Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

শোকের এপিটাফ

কবির বকুল

১৮ অক্টোবরের সকালটা কি জানত আজ সারা দেশে নামবে শোকের ছায়া। অফিসে যাওয়ার পথে মুঠোফোনে আসবে ‘আইয়ব বাচ্চু নেই’ এই আকষ্মিক খবরটি। দু’কানে অবিশ্বাস। সবকিছু যেন নিমেষেই থমকে গেল। অফিসের পথ ঘুরিয়ে চলে যাই স্কয়ার হাসপাতালের বহিঃবিভাগে। সেখানে যেতেই ডঃ মির্জার সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, হ্যাঁ আইয়ব বাচ্চু নেই। বহিঃবিভাগের ভেতরে কোনার শেষ বেডে শুয়ে সাদা চাদরে মোড়ানো তাঁর নিথর দেহ। শুধু মুখটা খোলা। আহ, কি স্নিগ্ধ, নিম্পাপ ওই মুখ। গভীর ঘুমে ডুবে আছেন। সেই মায়ামুখে হাতের আঙুল বুলিয়ে দিতেই চোখ ভেঙে নেমে এলো অশ্রæ। ‘আরও বেশি কাঁদালে উড়াল দেব আকাশে’। সত্যিই তিনি উড়াল দিয়েছেন? এতো দ্রæত? কেন? এই প্রসঙ্গে পরে যাই। আগে যে কথাটা বলা জরুরি, সেটা বলি।
গীতিকবি হিসেবে আমার ভিত্তি প্রস্তর নির্মাণ হয়েছিল বাচ্চু ভাইয়ের গাওয়া গান দিয়েই। আমার লেখা প্রথম গানটি তিনিই গেয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালের কথা। তপন চৌধুরীর মাধ্যমে ‘কাল সারা রাত তোমারই কাঁকন যেন কানে কানে রিনিঝিনি বেজেছে, আমাকে ডেকে ডেকে রাত্রির নিশীথে ভালোবাসার আবীরে মেখেছে’ এই গানটি তাঁর হাতে যায়। সেই গীতিকবিতাটি সুরে প্রাণ পেয়ে বাচ্চু ভাইয়ের কণ্ঠে শ্রোতার কাছে আসে ‘ময়না’ অ্যালবামের মাধ্যমে ১৯৮৮ সালে। কিন্তু তখনও বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। পরিচয়টা হয় কাকরাইল ‘সারগাম’ রেকর্ডিং স্টুডিওতে; ওই বছরই। প্রথম পরিচয়েই স্নেহের চাদরে জড়িয়ে নেন তিনি। তার পর কত গান। কত স্মৃতি। আমার লেখা ২০/২২টি গান (তাঁর এবং অন্যের সুরে) তিনি গেয়েছেন। এর মধ্যে মিশ্র অ্যালবাম, এলআরবির অ্যালবাম এবং চলচ্চিত্রের গানও রয়েছে। অন্য শিল্পীর জন্যেও আমার লেখা কিছু গান সুর করেছেন তিনি। প্রথম গানটির পর বাচ্চু ভাইয়ের সুরে দ্বিতীয় গানটি আমি লিখি সুরের ওপর। নতুন অভিজ্ঞতা। তিনি তখন থাকেন মালিবাগ। যার জন্য গানটি করেছিলেন সেই শিল্পীও আজ প্রয়াত। চট্টগ্রামের নওশাদ বাবু। এই গানটি ছিল ‘কিছু কিছু কথা আছে অগোচরে থাকে মনে’। তবে বাচ্চু ভাইয়ের গাওয়া আমার লেখা যে গানগুলো শ্রোতাপ্রিয়, এর বেশির ভাগই চলচ্চিত্রের গান। এর মধ্যে শ্রদ্ধেয় আলাউদ্দিন আলীর সুরে ‘সাগরিকা’ ছবির ‘আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে আমি ছুঁয়েছি তোমায়’, ‘মিস ডায়না ছবির ‘যদি থেমে যায় পৃথিবীর সব কোলাহল’, শওকত আলী ইমনের সুরে ‘কালো চশমা’ দুটো গান ‘আমি দিওয়ানা দিওয়ানা’, ‘জন্ম জন্মান্তরে থাকবে এই অন্তরে’ এবং ‘মগের মুল্লুক’ ছবির ‘কি দারুণ দেখতে’ উল্লেখযোগ্য। মিশ্র অ্যালবামে প্রিন্স মাহমুদের সুরে ‘বাড়ালে হাত বন্ধু সবাই হয় না’ এবং প্রয়াত প্রণব ঘোষের সুরে ‘নিরব চিঠি’ গান দুটোও বহুল শ্রæত।
এই গানগুলো সৃস্টির পেছনের গল্প শুনলে বোঝা যেত বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কেমন ছিল। কিন্তু এই ছোট্ট লেখায় তা বলে শেষ করা যাবে না। বরং ফিরে যাই ১৮ অক্টোবরে। মৃত্যু সংবাদ শুনে হাসপাতালটা সকাল ১১টার মধ্যেই হয়ে গেল জনারণ্য। একটা মানুষ চলে গেলে তারপর উপলব্ধি হয়, মানুষ তাকে কতটা ভালোবাসতেন। বাচ্চু ভাইয়ের বেলায়ও তাই ঘটলো। এক নজর তাঁকে দেখার জন্য মিছিল নেমেছিল ঢাকা এবং চট্টগ্রামে। বাচ্চু ভাই যেন ছিলেন গানের রাজ্যের রাজা। রাজার মতোই চলে গেছেন। ১৬ অক্টোবর তিনি রংপুরে গান করেছেন। গিটারের মুর্চ্ছনায় মোহিত করেছেন হাজার হাজার দর্শক শ্রোতাদের। তাঁর একদিন পর চলে গেছেন কাউকে কিছু না বলে।
তবে ১৮ অক্টোবর থেকে গত সাতটা দিন আমার গেছে নিদ্রাবিহীন। বাচ্চু ভাই নেই! নেই! হিসেব মেলাতে পারিনি তবুও। ইঙ্গিতটা তিনি গানে গানে আগেই দিয়ে রেখেছিলেন কি? নাহলে কেন গাইবেন ‘এই রূপালি গিটার ফেলে, একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে’। দুঃখ বিলাসিতায় ভরা তাঁর সব গান। ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো, অনেক কথায় মুখর আমায় দেখো, দেখো না কেউ হাসি শেষে নিরবতা’, সুখেরই পৃথিবী, সুখের অভিনয়, যতোই আড়ালে রাখো, আসলে কেউ সুখী নয়’ সেই তুমি কেন এতো অচেনা হলে, এই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম’, আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি, তাই তোমার কাছে ছুটে আসি, ফেরারী এ মনটা আমার মানে না কোনো বাঁধা’। এমনসব হৃদয় নিঙড়ানো বেদনাভরা আর্তি ছিল তাঁর গানে। সব ফেলে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে তিনি চলে গেলেন। মৃত্যু এমনই। না বলে আসে, নিয়ে যায় ছিনিয়ে প্রিয়জনকে। আমাদের প্রিয় বাচ্চু ভাই, মৃত্যু তাকেও ছোবল মেরে নিয়ে গেছে হঠাৎ। বাচ্চু ভাই আপনি যেখানেই থাকুন শান্তিতে থাকুন।