Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

লেখক-পাঠক একসঙ্গে

লেখকের প্রতি পাঠকের কতই না প্রশ্ন থাকে। সেই ভাবনা থেকে ২০০৯ সালে আনন্দ আলোর শীর্ষকাহিনী ছিল লেখক-পাঠক একসঙ্গে। সব্যসাচী লেখক কবি সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আড্ডায় বসেছিলেন তারই ভক্ত জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন। অনেকটা গুরু-শিষ্যের মতোই। আর পাঠকের প্রতিনিধি হিসেবে তাকে প্রশ্ন করার জন্য হাজির ছিলেন জনপ্রিয় তারকা উপস্থাপক ফারজানা ব্রাউনিয়া। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি আমাদের অন্তরে বিরাজমান। একুশে বইমেলা উপলক্ষে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি আমরা। আর তাই প্রতিবেদনটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো -সম্পাদক

ফারজানা ব্রাউনিয়া: আমি ব্রাউনিয়া ভীষণ ভীত সন্ত্রস্ত আজ। দেশের ১৫ কোটি জনগণ, তার মধ্যে একজন আমি। ১৫শ লেখক, তার মধ্যে পনেরজন হচ্ছেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাদের মধ্যে দুজনের সামনে আমি বসে আছি। প্রিয় লেখকের সামনে বসে কথা বলার এমন সৌভাগ্য কজনেরই বা হয়। আনন্দ আলো আমাকে এই সুযাগ করে দেবার জন্য প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই। আমার প্রশ্ন কবি অথবা লেখক কারা? লিখলেই কী কবি বা লেখক হওয়া যায়। এক্ষেত্রে কোনো সংজ্ঞা বা ফরমুলা আছে কী?
সৈয়দ শামসুল হক: (প্রশ্ন শুনে মৃদু হেসে) লিখলে তো এক অর্থে লেখকই বটে। যে লেখে সেই লেখক। কিন্তু লেখককে যদি বিশেষভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হয় তাহলে তার লেখায় সাহিত্যমান আছে কিনা দেখতে হবে। কবিতা লিখতে হবে। কিন্তু লেখা শব্দ কবিতা হচ্ছে কিনা তার ওপর নির্ভর করবে কবি হয়ে ওঠা বা না ওঠা। একটা গল্প আমি বলেই যেতে পারি। কিন্তু সেটা উপন্যাসের সংজ্ঞায় পড়ে কিনা তা আগে ভাবতে হবে। ধরো, আমি কবিতা লিখি। এক্ষেত্রে আমার ৪টি বিচার আছে। একটা হচ্ছে, এটা কবিতা হলো কিনা। দ্বিতীয়টা হচ্ছে আমি যা লিখেছি সেই ধারাতে এটা কোথায় আছে? আমি কি এগিয়েছি নাকি পিছিয়েছি? তৃতীয়ত, আমি যে ভাষায় লিখছি বা যে ইতিহাস তুলে ধরছি তার স্থান কোথায়? চতুর্থ, এই কবিতা কি বিশ্বমানের হয়েছে? অন্যদের তুলনায় আমি কোথায় দাঁড়ালাম? তবে আমি একথাই মনে করি লেখালেখির ক্ষেত্রে এতটা কঠোর হবার কোনো প্রয়োজন নাই। লেখক নিজের কাছে পরিষ্কার থাকলেই লেখক হয়ে উঠতে পারবেন। তবে লেখকের ভাষার ওপর দখল থাকতেই হবে। লেখককে শুদ্ধ ভাষা জানতেই হবে। একটা ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে বলব। বিভিন্ন সভা, সেমিনারে অশুদ্ধ উচ্চারণে অনেককেই কথা বলতে দেখি। তারা হয় কবি না হয় লেখক। কেউ কেউ আবার লেখক শব্দটাও ভালোভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। বলেন, আমি একজন লেখোক। আজকের তরুণ ছেলেমেয়েরা এসব দিক খুব খেয়াল করে।
ফারজানা ব্রাউনিয়া: ইমদাদুল হক মিলন আপনার মন্তব্য?
