Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

স্থপতি এবং স্থাপত্য গড়ার কারিগর সেলিনা আফরোজা

সেলিনা আফরোজা লুলু। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য স্থপতি, হাউজিং বিশেষজ্ঞ এবং এডুকেটর। দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে বাংলাদেশের স্থাপত্য অঙ্গনে দৃপ্ত পদচারনা তার। আন্তরিক সদিচ্ছা, দৃঢ় মনোবল ও উৎসাহ এবং কঠোর পরিশ্রম তাকে আজকের অবস্থানে এনেছে। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছরে তিনি যোগ দেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের স্থাপত্য অধিদপ্তরে সহকারি স্থপতি হিসেবে। দীর্ঘ ৩১ বছর স্থাপত্য অধিদপ্তরের কর্মে নিয়োজিত থেকে ২০১১ সালে অতিরিক্ত প্রধান স্থপতি হিসেবে অবসর নেন। চাকরী জীবনে অনেক সরকারি ভবনের নকশা করেছেন তিনি। ২০১৩ সালে সেলিনা আফরোজা লুলু শান্ত মারিয়াম ইউনির্ভাসিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আর্কি টাইপ লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান। স্থাপত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি উইমেন আর্কিটেকটস ইঞ্জিনিয়ার্স প্লানার্স অ্যাসোসিয়েশন (ওয়েপা) বাংলাদেশ এর সভাপতির দায়িত্বে আছেন। তিনি বাংলাদেশ স্থাপত্য ইনস্টিটিউটের ফেলো মেম্বার। এবার শাহ সিমেন্ট সুইট হোমে তাকে নিয়েই প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

‘প্রাকৃতিক অফুরন্ত আলো, বাতাস, সূর্য্যরশ্মী, পানি, সবুজ গাছপালা সহ প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে দেশজ নির্মাণ সামগ্রী এবং টেকনোলজির সমন্বয়ে ব্যবহার বান্ধব এবং পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্যের ডিজাইন করাই আমার মূল লক্ষ্য’Ñ কথাগুলো বললেন বিশিষ্ট স্থপতি সেলিনা আফরোজা লুলু। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। তার বাবার নাম মরহুম মো: আমীর আলী মিঞা। তিনি সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মা মরহুম বেগম সুফিয়া আশারী একজন গৃহিনী। স্কুল জীবন থেকেই সেলিনা সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছবি আঁকা, নাচ-গান, আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা সব মাধ্যমেই পারদর্শী ছিলেন। এসব গুণাবলী কাজে লাগানোর জন্যই স্থাপত্যে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ জন্মায় তার। বাবা-মার উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণায় আজ তিনি হয়েছেন দেশের সফল একজন স্থপতি। যশোর শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৭০ সালে। ১৯৭৩ সালে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন ইডেন গার্লস কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। ১৯৮০ সালে তিনি ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করে বের হওয়ার পর পরই সেলিনা আফরোজা যোগ দেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের স্থাপত্য অধিদপ্তরে সহকারী স্থপতি হিসেবে। এরপর তিনি স্কলারশীপ নিয়ে ইংল্যান্ডে পড়তে যান। ১৯৮৭ সালে তিনি ইংলান্ডের ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসল আপন টাইন থেকে হাউজিং অব ডেভেলপিং কান্ট্রি বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করেন।
