। রান্নাচালার ওদিকটায় লাউ কুমড়ো শসা ঝিঙের মাচান। দোচালা ঘরটার পেছনে দুতিনটে আম আর একটা তেঁতুল গাছ। গাছগুলো জড়াজড়ি করে আছে বলে বাড়িটা বেশ ছায়াময়। উঠোনের একটা দিকে শুধু রোদ পড়েছে। সেই রোদে তারে শুকাতে দেয়া হয়েছে বারো তেরো বছর বয়সী একটি মেয়ের ছিটকাপড়ের জামা। কয়েকটা হাঁস মুরগি চড়ছে ওদিকপানে।
বাড়ি দেখে মনটা খারাপ হল ইউসুফের।
মা’ নামে আনিসুল হকের একটি উপন্যাস আছে। ছেলে ভাত খাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। মা ভাত নিয়ে বসে থাকে ছেলের জন্য। কিন্তু ছেলে তো আর ফিরে আসে না। আসবে কি করে? ছেলে তো দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে গেছে। সেই মা জীবনে আর কোনো দিন ভাত খাননি।
আনিসুল হকের এই উপন্যাসটি পৃথিবীর একাধিক ভাষায় অনুদিত হয়েছে। বাংলায় এর মুদ্রণ হয়েছে ৮০ বার।
অনেকেই বলেন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাহিত্যে খুব একটা কাজ হয়নি। তারা ভুল বলেন। না বুঝে, না পড়ে একটা গৎবাধা কথা বলেন অনেকে। আসল কথা হলো মুক্তিযুদ্ধের গল্প, কবিতা, উপন্যাসের প্রতি আমাদের আগ্রহ ও যতেœর পরিবেশটা কতটা স্বচ্ছ? কতটা আন্তরিক? যদি প্রশ্ন করি, আপনার বাসায় বইয়ের আলমারী আছে কী? ধরে নিলাম সবার বাসায়ই বইয়ের আলমারী আছে। ওই আলমারীতে মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা কয়টি বই আছে? এই যে বইমেলা চলে গেল কয়জন বইমেলা থেকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা গল্প, কবিতা ও উপন্যাসের বই কিনেছেন? আমরা অনেকেই খোজ খবর না রেখেই মন্তব্য কবে বসি-আমাদের কিছুই ভালো না।
যেমন ধরা যাক, প্রতি বছরই ডিসেম্বর ও মার্চ মাসে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক টেলিফিল্ম প্রচার করা হয়। প্রায়শই দেখা যায় অধিকাংশ নাটক টেলিফিল্মে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালকে তুলে ধরা আপ্রাণ চেষ্টা থাকলেও তা দর্শককে টানে না। এর একটাই কারণ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালকে বিশ্বস্ততার সাথে উপস্থাপন করতে না পারা। অথচ নাটক, টেলিফিল্ম নির্মাণ ভাবনায় আমরা যদি আমাদের কবি সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মকে গুরুত্ব দেই তাহলে একটা পরিবর্তন আসবে আশাকরি।
ধরা যাক, আগামী ডিসেম্বরে দেশের প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল একটা যৌথ সিদ্ধান্ত নিল যে, প্রতিটি নাটক ও টেলিফিল্ম’এর কাহিনী নেওয়া হবে দেশের কবি সাহিত্যিকদের প্রকাশিত গল্প ও উপন্যাস থেকে। তাহলে লাভ হবে দুটো। এক. আমাদের সাহিত্যের প্রতি পাঠকের আগ্রহ বাড়বে। দুই. নাটক, টেলিফিল্মে একটা পরিবর্তন আসবে।
আশাকরি সকলে বিষয়টি ভেবে দেখবেন।