সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
শিশুশিল্পী হিসেবে ‘নতুন সুর’চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আবির্ভাব ঘটে জীবন্ত কিংবদন্তী তুল্য অভিনয় শিল্পী শাবানার। পরে ১৯৬৭ সালে চকোরী চলচ্চিত্রে চিত্রনায়ক নাদিমের বিপরীতে প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। শাবানার প্রকৃত নাম রতœা। চিত্র পরিচালক এহতেশাম ‘চকোরী’ চলচ্চিত্রে তাকে শাবানা নামে তুলে ধরেন। তাঁর পুরো নাম আফরোজা সুলতানা। পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার ডাবুয়া গ্রামে। তিনি ৩৬ বছরের কর্মজীবনে ২৯৯টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ষাট থেকে নব্বই দশকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন এই অভিনেত্রী। ২০০০ সালে রূপালী জগৎ থেকে নিজেকে আড়াল করে ফেলেন। বর্তমানে সপরিবার আমেরিকায় বসবাস করছেন।
চলচ্চিত্রকার এহতেশামের হাত ধরে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় শাবানার। এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’চলচ্চিত্রে তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রে এহতেশামের সহকারী ছিলেন আজিজুর রহমান। তিনি তাকে স্ক্রিপ্ট মুখস্থ, সংলাপ প্রদান, ও ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর তালিম দেন। শিশুশিল্পী হিসেবে তিনি ইবনে মিজান পরিচালিত ‘আবার বনবাসে রূপবান’ (১৯৬৬) এবং পার্শ্বচরিত্রে মুস্তাফিজ পরিচালিত ডাক বাবু (১৯৬৬) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। পরের বছর ১৯৬৭ সালে এহতেশাম পরিচালিত উর্দু চলচ্চিত্র চকোরী’তে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। এই চলচ্চিত্রে পরিচালক এহতেশামই তার ‘রতœা’ নাম বদলে শাবানা রাখেন।
১৯৭০ এর দশকের শুরুতে শাবানা কাজী জহির পরিচালিত মধু মিলন (১৯৭০) ও অবুঝ মন (১৯৭২) এই ২টি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি রাজ্জাকের সঙ্গে জুটি গড়ে তোলেন। ১৯৭০ সালে তিনি শোর লখনভী পরিচালিত উর্দু চলচ্চিত্র চান্দ সুরজ এবং মোস্তাফিজ পরিচালিত একই অঙ্গে এত রূপ ও কাজী মেসবাহউদ্দীন পরিচালিত ছদ্মবেশী ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৭২ সালে তাঁর অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো হলো এস এম শফির ছন্দ হারিয়ে গেল, নাজমুল হুদার চৌধুরী বাড়ি এবং আজিজুর রহমানের সমাধান ও স্বীকৃতি। এই বছর তিনি মাসুদ পারভেজের প্রযোজনায় চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ওরা ১১ জন (১৯৭২) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
পরের বছর তিনি আজিজুর রহমান পরিচালিত অতিথি ও সি বি জামান পরিচালিত ঝড়ের পাখি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৭৭ সালে সিরাজুল ইসলাম ভুঁইয়া পরিচালিত জননী চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার মাধ্যমেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রত্যাখ্যানে রীতি শুরু হয়। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা শাবানা ১৯৭৯ সালে প্রযোজক হিসেবে নতুন পরিচয়ে আবির্ভূত হন। ১৯৭৯ সালে তার স্বামী ওয়াহিদ সাদিককে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন এস এস প্রডাকশন্স এবং নির্মাণ করেন মাটির ঘর চলচ্চিত্র। এটি পরিচালনা করেন আজিজুর রহমান এবং এতে শাবানার বিপরীতে অভিনয় করেন তৎকালীন আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা রাজ্জাক।
আশির দশকে শাবানা বেশ কিছু ব্যবসাসফল ও অসাধারণ চলচ্চিত্র দর্শকদের উপহার দেন। ১৯৮০ সালে আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত সখী তুমি কার এবং আজিজুর রহমান পরিচালিত শেষ উত্তর ও ছুটির ঘণ্টা চলচ্চিত্রগুলো তাকে সুখ্যাতি এনে দেয়। রোমান্টিক-নাট্যধর্মী সখী তুমি কার চলচ্চিত্রে রাজ্জাক ও ফারুকের বিপরীতে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি প্রথমবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
