Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আহ্ আফ্রিকা! বাহ আফ্রিকা!

ফারজানা ব্রাউনিয়া:
খুব ভোরে সূর্য ওঠার আগেই আমি, সুমন, জিয়া হায়দার এবং জিপ চালক ও গাইড পাওয়েল বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। সূর্য উঠি উঠি করছে আর আমরা মুকাম্বি লজ-এর পাশে বয়ে চলা কাফুয়েনদী পার হবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কফি হাতে গেইম ড্রাইভের জন্য যোগ্য পোষাকে পারাপারের ছোট্ট ফেরিটিতে উঠে বসতেই যাত্রা হলো শুরু। জমাটবাধা কালো পানি আর ছলকে উঠা ঢেউয়ের ছন্দও যেনো দৃঢ়। এই নদীতে কোনো মানুষ কখনও সাঁতার কাটে না! কুমিরের ঘন বসতিপূর্ণ নদী হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। আরও আছে সপরিবারে জলহস্তিরা। তারা সাঁতার কাটে না, ডুবে যায় পানিতে এবং তলদেশে হেঁটে পার হয় নদী। প্রচন্ড শক্তিশালী এই প্রাণী মাংসাশী না হলেও পদপৃষ্টে মানুষ হত্যায় এরা অনন্য।
ফেরি অন্য পাড়ে ভিড়তেই দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টি স্থির হলো কুমির অথবা একটি কাঠের ভেসে থাকা টুকরোর উপর। ভালো করে তাকিয়ে দেখা গেলো, হ্যাঁ ঠিকই। এটা কুমির। সাবধানে পা টিপে টিপে উঠে যেতে হবে গাড়িতে।
গাঢ় জলপাই সবুজ রঙের খোলা জিপ। দেখে গলাটা শুকিয়ে গেল। চারপাশে খোলা ্এরকম একটি জিপে আমাদেরকে এই জঙ্গলে সফর করতে হবে! বাংলা কিংবা ইংরেজি ভাষায় কথা বললে পশু মহাশয়দেরকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে হয়তো বেঁচে থাকার একটা উপায় বের করা যেতো। কিন্তু সিংহ, চিতা কিংবা কালোবাঘ যদি আমাদেরকে দেখে সকাল কিংবা দুপুরের খাবার হিসেবে পছন্দ করে ফেলে, তাহলে কী হবে?
পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সাফারী-পার্ক কাফুয়ে ন্যাশনাল পার্কের আয়তন ২২৪০০ বর্গ কিলোমিটার যা বাংলাদেশের ছয় ভাগের এক ভাগ বলা যেতে পারে। ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ কলোনী স্থাপিত হওয়ার পর এখানকার ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠী নিকোয়া সম্প্রদায় আর সেখানে বসবাস করতে পারেনি। আদি রাজা মুইনিকাবুলওয়েবুলুওয়ে ক্ষমতাচ্যুত হলেও এখনও বিস্তৃত এই এলাকায় তাদের বংশধর কেউ কেউ রয়েছে বলে মনে করা হয়। ব্রিটিশ পরিবেশবিদ নরমেন কার, ১৯৫০ সালে কাফুয়ে ন্যাশনাল পার্কের নাম ঘোষণা করেন, যা বর্তমানে নর্থ-ওয়েস্ট প্রভিন্স, সেন্ট্রাল প্রভিন্স এবং সাউদার্ন প্রভিন্সে বিস্তৃত। অকৃত্রিম এই বনভূমিতে সহজাতভাবেই সিংহ, চিতাবাঘ, কালোবাঘ, হায়না, হাতি, জেব্রা, হরিণ, বুনো মহিষ, বুনো শুকর, বানর, বিষধর সাপ এবং বিভিন্ন রকমের আঞ্চলিক পাখির সহ অবস্থান লক্ষ্য করা যায়।
