Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

নাটক সিনেমায় বাংলা ভাষার এলোমেলো চেহারা

আগে আমরা অনেকে টিভি দেখে ভাষা শিখতাম। শুদ্ধ করে কথা বলা শিখতাম। এখন আর সেই যুগ নেই। এখন টিভিও যেন হুজুগের দাস। টিভি নাটকের ভাষা ‘গ্যাছে, হইছে, ডাকতেছি, করতেছি, মাইরালা আমারে, কান্দস কেরে, আবার জিগায়, ফাঁপরের মধ্যে আছি, দৌড়ের উপরে আছি, পুরাই পাঙ্খা’ ইত্যাদিতে গিয়ে ঠেকেছে। এইসব ভাষা এখন বাচ্চারাও শিখছে।
ইদানিং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত নাটকগুলোতে আঞ্চলিক ও কথ্যভাষার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে একটি নাটকে চরিত্রের প্রয়োজনেই আঞ্চলিক ভাষাটা চলে আসে। কিন্তু এটা এখন যেন স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। নাটকের সংলাপ বা বিজ্ঞাপনে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার যদি এভাবে হতেই থাকে-তবে বাংলা ভাষার মান তো থাকবেই না বরং ভাষার প্রাণ নিয়েও টানাটানি অবস্থা হতে পারে।
বাংলা বানানের অপব্যবহার তো প্রায় লাঞ্ছনার পর্যায়ে পৌঁছেছে। উচ্চারণও তথৈবচ। বাংলার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও ইংরেজি মিলিয়ে একটা জগাখিচুরি ভাষা তৈরি করা হচ্ছে। শুধু বাংলা শব্দ দিয়ে বাক্য বলেন এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বাক্যের কোথাও না কোথাও অকারণ বিদেশি শব্দ, আছেই। এটা প্রায় সবশ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে সচল। টেলিভিশনে বিশিষ্টজনদের আলোচনাও এ ধরনের শব্দ বাক্য শোনা যায় সব সময়।
যেমন, ‘এক্সকিউজ মি আপনার প্রোবলেমটা কী?’ ‘ডোন্ট মাইন্ড আমি আসলে এটা বলতে চাইনি’, ‘আই অ্যাম সো সরি লেট হয়ে গেছে’, ‘ডোন্ট ওরি আমি দেখছি’, ‘প্লিজ আমাকে একটু হেলপ কর’ ইত্যাদি। এই বাক্যগুলোর প্রত্যেকটা সুন্দর বাংলায় বলা সম্ভব। কিন্তু লেখাপড়া জানা মানুষের মুখে সেই বাংলা শোনা যায় না। প্রায় প্রতি বাক্যেই এক বা একাধিক বিদেশি শব্দ আছেই। আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবীও কোনো বিশেষ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি সাড়ে পনেরো আনা ইংরেজিতে নিজের ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করেন।
শহুরে ইংরেজি মাধ্যমে শিশু এবং কিশোরদের একটা বড় অংশের পরিচয়ই নেই বাংলা অক্ষরের সঙ্গে। তাদের বাংলায় কিছু পড়তে বললে তাদের অভিভাবকরা যতœ করে সেটা রোমান হরফে লিখে দেন তাদের পড়বার উপযোগী করে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ভাষার কাজই হলো বোঝানো, তাকে আবার বোঝাবে কে? হক কথা। ভাষা বোঝা বা বোঝানোর জন্য নিশ্চয়ই কেউ অভিধান পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে না। মোটা রকমে বোঝাতে এবং বুঝতে পারলেই