ইমদাদুল হক মিলন: হক ভাইয়ের কথার সঙ্গে আমি একমত। তার কথার পরে তো আর কথা থাকে না। আমি শুধু একটা বিষয় যুক্ত করতে চাই হ্যাঁ, ঠিক আছে, লিখতে তো সবাই পারে। সবার অধিকার আছে। অক্ষরজ্ঞান থাকলেই লেখা যায় অনেকের এই ধারণাও আছে। তবে লেখক ব্যাপারটা অন্যরকম। আমরা যদি জীবনানন্দ দাশের একটি লাইন মনে রাখি সকলেই কবি নন কেউ কেউ কবি। তিনি কেন এই কথা বলেছিলেন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। আমার একটা গল্পের কথা বলি। নাম নিরন্নের কাল। গ্রামে খুব অভাব। তিন-চারদিন ধরে রান্না হয়নি এরকম একটি বাড়ি। কিশোরী একটি মেয়ে তার ছোট্ট ভাইকে নিয়ে মাঠে হাঁটতে বেরিয়েছে। যদি কোথাও কিছু খাবার পাওয়া যায়। ভাইকে সে ক্ষিধের কষ্ট ভুলিয়ে রাখছে নানা কথা বলে বলে… কিন্তু ভাইটা ঘুরে ফিরেই জানতে চায় আচ্ছা, বুবু পাকা ধানের রঙ কেমন? মানে শিশুটি বহুদিন পাকা ধান দেখেনি। বোনটা তাকে তখন বোঝাচ্ছে এমন করেÑ শীতকালে আমাদের বাড়ির পাশে গাঁদা ফুল ফোটে না? তার রঙ দেখছোস? গাঁদা ফুলের পাঁপড়ির রঙ যেমন ধানের রঙ সেরকমই। সৈয়দ শামসুল হকের একটি উপন্যাস আছে নাম নীল দংশন। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। মূল চরিত্র একজন তরুণ। নাম কাজী নজরুল ইসলাম। তরুণকে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ভেবেই পাকিস্তান আর্মি ধরে নিয়ে যায়। তরুণকে অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। নির্যাতনের মাত্রা এতই বেশি ছিল তরুণটি একসময় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়। এই যে অনুভব এটাই হচ্ছে লেখকের কারিশমা!
ফারজানা ব্রাউনিয়া: এবার জিজ্ঞাসা পর্ব। আপনারা পরস্পরকে প্রশ্ন করতে পারেন।
ইমদাদুল হক মিলন: ধন্যবাদ ব্রাউনিয়া। প্রথমে আমি একটু ভ‚মিকা দিতে চাই। আজ আমার জীবনের একটি অত্যন্ত স্মরণীয় দিন, উৎসবের দিনও বটে। কেন এ কথা বলছি? কারণ বাংলা সাহিত্যের একজন কিংবদন্তি লেখকের সামনে আমি বসে আছি। তার সঙ্গে বসেছি। আনন্দ আলো আমাদের কথা রেকর্ড করছে, পত্রিকায় এসব ছাপা হবে। আমার কাছে এটি স্মরণীয় ঘটনা। আমার লেখালেখির জীবনটা নেহায়েত ছোট নয়। আমার প্রথম লেখা প্রকাশ হয়েছিল ১৯৭৩ সালে, অর্থাৎ ৩৫ বছর আগে। এই ৩৫ বছরের লেখালেখির জীবনে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। অনেক সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। কিন্তু আজকেরটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমি সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে বসে কথা বলছি। একই কাগজে আমাদের দু’জনের কথা ছাপা হবে, প্রচ্ছদে ছবি থাকবে। এটা আমার জন্য বড় প্রাপ্তি। এজন্য সৈয়দ হকের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
সৈয়দ শামসুল হক: (মিলনের কথা শেষ না হতেই প্রায় কথা কেড়ে নিয়ে) মিলন এ প্রসঙ্গে তাহলে আমাকেও বলতে হয়। তোমার লেখালেখির জীবন ৩৫ আর আমার ৫৬ বছর পার হয়ে গেল। আমার চেয়ে কুড়ি অথবা পঁচিশ বছর পরে একজন লেখালেখি শুরু করেছেন এবং বেশ জনপ্রিয় তিনি। তার সঙ্গে কথা বলবার একটা সুযোগ হলো এটা আমার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা। ভাবতে ভালো লাগছে যে, আমি পুরনো হয়ে যাইনি। আমি নতুনের সঙ্গে এখনো পা ফেলে চলেছি।
ইমদাদুল হক মিলন: হক ভাই এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নাই। আনন্দ আলোর পাঠকদের উদ্দেশে বলি সৈয়দ শামসুল হকের মতো লেখক কখনো পুরনো হয় না। সৈয়দ হক হচ্ছেন প্রতিদিনকার লেখক, সবসময়কার লেখক, সারাজীবনের লেখক। সৈয়দ হক বেঁচে থাকলে শুধু আমি কেন আমার পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের সঙ্গেও এভাবে সমানতালেই চলবেন।