brownia-1তিন ঘন্টার জন্য আমরা আফ্রিকার এই গহীন বনভূমিতে ঢুকে পড়েছি। নির্দিষ্ট ট্রেইল ধরে তিন ঘন্টা পর হয়তো আবার ফিরতে পারবো নিরাপদ আশ্রয়ে। গাড়িতে উঠেই ১৭ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পাওয়েল আমাদের শিখিয়ে দিল বনভূমির নিয়ম-কানুন। ‘নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়েই গাড়ি চলবে। গাড়ির ভিতরে থাকলে পশু-পাখি সাধারণত আক্রমণ করবে না। চলমান গাড়ির আওয়াজেও তারা অভ্যস্ত। কিন্তু কিছুতেই, কোনো অবস্থাতেই মাথা কিংবা শরীরের কোনো অংশ গাড়ির বাইরে বের করা যাবে না কোনো নির্দেশ ছাড়া। তাহলে কিন্তু সিংহ মামা আমাদেরকে স্পট করে ফেলবে। যদিও সাধারণত তারা মানুষ খায়না। তবে শিকারে অপারগ বৃদ্ধ ক্ষুধার্ত সিংহ হলে কী করবে তা বলা মুশকিল।’
মুহূর্তের জন্য মনেহলো এতটা ঝুঁকি নেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? আবার মনেহলো বেঁচে থাকাটা অবাক প্রাপ্তি বটে। তবে বেঁচে থাকটাকে স্বার্থক করতে হলে জীবনের ছুঁড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করেই সুবিচার করতে হয় মহামূল্যবান এই জীবনের প্রতি।
পাওয়েলের কথাগুলো মন্ত্রের মতো মনে রেখে পুরো প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে আবিস্কার করলাম প্রকৃতির কাছে আমরা কতটা ক্ষুদ্র।
সূর্যের প্রথম সোনালী আভা ছড়িয়ে আছে বনভূমির আনাচ-কানাচ আলোকিত করে। সঙ্গে আছে হিম শীতল বায়ু প্রবাহ। গাড়িতে রাখা সেলাই করা কম্বলগুলো পরে নিতে হলো আমাদের। গাড়ি চলাকালীন প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস জানান দিল দিনে যতটাই গরম থাকুক না কেনো, রাতে এই বনভূমি ঢেকে থাকে হিম-শীতল শীতের চাদরে। দিনে উষ্ণ আর রাতে শীতল, এই বিশেষ আবহাওয়ার কারণেই পশুপাখিদের বসবাসের জন্য এ অঞ্চল দারুণ আরামদায়ক।
কী অসাধারণ হলুদ বুনোফুলে সেজে আছে এই বনাঞ্চল। ভিন্ন রঙের বুনো মাছিরা তা তা থৈ থৈ করে আমাদেরকে ঘিরে ধরলো। অভিজ্ঞ পাওয়েল চট করে গাড়ি থেকে নেমে হাতির শুকনো বিষ্ঠা নিয়ে গাড়ির এক কোণে রেখে তাতে আগুন ধরিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই আগুন থেকে ধোঁয়ার কুন্ডলী চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই মাছিরা উধাও।
নির্ধারিত পথ চলতে চলতে জানলাম, আমরা আছি বনভূমির উত্তর অংশে। এই অংশের বাসুঙা সমতলে বন্যায় ভেসে এসে শত সহ¯্র হরিণ ও অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণী, জেব্রা, বুনো পশু, বুনো মহিষ ইত্যাদি এখানে বসবাস করে। প্রায় প্রতিটি গাছের নিচেই বনের রাজা সিংহের উপস্থিতি অস্বাভাবিক কিছু না। তিন থেকে চারফুট লম্বা ঘাস যুক্ত এই নরম মাটি চিতাবাঘের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান। চিতাবাঘ একবার মনস্থির করলে ঘন্টায় প্রায় ১১০ কিলোমিটার বেগে দৌড়ে তার শিকারকে ধরে ফেলে। কথাগুলো শুনতে শুনতেই রাস্তার পাশের সমতল ভূমিতে একটি বুনো মহিষের কঙ্কাল ও মাথা পড়ে থাকতে দেখে আমাদের চেহারা আরও ঝুলে গেলো।