Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ভাই-বোনের মধুর গল্প

খান আতাউর রহমান এবং নীলুফার ইয়াসমিন বাংলাদেশের সংগীত জগতের দুই কিংবদন্তি। তাদেরই সুযোগ্য সন্তান হিসেবে শুদ্ধ সংগীতচর্চা করছেন মেয়ে রোমানা ইসলাম এবং ছেলে আগুন। ইতোমধ্যে দুই ভাই-বোন শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের অ্যালবাম। আনন্দ আলোর এবারের মুখোমুখি বিভাগে সংগীত শিল্পী এই দুই ভাই-বোনকে নিয়ে আড্ডায় বসেছিলেন মোহাম্মদ তারেক।

আনন্দ আলো: বোন রোমানা ইসলাম আর ভাই আগুন পরস্পরের কাছে কে কেমন?

রোমানা ইসলাম: ছোটবেলা থেকেই আগুন একটু পাগলা টাইপের। ওর সঙ্গে আমার অনেক মিল আছে। আমি পাগলামি করতে করতেই এ লাইনে চলে আসি। কিন্তু ওর পাগলামিটা রয়েই যায়। অবশ্য ওর ভেতরে এত মেধা আছে যে ওই পাগলামির মধ্যেও সবকিছু বের হয়ে আসে। এটা গানে কিংবা অভিনয়ে বলেন সব কিছুর মধ্যে কিন্তু উজ্জ্বল হয়ে আছে। আব্বার ছাপটা ওর মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি দেখতে পাই।

আগুন: এক বাক্যে আমার বোন মাটির মানুষ। ওর মতো একটা বোন পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের। আমার সঙ্গে ওর কেমিস্ট্রিটা একেবারেই আলাদা। আমার না বলা কথাগুলো, না বলা আবেগগুলো ও সহজেই বুঝে যায়। আমার পাগলামিগুলো ভাই বোনরা সবাই গ্রহণ করে। ও আমাকে একটু বেশি ভালোবাসে বলে আমার  পাগলামিটা মেনে নেয়। এদিক দিয়ে আমি খুব লাকি।

আনন্দ আলো: বোনের শাসন আর ভাইয়ের জ্বালাতন দুই ভাই-বোনের কাছে কেমন?

রোমানা ইসলাম: ওর অনেক জ্বালাতন। ছোট ভাইয়ের জ্বালাতন গুলো ভালোই লাগে। ছোটরা তো সব সময় জ্বালাতন করেই থাকে। বড় বোনের কাছে ছোট ভাইয়ের আবদার, আহ্লাদ এসব তো ছিলই। এখনো আছে। ওর যন্ত্রণাগুলোই বেশি মনে হয় কোনো কষ্টের সময়, কোনো দুঃখের সময়। শাসন, অনুশাসন, ভালোবাসা, রাগ, অনুরাগ, প্রতিটি ব্যাপারেই ওর সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা। একজন বন্ধু যেমন আরেকজন বন্ধুকে বুঝে, ভালোবাসে, ঠিক তেমনি আমাদের মধ্যেও সেই সম্পর্ক।

আগুন: আমার আপা খুবই দায়িত্বশীল ¯েœহময়ী একজন মানুষ । আমরা ছোটবেলা থেকে গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। আমরা পরস্পর দুজন খুবই ভালো বন্ধু। ও খুবই ডমেনেটিং এবং কেয়ারিং। সত্যি কথা বলতে, বোনের যে ভালোবাসা, বোনের যে দায়িত্ব বোধ প্রত্যেকটি জিনিসই যতটুকু থাকা দরকার তার চেয়ে বেশি ওর মধ্যে আছে। ব্যক্তি হিসেবে আপা অসাধারণ একজন মানুষ। তিনি ভালো স্ত্রী, ভালো মা। এবং সর্বোপরি একজন ভালো বোন। ঘর-সংসার এবং গান সবকিছু সমান ভাবে দেখছেন।

আনন্দ আলো: সংগীতে বাবা-মায়ের প্রভাব কতটুকু?

রোমানা ইসলাম: জন্মেছি যে ঘরে সেই প্রভাবটাই তো রক্তেই কথা বলছে। সেটা তো আছেই। সে ক্ষেত্রে বাবা খান আতাউর, মা মাহবুবা রহমান দুজনেরই প্রভাব রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই বাবা হারমোনিয়াম ধরে ধরে গান শিখাতেন। গান গাওয়ার আবেগ এবং অনুভ‚তি বাবার কাছ থেকেই শিখেছি। সম্পূর্ণ ভাবে বাবা মায়ের প্রভাব আছে বলেই আজকে আমি রোমানা ইসলাম।

আগুন: সংগীতে আমার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের প্রভাব অনেক বেশি। ছোটবেলায় দেখতাম মা নীলুফার ইয়াসমিন গান করতেন, রেওয়াজ করতেন। এ বিষয়টি আমাকে অনুপ্রেরণা জোগায়। আমি যা শিখেছি সবই বাবা-মায়ের কাছ থেকে। আমি আজকের আগুন হয়েছি বাবা-মায়ের কারণে। আমি অনেক সৌভাগ্যবান যে আমি তাদের সন্তান। আমাদের ভেতরে বাবা-মায়ের যতটুকু প্রভাব আছে তা মনে হয় কেবল জন্ম সূত্রেই পাওয়া।

আনন্দ আলো: একে অপরের ভালো মন্দ দিকগুলো বলবেন?

রোমানা ইসলাম: আগুন একজন সত্যবাদী মানুষ। মিথ্যা কথা সচরাচর বলে না। মানুষের প্রতি সহানুভ‚তিশীল। একদমই মানুষকে ঠকায় না। ওর ভেতরে টেলেন্ট আছে। ওর মন্দ দিকটা হচ্ছে ও পাগলাটে। ও খুব রেগে যায়। রাগটা কন্ট্রোল থাকে না। অপ্রিয় সত্য কথা মুখের ওপর বলে ফেলে।

আগুন: আপা অসাধারণ একটি মেয়ে। মিশুক প্রকৃতির। সহজেই সবার সঙ্গে মিশতে পারে। মানুষকে অল্পতেই বিশ্বাস করেন। মন্দ দিক বলতে আমার মতো রাগটাও ওর ভেতরে একটু আছে।

আনন্দ আলো: বোনের কাছে ভাইয়ের কোন গানটি আর ভাইয়ের কাছে বোনের কোন গানটি প্রিয়?

রোমানা ইসলাম: আগুনের গানতো আমার কাছে খুবই ভালো লাগে। ওর যে গানের গলা। খোদা প্রদত্ত আওয়াজ। একদম নিজস্বতা আছে। অন্য কারোর সঙ্গে মিলে না ওর গানের গলা। বাবার শেষ ছবিতে আগুন গেয়েছিল ‘ও আমার জন্মভ‚মি’ গানটি। এটি আমার কাছে অসম্ভব ভালো লেগেছিল। এ ছাড়া ওর গাওয়া ‘আমার স্বপ্নগুলো কেন এমন স্বপ্ন হয়’, ‘পৃথিবীতে সুখ বলে, জীবনের সব সুখ, ঝড়ো বেদনা মত গানগুলো আমার ভালো লেগেছে। প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহ্র লিপসিংএ ওর বেশির ভাগ গান আমার প্রিয়।

আগুন: আপার যে কোনো গানই আমার ভীষণ ভালো লাগে। একজন সংগীত শিল্পী হিসেবে আপা অসাধারণ। তার গায়কি আমাকে মুগ্ধ করে। আপার গাওয়া ‘হায়রে আমার মন মাতানো দেশ’, ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে’ গান দুটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। এছাড়া ওর কণ্ঠে ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘তোমার আগুনে পোড়ানো দুটি চোখে’, ‘একি সোনার আলোয়’, ‘ওগো বন্ধু মনে রেখো’, ‘আমার গলার হাড়’, ‘যদি আর দেখা নাই হয়’ গানগুলো অসাধারণ লাগে।

আনন্দ আলো: বাবা-মায়ের কোন গানটি সবসময় আপনাদের হৃদয়ে বেজে ওঠে?

রোমানা ইসলাম: নির্দিষ্ট করে কোনো গানের কথা বলা যাবে না। বাবা মায়ের গাওয়া সব গানই হৃদয়ে বাজে সব সময়।

আগুন: বাবা মায়ের গাওয়া সব গানই আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমাদের দুই ভাই বোনের ইচ্ছা আছে ক্রমান্বয়ে বাবা-মায়ের গাওয়া সবগুলো গানই এভাবে আমরা শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরবো।

আনন্দ আলো: দুই ভাইবোনের একসঙ্গে স্মৃতিময় কোনো ঘটনা?

রোমানা ইসলাম: ৯ ফেব্রæয়ারি আগুনের জন্মদিন। ওই দিনটা আমি যদি রাত ১২টার সময় ফোন না করি ও খুব মন খারাপ করে। আমার জন্মদিনে ও উইশ করুক বা না করুণ সেটা অন্যকথা। তার জন্মদিনে রাত ১২টার সময় আমাকে উইশ করতেই হবে। পরের দিন করলে চলবে না। কোনো একটা সময় ওর জন্মদিনের সময় ১২টা ৮ মিনিট বেজে গেছে আমি ফোন করিনি। ও ১০ মিনিটের মাথায় আমাকে ফোন দিয়ে বলে, ‘তুমি ফোন কর নাই কেন’? তারপর থেকে ওর প্রতি জন্মদিনে রাত ১২টার সময় ওকে উইশ করতে হয়। এরকম অনেক ছোট ছোট ঘটনা আছে।

আগুন: ১৯৯২ সালে আমি প্রথম অ্যালবাম বের করি। অ্যালবামের নাম ছিল ‘রক্ত ভেজাল’। সেখানে আমার জীবনের প্রথম ডুয়েট সিঙ্গার ছিল আপা। গানটি আমার লেখা ও সুর করা। আমাদের ভাইবোনের কাজ প্রথম হয়েছে এটা ভাবতে এখনো ভালো লাগে। সেটা আমার জীবনে সত্যিকার আনন্দের একটা স্মৃতি।

আনন্দ আলো: বাবার গানগুলো নিয়ে অ্যালবাম বের করার পরিকল্পনা আছে কী?

রোমানা ইসলাম: সব সময় বাবার গান করে যাচ্ছি। বাবার গান নিয়ে আমি একটা অ্যালবামও বের করেছিলাম। আগামীতে আমার একটা পরিকল্পনা আছে বাবার কিছু দেশের গান নিয়ে অ্যালবাম করার। বাবার গানগুলো জাতীয় পর্যায়ে আর্কাইভ করে রাখা উচিত।

আগুন: আব্বার গান আমি তেমন একটা করিনি। ইদানিং আপার সঙ্গে বাবার গানগুলো করছি। গান করে দেখি ভালো লাগছে এবং শান্তি পাচ্ছি। এখন ইচ্ছে করছে বাবার গান গুলো করতে। স্টেজে বাবার জনপ্রিয় গানগুলো গাইছি। আব্বার বেশির ভাগ গানগুলো মেয়েদের কণ্ঠে গাওয়া।

আনন্দ আলো: সংগীতাঙ্গনে নতুন যারা আসছেন তাদের নিয়ে আপনাদের প্রত্যাশা কী?

রোমানা ইসলাম: নতুনরা অবশ্যই ভালো গাইছে। তবে একটা বিষয় জানতে হবে সংগীত হচ্ছে গুরুমুখী বিদ্যা। সাধনার জায়গা। উপসনার মতো। শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসাটা যদি ওদের মধ্যে থাকে তাহলে ওরা সংগীতে ভালো করতে পারবে। তা না হলে ¯্রােতে আসবে, আবার ¯্রােতেই ভেসে যাবে।

আগুন: নতুনদের প্রতি আমার পরামর্শ নিয়মিত চর্চা করতে হবে। সাধনা করতে হবে। বড়দেরকে সম্মান করতে হবে। যে কোনো গানই করেন না কেন তা কিন্তু দরদ দিয়ে, মনোযোগ সহকারে করতে হবে। তবে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।

আনন্দ আলো: আপনাদের আগামীর পরিকল্পনা কী?

রোমানা ইসলাম: আমরা দুই ভাই-বোন যতদিন সংগীতের জগতে থাকব ততদিন আমরা কাজ করব। আর একটা বিষয় সর্বদা মেনে চলার চেষ্টা করি তা হচ্ছে শুদ্ধ সংগীত করার। শুদ্ধ সংগীত করার জন্য আত্মাটাও শুদ্ধ হওয়া দরকার। কারণ আত্মার সঙ্গেই জড়িত। আর শুদ্ধ আত্মা থেকে কখনো অশুদ্ধ সংগীত  হতে পারে না।

আগুন: মরণের আগ পর্যন্ত ভালো কিছু গান গেয়ে যেতে চাই। এটা আমার পরিকল্পনা।