সৈয়দ শামসুল হক: (মিলনের কথায় সায় দিয়ে) শুধু বেঁচে থাকা নয় লিখে বেঁচে থাকা। লিখতে লিখতে বেঁচে থাকা…
ইমদাদুল হক মিলন: তা তো বটেই…
সৈয়দ শামসুল হক: বয়স হয়েছে তো। সে কারণে আমাকে অনেকেই মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে আপনার ইচ্ছা কী? (যেন আমি মৃত্যুশয্যায় শায়িত) আমি তাদের একটি কথাই বলি। কলম হাতে আমি মরতে চাই। কলমটা যখন ধরেছিলাম মিলন তখনকার সময়টা কিন্তু আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। আজ ভাষা আন্দোলনের এই মাসে কথাগুলো বলা জরুরি। আমরা যারা পঞ্চাশ দশকে লেখালেখি শুরু করেছিলাম তখন বাংলাভাষার ওপরে যে ষড়যন্ত্র চলছি তা ছিল ভয়াবহ, এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে আমরা লিখতে শুরু করি।
ইমদাদুল হক মিলন: তার মানে আপনার লেখালেখির শুরুর কালটা ছিল প্রতিবাদের, বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার…
সৈয়দ শামসুল হক: হ্যাঁ, অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম তো বটেই। ভয়াবহ এই সময়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার, বাঙালি কবি লেখককে কাছে টানার জন্য মাহে নও নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করল। যে পত্রিকায় লিখলেই ‘ভালো টাকা’ পাওয়া যেত। কিন্তু আমরা লিখিনি সে কাগজে। আমরা বরং কোনো রকম সম্মানী ছাড়াই, কখনো কখনো নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে আমাদের উত্তরাধিকারের ভাষা বাংলার বিজয় ত্বরান্বিত করার জন্য গল্প, কবিতা, উপন্যাস লিখেছি। এই ইতিহাসটা আজকালকার লেখকরা কতটা অনুভব করেন আমি জানি না। নিশ্চয়ই তারা অনুভব করেন। কারণ তারাও তো সেই প্রবাহে চলেছেন।
ইমদাদুল হক মিলন: হক ভাই আমি এই ক্ষেত্রে একটা কথা বলি। আপনাদের কাছে সমগ্র বাংলা ভাষাভাষি মানুষ কৃতজ্ঞ। কারণ বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে আপনারা কোনোপ্রকার আপস করেন নাই।
সৈয়দ শামসুল হক: ভাষা আন্দোলন থেকেই আমরা স্বাধীনতার দিকে এগিয়েছিলাম, মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। একথা যেমন সত্য, তেমনি ইতিহাসে আরেকটি সত্যও আছে। সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই। পঞ্চাশ দশকের কবি, লেখকরা আমরা যারা বেঁচে আছি এবং যারা বেঁচে নাই যেমন কবি শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, হাসান হাফিজুর রহমান, আমরা কিন্তু এক হিসেবে প্রথম মুক্তিযোদ্ধা। সাহিত্যে আমরা যারা ভাষার মাধ্যমে যুদ্ধটা শুরু করেছিলাম। আমাদেরকে শুধু ভাষাযোদ্ধা বললে বর্ণনাটা সম্পূর্ণ হবে না। আমরা কিন্তু প্রথম প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা পঞ্চাশ দশকে বাংলাভাষার পক্ষে যারা আমরা লিখতে শুরু করেছিলাম।
ইমদাদুল হক মিলন: হক ভাই এখানে একটা ব্যাপারে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করছি। আপনারা যে সময়টায় লেখালেখি শুরু করলেন, তখন কলকাতার লেখকরা বাংলা সাহিত্যে মোটামুটি জাঁকিয়ে বসেছেন। তারা খুব জনপ্রিয়। তাদের বই খুব বিক্রি হচ্ছে। কলকাতার প্রকাশনা জগৎটাও বেশ বিস্তৃত হয়ে উঠেছে। অপরদিকে আমাদের প্রকাশনা জগৎটা ছিল খুবই ছোট। আমাদের দেশের লেখককে বলা হতো বাঙালি মুসলমান লেখক। আমি মনে করি কবি লেখককে হিন্দু মুসলমানে বিভাজন করা ঠিক না। এই সময়টার বিশ্লেষণ কী আপনার কাছে?