শাবানা ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার যথাক্রমে দুই পয়সার আলতা (১৯৮২), নাজমা (১৯৮৩) ও ভাত দে (১৯৮৪) চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। আমজাদ হোসেন পরিচালিত দুই পয়সার আলতা চলচ্চিত্রে চাচার সংসারে পালিত পিতামাতাহীন এক মেয়ে কুসুম চরিত্রে অভিনয় করেন। সুভাষ দত্ত পরিচালিত নাজমা চলচ্চিত্রে স্বামীর সংসার থেকে নিগৃহীত নাজমা রহমান চরিত্রে অভিনয় করেন। আমজাদ হোসেন পরিচালিত ভাত দে চলচ্চিত্রে দরিদ্র বাউলের কন্যা জরি চরিত্রে অভিনয় করেন। এসময়ে তার অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রসমূহ হলো কামাল আহমেদ পরিচালিত রজনীগন্ধা (১৯৮২), লালু ভুলু (১৯৮৩), ও মা ও ছেলে (১৯৮৫), মতিন রহমান পরিচালিত লাল কাজল (১৯৮২), মমতাজ আলী পরিচালিত নালিশ (১৯৮২), মালেক আফসারী পরিচালিত ঘরের বউ (১৯৮৩), আমজাদ হোসেন পরিচালিত সখিনার যুদ্ধ (১৯৮৪), ও শেখ নজরুল ইসলাম পরিচালিত নতুন পৃথিবী। এছাড়া তিনি হিম্মতওয়ালী (১৯৮৪), বাসেরা (১৯৮৪), ও হালচাল উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
১৯৮৬ সালে শাবানা নায়করাজ রাজ্জাক পরিচালিত চাঁপা ডাঙ্গার বউ, এ জে মিন্টু পরিচালিত অশান্ত বাংলা চলচ্চিত্র এবং প্রমোদ চক্রবর্তী পরিচালিত শত্রæ হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। পরের বছর সুভাষ দত্ত পরিচালিত স্বামী স্ত্রী, দিলীপ বিশ্বাস পরিচালিত অপেক্ষা, বুলবুল আহমেদ পরিচালিত রাজল²ী শ্রীকান্ত, এ জে মিন্টু পরিচালিত লালু মাস্তান, জহিরুল হক পরিচালিত সারেন্ডার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। অপেক্ষা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি পঞ্চমবারের মতো শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৮৯ সালে তিনি মতিন রহমান পরিচালিত রাঙা ভাবী, কামাল আহমেদ পরিচালিত ব্যথার দান, ও এ জে মিন্টু পরিচালিত সত্য মিথ্যা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। রাঙা ভাবী ছবিটি তার নিজের প্রযোজনা সংস্থা থেকে নির্মিত। এতে তার সহশিল্পী ছিলেন আলমগীর ও শিশু শিল্পী তাপ্পু। শাবানা স্বামী পরিত্যক্ত নারী রোকেয়া চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন। ১৯৯০ সালে তিনি আজহারুল ইসলাম খান পরিচালিত মরণের পরে, কামাল আহমেদ পরিচালিত গরীবের বউ ও স্বপন সাহা পরিচালিত ভাই ভাই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। বিয়োগান্তক মরণের পরে চলচ্চিত্রে শাবানা ছয় সন্তানের জননী সাথী চরিত্রে অভিনয় করেন। প্রথমদিকে হাসিখুশি শাবানা হঠাৎ পাল্টে যাওয়া চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন। ১৯৯১ সালে তিনি শিবলি সাদিক পরিচালিত অচেনা, শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত টপ রংবাজ, এ জে মিন্টু পরিচালিত পিতা মাতা সন্তান, কাজী মোরশেদ পরিচালিত সান্ত¦না, শেখ নজরুল ইসলাম পরিচালিত স্ত্রীর পাওনা এবং নজরুল ইসলাম পরিচালিত উর্দু চলচ্চিত্র আন্ধি-এ অভিনয় করেন। শাবানা ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত পুনরায় টানা তিনবার যথাক্রমে রাঙা ভাবী (১৯৮৯), মরণের পরে (১৯৯০) ও অচেনা (১৯৯১) চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন এবং ১৯৯০ সালের গরীবের বউ চলচ্চিত্র প্রযোজনার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র প্রযোজক পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৯০ এর দশকের প্রথম দিকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করলেও শেষের দিকে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। প্রধান চরিত্রে মতিন রহমান পরিচালিত অন্ধ বিশ্বাস (১৯৯২), মালেক আফসারী পরিচালিত ক্ষমা, মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন পরিচালিত ল²ীর সংসার (১৯৯২), কামাল আহমেদ পরিচালিত অবুঝ সন্তান (১৯৯৩), শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ঘাতক (১৯৯৪) ও মাসুদ পারভেজ পরিচালিত