Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

বিনোদন একেকজনের কাছে একেকরকম

সৈয়দ ইকবাল: তিনজনের তিন রকম স্বপ্ন। তাই তিন জনের ভাবনার জগৎটাও আলাদা। চিন্তা-ভাবনায় একেকজনের চেয়ে আরেকজন একেবারেই ভিন্ন। তারপরও তিনজনের এক জায়গায় মিল রয়েছে তা হলো এই জগৎ সংসার থেকে হারিয়ে যাওয়া। সংসারের নানান ঝামেলা কিংবা কষ্ট তাদের সহ্য হয় না। তাই তো তারা বেরিয়ে পড়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। এমন জায়গা তারা খুঁজে বের করেন যেখানে তারা কাউকে চিনবেন না আবার তাদেরকেও কেউ চিনেন না। একের পর এক ঘটনা তাদের জীবনে আসতে থাকে। চাইলেই তো আর জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়। এক জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া মানে আরেক জীবনে প্রবেশ করা। তেমনি গল্পের নাটক ‘তিন পাগলের হলো মেলা’।

চ্যানেল আইতে শুরু হওয়া এই আলোচিত ধারাবাহিক নাটকটি পরিচালনা করেছেন জনপ্রিয় অভিনেতা-নির্মাতা আবুল হায়াত। এর আগে এই নির্মাতা ‘আকাশের ওপারে আকাশ’ শিরোনামের একটি ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ করেছিলেন। এরপর থেকেই নতুন নাটক নিয়ে ভাবছিলেন তিনি। নাটকের গল্পটি লিখছেনও তিনি। নাটকটিতে তিন পাগলের চরিত্রে অভিনয় করছেন আগুন, সাজু খাদেম ও শতাব্দী ওয়াদুদ। স¤প্রতি মানিকগঞ্জে নাটকটির প্রথম লটের শুটিং শেষ হয়েছে। ৫২ পর্বের এই নাটকটির বেশ কয়েকটি পর্ব প্রচার হয় চ্যানেল আইতে।

তিনজন ছন্নছাড়া মানুষ নতুন একটি পৃথিবী দেখার স্বপ্ন দেখে। তাদের যাপিত জীবনের সংগ্রাম নিয়েই এগিয়ে যায় ধারাবাহিকটির গল্প। আগুন একজন বাউল হতে চান। তাই তো তার জীবনটাকে একজন বাউলের মতো করে চিন্তা করতে থাকে। খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে সবকিছুতেই তার সন্ন্যাসী ভাব। অন্যদিকে সাজু খাদেম খুব অলস প্রকৃতির। কোনো কিছুতেই তার মন বসে না। কিছুই করতে ইচ্ছে করে না তার। কিন্তু জীবন নিয়ে তার কিছু নীতিগত গুণ আছে। জীবন নিয়ে তার ভাবনার জায়গাটা অন্য জায়গায়। অন্য দশজন যেভাবে চিন্তা করতে পারে তা থেকে একেবারেই আলাদা চিন্তা করে সে।

আর শতাব্দী ওয়াদুদ একজন হতাশাগ্রস্ত চলচ্চিত্র পরিচালক। অনেক যোগ্যতা থাকার পরও একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ কতে পারে না। নিজের যোগ্যতাটুকু প্রমাণও করতে পারল না সে। তাই তো জীবন নিয়ে বেশ হতাশাগ্রস্ত। এই তিন ছন্নছাড়া একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় তারা লোকালয় ছেড়ে দূর কোথাও চলে যাবে যেখানে সবকিছু সুন্দর। নাটকটি আবুল হায়াত রচনা ও পরিচালনা করার পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ও করেন। তিনি দেশে ফেরা একজন মুক্তিযোদ্ধা। এক সময় হতাশ হয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেলেও তিনি চান দেশের মাটিতেই যেন তার মৃত্যু হয়। একেবারেই অন্যরকম একটি গল্প নিয়ে ‘তিন পাগলের হলো মেলা’ ধারাবাহিকটি এগিয়ে যায়।

‘তিন পাগলের হলো মেলা’ ধারাবাহিকটি নিয়ে অভিনেতা-নির্মাতা আবুল হায়াত কথা বলেছেন আনন্দ আলোর সঙ্গে। তারই চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো-

আনন্দ আলো: এমন কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করার পেছনের গল্পটা বলবেন-