সৈয়দ শামসুল হক: মিলন তোমার কথার সঙ্গে আমি একমত। সাহিত্যে লেখককে হিন্দু-মুসলমান হিসেবে দেখাটা ঠিক নয়। কিন্তু একথাও তো সত্য। দুর্বলরাই বিভাজনের কাতারে পড়ে। তুমি পঞ্চাশ দশকে একবার দাঁড়াও। মীর মশাররফ হোসেন, কাজী নজরুল ইসলামসহ ৪/৫ জনকে জন্ম দিয়েই বঙ্গজননী বোধকরি বন্ধ্যাত্ব অবলম্বন করেছিল। কিন্তু পঞ্চাশের দশক থেকে বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়ে বঙ্গজননী হঠাৎ রতœগর্ভা হয়ে উঠলেন। এক্ষেত্রে পরিবেশ, প্রয়োজন এবং সময় তিনটার সমাহার লক্ষণীয়। প্রকাশনার কথা যদি বল অবস্থা তো ছিল বেশ দুর্বল। সে সময় প্রকাশক ছিল না। ১৯৫০ সালে যে নতুন কবিতার বই বেরিয়েছিল তার সংখ্যাগরিষ্ঠই স্বয়ং কবি বা লেখকের নিজের অর্থে প্রকাশিত। হাসান হাফিজুর রহমান, মুস্তাফা নূরউল ইসলামের সম্পাদনায় দাঙ্গার ৫টি গল্প প্রকাশ হয় পাট বিক্রির টাকায়। হাসান হাফিজুর রহমান দেওয়ানগঞ্জে গিয়ে পৈতৃক ব্যবসা পাট বিক্রি করে টাকা এনে বইখানি প্রকাশ করেন। আলাউদ্দিন আল আজাদের উপন্যাস জেগে আছি তার নিজের টাকায় প্রকাশ হয়। ১৯৫৪ সালে ১৮ বছর বয়সে আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়। সেখানেও আমার পৈতৃক অর্থের বিনিয়োগ ছিল। তখন বইয়ের প্রকাশক ছিল না। মাহুতটুলীতে ওয়ার্সি বুক সেন্টার নামে একটি বইয়ের দোকান ছিল। তারা ১৯৫৪-৫৫ সালে আলাউদ্দিন আল আজাদের দুটি বই ঢালকন্যা ও মৃগনাভি প্রকাশ করেছিল। আর ছিল ওসমানিয়া লাইব্রেরি। তারা আফসার উদ্দিন আহমেদের বই প্রকাশ করেছে। হামেদ আলী নামে একজন লেখক ছিলেন, চমৎকার গল্প লিখতেন ওসমানিয়া তার বই প্রকাশ করত।
১৯৫৪-৫৫ সালে বাংলাবাজারে প্যারাডাইস লাইব্রেরি নামে একটি লাইব্রেরি ছিল। এখন যেখানে মাওলা ব্রাদার্স আছে সেখানেই ছিল। মালিক ভদ্রলোকের নাম আমার মনে নাই। দীর্ঘদেহী, সুপুরুষ। তিনি প্রকাশ করেছিলেন শামসুদ্দীন আবুল কালামের অসাধারণ গল্পের বই ‘পথ জানা নাই’। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কামরুল হাসান। কামরুলের প্রচ্ছদের কথা যখন উঠল তখন বলি পঞ্চাশ দশকে তিনি প্রচ্ছদ করলেন তালেব মাস্টার ও অন্যান্য কবিতা, প্রকাশ করেছিল ওসমানিয়া লাইব্রেরি। এরপর বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকতে শুরু করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। প্রথম সৃজনশীল সুমুদ্রিত, পরিপাটি বই প্রকাশের উদ্যোগ নেন স্পন্দন পত্রিকার সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ। যিনি ছিলেন বার্ড এন্ড বুকস-এর মালিক। যেখান থেকে কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশ হয়।
