সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
আবুল খায়ের লিটু, চেয়ারম্যান, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন
আবুল খায়ের লিটু শিল্পপতি ও উদ্যোক্তা। দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি গভির অনুরাগী ব্যক্তিত্ব ও উদ্যোক্তা হিসেবে সমধিক পরিচিত। গেল ৫ বছর ধরে ঢাকায় বিশে^র অন্যতম বৃহৎ উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবের সফল আয়োজন করে বিশে^র সংগীত প্রিয় মানুষের আগ্রহে পরিণত হয়েছেন আবুল খায়ের লিটু। ২০১৭ সালের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব নিয়ে রাজু আলীম-এর পরিচালনায় চ্যানেল আই এর খোলা আকাশ অনুষ্ঠানে এই উৎসবের নানা দিক তুলে ধরেন তিনি। গ্রন্থনা করেছেন রেযা খান।
আনন্দ আলো: বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব এবার ৬ষ্ঠ বারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এবারের আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাই?
আবুল খায়ের লিটু: এবার বসছে ৬ষ্ঠ আসর। সাধারণত আমরা আর্মি স্টেডিয়ামে এই উৎসবের আয়োজন করে থাকি। এবার বিশেষ কারণে আমরা স্টেডিয়ামের বরাদ্দ আমরা পাইনি। প্রেস কনফারেন্স করে আমরা আয়োজন বাতিল করে দেই। কিন্তু বাতিল করার পরে সংগীত প্রেমী মানুষ এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ আমাদের কাছে ডিমান্ড করা শুরু করলো যে, উৎসবটা করা উচিত। পরিস্থিতি অনুধাবণ করে আমরা চিন্তা করলাম যে, এটি অবশ্যই করা উচিত। তারপরে নতুন করে আমরা চিন্তা করতে থাকলাম কি করা যায়? এই সময়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রী এবং মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী দুইজনই আমাদেরকে খুব সাপোর্ট দিয়েছেন। আবাহনী ক্লাব-এর চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানসহ আমাদের আরও যারা বন্ধু-বান্ধব আছেন বিভিন্ন জায়গায় মন্ত্রী পরিষদে এবং বাইরে থেকে যারা সংগীত শিল্পী আছেন তারা সবাই মিলে চেস্টা করে বিষয়টি একটি জায়গায় নিয়ে এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়। খুশির খবর হলো ডিসেম্বরের ২৬-৩০ তারিখ পর্যন্ত আবাহনী মাঠে ৫ দিনব্যাপী এই উৎসব অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমরা ৬ষ্ঠ বারের মতো আয়োজন করতে যাচ্ছি। এই জন্যে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। মাননীয় অর্থমন্ত্রী এবং সংস্কৃতিমন্ত্রীর কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ আমাদের পাশে থাকার জন্যে। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তি যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদেরকে সাহায্য করেছেন সাপোর্ট করেছেন তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। চ্যানেল আই’কেও অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের সঙ্গে থাকার জন্যে।
আনন্দ আলো: চ্যানেল আই কীভাবে সম্পৃক্ত এই আয়োজনের সঙ্গে?
আবুল খায়ের লিটু: মিডিয়া পার্টনার হিসেবে চ্যানেল আই আমাদের সঙ্গে আছে। চ্যানেল আই-এর সঙ্গে আমাদের এক্সপেরিয়েন্স খুবই ভালো। আমরা লন্ডনের অ্যালবার্ট হলে যে অনুষ্ঠান করেছিলাম তা বøুজ আমাদের আরেকটি প্রতিষ্ঠান কমিউনিকেশন করেছিল। সিঙ্গাপুরে একটি ফেস্টিভ্যাল করলো বøুজ কমিউনিকেশন চার দিনের জন্যে। ওখানেও আমাদের পার্টনার ছিল চ্যানেল আই এবং চ্যানেল আই-এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের।
আনন্দ আলো: অ্যালবার্ট হলে এবং সিঙ্গাপুরের মাঝামাঝি সময়ে সিলেটেও অনুষ্ঠান করেছেন আপনারা। সেখানকার দর্শকরা খুবই উৎসাহিত হয়েছেন?
আবুল খায়ের লিটু: ১০ দিনের একটি বাংলা সংস্কৃতি সম্মেলন করেছি। বাংলার যত দিক আছে- নাটক, গান, সিনেমা সবকিছু নিয়ে। এটি বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের একটি অনুষ্ঠান ছিল বাংলা সংস্কৃতি সম্মেলন। এখানেও চ্যানেল আই আমাদের পার্টনার ছিল।
আনন্দ আলো: বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। আপনাদেও তো একাধিক পাবলিকেশন আছে?
আবুল খায়ের লিটু: প্রতি মাসে ৮টি ম্যাগাজিন প্রকাশ করি আমরা। আমরা সিডি বের করি। নাটকে সহায়তা করি। বই প্রকাশ করি। আমাদের ম্যাগাজিনের ভেতরে আছে- আইসটুডে, কালি ও কলম খুবই নামকরা সাহিত্য পত্রিকা।
আনন্দ আলো: এবার উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবে শুধু প্রাচ্য নয় পাশ্চাত্যের গুরুরাও অংশ নিচ্ছেন?
