সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
আফজাল হোসেন
দুপুরের আগে ফোন বেজে ওঠে। ফোনের পর্দায় নাম ভেসে উঠেছে, ফরিদুর রেজা সাগর। সাগর ফোন করে জানতে চায়, ১লা মে থেকে তিন তারিখ পর্যন্ত খুব জরুরি কোনো কাজের ব্যস্ততা রয়েছে কি না? তেমন জরুরি কাজ নেই শুনে জানায়, কলকাতায় যেতে হবে। সাগরের মাথায় কোন পরিকল্পনার উদয় হলে, কি কেন এসব নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না। যখন যেটুকু বলা দরকার ততটুকুই বলে। ১লা মে যাওয়া, পরের দিনটা থাকা এবং তিন তারিখ সকালে ঢাকায় ফিরে আসা। এই পর্যন্ত জানা গেল। কেন যাওয়া তা নিয়ে কথাই হলো না। কথা হলো কলকাতা যাওয়া বিষয় ছাড়িয়ে অন্য দু এক বিষয়ে।
ফোন রাখবার আগে আবার জানানো হয়, তাহলে এক তারিখ কলকাতায়, খেয়াল রেখো। তারপর মনা আর ঈমানকে সঙ্গে নিতে বলায় নিজের মনেই প্রশ্ন ওঠে, ঘটনা কি? সেদিন নয়, দিন চারেক পর জানতে পারি, কলকাতায় পাঠক সমাবেশের একটা বইয়ের দোকান উদ্বোধন হবে। সে অনুষ্ঠানে আমরা অতিথি। এ পর্যন্ত জেনে ভালোই লেগেছিল আমাদের প্রকাশকের, আমাদের দেশের একটা গ্রন্থকেন্দ্র হবে সেখানে, সে শহরের উৎসাহী পাঠকেরা কলকাতার পাঠক সমাবেশ থেকে বাংলাদেশের প্রকাশিত বই কিনতে পারবে। এ ঘটনা বিশেষ, তা জেনে আনন্দ হওয়ারই কথা। একদিনের জন্য কলকাতা যাওয়ার আরেকটা আনন্দের দিক হচ্ছে লম্বা সময় ধরে নিশ্চিন্তে আড্ডা দেয়া যাবে। ঢাকা শহরে যা অসম্ভব কল্পনা।
এয়ারপোর্টে গিয়ে অনেক ঘনিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে দেখা। ক্রমে ক্রমে দেখা গেল ঘনিষ্ঠ মানুষদের সংখ্যা বাড়ছে। এত মানুষ একসঙ্গে হওয়া, অজ¯্র কথা বলাবলি, তারপর সবাই চমকায়। ছত্রিশজন একসঙ্গে কলকাতা যাওয়া হচ্ছে, এ পরিকল্পনা সাগরের। সবাই যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে তখনো কেউ জানে না। জানার আগ্রহ রয়েছে, কিন্তু সকলে একত্রিত হওয়ার আনন্দ ও হই চইয়ের নিচে তা চাপা পড়ে যায়। আকাশে যখন উড়ছে সবাই, হাতে হাতে একটা কাগজ পৌঁছে গেল, তাতে কলকাতা যাওয়ার পর কর্মসূচি লেখা রয়েছে। হোটেলে পৌঁছে যার যার ঘরে ব্যাগ স্যুটকেস রেখে, ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে একত্রিত হতে হবে। তারপর যার যেখানে যাওয়ার যেতে পারে, কিন্তু সাড়ে ছটার মধ্যে হাজির থাকতে হবে সিনেমা হলে। পরিষ্কার হলো, সবাই একসঙ্গে সিনেমা দেখা হবে। কোন সিনেমা কারো মনে সে প্রশ্ন নেই। সবাই জানে, বাহুবলী। যার যেমন বয়সই হোক, জোরে শোরে হল্লা করে ওঠার কথা। উড়ন্ত থাকার কারণে সামান্যে সন্তুষ্ট হতে হলো। এমন বিস্ময় ও আনন্দদায়ক ঘটনা জীবনে কমই ঘটে।