১৯৮৮ সালে ইংলান্ডের ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসল থেকে লাভ করেন মাস্টার অব ফিলোসফি ইন আর্কিটেকচার (এমফিল ইনআর্কিটেকচার)। ২০০০ সালে সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেকচার এন্ড ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে কোর্স করেন। ২০০৩ সালে জামবিয়ার লুসাকা থেকে হাউজিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফলোআপ ২০০৩ এ অংশ গ্রহণ করেন। ২০০৯ সালে ইনস্টিটিউট অব হাউজিং এন্ড আরবান ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (আইএইচএস) ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি নেদারল্যান্ডস থেকে ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট এন্ড ইনফরমাল সেটেলমেন্ট রেগুলারাইজেশন বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করেন।
১৯৯২ সাল থেকে স্থপতি সেলিনা আফরোজা স্থাপত্য কনসালটেন্সি ফার্ম আর্কি টাইপ লিমিটেডের উপদেষ্টা স্থপতি হিসেবে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। ২০০৯ সালে তিনি বাংলাদেশ স্টেট ইউনিভার্সিটির গেস্ট ফ্যাকালটি হিসেবে ডিজাইন হাউজিং স্টুডিও এবং থিউরী কোর্স এর ক্লাস নেন। ২০১১ সালে তিনি স্থাপত্য অধিদপ্তর থেকে অতিরিক্ত প্রধান স্থপতি হিসেবে অবসর নেন। তারপর ২০১৩ সালে তিনি শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থাপত্য বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের তিনি স্থাপত্যের নানা বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থাপত্য চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সরকারি চাকরীতে থাকাকালীন তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছেÑ বেইলী রোডের মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্ট, উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট, মানিক মিয়া এভিনিউতে ন্যাম ভবন, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাস ভবন, মৌলভীবাজারের টি গার্ডেনের শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ধরনের ভবন, সোবহানবাগ সরকারি কলোনি ভবন, ওসমানী মিলনায়তনের অডিটোরিয়াম, সিরাজগঞ্জের রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি অডিটোরিয়াম, ঢাকার শেরেবাংলা নগরের প্লানিং কমিশনের এনইসি বিল্ডিং অডিটোরিয়াম, ফরিদপুরের পল্লী কবি জসীম উদ্দীন সংগ্রহ শালা, পিডবিøউডি মেইনটেন্যান্স অফিস ভবন, পরিকল্পনা কমিশন ভবন কমপ্লেক্স, তেজগাঁও এর ভ‚মি ভবন, বাংলাদেশের সব জেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, গাজীপুরের বিআইটি মসজিদ, সোবহানবাগের ওমেনস ক্লাব, আজিমপুরের ডে কেয়ার সেন্টার, মিন্টো রোডের মন্ত্রীপাড়া এলাকার মসজিদ, মেট্টোপলিটন পুলিশের থানা কাম ব্যারাক বিল্ডিং, আজিমপুরের সরকারি কলোনি মসজিদ, আগারগাঁও কলোনী মসজিদ, রাজশাহীর সারদায় পুলিশ একাডেমী অফিসার্স মেস, ইস্কাটনের ইস্কাটন গার্ডেন গর্ভনমেন্ট অফিস, কুমিল্লায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউট, খুলনার শিল্পকলা একাডেমী, শাহবাগের ড. মিলন অডিটোরিয়া, শেরেবাংলা নগরের সংসদ ভবনের বিভিন্ন কক্ষের অভ্যন্তরীন কাজ, গ্রীন রোডের সোস্যাল ওয়েল ফেয়ার সেন্টার, রাঙ্গামাটি চট্টগ্রামের সরকারি কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের বাস ভবন, নাখালপাড়ার এমপি কমপ্লেক্স, শেরেবাংলা নগরের সরকারি স্টাফ এবং অফিসারদের বাস ভবন, উত্তরার ১৮নং সেক্টরে রাজউকের ২২ হাজার ফ্ল্যাট প্রকল্প, কুমিল্লা, বগুড়া, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, মৌলভীবাজার ও মাদারীপুরের টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন করেছেন।
