Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

কবির মুখোমুখি একদিন

খান মুহাম্মদ রুমেল: রাস্তার লাল আভা দেখে ঠাহর হয় হয়তো কোনো দিন পিচ ঢালাই হয়েছিল। অথবা বিছানো হয়েছিল ইট। কিন্তু সেসবের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই আজ। অনেকটা নদী মরে গেলেও ¯্রােতের রেখা থেকে যাওয়ার মতো। তেমনই এক পথে অটোরিকশার যাত্রী আমি আর ফটোগ্রাফার দীন ইসলাম। শহর পেরিয়ে যেতেই- দুপাশে ফসলী জমি। আসছে মৌসুমে আবাদের অপেক্ষায় মাটির ঢেলা বুকে নিয়ে শুয়ে আছে নিরন্তর। দূরে কোথাও একটু পরপর চোখে পড়ে বাড়ি ঘর। খোলা মাঠের কোথাও কোথাও দাড়িয়াবান্ধা কিংবা হাডুডু খেলার চিহ্ন আঁকা। হঠাৎ চোখে পড়ে লাল ইটের দালান। কালো রেখায় বাক্সবন্দী সাদা জমিনে লেখা-ঠাকরোকোনা রেলস্টেশন। চমক লাগে আমার। ব্যস্ত ভঙ্গিতে অটো থামাতে বলি চালককে। অবাক হয় দীন ইসলাম। আরো অবাক হয় চালক। আমার ভেতরে তখন তোলপাড়। হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ বইয়ের শুরুইতো এই রেলস্টেশন থেকে। রাতের আঁধারে দুই বোন নামে রেলস্টেশনে। চারপাশে জনমানুষ নেই। স্টেশন মাস্টারের কামরায় টিমটিমে আলো দেখে এগিয়ে শাহানা আর নীতু। এরই মধ্যে গোবরে পা পড়েছে নীতুর। নীতুর মাথায় পা ধোয়ার চিন্তা, শাহানার মাথায় সুখানপুকুর- দাদা ইরতাজ উদ্দীনের বাড়ি যাওয়ার চিন্তা। স্টেশন মাস্টার দুই বোনকে বসিয়ে রেখে চলে যায় চা আর জিলাপির খোঁজে। দুই বোনের দেখা হয় ঘাতক মতির সঙ্গে… কল্পনায় কতবার দেখেছি ঠাকরোকোনা রেলস্টেশন। ততদিনে শ্রাবণ মেঘের দিনে সিনেমা হয়ে গেছে। কিন্তু সিনেমায় ছিল স্টেশনের দিনের দৃশ্য। আমার মাথায় বইয়ে বর্ণিত রাতের দৃশ্য। বাস্তবে সেই স্টেশনে ঢুকে মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি কল্পনার সঙ্গে। আমার চপলতা দেখে অবাক হয় দিন নামে ইসলাম। বলে দাঁড়ান আপনার ছবি তুলে দেই। ছবিতে এই সৌন্দর্য ধারণ করা সম্ভব নয়- উত্তর আমার।

নির্মলেন্দু গুণ নেত্রকোনার বারহাট্টার কাশবন গ্রামে গড়ে তুলেছেন এক স্কুল। গাঁটের পয়সা খরচ করে চালান সেই স্কুলের ব্যয় ভার। গড়েছেন পাঠাগার। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ পড়তে আসে সেখানে। এই নিয়ে আনন্দ আলোতে লিখব আমি। ছবি তুলবেন দীন ইসলাম। আর এই উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে এক ভোরে নেত্রকোনার বাসে চেপে বসি আমরা। সূর্যটা মাথার উপরে উঠেও পুরোপুরি উঠেনি- অনেকটা তেমন দুপুরে আমরা নামি বাস থেকে। তাকে জিজ্ঞেস করে একটা অটোরিকশা নিই বারহাট্টা পর্যন্ত যাওয়ার চুক্তিতে। বাকি পথটুকু যাব রিকশা কিংবা পায়ে হেঁটে। পুরো পরিকল্পনা হয়ে গেছে দুজনের ছোট্ট বৈঠকে। আর বারহাট্টা যাওয়ার পথেই আমাদের আচমকা হুমায়ূন কীর্তিতে হারিয়ে যাওয়া।