আবুল হায়াত: এটা একটা ভিন্ন ট্র্যাকের গল্প। এখনকার সময়ে নির্মিতব্য নাটকগুলো থেকে একেবারেই ভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্পটা বলার চেষ্টা করছি। এমন বিষয় নিয়ে নাটক নির্মাণের ইচ্ছা আমার অনেক আগে থেকেই ছিল। ‘তিন পাগলের হলো মেলা’… শিরোনামের গানটি আমার খুবই প্রিয়। আমাকে সবসময়ই এই গানটি ভাবাতো। এই গানটি চিন্তায় এলেই তিনজন মানুষের চেহারা আমার সামনে ভেসে ওঠে। যারা এই সমাজ ব্যবস্থায় এবং এত অস্থির সময়েও ভালো কিছু স্বপ্ন দেখেন। সত্যের সন্ধানে বের হওয়া তিনজন মানুষ অন্যদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে। তিনজনের চিন্তা-ভাবনা একই। তবে তিনজন তিন জায়গা থেকে আসা। তিনজনের আবার একটি জায়গায় মিল আছে- তা হলো তিনজনই এতিম। এখনো এই সমাজে কিছু মানুষ আছেন যারা ভালো কিছু চিন্তা করতে পারেন। যাঁরা নিজেদের নীতি-নৈতিকতা দিয়ে এই সমাজ বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখেন। সেই চিন্তা-ভাবনা থেকেই আমার এই নাটকটি নির্মাণ করা। এই নাটকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গল্প শুরু হয়। একটার পর একটা সমস্যার মুখোমুখি হয় তিনজন। তারাই তাদের সমস্যার সমাধান করতে থাকে।

আনন্দ আলো: নাটকটি দর্শকদের কতটুকু বিনোদিত করবেন বলে মনে করেন?

আবুল হায়াত: দেখুন, বিনোদন তো একেকজনের কাছে একেক রকম। এখন তো সব হৈচৈ আর প্রেমের গল্প দিয়ে নাটকগুলো ভরপুর থাকে। জোর করে হাসানোর নাটকও রয়েছে। আমি যখন থেকেই অভিনয়ের পাশাপাশি নির্মাণে এসেছি তখন থেকেই একটা বিষয় মাথায় রেখেছি তা হলো সমাজের ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা সমাজের অবক্ষয়গুলো আমার লেখনী এবং নির্মাণের মাধ্যমে তুলে ধরা। তাই এই নাটকটিও সমাজের নীতি-নৈতিকতা এবং সত্যের সন্ধানের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছি। এখনো যে কোটি মানুষের মধ্যে কিছু মানুষ আছেন যারা খারাপের মধ্যেও ভালো, সত্যবাদিতা এবং নৈতিকতা থেকে এক চুলও নড়ে না-তাদের গল্প এই নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমি বিশ্বাস করি এখনো অনেক দর্শক আছেন- যারা এই ধরনের নাটক দেখতে চান। যে ধরনের নাটক দিয়ে আমি নির্মাণ শুরু করেছিলাম, সেই ধরনের নাটক আমি এখনো নির্মাণ করছি। আমি আমার জায়গা থেকে একটুও সরবো না। সমাজের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরাই আমার নির্মাণের মূল জায়গা। সেই জায়গা থেকে চ্যানেল আই আমার এমন গল্পের একটি নাটক নির্মাণ করার সুযোগ দেয়ায় আমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি। সত্যিই ভালো লাগছে এই ভেবে যে, চারদিকে এত গø্যামার আর চাকচিক্যের ভিড়ে এমন গল্পের নাটক চ্যানেল আই প্রচার করার জন্য চ্যানেলটির কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। এই চ্যানেলটি শিকড়ের জায়গাটা খুব ভালো বোঝে বলেই এখনো দেশ-মাতৃকা আর ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে তারা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন।

আনন্দ আলো: এত চ্যানেল এত নাটক ট্রচার হচ্ছে। তারপরও আমাদের নাটক থেকে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বলে মনে করেন?