ঘরের শত্রæ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার পার্শ্বচরিত্রে অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে ¯েœহ (১৯৯৪), কন্যাদান (১৯৯৫), সত্যের মৃত্যু নাই (১৯৯৬), স্বামী কেন আসামী (১৯৯৭) উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৭ সালে তিনি হঠাৎ করেই অভিনয়ের ইতি টানেন। তার অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র আজিজুর রহমান পরিচালিত ঘরে ঘরে যুদ্ধ ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায়। এরপর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে তার পরিবারের কাছে চলে যান এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
শাবানা ১৯৭৩ সালে ওয়াহিদ সাদিকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ওয়াহিদ সাদিক একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। শাবানার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এস এস প্রডাকশন্সের দেখাশোনা করতেন সাদিক। ১৯৯৭ সালে শাবানা হঠাৎ চলচ্চিত্র-অঙ্গন থেকে বিদায় নেয়ার ঘোষণা দেন এবং ২০০০ সালে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। শাবানা-সাদিক দম্পতির দুই মেয়ে- সুমি ও ঊর্মি এবং এক ছেলে- নাহিন।
শাবানা মোট ১০ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তাঁর অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে আছে ১৯৯১ সালে প্রযোজক সমিতি পুরস্কার, ১৯৮২ ও ১৯৮৭ সালে বাচসাস পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে আর্ট ফোরাম পুরস্কার, ১৯৮৮ সালে আর্ট ফোরাম পুরস্কার, ১৯৮৮ সালে নাট্যসভা পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে কামরুল হাসান পুরস্কার, ১৯৮২ সালে নাট্য নিকেতন পুরস্কার, ১৯৮৫ সালে ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে সায়েন্স ক্লাব পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে কথক একাডেমি পুরস্কার এবং ঐ বছরই জাতীয় যুব সংগঠন পুরস্কার। এছাড়াও শাবানা মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, রুমানিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালসহ আরো বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন।
সন্তানদের পাশে থাকব বলেই প্রবাসে আছি
-শাবানা
জীবন্ত কিংবদন্তি চলচ্চিত্র তারকা শাবানা এখন পরবাসে থাকেন। বহু বছর পর দেশে এসেছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে তার দেখা পাওয়া সত্যি দুষ্কর। এবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে শাবানাকে আজীবন সম্মানা প্রদান করা হবে। তার পরই আবার ফিরে যাবেন পরবাসে। তার এই এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো শুধু আনন্দ আলোর পাঠকদের জন্য।
আনন্দ আলো: একসময় আমাদের চলচ্চিত্রের নির্ভরযোগ্য অভিনেত্রী ছিলেন আপনি। শাবানা এই নামটিই আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ চলচ্চিত্র থেকে উধাও হয়ে গেলেন কেন?
শাবানা: উধাও হইনি। তবে বলতে পারেন নিজেকে একটু সরিয়ে নিয়েছি। অনেকদিন তো চলচ্চিত্রে অভিনয় করলাম। দেশের মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। আমি আজকের শাবানা হয়েছি দর্শকদের অগাধ ভালোবাসার কারণে। আমার বড় মেয়ে যখন বিদেশে পড়তে গেল, তার সঙ্গে একে একে অন্যরাও চলে গেল বিদেশে পড়তে তখন মনে হলো কোথায় যেন একটা শূন্যতা অনুভব করছি। সন্তানরা যখন দেশে ছিল তখন গভীর রাতে শুটিং থেকে ফিরেও তাদের মুখটা দেখে নিতাম। কিন্তু ওরা যখন একে একে বিদেশে চলে গেল তখন মনে হলো সন্তানদের সংস্পর্শ ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। অনেক দিন তো অভিনয় করলাম। এবার সন্তানদেরকে সময় দেয়া দরকার। সে কারণে চলে গেলাম বিদেশে তাদের কাছে।
আনন্দ আলো: হঠাৎ চলে গেলেন আপনার দীর্ঘদিনের চলচ্চিত্র জগৎ থেকে। এই জগৎকে ঘিরে তো আপনার অনেক স্মৃতি আছে। সেই স্মৃতিগুলো কি আপনাকে নাড়া দেয়। প্রিয় মানুষদের কথা কি মনে পড়ে?