বারহাট্টা নেমে আমরা খোঁজ করি রফিজের চায়ের স্টল। সেই যে, ‘হুলিয়া’ মাথায় বাড়ি ফেরার পথে বাস থেকে নেমে রফিজের স্টলে চা খেয়েছিলেন কবি। আর ‘পুনর্বার চিনি দিতে এসেও রফিজ তাকে চিনতে পারেনি’- সেই চায়ের স্টল।

বারহাট্টা থেকে রিকশায় দুই আড়াই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা থামি বিশাল বটবৃক্ষের নিচে। বটবৃক্ষ ঘেঁষে হাতের ডানে একটি প্রাইমারি স্কুল। একটু এগিয়ে হাতের বাঁয়ে বাঁশের বেড়া আর টিনের চালার লম্বা ঘর চোখে পড়ে। সামনে বাঁশের ডগায় পতপত করে উঠছে লাল সবুজ পতাকা। বুঝে নিই এটাই কবির স্কুল। কিন্তু কবি কোথায়। তাঁর বাড়ি কোনটা। গত রাতে কথা হয়েছে- ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে কিশোরগঞ্জে একটি অনুষ্ঠান শেষ করে রাতে বাড়ি ফিরবেন তিনি। আর আমরা সকালে রওনা হয়ে দুপুর নাগাদ কাশবনে পৌঁছে তাঁর সঙ্গে আলাপ করে ঢাকা ফিরবো। তিনি কি এসেছেন? ফোন করতে সাহস হয় না। একজনকে জিজ্ঞেস করি কবির বাড়ি কোনটা? উত্তর পাওয়ার আগেই সামনে পেয়ে যাই কবিকে। সাদা দাড়ি গোঁফ আর ধূসর পাঞ্জাবির সঙ্গে চেক লুঙ্গি পরা কবির মুখে অমলিন হাসি।

আমরা ঘুরে ঘুরে কবির স্কুল দেখি। ছাত্র শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলি। দীন ইসলাম ছবি তোলে। কবির লাইব্রেরি দেখি। কবির স্বপ্নের কথা শুনি। ছবি এঁকে আর সাহিত্য করে পাওয়া পুরস্কারের টাকা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন স্কুল গড়ার স্বপ্নকে- সেই গল্প শুনি।

Nirmolendo-gun-1কিন্তু আমার মাথায় আবারো ভর করে কবির লেখা অমর কবিতা ‘হুলিয়া’। সেই যে তিনি বাড়ি ফেরার পরে- ‘অনেক পথ ঘুরে পুকুরের জলে চাল ধুতে গেলেন মা’- কোথায় সেই পুকুর? কোথায়- ‘বাষট্টির ঝড়ে ভেঙে যাওয়া অশোক গাছ’। কবি হাসেন। বাড়ির পেছনের পুকুর দেখিয়ে বলেন- এটিই সেই পুকুর। পাল্টা প্রশ্ন করি ৯১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর পর আপনার মার্কা ছিল কুমির। আর নির্বাচনী প্রচারণার জন্য বান্দরবান থেকে দুটি জ্যান্ত কুমির এনেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সেই কুমির দুটি কি এই পুকুরেই ছাড়া হয়েছিল?

অশোক গাছের কথা কিছু বলেন না কবি। ভালোবাসার নামে সারারাত ‘বাসন্তীর সঙ্গে সেই গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকার কারণেই কি এই নীরবতা?

নাকি (‘বাসন্তী, আহা সেই বাসন্তী এখন বিহারে। ডাকাত স্বামীর ঘরে চার সন্তানের জননী হয়েছে)’ বাসন্তীর সংসারের কথা ভেবে এই নীরবতা?

কবি আবারো হাসেন- দাড়ি গোঁফের আড়ালে মুচকি হাসি।

বেলা গড়ায়। কাঁচকি মাছের ঝোল আর ডিম ভুনা দিয়ে একসঙ্গে ভাত খাই করি সাথে পাশাপাশি বসে।

সূর্য আকাশে ঢলে পড়ার আগে বিদায় নিয়ে ঢাকার পথ ধরি আমরা। আমি আর দীন ইসলাম।

আসার আগে কবির আত্মজীবনী ‘আমার ছেলেবেলা’ নিজ হাতে স্বাক্ষর করে আমাকে উপহার দেন।

অমূল্য সেই উপহার বুকে ধরে স্বর্গীয় অনুভ‚তি নিয়ে ঢাকার পথ ধরি আমরা।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, সময় টিভি