যে সময়টার কথা বলছি সেটা ছিল পরাধীনতার কাল। শুধু মনিব পাল্টেছিল। ইংরেজ গিয়ে পাঞ্জাবি এসেছে। পরাধীনতার কালে শিল্পী সাহিত্যের ভেতরে অগ্নি থাকে কিন্তু ব্যাপ্তি ঘটে না। তবে হ্যাঁ, বর্তমান সময়ে আমাদের সাহিত্য অনেক অগ্রগতি লক্ষ্য করছি। একদিকে আধুনিক মুদ্রণ ও কম্পিউটার প্রযুক্তির আগমন। পাশাপাশি অনেক লেখকের উঠে আসা।
সাহিত্য বলতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে উপন্যাস। এক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনের ভ‚মিকা খুবই গুরুত্বর্পূ। এক সময় কলকাতার বইয়ে বাংলাদেশ ছেয়ে গিয়েছিল। একথা স্বীকার করতেই হবে সেখান থেকে পাঠকের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছে আমাদের হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলন। মিলন তোমাদের অবদান আজকে স্বীকৃত, নন্দিত, উল্লিখিত হওয়া উচিত।
মিলন এবার তোমার কাছে আমার একটা প্রশ্ন নূরজাহানের মতো একটি অসাধারণ উপন্যাস কেন অসমাপ্ত রেখেছো?
Milon-Browniaইমদাদুল হক মিলন: হক ভাই আমিও এই প্রশ্নটা মাঝে মাঝে নিজেই নিজেকে করি। আমি এখন থেকে বারো বছরেরও আগে উপন্যাসটি শুরু করেছিলাম, প্রথম পর্বটা লিখতে আমার দু’বছর লেগেছে। দ্বিতীয় পর্বটা লিখতে গিয়ে আমার ৪/৫ বছর লাগল। দুটো পর্ব লেখার পর কেন যেন আমার ভেতরে একটা ভয় ঢুকে গেল। আপনি একজন লেখক কাজেই আমার এই অনুভবটা নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারবেন। নূরজাহানের তৃতীয় পর্ব লিখতে শুরু করেছিলাম। অনেক দূর যাবার পর কেন যেন মনে হলো আমি কী আগের সেই ধারাবাহিকতা রাখতে পারছি? চরিত্রগুলো কী আমার মধ্যে আছে? আমি যে জায়গাটিকে তুলে আনার চেষ্টা করছি তাকে আমি কতটা জানি? জায়গাটা কী আমার হাতের মুঠোয় আছে? আমি কি গাছের পাতার রঙ বদলাতে দেখতে পাচ্ছি? আমি কী বর্ষাকালে সেই পানি আসার সময়টা দেখতে পাচ্ছি? এসব ভেবে আমি বিব্রতবোধ করতে থাকলাম। আজকের এই আড্ডায় কথাগুলো বলতে পেরে নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। আপনি লেখক বলেই আমার অনুভবের কথা বুঝতে পারবেন। সাধারণ পাঠক হয়তো বুঝবে না। যখনই লেখাটা লিখতে যাই অনেকখানি লিখি। হঠাৎ মনে হয় আমি কী ঠিক জায়গায় আছি? এই বিভ্রান্তির কারণে লেখাটা শেষ করা যাচ্ছে না।
সৈয়দ শামসুল হক: হ্যাঁ, এটা ঠিক। অনেকদিন ধরে একটা লেখা লিখলে অনেক রকম সংশয় দেখা দিতে পারে। আগের সেই মেজাজ, সেই সুর, কাঠামো কী এখনও আছে? আরেকটা হতে পারে চরিত্রগুলোর কনটিউনিটি অর্থাৎ ধারাবাহিকতা সেটি ঠিক আছে কিনা এটাও ভাবায়। মিলন তোমার কাছে ঋতু বদলের কথাগুলো শুনে খুব ভালো লাগল। আমার বিশ্লেষণ আজকালকার কবি লেখকরা এ নিয়ে তেমন একটা ভাবেন না। আমি অনেকের লেখায় বর্ণনা দেখে হেসে ফেলি। যে মাসে যে ফুল ফোটার কথা না তা ফুটিয়ে দিয়েছে। যে মাসে পথ খটখটে থাকার কথা সে মাসের পথ কর্দমাক্ত। এখনকার লেখকদের লেখায় প্রকৃতির বর্ণনা কম পাই। কেন থাকে না