Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

চারটা পয়তালি­শ মিনিটের গল্প!

সৈয়দ ইকবাল: কবিতা পড়ছেন অভিনেত্রী প্রভা। সেই কবিতা আনমনা হয়ে শুনছেন গুণী অভিনেতা তারিক আনাম খান। ‘চারপাশ অস্বস্তিতে ভরে গেলো, ইপিল ইপিল গাছ ও তার গোড়ায় যুবক যুবতিদ্বয়ের মনে বেশ স্বস্তি তখনও, দ্যাখো তো, আকাশ কেমন লাগে…, অপর্না আর আমি….’  কবিতার এই লাইনগুলো পড়ছিলো প্রভা। ঠিক তখুনি একটা ‘কাট’ শব্দ। পরিচালক প্রভার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘একটু গভীরভাবে আরও মনযোগ দিয়ে লাইনগুলো পড়তে হবে। বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে।’  আবার ফাইভ, ফোর, থ্রি, টু, ওয়ান, জিরো, অ্যাকশন…. ক্যামেরা ট্রলি হচ্ছে। একদম শান্ত একটা পরিবেশ। কবিতার লাইনগুলো পড়ে যাচ্ছেন প্রভা। আর তারিক আনাম খান শান্ত দর্শক হয়ে শুনছিলেন। এক সময় কবিতা পড়া শেষ হয় প্রভার। সাথে সাথেই তারিক আনাম খানের মুখ থেকে ডায়লগ শুরু হলো- ‘তোমার মধ্যে আমার যৌবনকালটা দেখতে পাচ্ছি, তখন কতো সহজে আমি একেকটা কবিতা লিখতাম। পাঠক, সমালোচক, প্রকাশক, বিশ্ব কবিতার হালচাল, কবিতার আধুনিকায়ন কিংবা বাজার- কোনো কিছু নিয়েই আমার ভাবতে হতো না।’  কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছিলেন তারিক আনাম। তখনো ক্যামেরা চলছিল। পরিচালক মনিটরের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যাচ্ছেন। তার চোখে-মুখে প্রশান্তির ঝলকানি। ক্যামেরাম্যানের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে যাচ্ছেন- ‘চলতে থাকুক দৃশ্যটি।’ তাই হলো। একবারে মাস্টার শটটা নেয়া হলো। এবার ক্লোজ শট নেয়ার পালা। নিয়ম মাফিক তাই নেয়া হলো। এ সময় সেটের এক কোণায় বসে মোবাইল ফোনে খুটখাট করতে দেখা যাচ্ছিল অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতিকে। প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, ‘এখানে আমি তারিক আনাম খানের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করছি। তিনি একজন কবি। তার কবিতা কিংবা কবির জীবন নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। বরং তার একঘেয়েমি জীবনে আমি অতিষ্ট। তাই তো একসময় তাকে ছেড়ে আমি চলে যাই। ছোট্ট একটি চরিত্র। কিন্তু চরিত্রের মধ্যে গভীরতা আছে।’ কথাগুলো বলেই আবার মোবাইল ফোনে মনোযোগ দিলেন তিনি।  এরইমধ্যে সূর্য মামা বাড়ি যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে, মানে প্রকৃতিতে আঁধার নামার সময় হয়ে এসেছে। হয়তো মিনিট বিশেকের মধ্যেই সূর্য পৃথিবীর আরেকপ্রান্তে গিয়ে উঁকি দিবে। তাই পরিচালক হারুন রুশো বললেন, ‘একটি মাত্র দৃশ্য আছে যা দিনের আলো থাকতে থাকতেই নিতে হবে। তাড়াতাড়ি শটটা নেবো।’ যেই কথা শেষ কাজ। ছাদের আরেক পাশে অন্য একটি দৃশ্য নেয়ার প্রস্তুতি শুরু হলো।  ফুলের টবে পানি দিচ্ছিল অভিনেতা আশিক চৌধুরী। সেখানে আচমকা উপস্থিত প্রভা। প্রভাকে দেখে আশিক কিছুটা নার্ভাস। আগ বাড়িয়ে প্রভাই তার সাথে কথা শুরু করে। ‘আচ্ছা, আপনাকে যদি ফুল আর আমার মধ্যে যেকোনো একটিকে মেরে ফেলতে বলা হয় তাহলে আপনি কাকে মারবেন?’ প্রভা আশিকের উদ্দেশ্যে কথাটা ছেড়ে দেয়। আশিক খানিক ভেবে উত্তর দেয়- ‘আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবো।’ প্রভা তখন টবে থাকা ফুলের দিকে ইশারা করে বলে, ‘তাহলে এই সুন্দর ফুলটা আমার খোঁপায় পরিয়ে দিন।’ ইচ্ছা না থাকা স্বঁত্তে¡ও আশিক ফুলটা গাছ থেকে ছিঁড়ে। তার ভয় ছিলো বস (তারিক আনাম খান) ফুল ছিঁড়তে দেখলে রাগ করবে। কথায় বলে না যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয় আশিক ফুলটি ছিঁড়ে প্রভার খোঁপায় পরানোর সময় পাশ থেকে চিৎকার করে উঠেন তারিক আনাম খান।  এমন সময় ‘কাট’ শব্দ। চিৎকারের সঙ্গে আশিকের ভয় পাওয়ার এক্সপ্রেশনটি ঠিক মতো হয়নি। পরিচালক বুঝিয়ে দিলেন ভয় পাওয়ার এক্সপ্রেশনটা কেমন হবে। আবার ফাইভ, ফোর, থ্রি, টু, ওয়ান, জিরো, অ্যাকশন… বলতেই তারিক আনাম খান নিজেই ‘লুক’ বলে জোরে চিৎকার করে আশিকের এক্সপ্রেশনটা আনাতে সক্ষম হলেন। শটটা শেষ হলো। কেউ একজন তখন ক্যামেরার পেছন থেকে বলে উঠলো, ‘ তারিক স্যার ‘লুক’ বলে জোরে চিৎকার দেয়াতে আশিকের এক্সপ্রেশনটা অন্যরকম হয়েছে। গুণী অভিনেতাদের এই হচ্ছে কারিশমা।’  দৃশ্যটি একবারে নেয়া হলো। অন্ধকার নেমে এসেছে। পুরো ইউনিট হাউজের ভেতরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এরই ফাঁকে আনন্দ আলো টিম তারিক আনাম খানের মুখোমুখি। নাটকটিতে নিজের চরিত্র নিয়ে কথা বললেন তিনি।  ‘এখানে আমি একজন কবির ভূমিকায় অভিনয় করছি। আমি কবিতা ছাড়া কিছুই বুঝি না। জীবনের অন্য সম্পর্কগুলোর মায়া আমাকে কখনো টানেনি। সংসার করবো না বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু বন্ধুদের চাপে একসময় বিয়ে করতেই হলো। বেলার কাজ অবেলায় করলে যা হয়! স্ত্রীর (জ্যোতিকা জ্যোতি) সঙ্গে বয়সের ফাঁরাক বেশি হওয়ায় কোথায় গিয়ে যেনো মিলতো না অনেক কিছু। ব্যস, একটি বিশেষ দিনের ৪.৪৫ মিনিটে স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে যায়। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর আর কবিতা লিখতে পারি না আমি। শত চেষ্টা করেও কবিতা লেখা হয় না। এরই মাঝে আমার কবিতার এক ভক্তের (প্রভা) আগমন ঘটে। সেও কবিতা লিখে। প্রতিদিন আমাকে তার লেখা কবিতা শোনায় সে। তার প্রতি আমার এক প্রকার ভালো লাগা এবং শেষমেষ সেটা হয়তো ভালোবাসার দিকেই যায়। তবে শেষে আসলে অন্যরকম একটা ঘটনা ঘটে। গল্পটায় অন্যরকম একটা রিদম আছে। খুব ভালো লাগছে কাজটি করে। আর এখন তো আসলে গল্প পছন্দ না হলে কাজ করা-ই হয় না। তবে এ ধরনের গল্পের জন্য যেমন বাজেট এবং বেশ কয়েকদিন শুটিং করার প্রয়োজন- তা ছেলেরা করতে পারছে না। তাই তো অনেক সময় অনেক কাজ করাও হয় না। আমার ধারনা অনেক ভালো ভালো গল্পের কাজ থেমে আছে।’ শেষের কথাগুলো যেনো বেশ আক্ষেপের সুরেই বললেন গুণী এই অভিনেতা। অবশ্য পরিচালক হারুন রুশোর মুখেও একই কথা শোনা গেলো। বললেন, 05_2‘আসলে আমার এই কাজটার জন্য ৪/৫ দিন শুটিং করার প্রয়োজন ছিলো। গল্পটা ভাবনার সময় তারিক আনাম খান স্যারের কথাই মাথায় এসেছিল। তাকে পাওয়া অবশ্যই বিশাল একটি ব্যাপার। কিন্তু হলে কী হবে! আমি তো বাজেটের জন্য বেশিদিন শুটিং করতে পারিনি। কিছু ড্রিম সিক্যুয়েন্স, ফ্যান্টাসি শট নেয়াই হলো না। সেগুলোর জন্য যেমন সেট চিন্তা করেছিলাম সেটা সম্ভব হয়নি। আর তারিক স্যার এবং প্রভার যেই ক্যামেস্ট্রি সেটা ফুটিয়ে তোলার জন্য আরো অন্তত দুইদিন বেশি শুটিং করার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু বাজেটের জন্য পারলাম না। তারপরও যতোটুকু করেছি আশা করছি দর্শকদের ভালো লাগবে। নাটকের নামটাও খুব সুন্দর। ‘সময় এখন ৪.৪৫ মিনিট’র এই নাটকটি নিয়ে আমি বেশ আশাবাদী। এটি এনটিভিতে প্রচার হওয়ার কথা রয়েছে।’  মেকআপ রুমে গিয়ে দেখো গেলো পরবর্তী সিক্যুয়েন্স অনুযায়ী মেকআপ নেওয়ার ব্যস্ত প্রভা। এরই ফাঁকে নাটকটি নিয়ে তার ভাষ্য শোনা গেলো। বললেন, ‘নাটকটিতে আমি একজন উদীয়মান নারী কবির চরিত্রে অভিনয় করছি। তারিক আনাম খান একজন নামকার কবি এবং আমি তার ভীষণ ভক্ত। হঠাৎ করে তিনি কবিতা লেখা বন্ধ করে দেয়ায় আমার কিউরিসিটি জাগে কেনো তিনি কবিতা লেখা বন্ধ করলেন! একথা জানার অশায় আমি তার সান্নিধ্যে আসি। কিন্তু শেষমেষ একজন কবির জীবনের অন্য এক অধ্যায় আমার সামনে হাজির হয়। আসলে আমরা অনেক বড় বড় মানুষের বাহ্যিক দিক দেখে ভাবি, হয়তো তিনি কতো সুখী এবং আনন্দে আছেন। কিন্তু তার কাছে গেলেই বোঝা যায় তিনি সত্যি কতটুকু ভালো আছেন! এমনি বিষয় ফুটে উঠেছে নাটকটিতে।’  এবার বিশাল বড় একটি রুমে শট নেয়ার জন্য প্রস্তুতি চলে। খুব সুন্দর করে রুমটি সাজানো হয়েছে। বিশাল বড় রুমটিতে কৃত্রিম একটি নৌকা আছে, আছে গাছগাছালি, পাখির কিচিরমিচির শব্দ, জেলেদের মাছ ধরার জাল, কৃত্রিম হাঁস পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে, গ্রামের সেই হ্যারিকেন সহ রয়েছে আরো অনেক গ্রামীন পণ্য। এটাই হচ্ছে কবি তারিক আনাম খানের লেখার স্থান। যেখানে তিনি গ্রাম্য জীবনচিত্রের মধ্যে কবিতা লিখতেন প্রতিদিন। গ্রামের দৃশ্য ছাড়া কবিতা লেখা হয় না। তাই তো শহরের ইট-কাঠের পরিবেশে এক অদ্ভুদ জায়গা কৃত্রিমভাবে তৈরি করে নিয়েছেন। সেখানেই চলতে থাকলো একের পর এক দৃশ্যধারণ…।   ছবি: রাকিবুল হক