কয়েকটি পরিবার, বন্ধু-বান্ধব একত্রে কলকাতা যাওয়া হচ্ছে বাহুবলী সিনেমা দেখার জন্য। সব বয়সী মিলে সংখ্যায় ৩৬ জন। সবার জানা বাহুবলী সিনেমা সাগরের খুব পছন্দ। তার দ্বিতীয় পর্ব মুক্তি পেতে যাচ্ছে। সে পর্ব আসছে অনেক বিস্ময় আর চমক নিয়ে। সে বিস্ময়, চমক ভাগাভাগি করে সবাইকে নিয়ে উপভোগের ইচ্ছা সাগরের। যে ছবি নিয়ে ভারতবাসীর কৌতুহলের অন্ত নেই। যে ছবির টিকেট পাওয়ার জন্য ভারত এবং ভারতের বাইরে হৈ হৈ কাÐ রৈ রৈ ব্যাপার হচ্ছে, সেই বাহুবলী ঢাকা থেকে উড়ে গিয়ে দেখা হবে। দেখার আনন্দ দ্বিগুণ করতে সাগরের এই পরিকল্পনা।
আমাদের জীবনে এমন ঘটনা না ভোলার মতো, অত্যন্ত আনন্দের হয়ে থাকবে। বিষয়টা নিয়ে ভালো কথা, মন্দ কথা হতে পারে। ভ্রæ কোঁচকানো আলাপ সালাপ, তাও হয়তো হবে। নিজের রুচি অভিরুচি অনুযায়ী যে যেমন মন্তব্যই করুক, আমাদের মন্তব্য হচ্ছে সামর্থ্য থাকলেই মানুষ অনেক কিছু করে না বা করে উঠতে পারে না। আনন্দময় মনে হলেও সে আনন্দ অর্জনের তাগিদ বহু মনে থাকে না। সব মনে কৌত‚হল থাকে, সে কৌত‚হল টান মেরে এতজনকে একসঙ্গে এমন আনন্দে সামিল করায় না। মানুষের মনে ইচ্ছা জাগবে, সে ইচ্ছা পূরণের ইচ্ছা সকল মনে বিশেষভাবে জেগে ওঠে না বলে ইচ্ছা অপূর্ণই রয়ে যায়।
অনেকটা বয়স অতিক্রম করে এসে, যখন এদিক সেদিকে দেখি, মানুষে মানুষে সম্পর্ক এখন স্বার্থ ও সুবিধার অঙ্কে ভরপুর। প্রায় সবাই এখন সম্পর্কের অন্দরে আবেগের জায়গা কমিয়ে হিসাব নিকাশের জায়গা বাড়িয়ে তোলায় ব্যস্ত। সংবেদনশীলতা কমিয়ে হৃদয়ে পোক্তভাবে ভান ভনিতার বাড়ি তৈরির জন্য সাগ্রহে জায়গা ছাড়তে প্রস্তুত। এরকম সময়ে দল বেঁধে সিনেমা দেখতে যাওয়ার মতো ছেলেমানুষি আনন্দের সাধ পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে জাগে, তা পরম সৌভাগ্যের।
আলাদা আলাদাভাবে সবারই কলকাতা এসে রথ দেখা ও কলা বেচা হয়, হয়েছে বহুবার। এবারই প্রথম সবাই মিলে আসা হয়েছে শুধুই রথ দেখতে। বাহুবলী তো রথ দেখার মতোই। কলকাতায় অনেককে বলতে শুনেছি, কোথাও কোথাও পড়েছিও, ছবিটা নিয়ে মানুষের বাড়াবাড়ি একটু বেশি রকমের। জেনেছি, বাহুবলী একসঙ্গে নয় হাজার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। এত অধিকসংখ্যক প্রেক্ষাগৃহে আগে কখনো কোনো ছবিই মুক্তি পায়নি। তাই যদি হবে মানুষের আগ্রহ বাড়াবাড়ি রকমেরতো হতেই পারে। মুক্তি পাবার সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা দেখবার জন্য রেকর্ড সংখ্যক মানুষ অগ্রিম টিকেট কেটেছে। একটা পত্রিকা লিখেছে, আমেরিকাতে এই প্রথম একটা ভারতীয় ছবি একসঙ্গে এক হাজার চারশত প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে। জানা হয়, দুই শত কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত বাহুবলী ভারতের বাইরে সারা বিশ্বের এগারো শত সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে এবং আগ্রহ সৃষ্টি করার মতো ঘটনার পর ঘটনার জন্ম দিয়েই চলেছে। দু’একটা খবর কানে পৌঁছালে বাহুবলী বিষয়ে কৌত‚হল জাগবারই কথা।
অনেকে বলতে পারেন বাহুবলী এত মাতামাতি করার মতো ছবি নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মাতামাতি হচ্ছে। কলকাতার সব সিনেমা হলে একটা ছবিই চলছে, বাহুবলী। বাহুবলীর দ্বিতীয় পর্ব দেখার জন্য হুড়মুড়িয়ে হলের দিকে ছুটছে দর্শক। ভালো মন্দ সব রকমের বলাবলি চলছে বাহুবলী নিয়ে। এ বলাবলি সাধারণ নয়, বিশেষ। বলাবলি চলছে, চলতে থাকবে অনেকদিন। বিশেষজ্ঞরা ধারণা দিয়েছে এ সিনেমা একহাজার কোটি টাকার ব্যবসা করবে। ভারতের সিনেমা বাণিজ্য আরো উঁচু লক্ষ্যে পৌঁছে গেল।
মুহূর্তে মুহূর্তে বিস্ময় সৃষ্টির চেষ্টাকে আমরা সমীহ করেছি। দোষ ত্রæটি থাকুক, তা আমাদের হয়রান করেনি। ছবি দেখে ঠকে গেলাম না জিতে গেলাম এসব নিয়ে মাথা ঘামানো অবান্তর। অবাক হয়েছে সবাই। সবারই মনে হয়েছে, মানুষের সাধ্য রয়েছে, সামর্থ্য সীমাহীন, শুধু সাধ থাকলেই হয়।
মানুষ দলে দলে সিনেমা হলের দিকে ছুটছে ‘কাটাপ্পা বাহুবলীকে কেন মারলো’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। সে ছোটা থামছে না। তা নিয়ে লেখালিখি হচ্ছে বিস্তর এবং বিচিত্র রকম। অধিকাংশকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেবার মতো কাÐ বাহুবলী ঘটাতে পেরেছে। জানা গেল ভারতের কোনো প্রদেশে নিয়মিত চারটির বদলে আটটি প্রদর্শনীর অনুমতি দেয়া হয়েছে। দুই ঘণ্টা সাতচল্লিশ মিনিট দৈর্ঘ্যরে বাহুবলীর নির্মাতা এস এস রাজামৌলি। যে যত কথাই বলুক, রাজামৌলি সবচেয়ে বড় স্বপ্নটা সহজে দেখতে পারেন। সেই স্বপ্ন দেখাতে সবাইকে জড়ো করতেও পারবেন। এমন আত্মবিশ্বাস ছিল বলেই বিশেষ হয়ে উঠেছে বাহুবলী। প্রবল বাহুবলী জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে, হয়ে চলেছে মানুষ।
বলতে দ্বিধা নেই, আমাদেরও সে জ্বরে আক্রান্ত হতে হয়েছে। সাগর বাহুবলী জ্বর এবং বাহুবলী স্বপ্ন উভয়েই আক্রান্ত। প্রথম বাহুবলী দেখার পর থেকে সে ছবির বিস্ময়কর জায়গাগুলো যখনই সময় পায়, দেখেছে আর ভেবেছে- এরকম একটা স্বপ্ন তো আমরাও দেখতে পারি।
বাহুবলীর ভিডিও ঢাকায় এলে অনেকের মুখে ছবিটার কথা শুনেছিলাম, দেখা হয়ে ওঠেনি। পত্রিকায়, এখানে ওখানে বাহুবলীর পোশাক-আশাক দেখে অনুমান করে নিয়েছি রাজারাজড়ার গল্প, দেখার আগ্রহ জাগেনি। বন্ধু ফরিদুর রেজা সাগর একদিন অতি আনন্দে, উত্তেজনায় জিজ্ঞাসা করে বাহুবলি দেখেছি কি না। উত্তরে না শুনে তুমুল উৎসাহে নিজের ফোনে ধরে রাখা বাহুবলির একটা গান দেখায়। অসামান্য প্রকৃতি, অবিশ্রাম ঝর্না জলরাশি, মোহিত হওয়ার মতো চিন্তা শক্তি, মুগ্ধ হওয়ার মতো চিত্রায়ণ তার মধ্যে নায়ক নায়িকার অভিনয় দেখে বাক্যহারা হতেই হয়। তারপর থেকে যে বন্ধুর সঙ্গেই দেখা হয় সবার কাছে সাগরের সেই গান দেখানোর গল্প শুনি। চল্লিশ বছর ধরে সাগরকে জানি, আমাদের আর ওর আনন্দ, উত্তেজনার প্রকাশ এক নয়। বাহুবলী বা ওই গান কাছেরজনদের দেখানোয় তার আনন্দ বা ছবি বিষয়ে আলাপের আগ্রহে নয়, এমন সিনেমা বা গানের কল্পনা মানুষ করতে পারে এবং তার বাস্তবায়ন সম্ভব ভেবেই সাগরের আনন্দ। সবাইকে নিয়ে উপভোগ করতে পারলে এরকম আনন্দ সম্পূর্ণ হয় তার।
যুবকবেলায় পাঁচ সাতজন একত্রে ছবি দেখা হয়েছে বহুবার। এইবেলায় এসে বড় ছোট মাঝারি মিলে ছত্রিশজন একসঙ্গে সিনেমা উপভোগ অবিস্মরণীয় ঘটনাই। বাহুবলী শুধু সিনেমা দেখা নয়, মনে করিয়ে দিয়েছে বেঁচে থাকা বড় কথা নয় বড় বড় স্বপ্ন দেখতে হয়। বড় স্বপ্ন মানে বড় করে বেঁচে থাকা। বড় স্বপ্ন মানে জীবনে নতুন সম্ভাবনা, অনুপ্রেরণা। রোজ ক্ষুদ্র চর্চায় যে আনন্দলাভ হয় তা আসলে সত্য নয়, ঘোর। এই ঘোরের চক্কর থেকে বের না হতে পারলে অর্থবহ জীবনলাভ হয় না, হবে না। আমাদের এত রূপকথার গল্প, সব পড়ে আছে অন্ধকারে। বাহুবলী সাগরের মধ্যে একটা স্বপ্ন তৈরি করে দিয়েছে। এমন ধরনের সিনেমা তো আমাদের দেশেও হতে পারে। যারা সাগরকে চেনে, সবারই জানা দেশের জন্য প্রথম এবং নতুন কিছু করার ইচ্ছা তার মনে যদি জাগে সে ইচ্ছা সাগর অপূর্ণ রাখে না। বাহুবলী স্বপ্নে আমাদের যদি জাগরণ ঘটে, তা সমগ্র জাতির ধ্যান ধারণা ও সংস্কৃতিকে পাল্টে দিতে পারে। সিনেমাকে আমরা ভালো চোখে দেখতে শিখিনি, সে দোষ সিনেমার নয়। আমাদের অসচেতনতা, ব্যর্থতা। আমরা গায়ের বল, বাহুর বল, গলার বল নিত্য হজম করে চলেছি। বাহুবলী চিন্তার বল, অসাধারণ। মনের বল, চিন্তার বলে বলীয়ান হতে পারলে বাহুবলী এ ভূমিতেও ঘটতে পারে। স্থির বিশ্বাস, ঘটবেও।