কাল রাতেই হয়তো সিংহ পরিবার অথবা চিতাবাঘেরা এখানেই নৈশভোজ সেরেছে। যে রাস্তা ধরে এগুচ্ছিলাম তার উপর হাতি এবং অন্যান্য পশুর পায়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে ছিল। কোন পায়ের ছাপ কোন পশুর তা বর্ণনা করলো পাওয়েল। কিন্তু আমাদের ছানাবড়া চোখ আবিস্কার করতে ব্যর্থ হলো আসলে কোন ছাপটি কোন পশুর। তা করতে হলে সম্ভবত দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। তবে স্পষ্ট বোঝা গেল যে আমরাই এখানেই সংখ্যালঘু আর পশুরাই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। একবার দুর্ঘটনা ঘটে গেলে ফিরে এসে আর আনন্দ-আলোতে লিখতে হবে না। বরং, আনন্দ-আলোই হয়তো লিখতো অবশেষে কী ঘটেছে তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
brownia-2বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়ের গা ছম ছম অনুভূতি নিয়েই পথ চলছি আমরা। হঠাৎ পথে বিশাল এক গাছ পড়ে আছে দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম আমরা। কে ফেললো এই গাছ? জেনেছি এই দেশে প্রায় সত্তুরটি ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠীর বসবাস। তারমধ্যে সিংহ শিকারী মাসাই ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠীও রয়েছে। হয়তো মানুষখেকো মানুষের বসবাসও থাকতে পারে এই বনভূমিতে।
আমাদের আশ^স্ত করলো পাওয়েল। হাতিরা চলাচলের সময় নিজের অজান্তেই অনেক সময় গাছ ফেলে চলে যায়। বোঝা গেল কাজটি হাতির। হয়তো কিছুক্ষণ আগেই মহাশয় এখান দিয়ে হেঁটে গিয়েছে। কিন্তু এখন আমাদের কী হবে?
অভিজ্ঞ পাওয়েল নির্দিষ্ট ট্রেইল ফেলে ঘুরে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটলো। কিছুদূর যেতেই দেখতে পেলাম একটি বুনো শুকোর তার দুটো বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। গাড়ির আওয়াজে বাচ্চা দুটো দুধ খাওয়া ছেড়ে আমাদের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। আমরা দ্রততার সাথে তাদেরকে মোবাইল ফোনে ক্যামেরা বন্দী করি। আরও কিছুদূর যেতেই সোনালী রঙের তিন থেকে চার ফুট ঘাস নড়ে উঠতেই আমরা সাবধান হয়ে গেলাম। হয়তো সিংহ! ঘাসগুলো সজোরে নড়তে শুরু করলো। আরেকটু কাছে যেতেই বড় শিংওয়ালা একটি হরিণ ছুটে বেরিয়ে গেলো একদিকে। বাহ্! কী সুন্দর তার পুষ্ট শরীরের দুলুনি। দূরে একটা বড় গাছের নিচে কিছু একটা নড়া-চড়া দেখে নিশ্চিত হলাম, এটা সিংহ-ই হবে। পাওয়েল গাড়ি চালিয়ে অনেক কাছে চলে এলো। সত্যিই একটি সিংহ। কিন্তু সিংহের এমন