জানি না। আমার একটা উপন্যাস নিয়ে এখন কাজ করছি। কাহিনীতে আছে যে মাস অর্থাৎ বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের সময়কাল। এর পটভ‚মি হচ্ছে উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম যেখানে আমি জন্মেছিলাম। আমার অনেক লেখায় কুড়িগ্রামে জলেশ্বরী নামে একটি ভূখন্ড, তৈরি হয়েছে। মে মাসের কথা বলছিলাম। প্রকৃতির বর্ণনা দেবার সময় কেন যেন মনে হলো ঠিক লিখছি না। সময় অনুযায়ী আকাশ, বাতাস প্রকৃতির বর্ণনা বোধকরি ঠিক হচ্ছে না। তাই আমি লেখাটা থামিয়ে রেখেছি। মে মাসে এলাকায় গিয়ে সবকিছু দেখার পর লিখব। কাহিনীর একটু আভাষ দিতে পারি, একটি জায়গা থেকে নগর পর্যন্ত যেতে হবে। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে পথঘাট কেমন থাকে? ঘাসের রঙ কেমন হয়? কী ফসল হয়, কী ধরনের ফুল ফোটে? আকাশের মেঘ কী সাদা থাকে নাকি ধূসর? মেঘ সাধারণত কোন দিক থেকে আসে? নক্ষত্রের বর্ণনাও দিতে চাই। হাস্যকর হলেও সত্য বহু লেখায় দেখেছি কালপুরুষকে সন্ধ্যেবেলায় যে দিক থেকে উঠিয়েছে সেদিকে কালপুরুষ ওঠে না। অথচ লেখক মনে করেছে কালপুরুষকে উঠালেই তার গল্প সার্থক হয়ে উঠবে। তরুণদের মধ্যে যারা লেখালেখি করছেন তাদেরকে আমি প্রকৃতিকে চিনতে পরামর্শ দেব।
ইমদাদুল হক মিলন: হক ভাই, আরেকটি প্রশ্ন করতে চাই। বাংলা সাহিত্যে গল্প উপন্যাসে একটি বড় জায়গা ছিল প্রকৃতির বর্ণনা। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক পথের পাঁচালী, হাসুলিবাঁকের উপকথা, পুতুলনাচের ইতিকথায় গ্রামের চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। আপনি যেমন বললেন পাতার রঙ, ঘাসের রঙ কোন মাসে কোন ফুল ফোটে, বছরের কোন সময়টা কী রকম? এ ব্যাপারগুলো লেখকদের মধ্যে একসময় নিবিড়ভাবে ছিল। প্রকৃতি এবং মানুষকে একসঙ্গে করা। মানুষ প্রকৃতির অংশ। কিন্তু এখন যেন এই বোধ দেখি না।
সৈয়দ শামসুল হক: তোমার লেখায় এটা আছে মিলন…
ইমদাদুল হক মিলন: হক ভাই আমার প্রশ্ন এখনও শেষ হয়নি। আপনার দুটি উপন্যাসের কথা আমি উল্লেখ করতে চাই। আমি জানি না এ প্রজন্মের ছেলেময়েরা উপন্যাস দুটো পড়েছে কিনা। একটার নাম হলো রক্তগোলাপ। অসাধারণ লেখা। শুরুটা হয়েছে একটা বর্ণনা দিয়ে। একজন জাদুকর, সে জাদু দেখাবে, তার একটা ব্যানার… ঝড়ে একটু ভেঙে গেছে। তার যে বর্ণনা… খুব কাছ থেকে না দেখলে অথবা অনুভব না করলে এই বর্ণনা দেওয়া মুশকিল। আরেকটি গল্পের কথা বলি। কালামাঝির চরণদার বলে হক ভাইয়ের একটা গল্প আছে। একজন মাঝি নৌকায় লাশ নিয়ে যাচ্ছে। বর্ষাকাল, ধানি জমির উপর দিয়ে নৌকা যাচ্ছে। লাশ পড়ে আছে নৌকার ভেতর। এই যে বর্ণনা… এই বর্ণনার শক্তিটা আমি এখনকার অনেক লেখকের মধ্যে দেখি না।
