Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্য চর্চায় সবুজ স্থপতি তাসনীম তারিক

তাসনীম তারিক। বাংলাদেশের স্বনামধন্য একজন স্থপতি। স্থাপত্যচর্চায় শুরু থেকেই ‘পরিবেশ ও মানুষ’ নিয়ে গবেষণাধর্মী ডিজাইনকার্যে নিয়োজিত আছেন। ইতোমধ্যে তিনি হয়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিলের (টঝএইঈ) এর খঊঊউ (লীডারসিপ ইন এনার্জি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন) অ্যাকরিডিটেড প্রফেশনাল হিসেবে বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য চর্চার একজন অন্যতম কান্ডারী। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত আছেন। তিনি যুগপৎভাবে এই ‘সবুজ স্থাপত্য’ বিষয়ে গবেষণা করছেন এবং সেই সকল ‘সবুজ নীতি’ গুলোকে বিভিন্ন প্রজেক্টে অনুসরণ করে নির্মাণ করে চলেছেন বাংলাদেশের স্থাপত্য ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। এবার শাহ্ সিমেন্ট সুইট হোমে তাকে নিয়েই প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

তাসনীম তারিকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাবা খন্দকার তারিকুল ইসলাম পেশায় একজন তড়িৎ প্রকৌশলী (বুয়েট ’৭৫ ব্যাচ)। মা ফজিলাতুন নেসা মেরীন একজন শিক্ষিকা। বড় ভাই খন্দকার মোস্তফা তারিক তানিম গ্রামীণফোনের একজন কর্মকর্তা। তাসনীম তারিকের জীবনসঙ্গী স্থপতি সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশল বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে।
ছোটবেলা থেকেই স্থপতি তাসনীম তারিক ছিলেন তুখোড় ও মেধাবী শিক্ষার্থী। স্কুল জীবনে তিনি সর্বদা প্রথম/দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের সাথে জড়িত ছিলেন। ছবি আঁকা, গান, কবিতা, আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, বির্তক প্রতিযোগিতা, অভিনয় সহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে তিনি জিপিএ ৫ ফাইভ পেয়ে এসএসসি পাস করেন ২০০১ সালে। ওই বছরে সমগ্র বাংলাদেশের মাত্র ৭৬ জন এত ভাল ফলাফল অর্জনে সক্ষম হন, যার জন্য পরবর্তীতে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভ‚ষিত হয়েছেন। ২০০৩ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষে অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে অর্জন করেছেন বিভিন্ন স্কলারসিপ ও সম্মাননা। ২০১০ সালে তিনি কৃত্বিতের সাথে ‘ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার’ ডিগ্রি লাভ করেন। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে উক্ত বছরই প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। তখন থেকেই গভীর অধ্যবসায়ের সাথে স্থাপত্য বিভাগে অধ্যাপনা করে চলেছেন তাসনীম তারিক। শিক্ষকতার পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশবান্ধব ও মানব উপযোগী স্থাপত্যনীতি বিষয়ে গবেষণা কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
২০১৩ সালে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস রুমের অভ্যন্তরে পরিবেশগত অবস্থা (বাতাসের তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ ইত্যাদি) এবং এই সকল বিষয়ের সাথে ছাত্রদের মেধা মননের বিকাশের কি রূপ সম্পর্ক রয়েছে এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা চালান। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হতে সর্বোচ্চ সিজিপিএ অধিকার করে সম্পন্ন করেছেন ‘মাস্টার অব আর্কিটেকচার’, অর্জন করেছেন আহসানুর রহমান স্বর্ণপদক এবং ভ্রæম্যান স্কলারসিপ। পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান ও তার ব্যবহার (যেমনÑ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ নীতি, ব্যবহৃত পানি পুণরায় ব্যবহারনীতি, শহরের পার্ক উদ্যান সমূহের সংস্কারনীতি, পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্য, দিনের আলোক সর্বোচ্চ ব্যবহার নীতি, গৃহের অভ্যন্তরভাগের পরিবেশ) ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর লেখা গবেষণাপত্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত ও সমাদৃত হয়েছে। তাসনীম বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যেমন: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) হেড অফিসের প্রস্তাবিত ৩২ তলা গ্রীন বিল্ডিং প্রকল্প, মিরপুরে টাউনশিপ ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প, ঢাকা ও রংপুর চিড়িয়াখানার আধুনিকায়ন প্রকল্প, সোনালী ব্যাংকের ডিজাইন প্রকল্প, সবুজ ফ্যাক্টরি প্রকল্প, বাংলাদেশের গামেন্টস্ ফ্যাক্টরি সমূহের অগ্নি ও ইলেকট্রিক্যাল সেফটি অ্যাসেসমেন্ট সহ বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে ডিজাইন টিম মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
‘সবুজ নীতি’ ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রজেক্ট তৈরি করে বাংলাদেশের স্থাপত্য চর্চার উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেন তাসনীম। তিনি বলেন, এনার্জি এবং এনভায়রনমেন্ট (শক্তি ও পরিবেশ) স্থাপত্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আলো, বাতাস, বৃষ্টির পানি ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তিকে আমাদের স্থাপত্যের সাথে একসূত্রে বেঁধে ফেলতে হবে। আজকের এই জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে কেবলমাত্র দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য চর্চা নীতি হতে বেরিয়ে এসে আরম্ভ করতে হবে ‘পরিবেশ বান্ধব, মানববান্ধব ও দৃষ্টি নন্দন’ স্থাপত্য চর্চা।

এ সময় তিনি রিনিউবেল এনার্জি এবং সাইটেইনেবল আর্কিটেকচারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। এ সকল নীতির উপর ভিত্তি করে ইতিমধ্যে তিনি ও তাঁর দল জিতেছেন বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্থাপত্য প্রতিযোগিতা। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট আয়োজিত জাতীয় ডিজাইন প্রতিযোগিতায় রাজউক এর প্রধান কার্যালয়ের ‘গ্রীন বিল্ডিং ডিজাইন’ এ প্রথম স্থান অধিকার করেন। অপর এক জাতীয় ডিজাইন প্রতিযোগিতায় ন্যাশনাল হাউজিং অথোরিটি (ঘঐঅ) এর প্রধান কার্যালয় ডিজাইনে তৃতীয় স্থান স্থান অর্জন করেন।
বর্তমানে তিনি সবুজ স্থাপত্য চর্চা ও লীড সার্টিফিকেশনের কাজে (খঊঊউ ঈবৎঃরভরপধঃরড়হ) নিয়োজিত আছেন। তাসনীম তারিক বলেন, একটি স্থাপনা কতখানি পরিবেশ উপযোগী, তা পরিমাপ করবার জন্য সারাবিশ্বে সর্বাধিক ব্যবহৃত রেটিং সিস্টেম হল লীড (খঊঊউ), যা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিল (টঝএইঈ) হতে অনুমোদিত। এই সিস্টেমের আওতায় আটটি মূল বিষয়ের অধীনে স্থাপত্যের পরিবেশ উপযোগিতা যাচাই করা হয়। বিষয় গুলো হলোÑ
১. প্রজেক্টের অবস্থান এবং যাতায়াত ব্যবস্থা। ২. সাসটেইনেবল সাইট। ৩. পানির ব্যবহার নীতি। ৪. শক্তি ও পরিবেশনীতি। ৫. পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার। ৬. অভ্যন্তর ভাগের পরিবেশগত অবস্থা যাচাই। ৭. নতুন কিছু করবার প্রয়াস। ৮. দেশীয় উপকরণ ও নীতির ব্যবহার।
প্রত্যেকটি বিষয়ে অত্যন্ত সুচারুরূপে তথ্য সংরক্ষণ ও প্রদানের মাধ্যমে স্থাপনাটির ‘সবুজ সনদপত্র’ ইউ.এস. গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিল হতে প্রাপ্ত হয়। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ স্থাপনাই প্রকৃত অর্থে ‘সবুজ’। কারণ তাতে কোনো অপচয় নেই, নেই কোনো পরিবেশগত হুমকি। সে জন্য ‘সবুজ’ হতে হলে যে সার্টিফিকেশন লাগবেই তা নয়। কিন্তু এই ‘সবুজ নিয়ম’ কানুন গুলো মেনে চললে যে কোনো স্থাপনাকেই অনেক বেশি স্বনির্ভর ও সাশ্রয়ী করে তোলা সম্ভব। তিনি নিয়মিত বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে খঊঊউ বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষকে করে চলেছেন আলোকিত। স্থাপত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি অসাধারণ অ্যাকরেলিক পেইন্টিং এবং ফটোগ্রাফি করে থাকেন। ভালোবাসেন দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতে। যুক্তরাজ্য, কোরিয়া ও ইউরোপসহ বিশ্বের ২৬টি দেশে ভ্রমণ করেছেন। তিনি মনে করেন, বিশ্বের বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনা পরিদর্শন তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে বিকশিত হতে সাহায্য করে সবসময়।
তাসনীম স্বপ্ন দেখেন সবুজ দিনের, যখন প্রতিটা স্থাপনা হয়ে উঠবে পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল ও স্বনির্ভর। এমনিভাবেই স্থাপত্যের ‘সবুজ চর্চা’য় মনোনিবেশ করে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে চলেছেন ‘সবুজ স্থপতি’ তাসনীম তারিক।