ভঙ্গিমা আমি আগে কখনও দেখিনি। খাবারের পর সিংহটা পেট ফুলিয়ে চার হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। তার পাশেই হরিণ এবং কিছু দূরে বড় বড় কয়েকটি সারস পাখি হাঁটছে। বনের রাজা সিংহ পশু দেখলেই শিকার করে না। বরং, তার ক্ষুধা নিবৃত হলে হাতের নাগালে হরিণ ঘুরলেও সে তাকে আক্রমণ করে না। মানুষ কিন্তু এ থেকে কখনও কোনদিন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে না। মানুষের ক্ষুধা আজন্ম। যত পাই তত খাই, যত খাই তত চাই। ক্ষুধা মিটে গেলেও চাই। অন্যের প্রয়োজন কেড়ে নিয়ে অপ্রয়োজনেও আমার চাই। আরও চাই, আরও চাই…।
কাফুয়ে নদীর পাশে বড় একটি গাছ। নদীর অল্প পানির উপর দিয়ে গাড়ি নিয়ে পাড় হলাম আমরা। গাছের উপরে জাম্বিয়া জাতির পাখি ঈগল। তীক্ষè দৃষ্টিতে মাছের দিকে তাকিয়ে। নদীর পাশে ঝোঁপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে দুটো জলহস্তিকে দেখা যাচ্ছে। ডোবে আর ভাসে। থামতে বললাম পাওয়েলকে। না থেমেই সে ছুটে চললো। আমরা কিছু বোঝার আগেই নদীর পাড়ের বেশ খোলা একটি জায়গায় গাড়ি থামিয়ে আমাদেরকে দেখালো প্রায় তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশটি জলহস্তি একসঙ্গে খেলছে। কেউ ডুবে যাচ্ছে কেউ ভেসে উঠছে। আবার কেউ কাউকে একটু ধাক্কা দিচ্ছে।
পাওয়েল গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে ভালো করে লক্ষ্য করলো কোনো হিং¯্র পশু আছে কিনা। গাড়ি থেকে নামার অনুমতি পেলাম আমরা। কিন্তু সাবধান। জলহস্তি ছুটে এলেই গাড়িতে উঠে পড়তে হবে। একসঙ্গে এতগুলো জলহস্তি জীবনে কখনও দেখিনি। নয়ন জুড়ানো এ দৃশ্য দেখা শেষে গাড়িতে উঠতে যাবো এ সময় হঠাৎ বলে উঠলেন জিয়া হায়দার, ‘ফারজানা, সুমন, দ্যাখো, দ্যাখো একটা চিতাবাঘ পানি খাচ্ছে!’ মিশ্র অনুভূতি। প্রথমে হা করে কিছুক্ষণ দেখলাম। পরে নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি। তারপর চোখের ভাষা বুঝে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে পড়া। আবারও যাত্রা শুরু। তবে যাত্রা শুরুর আগে চিতাবাঘের ছবি মোবাইলের ক্যামেরায় বন্দী করতে ভুললাম না।
কিছুটা এগুনোর পরেই হালকা জঙ্গলের মাঝে এক জায়গায় দেখা গেল শত শত বুনো মহিষের দল এপাশ থেকে ওপাশে ছুটছে। গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে মাথা বের করে এ দৃশ্য অবলোকন করলাম আমরা। তারপর হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মহিষেরও বেশ পেছনে উঁচু পাহাড়ের আগে আগে হাতির দল সারিবেঁধে জঙ্গলে ঢুকে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য মনেহলো আমরাও বোধহয় এই প্রকৃতিরই অংশ। হয়তো ছিলাম কোনো একসময়। কিংবা এই পৃথিবী হয়তো তাদেরই। আমরাই হয়তো এখানে এলিয়েন!