শাবানা: আমিতো আগেই বললাম দর্শকদের ভালোবাসার কারণে আমি আজকের শাবানা হয়েছি। চলচ্চিত্র জগতেই তো জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ব্যয় করেছি। কত স্মৃতি, কত ঘটনা। প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্যকে মিস করি। একসময় রাত দিন ২৪ ঘণ্টা চলচ্চিত্রের জন্য বিরতিহীন কাজ করেছি। ফলে চলচ্চিত্রাঙ্গনের মানুষদের সঙ্গেই আমার ২৪ ঘণ্টার চলাফেরা ছিল। আমার ছবির ডাইরেক্টর, আমার ছবির প্রডিউসার সবাইকে আমি মিস করি। প্রিয় সহকর্মীদের কথা মনে পড়লে কখনো কখনো মন উদাস হয়ে যায়।
আনন্দ আলো: তার মানে আপনার দীর্ঘদিনের বিচরণ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রাঙ্গন ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়েছিল?
শাবানা: না, একে ঠিক কষ্ট বলব না। আমি তো জেনেবুঝেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। যখন সন্তানেরা ছিল না তখন সংসারে আমার দায়িত্ব ছিল একধরনের। যখন সন্তানেরা এলো তখন মা হিসেবে আমার দায়িত্বের ধরনটা বদলে গেল। আমি একজন অভিনেত্রী। কিন্তু আমিতো কারও মা, কারও স্ত্রী। কাজেই নিজেকে বদলানো দরকার। সন্তানদের জন্য সময় বের করা দরকার। পবিত্র হজ করলাম। তখন সংসার, সন্তান ও ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে নতুন উপলব্ধির জন্ম হলো। সংসারে সময় দেয়া, সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করাকেই পবিত্র কর্তব্য বলে মনে হলো। মহান সৃষ্টিকর্তা একজন অভিনেত্রী শাবানাকে আজকে যে পজিশনে এনেছেন তার জন্য শুকরিয়া আদায় করতে চাই। আল্লাহর অসীম রহমতে আমি আজকের শাবানা হতে পেরেছি। অভিনয়তো অনেক করলাম। এবার সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই। সন্তানদের পাশে থাকতে চাই। সে কারণে চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।
আনন্দ আলো: সন্তানদের মধ্যে কে কি করছে?
শাবানা: বড় মেয়ে সুমী এমবিএ করেছে। সে গৃহিণী। দ্বিতীয় মেয়ে উর্মি হারবার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছে। ঐ ইউনিভার্সিটিতেই সে শিক্ষকতা করছে। একমাত্র ছেলে নাহিন সাদিক বøমবার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে।
আনন্দ আলো: বিদেশে থাকেন। দেশের চলচ্চিত্রের খোঁজখবর রাখেন? দেশের চলচ্চিত্র দেখেন?
শাবানা: হ্যাঁ সময় পেলেই দেশের চলচ্চিত্রের খোঁজখবর নেই। আজকাল ইউটিউবে তো সারা দুনিয়ার খবর পাওয়া যায়। শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, মাহী, পরীমনি এদের নাম শুনি মাঝেমধ্যে। তাদের নিউজ পড়ি। আমার সময়ে মৌসুমী, শাবনূর, শাবনাজ, পপি এদেরকে পেয়েছিলাম। ওদের খবরও আগ্রহ নিয়ে পড়ি। দেশের প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন ভার্সন থাকায় খবর পেতে সুবিধা হয়।
আনন্দ আলো: দেশে যখন ছিলেন তখন অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাতেন। ঘড়ির কাটা ধরে চলতো জীবনলিপি। বিদেশে তো তারকা পরিচয়ের ব্যস্ততা নাই। সময় কাটে কীভাবে?