হলো। কিন্তু আঞ্চলিকতার বাইরে সব ভাষারই একটা মান্য রূপ আছে। সেই রূপও একটু একটু করে বদলে যায়। রোজকার কথ্য ভাষা এবং ভঙ্গিতে খানিকটা এলোমেলো চেহারা আসতেই পারে। কিন্তু যখন ছাপার অক্ষরে ভাষা দেখছি বা লেখাপড়া জানা মানুষের মুখের কথা শুনছি, বা বিভিন্ন জনপ্রিয় মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের ভাষার বা সংলাপ বা বক্তৃতার ভাষার সংস্পর্শে আসছি তখন তার প্রভাব অনেক বেশি এবং সেখানে ক্রমাগত দেখা যাচ্ছে এক অদ্ভুত ভাষা।
এক সময় শিশুদের ভাষা শেখা ও ভাষা চর্চাকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করত শিশুসাহিত্য ও শিশুতোষ পত্রিকা। শ্রেণি-পাঠাগার, স্কুল-পাঠাগার এবং পারিবারিক ও স্থানীয় পাঠাগারগুলোর আকর্ষণীয় সংগ্রহ তাদের মনের খোরাক জোগাতো। এখন সে সুযোগ শিশুদের নেই। স্কুলের পড়া আর কোচিংয়ের পর তাদের খুব-একটা সময়ও থাকে না। যেটুকু সময় হাতে থাকে তা কেটে যায় মোবাইল-ট্যাব-ল্যাপটপ-কম্পিউটার-নির্ভর নানা রকম খেলায় কিংবা কার্টুন দেখায়। বলাবাহুল্য এগুলোর প্রায় সবই ইংরেজি কিংবা হিন্দি ভাষায় নির্মিত। এ ক্ষেত্রে দৃশ্য-শ্রæতি মাধ্যম তাদের ভাষামানসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। প্রমিত বাংলার বদলে অন্য ভাষা তাদের মন-মগজকে প্রভাবিত করে। ফলে প্রমিত বাংলা শেখায় অনুক‚ল পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয় শিশুর।
আমাদের মাধ্যম গুলোতে নামকরণের ক্ষেত্রেও ইংরেজি ভাষার আধিপত্য লক্ষ্যণীয়। টিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামকরণেও প্রাধান্য পাচ্ছে ইংরেজি। যেমন- আওয়ার ডেমোক্রাসি, আজকের রেসিপি, এনটারটেইনমেন্ট, ওয়ার্ল্ড মিউজিক, কমেডি আওয়ার, ক্লাস রুম, গেম শো, গø্যামার ওয়ার্ল্ড, জিরো আওয়ার, টক শো, টপ চার্ট, টপ মডেল, টিউন ফ্যাক্টরি, টেলি কুইজ, টোটাল স্পোর্টস, ট্রাভেল অন, ডক্টরস চেম্বার, ড্যান্স ফর ইউ, নিউজ আওয়ার, নিউজ আওয়ার এক্সট্রা, নিউজ অ্যান্ড ভিউজ, নিউজ টুয়েন্টি ফোর, পাপেট শো, প্রিংকস অ্যান্ড ডেজার্ট, ফিফটি মিনিটস, ফেইস টু ফেইস, বিউটি টাইম, বিজনেস টক, বিজনেস ভিশন, বিজিদের ইজি শো, বিটস আনলিমিটেড, ব্রাইডল শো, মার্কেট ট্রেন্ড, মিউজিক ট্রেন, মিউজিক বক্স, মিউজিক্যাল লাউঞ্জ, মিট দ্য মেকার্স, মিডিয়া গসিপ, রিপোর্টার্স ডায়েরি, লাইফ স্টাইল, লিড নিউজ, লুক অ্যাট মি, শপারস গাইড, শপিং অ্যান্ড কুকিং, সিনেমা এক্সপ্রেস, সিনে হিটস, সেলিব্রেটি সিক্রেট, স্টার্স ফান, স্টুডিও কনসার্ট, স্পোর্টস টাইম, স্পোর্টস টুয়েন্টি ফোর, স্পোর্টস ডেইলি, স্পোর্টস ভিশন, হাই লাইভ, হাউস ফুল ইত্যাদি। এ থেকেই কি বোঝা যায় না যে, গণমাধ্যমে বাংলা ভাষা ও বাঙালির সংস্কৃতির ওপর ইংরেজির আগ্রাসন কী ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে!