বুনো মহিষ থেকে চোখ ফেরাতেই দানবাকৃতির এক গাছ চোখে পড়লো। এ গাছ আগেও কয়েকবার দেখেছি। তবে পাওয়েলের কাছে জানতে পারলাম এ গাছের বাকল হাতির খুব প্রিয় খাবার। গাছটির নাম বাওবাব। গাছটির কাঠ দিয়ে আসবাব তৈরী হয় না। কারণ এ গাছের পঁয়ষট্টি শতাংশই পানি। বাওবাব গাছের ফল অত্যন্ত সুস্বাদু। বেলের মতো শক্ত আবরণে ছোট ছোট কালো বীজ ঘিরে সাদা যে অংশটুকু থাকে তা দিয়ে অত্যন্ত সু-স্বাদু শরবত তৈরী করা হয়। দেখে মনেহয় দুধ। কিন্তু মুখে নিলেই টক-মিষ্টির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই মনেহয়, গাছটি কথা বলবে। আঙুলের মতো ডালপালাগুলো নেড়ে নেড়ে বলে উঠবে, ‘আফ্রিকাতে স্বাগতম।’
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি প্রায় দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। তারমানে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ফিরে যাচ্ছি যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। সোনালী উঁচু ঘাসের মাঝ দিয়ে যে ট্রেইল ধরে আমরা ফিরছিলাম, সে পথটি ছিল বেশ কর্দমাক্ত। পাওয়েল কিছুক্ষণের জন্য থেমে ভাবলো কী করা যায়। অভিজ্ঞ চেহারায় চিন্তার ছাপ দেখে আমরাও চিন্তিত হয়ে পড়ি। বনভূমির যে অংশে আমরা এসেছি এ অংশের বিশেষ ধরনের মাটি খুবই পিচ্ছিল। যে দিক থেকেই বেরুতে চেষ্টা করবো সেদিকেই আটকে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাহলে উপায়?
সূর্য মধ্য গগণে ওঠার পর কড়কড়ে রোদে এই কাদা শুকিয়ে গেলে তবেই আমরা বের হতে পারবো। ঘড়ির কাটা তখন নয়টা ছুঁই ছুঁই। মধ্য গগণে সূর্য ওঠার জন্যে অনন্তপক্ষে তিন-চার ঘন্টা এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। তারচাইতে অন্যকোনো উপায় বের করার চেষ্টা করাটাই সমীচীন বলে ভাবা হলো। পাওয়েল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। অভিজ্ঞ চোখে দূরবীন দিয়ে দেখে নিল আশে-পাশে কোনো হিং¯্র পশু ওঁতপেতে আছে কিনা। তারপর গাড়িটিতে চারচাকার শক্তি আরোপ করা হলো।একটু পিছনে নিয়ে ডানদিকে ঘুরে ছুটলো গাড়ি। বড় বড় ঘাস মাড়িয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। এই বড় ঘাসের মাঝে চিতাবাঘ কিংবা সিংহ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওইতো ঘাসের পরে একটু সমতল ভূমি দেখা যাচ্ছে। পাওয়েলের গাড়ি ছুটছে। হঠাৎ করেই নরম মাটিতে আটকে গেল চাকা। চারচাকার শক্তিতে এস্কেলেটরে যতোই জোরে চাপ দিচ্ছে পাওয়েল ইঞ্জিনের গোঙানি ততোই বাড়ছে। এক বিশাল পশু যেনো ফাঁদে আটকে পরে গোঁ গোঁ করছে। উপায়ান্ত না দেখে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে বেশ সরঞ্জাম বের করতে করতে আমাদেরকে বললো,‘আমরা একটু বিপদে পড়েছি। তবে চিন্তার কিছু নেই। নরম মাটির কারণে চাকা আটকে গেছে। জঙ্গল থেকে ডালপালা কেটে চাকার নিচে দিয়ে হয়তো গাড়িটি বের করে নিয়ে যেতে পারবো।’
আমাদের রক্তে একটা হিম প্রবাহ অনুভব করলাম। ঘাড়ের পেছন থেকে একটা ঘামের রেখা তীর তীর করে নিচে নেমে গেল। বেশ কিছুক্ষণ বাক্যালাপ নেই। প্রথম মুখ খুললেন জিয়া হায়দার, ‘আমরা কি তবে সিংহের খাবার হতে চলেছি?’ উত্তরে সহাস্যে পাওয়েল বললো, ‘অস্বাভাবিক কিছু নয়।’ ভীষণ পরিশ্রম করে কাঠ কেটে আনলো, জ্যাক লাগিয়ে চাকা উঁচু করে তার নিচে কাঠগুলো ঢুকালো পাওয়েল। তার আদেশে আমাদের গাড়িতেই বসে থাকতে হলো। এরই মাঝে সমতল ভূমির ওপাশ থেকে প্রায় বিশ-ত্রিশটি হরিণের একটি দল ঘাড় উঁচু করে কান খাড়া করে কৌতুহল ভরে আমাদের দেখছে। ভাবছিলাম, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। যাদেরকে দেখতে আমরা এসেছি, এখন তারাই আমাদের দেখছে।
পাওয়েল প্রস্তুত। গাড়িতে উঠে বসলো। ইঞ্জিন স্টার্ট দিতেই আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা শুরু করলাম। চারচাকার শক্তি নিয়ে অনেক জোরে টান দেয়া হলো গাড়িটি। গাড়ির বিকট শব্দে হরিণগুলো দৌড়ে পালালো। কিন্তু বিপদ থেকে উদ্ধার পেলাম না আমরা। এবার সত্যি সত্যি সত্যি সকলেরই মন খারাপ হয়ে গেল। পাওয়েলের মুক্তঝরা হাসি আর ঠোঁটে নেই। কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে। নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। বেশ কিছুক্ষণ তীব্র নীরবতার পর, ‘আমাদের নেই কোনো ভয়, আমাদের নেই কোনো ভয়, আমাদের নেই কোনো ভয় আজকে। বুকের গভীরে আমরা জেনেছি, আমাদের নেই কোনো ভয় আজকে।’ গানটি মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো আমাদের তিনজনের মাঝে। দলনেতা পাওয়েলের সাহস যোগাতে গাড়ি থেকে নামলাম আমরাও। প্রথমে সুমন ক্যামেরা হাতে পাওয়েলের সঙ্গেই জঙ্গলের একটু ভিতরে চলে গেল চ্যানেল আইয়ের জন্য দৃশ্যগুলো ধারণ করতে। আরও কিছু কাঠ নিয়ে তারা দুজন ফিরতে ফিরতেই আমি আবিস্কার করলাম বড় পড়ে থাকা কাঠের গুড়ি। গাড়ির ভেতরে রাখা কফি, গরম পানি সব কিছু নিয়ে জিয়া হায়দার যুক্ত হলেন আমার সঙ্গে। এরই মাঝে পাওয়েল আর সুমন ফিরে এলো ক্লান্ত হয়ে। পাওয়েল হাতে আরও কিছু বড় বড় গাছের ডাল। মনোবল ভেঙ্গে যাওয়া দলকেপুনরুজ্জীবিত করতে চার কাপ কফি হাতে এক হলাম আমরা। কফির কাপে চুমুক দিয়ে চারজন একসঙ্গে হয়ে একমত হলাম যে, ভয়ংকর বিপদ আসতেই পারে। তবে সেই বিপদ আসবে বলে প্রতিটি মুহূর্তে বার বার মৃত্যু ভয়ে মরে যাওয়ার চেয়ে কফির কাপে চুমুক দিয়ে হাসি মুখে বিপদ থেকে উদ্ধারের সর্বত্তম চেষ্টা করাটাই বীরের কাজ। কথায় আছে – ফরচুন ফেভারস্ দ্য ব্রেভ। সৌভাগ্য বীরের পক্ষে থাকে। ঘটলোও তাই। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো। চারজন মিলে ভয়কে জয় করে গাড়িটিকে আমরা ঠিকই বের করে নিলাম।
