Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

স্যার আপনি কি আমাদের নজরুল?

স্যার, আপনাকে চেনা চেনা লাগতেছে… আপনি কি আমাদের কাজী নজরুল ইসলামের কেউ হন? আত্মীয়…? অথবা…?

সিএনজি ড্রাইভারের কথা শুনে আবেগ আপ্লুত হয়ে উঠলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিশেষ করে ‘আমাদের  নজরুল’ কথাটাই তাকে বেশি আবেগ তাড়িত করেছে। এই দেশের মানুষ সত্যি সত্যি তাকে ভালোবাসে। তা নাহলে আমাদের নজরুল বলবে কেন?

সম্পর্কিত

সিএনজি ড্রাইভার মুখ হা করে তাকিয়ে আছে। বিদ্রোহী কবির দিকে অপলক দেখছে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এওকি সম্ভব? হুবহু নজরুল ইসলামের মতো কেউ একজন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা দরকার। আবার একই প্রশ্ন করলো সিএনজি ড্রাইভারÑ স্যার আপনি কি আমাদের নজরুল ইসলামের কেউ হন?

লোকটিকে বাজিয়ে দেখতে চাইলেন বিদ্রোগী কবি। প্রথমে নাম জিজ্ঞেস করলেনÑ কি নাম?

স্যার কি আমার নাম জিগাইতেছেন?

হ্যাঁ তোমার নাম…

মকবুল, মকবুল হোসেন।

লেখাপড়া কতদূর?

ডিগ্রি পাস, জগন্নাথ কলেজ থেকে…

ডিগ্রি পাস অথচ সিএনজি চালাও…

কি করবো স্যার? দ্যাশে তো চাকরি নাই। তাই…

নজরুল ইসলামরে চিনো?

কোন নজরুল?

ঐ যে বলল্যা আমাদের নজরুল, তাকে চিনো?

মকবুল এবার বত্রিশপাটি দাত বের করে হাসলোÑ তাকে এই দেশে কে না চিনে? সে তো আমাদের জাতীয় কবি.

তাকে সামনা সামনি দেখছো?

না, তবে লোকমুখে শুনছি শেষ বয়সে তিনি নাকি বোবা ছিলেন, কথা বলতে পারতেন না।

মকবুলের কথা শুনে একটু যেন বিব্রতবোধ করলেন বিদ্রোহী কবি। তবে সামলে নিয়ে বললেন, তোমার মতো এই দেশে কি সবাই নজরুল ইসলামকে চিনে?

মকবুল ভেবে নিয়ে বলল, সাধারণ মানুষ হয়তো সেইভাবে চিনে না। তবে শিক্ষিতজনেরা চিনে, সম্মান করে… আপনি কি স্যার নজরুল ইসলামের আত্মীয়? আপনার চেহারা এক্কেবারে আমাদের কাজী নজরুল ইসলামের মতো। মানুষটা স্যার সারাজীবন অনেক সংগ্রাম করেছে। রুটির দোকানে চাকরি করেছেন, সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, পত্রিকা বের করতেন। শেষ বয়সে কি যে হইলো জবান বন্ধ হইয়া গেল। আল্লাহর এইটা কেমন বিচার? একটা মেধাবী মানুষের জবান বন্ধ কইর‌্যা দিলেন? চিন্তা কইর‌্যা দেখেন স্যার, আমাদের নজরুল ইসলাম শেষ বয়সে যদি কথা বলতে পারতেন তাইলে মনে হয় আমরা তার কাছ থাইক্যা আরো অনেক কিছু জানতে পারতাম, শিখতে পারতাম। তার বিদ্রোহী কবিতাটা পড়েছেন স্যার? চিন্তা কইর‌্যা দেখেন ঐ সময়ে এই ধরনের কবিতা লেখা যা-তা ব্যাপার নয়।

সিএনজির ভটভট শব্দ থেমে গেছে। মকবুল ড্রাইভার তার ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে দৌড়ে এসে বিদ্রোহী কবির জন্য সিএনজির দরজা খুলে দিল। হাসতে হাসতে আবারও একই প্রশ্ন জানতে চাইলÑ স্যার বললেন না, আপনি কি আমাদের নজরুল ইসলামের কেউ? আপনার মোবাইল নম্বরটা একটু দিবেন?

বিদ্রোহী কবি আমতা আমতা স্বরে বললেন, আমার তো মোবাইল নম্বর নাই।

মকবুল এবার সেলফি তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে বললÑ তাইলে স্যার আপনার সঙ্গে একটা সেলফি তুলি। ফ্যামিলির লোকজনকে দেখাবো… বলেই মোবাইলে সেলফি তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো মকবুল। কিন্তু মোবাইল কাজ করছে না। কেন কাজ করছে না সেটা বিদ্রোহী কবি বুঝতে পারলেও মকবুল তো বুঝতে পারছে না। সে কসরত করেই যাচ্ছে। বিদ্রোহী কবি তাকে

থামিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার মোবাইলে বোধহয় ঝামেলা আছে। পরে যদি কোনো দিন দেখা হয় তাহলে সেলফি তোলা যাবে। তোমার ভাড়া কত হয়েছে বলো…

মকবুল ভাড়ার কথা শুনে আতকে ওটার ভঙ্গি করে বলল, আপনি এইটা কি বললেন স্যারÑ আপনার কাছে ভাড়া নিব? ছিঃ ছিঃ ছিঃ লজ্জা দিলেন স্যার। ভাড়া লাগবে না। বলেই সিএনজি চালিয়ে চলে গেল মকবুল।

বিদ্রোহী কবি ধানমন্ডির কবি ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। নিজের নামে গড়া এই ভবনটি দেখতে চান তিনি। কিন্তু তার আগে চেহারা বদলাতে হবে। নাহলে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হতে পারে। চেহারা বদলে ফেললেন তিনি।

 

গেটের মুখেই হোচট খেলেন বিদ্রোহী কবিÑ কোথায় যাবেন? দারোয়ান কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করলো। কবি বললেন, ভিতরে যাব?