Afroza-projectস্থাপত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি উইমেন আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার্স এবং প্লানার্স এসোসিয়েশন (ওয়েপা), বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি এই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দেশে-বিদেশে ২৭টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার এবং ওয়ার্কশপে যোগ দেন। ১৯৭৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্বামীর নাম মরহুম আবু জাফর মোহাম্মদ আলমগীর। তিনিও একজন স্বনামধন্য স্থপতি ছিলেন। তাদের রয়েছে দুই সন্তান। বড় ছেলে রায়হান আলমগীর আমেরিকা থেকে পাশ করা স্থপতি। বর্তমানে তিনি আর্কিটাইপ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ছোট ছেলে জোহান আলমগীর একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার এবং জনপ্রিয় গিটারিস্ট। তিনিও আমেরিকা থেকে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপর পড়াশোনা করেছেন। বসবাস করছেন আমেরিকাতেই। ব্যান্ড ‘সাবকনসাস’ এর প্রতিষ্ঠাতা তারা দুই ভাই।
স্থপতি সেলিনা আফরোজা লুলু বলেন, স্থাপত্য নির্মাণের জন্য ক্লাইমেট বা জলবায়ু প্রধান বিবেচ্য বিষয়। ছাদ, কলাম, মেঝে, দেয়াল নিয়ে একটা ভবন গড়ে উঠলেই সেটা স্থাপত্য হয় না। স্থাপত্যের জন্য ফাংশন এবং ফর্মের নিবীড় সম্বনয়ে নান্দনিকতা এবং পরিকল্পনার সমাবেশ ঘটিয়ে একজন স্থপতি তার সঞ্চিত জ্ঞানের বাইরে মেধা, মননশীলতা, সৃজনশীলতার সমন্বয় ঘটিয়ে যে ভবন তৈরি করে সেটাই স্থাপত্য। এই কারনেই সকল স্থপতি আলাদা ও স্বকীয় প্রনোদনা নিয়ে কাজ করে। একটা ভবনের প্রয়োজনীয় উপাদান হচ্ছে জমি, নির্মাণ সামগ্রী, শ্রমিক, অর্থায়ন, অবকাঠামো এবং রেগুলেশন। এই গুলোকে বিবেচনা করেই ভবন নির্মাণ করতে হয়।
বর্তমানে কম্পিউটারের সাহায্যে নকশা প্রনয়নের কাজ তরান্বিত করা যায়। আধুনিক ভবনের ভেতরে কেন্দ্রীয় প্রসেসরের মাধ্যমে ভবনটির নিরাপত্তা এবং ভবনবাসীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে নকশা প্রণয়নের কাজ করা যায়। উন্নত টেকনোলজির সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে বাড়ির যে কোনো জায়গায় তাপমাত্রা, আদ্রর্তা জেনে নেয়া যায়। আগামী ২০২৫ থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত নির্মাণ শৈলীর এ সময়টাকে বলা হচ্ছে বায়োমরফিজমের যুগ। পরিবেশ এবং জীবনের সাথে সামঞ্জস্য থাকার কারণে এধরনের স্থাপত্য কলা শুধু মাত্র জৈবিকই হবে না বরং যে স্থানে এটি গড়ে উঠবে সেই জায়গাটির পারিপাশ্বিকতার সাথেও এর যথাসম্ভব সঙ্গতি রেখেই স্থাপত্য তৈরি হবে। তিনি আরো বলেন, একজন স্থপতি প্রভাবিত করে ভবনকে এবং ভবন প্রভাবিত করে মানুষকে। প্রকৃত পক্ষে স্থাপত্য পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত করে মানুষের জীবন ধারা। আর পরিবেশ তৈরীতে স্থপতিদের ভ‚মিকা অনিস্বীকার্য। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা নির্ভর স্থাপত্য শিল্প একটি দেশের বা জাতির প্রকৃত সভ্যতা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের মাপকাঠি হিসেবে পরিগণিত। বর্তমান পরিবেশ সচেতনতার যুগে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সাথে সামাঞ্জস্য পূর্ণ স্থাপত্য অধিক গ্রহণ যোগ্য। আগামী দিনের নির্মাণ শৈলী নিয়ন্ত্রীত হবে নব প্রযুক্তির সাথে সংহতি রেখে। সেই সময় জনসংখ্যা অর্থনীতি, পরিবেশগত সম্পর্ক সর্বোপরি পরিকল্পনাকারীর সৃজনশীলতার বিষয়টি বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি কাজে নজর দেন সেলিনা আফরোজা। স্থাপত্য নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থপতি সেলিনা আফরোজা লুলু বলেন, আমি গ্রীণ আর্কিটেকচার নিয়ে অধিকতর গবেষনার চিন্তা করছি। ভবিষ্যতে স্থাপত্য কলার ওপর বই লেখার ইচ্ছা আছে আমার।