সূর্যের সোনালী আলোকে আরও সোনালী মনে হলো। গাছের পাতায় আলোর ঝিলিমিলিতে যেনো জীবনের উৎসব মেতে উঠেছে। আবারও বলতে হচ্ছে, বেঁচে থাকাটাই আসলে অবাক প্রাপ্তি। আর এ সফরে প্রাপ্তি যোগ হলো নতুন একটি পরীক্ষিত বন্ধু, পাওয়েল। খুব অল্প সময়েই ঘাটে পৌঁছে গেলাম আমরা। ফেরীতে উঠে বিদায় নেবার আগে পাওয়েলের দিকে তাকিয়ে দেখি মুক্তঝরা হাসির রোদের সঙ্গে তার চোখের কোণে কিছুটা বৃষ্টির আভাস। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে সুমনকে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাদের দেশের মানুষরা কি এমনই?’ জিয়া হায়দার প্রশ্ন করলেন, ‘ক্যামন?’ আমাদের অবাক করে দিয়ে পাওয়েল বললো, ‘ঈশ^রের মতো।’ আমি বলে উঠলাম, ‘সেই একই আলোতে আমি তোমার মাঝেও দেখেছি। তাহলে কী বলা যায় না, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মাঝেই রয়েছে ঈশ^রের আলো?’ বন্ধু পাওয়েল সাহসী নারী হিসেবে আমার একটি ছবি তুলতে চাইলো। চট করে তার সঙ্গে একটি ছবিও তুললাম আমি। তবে পাওয়েল বললো, ‘শুধু এই ছবি নয়। সিংহের সাথে তোমার একটি ছবি তুলে দিতে চাই আমি।’ আমি বললাম, ‘মাত্র সিংহের কবল থেকে বেরিয়ে এলাম। আবারও…।’ পাওয়েল আশ^স্তের হাসি হেসে বললো, ‘ভয় নেই। এটি জঙ্গলের সিংহ হলেও তার সঙ্গে মানুষের সখ্যতা রয়েছে এবং তোমাকে আমি পঞ্চাশ শতাংশ নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, সে তোমার ঘাড় মটকে খাবে না।’
brownia-3সিংহ বাড়ির ঠিকানা নিয়ে বিদায় জানালাম বন্ধু পাওয়েলকে। ফেরীতে করে ফিরছি মুকাম্বি লজে। কাফুয়ে নদী পেরিয়ে যখন ফিরলাম নদীর পাড়ের ট্রি-হাউজ অর্থাৎ, গাছ বাড়িতে, ততক্ষণে সাহস অনেক বেড়ে গেছে।বারান্দা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলাম কুমিরের ছোট্ট বাচ্চারা খেলা করছে কাফুয়ে নদীর পানিতে। বানররা আমার প্রতিবেশী। গাছের ডালে বাচ্চা কোলে নিয়ে আমাকে দেখছে, যেভাবে নতুন প্রতিবেশী আসলে আমরা কৌতুহল নিয়ে দেখি। গোসলের বাথটাবটা একেবারে গাছের পাশে নদীর উপরে। কাঁচের দেয়ালের ভেতরে পরিষ্কার ধবধবে একটি বিছানা রয়েছে ঠিকই, তার চারপাশে রাজকীয় মশারীও আছে। কিন্তু কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছি না যে আমার নতুন প্রতিবেশী বানর, কুমির কিংবা হরিণ কোনো ঝটিকা সফর দেবে না আমার ঘরে। আমাদের তিনজনের ঘরগুলো এতটাই দূরে যে চিৎকার করে ডাকলেও একজন আরেকজনকে শুনতে পাবো না। এমনকি মোবাইলে নেটওয়ার্ক না থাকায় কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো আমরা বুঝি সত্যি সত্যি প্রস্তর যুগে, প্রকৃতির ঠিক মাঝে বসে আছি। দুপুরের খাবার প্রস্তুত। বন-মহিষের পোড়া মাংসের সঙ্গে বাওবাব গাছের জুস ছিল আমাদের পছন্দের তালিকায়। এছাড়াও, বুনো-হাতির প্রিয় আমারুলা ফলের নেশা নির্যাস, কুমিরের ধবধবে সাদা মাংশের বারবিকিউ ছাড়াও আরও অনেক উদ্ভট নতুন খাবারের সমারোহ ছিল। পেট পুড়ে দুপুরের খাবারের পর সূর্যাস্তের আগেই সম্পূর্ণ একা ঘরে থাকার নিয়ম-কানুন আমরা জেনে নিলাম। অন্ধকারে একা গাছ বাড়ি থেকে নিচে নামা নিষেধ। কাঁচের জানালাগুলো অবশ্যই বন্ধ রেখে প্রতিবেশি বানরদের তান্ডব লীলা থেকে নিজের ঘর বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ঘরে কোনো রকমের দূরালাপনী না থাকায় ঘরে ঢোকার পর সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন থাকতে হবে। কোনো রকমেই কোনো পশু-পাখিকে তাদের নিজস্ব বিচরণকালে এবং অবস্থানে বিরক্ত করা যাবে না। সিংহ কিংবা বাঘ দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উল্টো দিকে দৌড় দেয়া যাবে না। বরং, একাধিক মানুষ থাকলে কাছাকাছি একসঙ্গে থাকতে হবে। খুব সাবধানে চোখে চোখ রেখে নিজের পথে হেঁটে যেতে হবে। নিজেকে অত্যন্ত বড় এবং হিং¯্র প্রমাণ করতে হবে যদি কোনো পশু আমাদের দিকে ধেয়ে আসতে চায়। আক্রমণ করতে চাইলে পশুকে পাল্টা আক্রমণ করতে হবে। নৈশভোজের পর যদি কোনো অত্যন্ত জরুরী অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং ঘর থেকে বেরুতে হয় তাহলে প্রথমত দেহরক্ষী প্রয়োজন। কিন্তু তাদেরকে কী করে ডেকে পাওয়া যাবে এ প্রশ্নের উত্তর এখনও আমার জানা নেই। ঘরের ভিতরে দরজার পাশে একটি শক্তিশালী সার্চ লাইট রয়েছে যা হাতে নিয়ে ডানে এবং বায়ে আলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে নির্ভিক চিত্তে দৃঢ় পায়ে ভয় না পেয়ে মূল বাড়ি অর্থাৎ, রিসিপশনে গিয়ে পৌঁছতে হবে। সেখানে আদৌ বিপদকালে কাউকে পাবো কিনা সে প্রশ্নের উত্তরও আমার জানা নেই। তবে আশার বাণী একটাই, বানর ছাড়া হিং¯্র পশু কিংবা তৃণভোজী প্রাণী কেউ-ই আমাদের ঘরে প্রবেশ করবে না। ঘুমুতে যাবার আগে গাছ বাড়ির দেয়ালটি স্পর্শ করে দেখা গেল তা তাবুর কাপড়ে গড়া। আর কোনো রকম কোনো ব্যস্ততা কিংবা কাজ না থাকায় কল্পনার জগতে ভাসতে লাগলাম সিংহ কিংবা বাঘ কখনই যে আমাদের আক্রমণ করবে না এটা তাদের শেখালো কে। তাদের নখের যে ধার, থাবার যে ভার, তা দিয়ে এ ঘর উড়িয়ে দেয়া তাদের জন্যে এক মুহূর্তের ব্যাপার। বিভূতিভূষণের তাবুতে ঢুকে যাওয়া সেই সিংহের কথা আবারও মনে হলো। মোটামুটি, জুতো-মুজো পরেই এবারের সফরসঙ্গী আয়ান হিরসি আলী-র ‘ইনফিডেল (মাই লাইফ)’ বইটি পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।
খুব ভোরে যথা সময়ে গাইড এসে গরম পানি দিয়ে গেল এবং বললো বিশ মিনিট পর সে এসে নিয়ে যাবে। সুমন কিংবা জিয়া হায়দার বেঁচে আছে তা গাইডের চেহারা দেখে আমি বুঝতে পারলাম। অবশেষে সুমনের বাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে আমার বাড়ির সামনে আসতেই আমরা দুজনে মিলে জিয়া হায়দারের বাড়ি থেকে তাকে তুলে বড় মূল বাড়িতে, অর্থাৎ, রিসেপশনে ফিরে গেলাম। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্ত)