Natokঅন্যদিকে টিভির অনুষ্ঠান উপস্থাপনায়ও কোনো কোনো গণমাধ্যমের বাংলা ভাষার প্রতি রয়েছে মারাত্মক উন্নাসিকতা। ‘অসাধারণ’ না বলে বলেন ‘অসাম’, ‘খুব সুন্দর’ না বলে বলেন ‘জোশ’, ‘খুব ভালো’ না বলে বলেন ‘হেব্বি’। তারা অথবা তাঁদের পেছনের কুশীলবরা ইচ্ছাকৃতভাবে জগাখিচুরি বাংলিশ ভাষারীতি তৈরির এবং নতুন প্রজন্মকে বুলিমিশ্রণে প্ররোচিত করায় সক্রিয় ভ‚মিকা রেখে চলেছেন।
বাংলা শব্দ ভাÐারে উপযুক্ত শব্দ থাকলেও কথায় কথায় ইংরেজি বাকভঙ্গি ও পদবন্ধ ঢুকিয়ে দেয়ায় তাঁরা তৎপর। তাঁরা ‘যাহোক’ না বলে বলেন ‘অ্যানি ওয়ে’ , ‘প্রসঙ্গত’ না বলে বলেন ‘বাই দি ওয়ে’, ‘চমৎকার’ না বলে বলেন, ‘একসেলেন্ট’। এমনিভাবে তাঁদের কথায় অবলীলায় স্থান পায় ‘এক্সকিউজ মি’, ‘গুড জব’, ‘টাইম নাই’, ‘সাইড দেন’ ইত্যাদি প্রয়োগ। বুলিমিশ্রণে ভুল প্রয়োগেরও ছড়াছড়ি ঘটে। যেমন- আমাকে ফোন দিও। (ফোন করার বদলে ফোন দান করা?), ওর বিহেভ ঠিক না। (বিহেভ ক্রিয়াপদ; হওয়ার কথা-বিহেভিয়ার’)!
বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে ইংরেজিয়ানা। সড়ক ও সড়ক-সংলগ্ন স্থানের নামকরণে রোড, হাইওয়ে এভিনিউ, স্কোয়ার, স্ট্রিট, হাইওয়ে প্লাজা ইত্যাদি সর্বত্রই চোখে পড়ে। পরিবহনের নামের বেলায় ট্রান্সপোর্ট, গেইটলক, সিটি সার্ভিস, অল দ্যা ওয়ে ফার্স্ট ক্লাস, বাসস্ট্যান্ড ইত্যাদি ব্যবহার ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দোকানের নামের ক্ষেত্রে শপ, শপিং কমপ্লেক্স, শপিং মল, শপিং সেন্টার, এমপোরিয়াম, বুটিক হাউস, চেইন স্টোর, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, মেগাশপ, সুপার শপ, রেস্টুরেন্ট, ফাস্ট ফুড শপ, ফার্মেসি, স্টোর, সেলস কর্নার, সেলস সেন্টার ইত্যাদি শব্দের ছড়াছড়ি। বাসার নামের বেলায় ম্যানশন, লজ, ভিলা, হাউস, অ্যাপার্টমেন্ট ইত্যাদি অহরহ চোখে পড়ে।
এসব কখনো কখনো বাংলা বর্ণমালায় লেখা হয়, তবে ভাষা ইংরেজি। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও ইংরেজিতে। এ দেশে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষ হয়ে গেলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণে ‘ভিক্টোরিয়া’, ‘কুইনস’, ‘রয়্যাল’ ইত্যাদি নামের মহিমার প্রতি এ দেশের একশ্রেণির লোকের আনুগত্য এখনো বহাল রয়েছে।
বাঙালির একটা অংশ ক্রমেই হয়ে পড়ছে ‘বাংলিশ’ সংস্কৃতির ধারক-বাহক। তার প্রভাব পড়ছে সাধারণ বাঙালির জীবনেও। অন্যদিকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে প্রমিত বাংলা ভাষার চর্চা নেই বললেই চলে। দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা ভাষা বলতে গেলে পুরোপুরি উপেক্ষিত।
দেশের মাটিতে জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সম্পূর্ণ বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রতি এদের অন্ধ আকর্ষণ এবং লেখায় ও বাচনে প্রমিত বাংলা ব্যবহারে এদের অদক্ষতা বাংলা ভাষার প্রতি চরম উপেক্ষারই প্রকাশ। সব মিলিয়ে বাংলা ভাষা এক ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে।