Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

শুরুর দিকে আমার লেখা কেউ বুঝতে পারত না-শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

ঢাকা লিট ফেস্টে কলকাতা থেকে অতিথি হয়ে এসেছিলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। লিট ফেস্টের একটি বিশেষ অধিবেশনে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন-এর সাথে এক আলাপচারিতায় বলেছেন নিজের লেখালেখি সহ অন্যান্য প্রসঙ্গে অনেক কথা। তারই চুম্বক অংশ আনন্দ আলোর পাঠকদের জন্য।
আমার লেখার কোনো ছক নেই, পরিকল্পনা নেই। আমার লেখার ধরন অদ্ভুত। লিখতে বসার আগ পর্যন্ত জানি না কী লিখব। একটা মনে ধরার মতো লাইনের জন্য অপেক্ষা করি। যদি ওই বাক্যটি পছন্দ হয় লিখতে শুরু করি। এমনও হয়েছে বাক্যে একটি শব্দ খুঁজতে গিয়ে ১২/১৩ দিন লিখতে পারিনি। আবার কোনো কোনো দিন ১২/১৩ ঘণ্টা টানা লিখে গেছি। আমার লেখার ধরন অনেকটা তুলোর গুটি থেকে সুতো পাকানোর মতো। ধীরে ধীরে একেকটি চরিত্র দেখতে পাই। তাদের মুখ, শরীর কাঠামো, পোশাক ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তাদের জীবনযাত্রা, কথা দেখতে পাই। তখন আমার গল্প, উপন্যাস যেন হয়ে ওঠে একটি প্রতিবেদন লেখার মতো। তবে এভাবে লেখা প্রত্যাশিত নয়। আমার লেখার ধরনটা বৈজ্ঞানিকও নয়। কিন্তু আমি নিরুপায়। বাংলাদেশের পাঠকদের উদ্দেশে এভাবেই বললেন দুই বাংলার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
ঢাকা লিট ফেস্টে কলকাতা থেকে এসেছিলেন ৮৩ বছর বয়সের প্রবীণ কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক অধিবেশনে শিল্প, সাহিত্য, নিজের লেখালেখিসহ নানা প্রসঙ্গে আলোচনা করেন তিনি। তাঁর কথা শুনতে জড়ো হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। গোটা মিলনায়তন ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। লিট ফেস্টের শেষ দিনে শেষ সেশনে ছিল ‘শীর্ষেন্দুর সঙ্গে কথোপকথন’ শীর্ষক এই বিশেষ আয়োজন। সঞ্চালক ছিলেন দেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন।
শীর্ষেন্দু বলেন, ‘মানুষের জীবনের চলার পথে কিছু গর্ত থাকে যা এড়ানো যায় না। মানুষ ভেতরে ভেতরে নিষ্ঠুর, কখনো কখনো খুব দয়ালু হয়ে ওঠে। মনের সঙ্গে এই খেলা চলে যাকে আমরা বুঝতে পারি না। মনের মধ্যে এমন ভাবনা আসে, যা প্রকাশ করা যায় না; যাকে আমরা বোতলবন্দি করে রাখি। কিন্তু মনের মধ্যে সেটা থেকে যায়। আমি এই বিচিত্র জীবনকে দেখি। জীবন কত ভাবেই না প্রকাশিত হচ্ছে। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষ দেখি।’
নিজের লেখা প্রসঙ্গে শীর্ষেন্দু বলেন, “যখন লেখালেখি শুরু করি তখন আমার লেখা কেউ বুঝতে পারত না। সে জন্য আমি জনপ্রিয় লেখক হতে পারিনি। আমার মধ্যে ভয় কাজ করত লেখা যদি কেউ বুঝতে না পারে, তাহলে আমার পত্রিকা থেকে চাকরিটা না চলে যায়! আমার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’ পড়ে কেউ কেউ বলেছিলেন, ওর লেখা পড় না, মন খারাপ হয়ে যায়। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম তা শুনে। কিন্তু লিখতেই সব সময় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম।”
Shirshando-mokhopaddoyপ্রসঙ্গ ক্রমে শীর্ষেন্দু বলেন, একটি গল্পে মেশিনে পয়সা ঢোকানো আর কার্ড বেরিয়ে আসার বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে আমার তা পছন্দ হচ্ছিল না। পরে তা ৫০ বার লিখেছি। এই গল্পটি লিখতে আমার পৌনে দুই বছর সময় লাগে। এই গল্পটি যখন ছাপা হয় তখন তা খুব একটা আলোচনায় আসেনি। কিন্তু এতে আমার কিছু যায় আসে না। কেননা, আমি তো নিজের জন্যই লিখি।’ তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় একটা চেতন অবচেতনে বিরাজ করি। অনেক সময় মনেও থাকে না আমি লেখক। অদ্ভুত ধরনের এক অন্যমনষ্কতা কাজ করে। রাস্তাঘাটে আমি খুবই অনিরাপদভাবে চলাচল করি। একজন ব্যক্তি জীবনযাপনে অনেক টুকরোতে বিভক্ত হয়ে জীবন যাপন করে। স্ত্রীর স্বামী, সন্তানের বাবা। আমিও তাই।’