শাবানা: তারকা হিসেবে ব্যস্ততা নাই। কিন্তু সংসারের ব্যস্ততাতো আছেই। বিদেশে নিজের কাজ নিজে করতে হয়। সন্তানদের দেখাশোনা করি। নিয়মিত নামাজ পড়ি। আর সময় পেলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের খবর জানার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের কোনো ভালো খবর পেলে সেদিন যেন আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকে না।
আনন্দ আলো: মন খারাপ হয় কখনো?
শাবানা: হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই মন খারাপ হয়। যখন শুনি এফডিসিতে এখন আর আগের মতো শুটিং হয় না, সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন খুব খারাপ লাগে। একসময় কি জমজমাট ছিল এফডিসি। ঈদের ছবি মুক্তি মানেই সর্বত্র উৎসবের আমেজ। এখন নাকি এই সুন্দর পরিবেশ নাই। প্রযোজক, পরিচালক এমনকি শিল্পীরাও নাকি নানা ভাগে বিভক্ত। এসব খবর শুনলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। মন খারাপ হয়ে যায়।
আনন্দ আলো: আমাদের চলচ্চিত্রে যৌথ প্রযোজনা নিয়ে একধরনের অস্থিরতা চলছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?
শাবানা: যৌথ প্রযোজনা খারাপতো কিছু না। এদেশে অতীতেও অন্য দেশের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় অনেক ছবি নির্মিত হয়েছে। যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা আছে। সেটা মেনে ছবি বানালেই তো কোনো সমস্যা থাকে না।
আনন্দ আলো: এফডিসিতে আপনার অভিনয় জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে। গিয়েছিলেন কি এফডিসিতে?
শাবানা: না, যাইনি। যাবার ইচ্ছাও নাই। কারণ আমি যাদের সঙ্গে কাজ করেছি তাদের মধ্যে অনেকে জীবিত নেই। যারা আছেন তারা নাকি আর ছবি বানান না। কাজেই এফডিসিতে কার কাছে যাব? এখন যারা আছে তারা তো আমাকে চিনবে না। হ্যাঁ, একথা সত্য এফডিসিকে ঘিরে আমার অনেক সুখের স্মৃতির পাশাপাশি দুঃখের স্মৃতিও আছে। সেজন্য সেখানে আর যেতে চাই না।
আনন্দ আলো: অভিনয়ে কি আর ফিরবেন না?
শাবানা: না, আপাতত সেই সম্ভাবনা নাই।
আনন্দ আলো: দেশে কতদিন থাকবেন?
শাবানা: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আমাকে ‘লাইফ টাইম এচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ দেয়া হবে। ঐ অনুষ্ঠানের পরই বিদেশের ঠিকানায় ফিরে যাব।
আনন্দ আলো: লাইফ টাইম এচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছেন আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
শাবানা: এটা একজন অভিনেত্রীর জন্য বিরাট সম্মানের। গর্বেরও বটে। এই সম্মান শুধু আমার একার নয়। যারা আমাকে আজকের শাবানা হিসেবে তৈরি করেছেন তাদের সবার সম্মান। আমার বাবা-মায়ের সম্মান। দেশের কোটি কোটি দর্শক যারা আমাকে শাবানা বানিয়েছেন তাদের সম্মান। আমার চলচ্চিত্র পরিবারেরও সম্মান।
আনন্দ আলো: এবার দেশে এসে বিশেষ কোনো স্মৃতির কথা বলবেন? কার কার সঙ্গে দেখা হলো?
শাবানা: ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ স্মৃতি নিয়ে ফিরে যাব এবার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সত্যি অনেক বড় মনের মানুষ। আমাকে সামনে পেয়ে তিনি জড়িয়ে ধরেছেন। তাঁর আন্তরিক ভালোবাসায় সত্যি আমি অভিভূত। এটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতিময় ঘটনা হয়ে থাকবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গন নিয়েও অনেক কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন অচিরেই চলচ্চিত্রে বিদ্যমান সকল সমস্যার সমাধান করা হবে। বিদেশে প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর খবর পড়ি। অনেক আগে একবার এফডিসিতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এবার তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সত্যি অনেক উদার মনের মানুষ। দেশের শিক্ষা সংস্কৃতি বিশেষ করে চলচ্চিত্রের বিকাশ নিয়ে তার ভাবনা-চিন্তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। অনেক কৃতজ্ঞতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি।