Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

দেশের অর্থনীতি যত মজবুত হবে উন্নয়নও তত দ্রুত হবে

-ইফতেখার আহমেদ টিপু, চয়ারম্যান, ইফাদ গ্র ‍ুপ

বাংলাদেশে শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে আলোচিত নাম ইফতেখার আহমেদ টিপু। এই দেশের অটোমোবাইল শিল্পের তিনি অন্যতম একজন রূপকার। তারই আন্তরিক উদ্যোগে বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ ভ্যানসহ ভারি যানবাহন। অ্যাসেম্বিলিং প্ল্যান্ট তৈরি করে ইফাদ গ্রæপ দেশেই ভারি যানবাহন তৈরির ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করেছে। সকল উদ্যোগের নেতৃত্ব রয়েছেন ইফতেখার আহমেদ টিপু। ব্যক্তি জীবনে তিন সন্তানের জনক। তিনি একজন লেখক ও কলামিস্ট। নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লেখেন। তার লেখালেখির বিষয় দেশ, উন্নয়ন, শিল্পায়ন, বিনিয়োগ, নদনদীর ব্যবহার ও অর্থনীতির সম্ভাবনা। এই পর্যন্ত উন্নয়ন বিষয়ে ছয়টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। চলতি বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার নতুন বই ‘সময়ের চালচিত্র’। সম্প্রতি এই উন্নয়ন উদ্যোক্তা দেশের শিল্পায়ন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে নিজের মতামত তুলে ধরেন। লিখেছেন রাজু আলীম
আনন্দ আলো: শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য ও উন্নয়ন ধারায় সরকারের উদারনীতির ফলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি দ্রæত বৃদ্ধি হচ্ছেÑ এই বিষয়ে আপনার বিশ্লেষণ জানতে চাই?
ইফতেখার আহমেদ টিপু: সবচেয়ে আগে ভাবতে, বলতে এবং বুঝতে হবে ‘দিস ইজ নো মোর ও এ পিলিট্রিক্যাল ওয়ার্ল্ড’। এটি আগে ছিল এখন সেই যুগ শেষ। এখন হলো অর্থনীতির যুগ। যে দেশের অর্থনীতি যত মজবুত হবে সেই দেশের উন্নয়ন তত দ্রæত হবে। সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সবাই জানেন। একটা কথা মনে রাখা দরকার বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরের উদ্যোক্তা যারা, তারা তো টাকার বস্তা নিয়ে আসেননি। আমরা নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে, বিনিয়োগ করে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তারপরে বিনিয়োগ করি। কোন সাহসে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করবো এই প্রশ্ন জাগতে পারে। ব্যাংকের টাকা নিয়ে লাভসহ ফেরত দিতে হবে, আমাকেও ব্যবসায় লাভ করতে হবে। সবকিছু করে চালাতে হবে। এইসব করতে গেলে কয়েকটি জিনিস আমার প্রয়োজন। একটা হলোÑ আইনের শাসন থাকতে হবে দেশে, কথায় কথায় হরতাল দিয়ে দেশকে অচল করলে চলবে না, বিদ্যুতের যোগান থাকতে হবে, গ্যাস সরবরাহ থাকতে হবে। এইসব ঠিকমত পেলেই তখন একজন উদ্যোক্তা সাহস পাবেন বিনিয়োগ করতে। আর তখনই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে রপ্তানি করে ব্যাংকের ঋণ শোধ করেলাভ করতে পারবে। এটা করা গেলেই কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারবে এই দেশ তো শিল্পায়নের দিকে যাচ্ছে। তখন তারাও আসবে এদেশে বিনিয়োগ নিয়ে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগেই খবর নেয় এই দেশের বিনিয়োগকারীরা কি ধরনের বিনিয়োগ এখানে করছে। কত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ এখানে করছে তার খবর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নেন। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের চিত্রটাই বিদেশিরা দেখে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, প্রডাকশনে যাওয়া এবং তা সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে পরে বিদেশে রপ্তানি করা। এই ক্ষেত্রে সন্তোষজনক অবস্থায় আমরা এখনো পুরোপুরি যেতে পারিনি। আস্তে আস্তে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশিরা কিন্তু খেয়াল করে স্থানীয় কর্মসংস্থান কি হচ্ছে? এইসব করতে পারলে দেশের সবাই ভালো থাকবে।
আনন্দ আলো: আপনাদের বিনিয়োগের কি খবর?
ইফতেখার আহমেদ টিপু: আমরা বর্তমানে বিনিয়োগ করেছি বাংলাদেশে প্রথম বাস ট্রাক ভারি যানবাহন অ্যাসেম্বিলিং প্ল্যান্ট পরিপূর্ণ তৈরি করেছি। ১৯৮৫ সালে আমরা ভারত থেকে চেসিস নিয়ে আসতাম। পুরো গাড়ি আমদানি করতাম, এখানে নিয়ে আসতাম। কিন্তু এতে করে তো দেশের কোনো উন্নতি হলো না। এরপরে আমরা অ্যাসেম্বেলিং করা শুরু করলাম, পুরো বডি এখন দেশে তৈরি হচ্ছে। এতে করে সাহায্যকারী যেসব শিল্প গড়ে উঠছে তাদের সাহায্য করবো আমরা। যেমন ওরা পেইন্ট করে। ওদের পেইন্ট আমরা করবো। আর আমদানি করতে হবে না। যারা রেক্সিন করে স্থানীয়ভাবে তাদের জন্য ফোম আছে। এদের কারখানাগুলো আমরা চালিয়ে রাখবো এবং এদের ব্যবসাও যখন বাড়বে তখন অবশ্যই নিচের দিকেও আস্তে আস্তে ব্যবসা বাড়বে। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে আমরা যত উন্নতি করতে পারতো তত আমাদের উন্নতি হবে।
আনন্দ আলো: অ্যাসেম্বেলিংয়ের সঙ্গে আরও ছোট ছোট ব্যবসা সেগুলোও জড়িত? চূড়ান্তভাবে পুরো শিল্পকেই বিকশিত করছে?
ইফতেখার আহমেদ টিপু: এক্ষেত্রে সরকার আপ্রাণ সমর্থন দিচ্ছে। শুধু সরকার একা করলে চলবে না। দুনিয়ার সব জায়গায়ই সরকারি মালিকানায় কারখানা হয় কম। বেসরকারি খাতকেই বেশি করতে হয়। তাই সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। আমরা করবো, সরকার আমাদেরকে সাহায্য করবে।
আনন্দ আলো: সরকার অবকাঠামো তৈরি করে দেবে, আর বেসরকারি উদ্যোগ থেকে বিনিয়োগ না আসলে কাজ কঠিন হয়ে যায় এইতো?
ইফতেখার আহমেদ টিপু: হ্যাঁ এব্যাপারে আমি কিছু বলব, না বললে খুবই অন্যায় হবে। কারখানা করেছি আশুলিয়ায়। ধামরাইয়ে আরেকটা। আমরা গ্যাস পেয়েছি, একটু কষ্ট হয়েছিল কিন্তু পেয়েছি। বিদ্যুৎ পেয়েছিÑ রাস্তা, যা যা প্রয়োজন সবই পেয়েছি। এই কারণেই আমরা সাহস করেছি। আমাদের যারা বিনিয়োগকারী আছেন তাদেরকে এবং ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছি যে, দেখেন আমরা এইখানে কারখানা স্থাপন করতে যাচ্ছি। যেদিন থেকে ফাউন্ডেশন করি সেদিন থেকেই সবাইকে দেখিয়েছি। উদ্বোধনের দিন অবিশ্বাস্যভাবে ঢাকা থেকে এত মানুষ গেছেন, এতদূরে ধামরাইতে। প্ল্যান্ট দেখে ভারত থেকে এনডি টিভি এসেছিল। ডেইলি পত্রিকা এবং টেলিভিশনেও সারাদিন প্রচার করেছে সংবাদ।
আনন্দ আলো: ইন্ডিয়া টাইমসের সংবাদে এসেছে বাংলাদেশে আপনাদের অ্যাসেম্বেলিং প্ল্যান্টের খবর।
ইফতেখার আহমেদ টিপু: ম্যানুফ্রাকচারিং অনেকে না বুঝেই বলেন, কেন হচ্ছে না? এটি খুবই কৌশলের ব্যাপার। একটা ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে চারজন বা দুইজন লোক। কিন্তু একটা বাসে চড়ে বায়ান্নজন। আরো দশ পনের জন দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ির যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে বসানো না হলে তো দুর্ঘটনা ঘটবে। চিন্তা-ভাবনা করে দেখে শুনে বুঝে, খুবই ধীরে ধীরে আমরা এতদূর এসেছি। ইনশাআল্লাহ খুব দ্রæতই আমরা অনেক কিছু ম্যানুফ্রাকচারিং এ চলে যাব।
আনন্দ আলো: তরুণরাই এই দেশের ভবিষ্যৎ। ইফাদ গ্রæপ খুব দ্রæততম সময়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। এটি কীভাবে সম্ভব হলো?
ইফতেখার আহমেদ টিপু: যখনি আপনি কোনো বিনিয়োগে যাবেন বা কোনো কিছু বাজারজাত করবেন, প্রথমে নিজের অন্তর সাফ করতে হবে যে, আমি নিজেও ভালো খাব অন্যকেও ভালো খাওয়াব। ভেজাল মেশাবো না আমরা এটা প্রতিজ্ঞা করেছি। যদি প্রয়োজন হয়, আমি উৎপাদন বন্ধ করে দেব কিন্তু ভেজাল দ্রব্য উৎপাদন করবো না। আমরা আমেরিকায় ছিলাম, কিছু মানুষ এসে বলল, আমরা ইফাদের বিস্কুট খেয়েছি, চিপস খেয়েছি খুব ভালো। আমরা এগুলো আনতে চাই। ঠিক আছে আপনারা আবেদন করেন, আমি বললাম। তাদেরকে এখন মাল পাঠাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। ঢাকা শহরে পর্যাপ্ত মাল দিতে পারছি না আমরা। বর্তমানে আল্লাহর রহমতে ত্রিশটি দেশে ইফাদের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। আর মানের দিক দিয়ে আমরা সব সময়ই সেরা।
আনন্দ আলো: ভবিষ্যতে ইফাদ গ্রæপ এর আর নতুন নতুন কি প্রকল্প আসছে?
ইফতেখার আহমেদ টিপু: এবিষয়ে কিছু বলার আগে একটা জরুরি কথা বলতে চাই। আমরা মুষ্টিমেয় কয়জন মিলে যদি কারখানা করি খুব ভালো খাচ্ছি, ঘুরছি তাহলে তো দেশের সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের ভাবতে হবে পুরো বাংলাদেশকে নিয়ে। প্রতি ধাপে যে যেই জায়গায় কাজ করে তাকে সেই জায়গায় সুযোগ দিতে হবে, মূল্যায়ন করতে হবে। যেমন আমার একটা লেখায় লিখেছি দেশ বাঁচাও, কৃষক বাঁচাও। আজকে কৃষক যদি তার ন্যায্য মূল্য পায়, কৃষক যদি তার ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করাতে পারে, খাওয়া দাওয়া দিতে পারে তাহলে ভবিষ্যতে কিন্তু কৃষকের সন্তান কৃষকই হবে। আমি আপনি গিয়ে পারবো না। আমরা জানিই না কীভাবে কৃষিকাজ করতে হয়। কৃষকের সন্তান যেন তার বাবার কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়। এটা হলে আমাদের জন্য তা আত্মঘাতী হবে।
আনন্দ আলো: আপনার সন্তানেরা কীভাবে ইফাদ গ্রæপ-এর উন্নতিতে ভূমিকা রাখছে?
ইফতেখার আহমেদ টিপু: এটা খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার তবুও বলছি। আমার তিন সন্তান। তিনজনই আমেরিকায় লেখাপড়া করেছে। যেদিন ওদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়েছে সেদিনই আমি তাদের বলেছি দেখো বাবা, কারা বিদেশে এসে পড়ে থাকবে খুবই ব্যক্তিগত যাদের দেশে কিছু করার নাই। তোমাদের জন্য সওয়াবের কাজ আছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে ৭ হাজার কর্মচারী আছে। এদের পরিবার আছে, এদেরকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে, ন্যায়ের পথে থেকে কাজ করে কর্মসংস্থান বাড়াতে পারলে তোমরা অনেক সওয়াব কামাই করবে।। আমরা কনজ্যুমার আইটেমে ধীরে ধীরে প্রায় সাতাশটা আইটেমে চলে গেছি। আমরা গাড়ি সংক্রান্ত লাইনে আছি, এই লাইনে আরো অনেক কাজ করবো।