ভিতরে কার কাছে যাবেন?

কারও কাছে না। দেখবো…

দেখবেন, কি দেখবেন?

এইখানে এই ভবনে কি কি হয় দেখবো?

দারোয়ান এবার বাজখাই গলায় বলল, এইখানে দেখার কিছু নাই। সামনের মাসে আসেন। কবির জন্মদিনে গানের অনুষ্ঠান হবে।

এছাড়া কিছু হয় না? জন্মদিন আর মৃত্যু দিন ছাড়া…? কবির প্রশ্ন শুনে দারোয়ান বিরক্ত হয়ে বলল, আরো অনেক কিছু হয়। আপনি কোন বিষয়ে জানতে যান?

এইটাতো কবি ভবন?

হ্যাঁ, আমাদের কবির নামে ভবন। এইখানে কি কি হয়? লাইব্রেরি আছে?

হ্যাঁ।

আমি লাইব্রেরিটা একটু দেখবো?

কার্ড আছে, লাইব্রেরির কার্ড?

না, নেই।

তাহলে তো হবে না। কার্ড ছাড়া লাইব্রেরিতে ঢোকা যাবে না।

বলেই দারোয়ান হঠাৎ সামনের দিকে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। অফিসার টাইপের কেউ একজন গাড়ি থেকে নামছেন। দারোয়ান তাকে স্যালুট দিলেন। ভদ্রলোক গেট পেরিয়ে যাবার সময় কবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি? কার কাছে এসেছেন?

কবি মৃদু হেসে বললেন, কারো কাছে না। আমি কবি ভবন দেখতে এসেছি।

আপনার নাম?

নজরুল ইসলাম।

কি নাম বললেন? নজরুল ইসলাম। আমাদের কবির নামে নাম? বলতে বলতে দারোয়ানের দিকে তাকালেন ভদ্রলোক। বললেন, উনাকে লাইব্রেরিতে নিয়ে যাও। উনি যা দেখতে চায় দেখাও… বলেই গটগট শব্দ তুলে চলে গেলেন ভদ্রলোক।

 

একটা ঘরে গানের রিহার্সেল হচ্ছে। ওস্তাদজী গানের রিহার্সেল করাচ্ছেন। দূরে কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ তাদের একজনের কথা শুনে চমকে উঠলেন বিদ্রোহী কবি…

আপা ভাবতেছি মেয়েকে আধুনিক গান শেখাবো। নজরুল সংগীত কেউ শুনতে চায় না। মহিলার কথা শুনে পাশেই বসা অন্য একজন মহিলা বললেন, তবুও আপা, শেকড় বলে তো একটা কথা আছে। শেকড় ভুলে গেলে তো চলবে না।

দ্বিতীয় মহিলার কথা শুনে প্রথম মহিলা বললেন, কিন্তু আপা আগ্রহ তো ধরে রাখতে পারতেছি না। আমাদের পাশের বাসার সিম্মি আধুনিক গান শিখেছে। মাসে ৩/৪টা টেলিভিশনে অনুষ্ঠান পায়। নাইচ্যা নাইচ্যা গান করে। অথচ আমার চেয়ে বছরেও একবার টিভিতে চান্স পায় না। ফলে সে আগ্রহ ধরে রাখতে পারতেছে না। কি যে করি বুঝতে পারতেছি না। আমার মনে হয় কি আপা…স্কুল, কলেজে নজরুল, রবীন্দ্রনাথের গানের আরো বেশি চর্চা হওয়া দরকার। রেডিও টিভিতে নিয়মিত আরো বেশি বেশি নজরুল রবীন্দ্রনাথের গান প্রচার হওয়া দরকার। তানাহলে লোকজন তো ভুলে যাবে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে…।

 

পার্কে এসে ধপ করে একটা বেঞ্চির উপর বসলেন কবি। অস্থির লাগছে। আজিজ মার্কেটে বইয়ের দোকানে চক্কর দিয়েছেন। পরিস্থিতি ভালো না। নজরুল ইসলামের অনেক বই অধিকাংশ দোকানে নাই। জীবনের প্রথম গদ্য রচনা ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ কোথাও খুঁজে পেলেন না। একটি দোকানে ইচড়ে পাকা তরুণ সেলসম্যান বলল, এসব বই নাকি চলে না।

নজরুল নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলেন, তোমার গানের সংখ্যা ৪ হাজারেরও অধিক। তুমি কি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে কবি?

উত্তরটা পাশেই একদল তরুণের কণ্ঠ থেকে ভেসে এলো। বিকেলের নরম আবহাওয়ায় ওরা আবৃত্তির ক্লাস করতে বসেছে। ঝাঁকড়া চুলের এক তরুণ নেতৃত্ব দিচ্ছে। তার কণ্ঠে ভেসে এলো সেই কালজয়ী কবিতার প্রথম লাইনÑ বল বীর, বল উন্নত মম শীর…

কবি তাদের সঙ্গে মিশে গেলেন।