আবুল খায়ের লিটু: এবার কাজাখাস্থান থেকে একটা দল আসছে। এছাড়া এল সুভ্রামনিয়াম সাহেব যিনি আছেন- ভায়োলনিস্ট। তিনি খুব নাম করা একজন মানুষ ব্রিলিয়ান্ট পারফর্মারও শিক্ষিত একজন মানুষ। তিনি টিমটাকে লীড করবেন। ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল হবে কিছুক্ষণ তারপরে ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিক্যাল বাজাবেন। সবশেষে এল সুভ্রামনিয়াম সাহেব সলো করবেন। এবারে প্রথম ৬৫ জনের একটা দল সিম্ফনি পারফর্ম করবে একটা ওপেন কনসার্টে। দারুণ একটি অভিজ্ঞতা হবে আশা করছি।
আনন্দ আলো: আবাহনীর মাঠ তো আর্মি স্টেডিয়ামের তুলনায় ছোট? ওই রকম আবহ তৈরি করা সম্ভব হবে?
আবুল খায়ের লিটু: আমি বলি আপনাকে, না গেলে বুঝবেন না। আপাত দৃস্টিতে মনে হতে পারে ছোট জায়গা। আসলে কিন্তু ইউজঅ্যাবল স্পেস আর্মি স্টেডিয়ামের তুলনায় এক লক্ষ স্কয়ার ফিট বেশি। আর্মি স্টেডিয়ামে আমরা ইউজ করতাম দুই লক্ষ ষাট হাজার স্কয়ার ফিট আর আবাহনীর মাঠে তিন লক্ষ স্কয়ার ফিট।
আনন্দ আলো: সাউন্ডটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন। ওটা যেমন খোলা ছিল সবাই শুনতে পেতো। এখানে যদি খোলা রাখি- পাশে যে বাড়িগুলো আছে যেখানে বৃদ্ধ অসুস্থ মানুষ আছেন রাতে ঘুমাবেন যারা- তাদের কথা চিন্তা করে কোন ব্যবস্থা করবেন কি?
আবুল খায়ের লিটু: এইটা কিন্তু চ্যালেঞ্জ ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য সবার কনসার্ন ছিল এটি। আমরা একইভােেব কি করতে পারব কি না? আর্মি স্টেডিয়ামে যেভাবে করতাম আমরা? সেখানে কি হতো? গানটা গুলশান পর্যন্ত চলে আসতো। এই বছর আমরা নতুন জিনিস ইন্ট্রডিউস করেছি সেটি হলো নয়েজ ক্যাল। এটি একটি অ্যাপস যেটির মাধ্যমে নয়েজ একটি নির্দিস্ট জায়গার বাইরে যাবে না। ঠিক একটি কার্ভ পয়েন্টে গিয়ে থেমে যাবে। তা ডেমনস্ট্রেট করে আমরা নিরাপত্তা বাহিনীকে দেখিয়েছি যে, মাঠের বাইরে কোন সাউন্ড বাড়িতে বা হাসপাতালে যাবে না। মজার ব্যাপার হলো- অনেক বাড়ি থেকে ডিমান্ড কেন আমরা বাড়িতে বসে এই গান শুনতে পারবো না? ক্ল্যাসিক্যাল গান তো অন্য ধরনের গান। এই গান তো কস্ট দেয় না বা সাউন্ড পলিউশন তৈরি করে না? এই গান মানুষের মনটাকে ভালো করে দেয়। হয়তো বা দুই চার ঘণ্টা শুনলেই মানুষ এটির ভেতরে মগ্ন হয়ে যায়। আমরা করছি খুব কেয়ারফুলি। যাতে করে কোন জায়গা থেকে যাতে কোনো অভিযোগ না আসে।
আনন্দ আলো: এই ধরনের আয়োজনে অনেক টাকার ব্যাপার থাকে। এবার কাদের সহযোগিতা পাচ্ছেন?
আবুল খায়ের লিটু: আমরা আমাদের পার্টনার বদলাইনি কখনো। বরাবরই স্কয়ার আমাদের পার্টনার ছিল। এখনো স্কয়ার আছে এবং যতদিন পর্যন্ত আমরা ক্ল্যাসিক্যাল ফেস্টিভ্যাল করবো আই অ্যাম মোর দ্যান শিওর যে, তাদের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক স্কয়ার সবসময়ই থাকবে। কারণ এখানে পার্টনারশীপের ব্যাপার আছে। আর আছে ব্র্যাক ব্যাংক। এই দুই প্রতিষ্ঠানই আমাদের মেইন স্পন্সর। পাশাপাশি আমাদের আরও কিছু স্পন্সর আছে- বেঙ্গল এক্সপ্রেস, ইনডেক্স , চ্যানেল আই আছে। এই রকম আরও কেউ কেউ আছেন- যারা আমাদেরকে সহায়তা করেন।
আনন্দ আলো: যে কোনো বড় উদ্যোগের পেছনে কাছের বন্ধুরাই সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে…
আবুল খায়ের লিটু: হ্যাঁ- যদি তারা ভাল বন্ধু হন। আমাদের সহযোগিরা প্রত্যেকেই ভালো এবং নামকরা মানুষ। সবারই সমাজে একটা স্ট্যান্ডিং আছে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আবার খুব চুজি। আমাদের পার্টনাররা সবাই খুবই সিলেক্টিভ। আমাদের সঙ্গে অনেক পার্টনার আসতে চান। আমরা নেই না। সবার সঙ্গে যাই না।
আনন্দ আলো: উচ্চাঙ্গ সংগীতের মতো গুরুগম্ভীর বিষয়কে আপনি মাঠে ময়দানে নিয়ে আসলেন কেন?
আবুল খায়ের লিটু: উদ্দেশ্য ছিল একটাই। যে কোনো জিনিস নির্ভর করে হাউ ইউ অ্যাপ্লাই? প্রেজেন্টেশনের উপর নির্ভর করে মানুষ এটাকে কতটুকু গ্রহণ করবে আবার কতটুকু ফেলে দেবে? একই ক্রাউড বিভিন্ন জায়গায় যায় বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে। এই ফেস্টিভ্যালে যারা যায়, এই ৪০/৫০ হাজার মানুষ সারারাত থাকে। এদের যে ব্যবহার, এদের চলাফেরা, এদের আচরণ- ক্ল্যাসিক্যাল গানটাকে এরা আস্তে আস্তে রপ্ত করছে। আমি বলছি না এদের সবাই ক্ল্যাসিক্যাল গানের ভক্ত, আমি বুঝতাম না। কিন্তু আস্তে আস্তে এর ভেতরে ঢুকে গেলে এর যে মর্ম, এটা থেকে কিছু একটা পাচ্ছেন আপনি হয়তো ডিরেক্টলি না, ইনডিরেক্টলি- তা বুঝবার ক্ষমতা প্রতিটি ইয়াং ছেলে মেয়েদেরও আছে।
আনন্দ আলো: আপনি যুবকদেরকেই টার্গেট করলেন?
আবুল খায়ের লিটু: যখন রেজিস্ট্রেশন আরম্ভ করেছিলাম, বিশ হাজার ক্রস করে যাওয়ার পরে আমার এক বন্ধু বললেন, তুমি তো নিশ্চয়ই খুশি? প্রথম বছর কুড়ি হাজারের পর আমরা রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করে দিলাম। আমি তখন ওই ভদ্রলোককে বললাম, দেখেন আমাদের বাংলাদেশের ছেলে মেয়ে আন্ডার এস্টিমেট করেন না। ওরা নিশ্চয়ই শিব কুমার শর্মা, চৌরাশিয়া, রশিদ খান- এদের প্রত্যেকের নাম জানে। তিনি বললেন, দেখো বুঝে শুনে করো, পরে কিন্তু ছেলে মেয়েরা তোমাকে মারবে? পরে অনুষ্ঠানে দেখা গেল মোর দ্যান ২০ থাউজেন্ট মানুষের বেশিরভাগই কিন্তু ইয়াং ছেলে মেয়ে। চৌরাশিয়া এবং অসিত কুমার জী- তারা দুজন তো সারা দুনিয়ায় বলে বেড়ান বাংলাদেশের এই ক্ল্যাসিক্যাল ফেস্টিভ্যালের কথা যে, বিশে^র কোথাও আর এত বড় উৎসব হয় না। এই দেশে যারা গান শোনেন, এত ভদ্র শ্রোতা তিনি নাকি দুনিয়ার আর কোথাও দেখেননি।
আনন্দ আলো: বাংলাদেশের জন্যে এই যে সুনাম সুখ্যাতি পাওয়া এটা গর্বের?
আবুল খায়ের লিটু: ক্ল্যাসিক্যাল গান শোনেন, এত ভালো ভদ্র আচরণ করে অসাধারণ ব্যাপার। চৌরাশিয়া সাহেব যখন বাশি বাজান, রাত সাড়ে তিনটা বাজে তখন। বিশ^াস করবেন কি না জানি না রাত দুটো থেকে, নিজে গেলে দেখবেন, ঢোকা যায় না। গাড়ি আসতেই থাকে, গাড়ি আসতেই থাকে। আর মানুষ হেঁটে হেঁটে আসতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, ব্যাপারটা ফর্চুনেটলি নাকি আনফর্চুনেটলি আমি জানি না, আমাদের এটা ফিফথ এডিশন। চারবার করেছি তার ভেতরে তিনবারই ছিল ফুল হরতাল। এই হরতালে ছেলে মেয়ে, ভদ্রলোক মহিলারা, ভালো ঘরের মানুষ, মিডিল ক্লাস, লোয়ার মিডিল ক্লাস, আমরা অনেকেই সবাই মিলে একসঙ্গে হেঁটে হেঁটে এসেছি, আবার একসঙ্গে হেঁটে হেঁটে বাড়ি চলে গেছি। কেউ বোরিং ফিল করেননি, একদিন নয়, অল ফাইভ ডেজ। এটি অসাধারণ ব্যাপার।