আবুল হায়াত: এটার জন্য আসলে চ্যানেলই দায়ী। যেখানে একটি নাটক নির্মাণ হতে আগে চার দিন-পাঁচ দিন সময় লাগতো, সেখানে দুদিনে নাটক নির্মাণ হচ্ছে। কখনো কখনো নাকি নাটক এখন একদিনেও নির্মাণ হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। আর নাটক কী এখন সত্যিকারের নাটকের মানুষদের হাতে আছে? নাটক এখন চলে গেছে বেনিয়াদের হাতে। এজেন্সিবন্দি নাটক নির্মাণ হচ্ছে। এজেন্সি এবং মার্কেটিংয়ের লোক নাটকের আর্টিস্ট থেকে শুরু করে সবকিছু ঠিক করে দিচ্ছে। আবার সেই নাটক চ্যানেলে প্রচারও করছে। আমার কথা হচ্ছে- একটি খারাপ মানের নাটক চ্যানেলে প্রচার হয় কীভাবে? সেটা তো চ্যানেলের প্রিভিউ কমিটি দেখবে। এখন তো অনেক চ্যানেলে প্রিভিউ সিস্টেমই নেই। আমি আগে একজন অভিনেতা, তারপর নির্মাতা। তাই একজন অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করতে গিয়েই দেখেছি- শতকরা নব্বই ভাগ ডিরেক্টর ঠিক কী কারণে ডিরেক্টর হয়েছেন সেটা আমার বোধগম্য হয় না। বর্তমানে বেশির ভাগ ক্যামেরাম্যানরাই নাটক বানাচ্ছেন। নামেই থাকে ডিরেক্টর নামদারি অ্যারেঞ্জার। তাই এভাবে চলতে থাকলে নাটকের এই অবস্থাই হবে। কম টাকায় নাটক পাচ্ছে দেখে চ্যানেল তা প্রচারও করছে। এ থেকে উত্তোরণের জন্য অবশ্য চ্যানেলকেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ চ্যানেল তা প্রচার না করলেই হয়। কোয়ানটিটির দিকে না এগিয়ে কোয়ালিটির দিকে আমাদের তাকানো উচিত। নাটক এখন একটা সিন্ডিকেটের মধ্যে পড়ে আছে। এ থেকে আমাদের বের হতে হবে। আমি এখনো বিশ্বাস করি আমাদের দর্শক আমাদের নাটক দেখতে চায়। দর্শককে আমরা প্রপার জিনিসটা দিতে পারছি না বলেই তারা অন্য চ্যানেলে ঝুঁকছেন। আমি মাঝেমধ্যেই শুনি বিভিন্ন মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে কর্পোরেট কোম্পানি একেকটি নাটক নির্মাণে নাকি দশ লাখ টাকা পর্যন্ত বাজেট দিয়ে থাকেন। কারা পাচ্ছেন সেই বাজেট আর কারাইবা নির্মাণ করছেন সেসব নাটক? কয়েকটি নাটক আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল। ক্যামেরার ফ্রেম আর কালারের মধ্যেই সেসব নাটক আটকে আছে। সেসব নাটক দেখলে মনে হয়- আমাদের নাটকে প্রেম ছাড়া আর কোনো বিষয়ই নেই। শুধু একটি ছেলে বা দুটি ছেলে-মেয়েকে নিয়ে চলতে থাকে সেসব নাটক। নতুনত্ব মানে আমাদের শেকড়কে ভুলে যাওয়া নয় কিংবা সংস্কৃতিকে বদলে দেয়া নয়। আমাদের নাটকের ফরম্যাট এবং আমাদের যে সামাজিক ও পারিবারিক সংস্কৃতি রয়েছে তা নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই হবে একমাত্র কাজ। আজকাল নাটকে পরিবার থাকে না। বাবা-মা, ভাই-বোন বিহীন নাটকের গল্প থাকে। ঐ যে বাজেট থাকে না বলে পরিবারের গল্প বলা যায়। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে- পরিবারের কালচার দেখা ছাড়া একটি প্রজন্ম গড়ে উঠছে।

আনন্দ আলো: পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয়ের ব্যস্ততা কেমন?

আবুল হায়াত: বেশকিছু  ধারাবাহিক নাটকের শুটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। বিভিন্ন চ্যানেলে আমার অভিনীত ‘বৃষ্টিদের বাড়ি’, ‘মায়া’, ‘সংসার’, ‘উৎসব’, ‘আয়নাঘর’সহ আরো বেশ কয়েকটি ধারাবাহিক প্রচার হচ্ছে। এগুলোতে নিয়মিত অভিনয় করতে হচ্ছে। এছাড়াও নিজের পরিচালিত ধারাবাহিক নাটক ‘তিন পাগলে হলো মেলা’তেও অভিনয় করছি। আরো তো রয়েছে খÐ ও টেলিফিল্মের শুটিং।