আলোচনায় উঠে আসে শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাস প্রসঙ্গ। এ নিয়ে শীর্ষেন্দু বলেন, দেবদাস উপন্যাসে লজিকের খুব অভাব। শরৎচন্দ্র অল্প বয়সে লিখেছিলেন। ওই বয়সে বুদ্ধি পাকে না। সে জন্য লেখায় গ্যাপ রয়েছে। কিন্তু স্টোরি টেলিংয়ে শরৎচন্দ্রের মতো ম্যাজিশিয়ান বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি নেই। তার একটা উপন্যাস এ অঞ্চলের মানুষ ১০০ বছর ধরে পড়ছে। তাঁর কষ্টে চোখের জল ফেলছে। এটা অনেক বড় ঘটনা।
আলাপকারিতা চলছিল। অধীর আগ্রহে অপেক্ষামান ছিল কয়েক শত দর্শক। মিলনায়তনের আসন সীমিত থাকায় অনেকেই মেঝেতে বসেই উপভোগ করছিলেন শীর্ষেন্দুর আলাপচারিতা। লেখকের বেশিরভাগ কথাতেই ছিল হাস্যরস, যা দর্শককে করেছে প্রাণবন্ত ও হাস্যজ্জ্বল। দর্শকদের ঘন ঘন করতালি প্রকাশ করছিল কতটা উপভোগ্য ছিল সেই সেশন। নিজের জীবনের বিভিন্ন লেখা নিয়ে কথা বলেন তিনি। এছাড়া অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দেন। তার এই উত্তরের মধ্যেও ছিল রসিকতা এবং হাস্যরস।
একজন দর্শক যিনি বিদেশে একটি মিশনে কাজ করেছেন, তিনি বলেন বিদেশে দেবদাসের নাম নিলে সবাই শাহরুখ খানকে চেনে। যখন তিনি একজনের কাছে জানতে চাইলেন দেবদাস কে লিখেছে? তারা কেউ উত্তর দিতে পারেনি। এখানে দেবদাসের কোনও সংকীর্ণতা কিংবা শরৎচন্দ্রের কোনও দায় আছে? বা আপনি সেখানে থাকলে কেমন লাগতো? জবাবে শীর্ষেন্দু বলেন, ‘লেখককে মনে রাখতে না পারলেও, লেখাটিকে মনে রেখেছে এটাও কম কথা নয়।’
আরেক দর্শক জিজ্ঞেস করলেন, শীর্ষেন্দুর লেখা ‘ঔষধ’ এবং শেক্সপিয়ারের ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ এই দুটি লেখার ব্যাপারে। এই নারীবাদী সমাজে ঔষধ লেখার পর প্রতিক্রিয়াটাই বা কেমন ছিল? জবাবে শীর্ষেন্দু বলেন, ‘এটা তো খুব নারীবিরোধী লেখা বলে তারা মনে করে! আমাকে প্রায় পেটানোর আয়োজন করেছিল। আমি ক্ষমা চেয়েছি, আসলে এই ওষুধটাকে সত্যিকারের ওষুধ বলবো না। আসলে আমি স্বামী স্ত্রীর মিলনটা দেখাতে চেয়েছিলাম। সেটা করতে গিয়ে আমাকে একটু বাঁকাপথ অবলম্বন করতে হয়েছিল। মেয়েরা আমাকে যথেষ্ট অপমান করেছে। আমার বিরুদ্ধে মিছিল করার কথা ছিল কিন্তু শেষ অবধি আর করেনি। আমাকে থ্রেট করেছে, আমি ঠিক হয়ে গেছি। এখন আর ওরকম কিছু লেখি না। সেই থেকে আমি ভালো ছেলে হয়ে গেছি!’
আরেক দর্শকের প্রশ্ন আমরা বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের এত গুরুত্ব দিচ্ছি, কিন্তু সেখানে আমাদের লেখকদের কোনও গুরুত্ব নেই কেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা একটা ফ্যাক্ট। কিন্তু মিলনের লেখা কিন্তু গুরুত্ব পায়। পাঠক যে লেখা পড়ছে না এমনটি নয়। অনেকেই বসে থাকে, লেখা চলে না। এই জিনিস কিন্তু আমরা সেখানেও দেখতে পাই। পাঠক কমছে, কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে, সব জায়গায় নয়। কাজেই এটা নিয়ে দুঃখ করার চেয়ে আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশের সব লেখকই ধীরে ধীরে সম্মানিত হবে। ইউটিউবে সুন্দর সুন্দর বাংলাদেশি নাটক আছে। এখানকার টিভি চ্যানেল ওখানে দেখানো হয় না। পশ্চিমবঙ্গের ছেলেমেয়ে দেখতে পারে না। আমি কিন্তু ইউটিউবে বাংলাদেশের নাটক দেখি।
নাটকের গল্পগুলো খুব চমৎকার এবং মিষ্টি। আমার নিজেরও রোমান্টিক মিষ্টি গল্প পছন্দ। কাজেই এগুলো আস্তে আস্তে আদান প্রদানের মাধ্যমে হবে। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। সাংস্কৃতিক জিনিস জোর করে চাপানো যায় না। ভালো কাজ করতে করতে সেই কাজ গৃহীত হবে। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’