সৈয়দ শামসুল হক: মিলন আরেকটি সত্য আমাদের মেনে নিতেই হবে। প্রকৃতির বর্ণনা শুধু উপন্যাস থেকে নয় অনেকের কবিতা থেকেও হারিয়ে গেছে। সম্ভবত শেষ কবি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশ। যিনি প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তবে আমাদের মঞ্চনাটকে প্রকৃতির কথা আছে। ফসলের কথা আছে। সেলিম আল দীনের অনেক নাটক এর দৃষ্টান্ত।
ফারজানা ব্রাউনিয়া: অনেক কথা হলো। এবার আমি একটা বিষয় জানতে চাই। প্রেম না করলে নাকি লেখা জমে না। প্রেমে পড়েছেন? প্রেম আপনার কাছে কী? প্রথমে সৈয়দ শামসুল হক…
সৈয়দ শামসুল হক: (মৃদু হেসে) প্রেম বলতেই লোকের মনে লাফ দিয়ে ওঠে পুরুষের বেলায় নারী আর নারীর বেলায় পুরুষ। কিন্তু আমরা যেন ভুলে না যাই প্রেম অনেক ধরনের হতে পারে। ঈশ্বর প্রেম, দেশপ্রেম, আত্মপ্রেম। তোমাকে নির্দিষ্ট করে বলতে হবে কোন প্রেমের কথা জানতে চাচ্ছ?
ফারজানা ব্রাউনিয়া: আপাতত আপনার নারী প্রেম, কবে প্রেমে পড়েছিলেন, জানতে চাই।
ইমদাদুল হক মিলন: (হাসতে হাসতে) হক ভাই, এখন আপনার যে বয়স, ভয়ের কোনো কারণ নাই। নির্বিঘেœ বলতে পারেন।
সৈয়দ শামসুল হক: প্রেমে পড়বার জন্য প্রায় এক পায়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমার তের বছর বয়স থেকে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে প্রেমে পড়লাম সেটা ১৯৬৩ সালে। তিনিই আমার জীবনসঙ্গী আনোয়ারা।
আমরা ভুল করি সবসময়। প্রেমে আগেও পড়েছি, এখন পড়ব, ভবিষ্যতেও প্রেমে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছি। এসব হলো বাজে কথা। আসল কথা হলো ভালো লাগা। একজনকে অন্যজনের ভালো লাগতেই পারে। সুচিত্রার গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালো লাগে, কনিকার গানও ভালো লাগে। বন্যার গানও ভালো লাগে। এক্ষেত্রে কি হয় আমি তিনজন গায়িকার গান পছন্দ করতে পারি। কিন্তু বলতে পারি না আমি তাদেরকে ভালোবাসি। এটা আমাদের সমাজের একটা অন্ধকার দিক। নারী-পুরুষের সম্পর্কটা আমাদের সমাজে কখনই সেই রকম স্তরে ছিল না যেখানে নর-নারী পরস্পরকে প্রেম বা শারীরিক চাওয়া পাওয়া ব্যতিরেকে বন্ধু হিসেবে, প্রীতিভাজন হিসেবে ভাবতে পারে। এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি।
ফারজানা ব্রাউনিয়া: পরিবর্তন কি একেবারেই আসেনি?
সৈয়দ শামসুল হক: আসেনি তা বলব না। আমি আজীবন এটা পালন করেছি। এজন্য অবশ্য আমাকে বহু খেসারতও দিতে হয়েছে। আমি নারী-পুরুষকে কখনো আলাদা করে দেখি না।
ফারজানা ব্রাউনিয়া: ইমদাদুল হক মিলন এবার আপনার পালা! সৈয়দ শামসুল হককে সাহস যোগালেন তখন, যা বয়স, তাতে আর ভয়ের কারণ নাই। আপনার বেলায়…
ইমদাদুল হক মিলন: (হাসতে হাসতে) না, না, আমারও এখন আর ভয় নাই। ভয় কেটে গেছে। আমি সবসময় হক ভাইয়ের অনুসারী। আমি একটু স্মৃতিচারণই করতে চাই। হক ভাইকে যখন প্রথম দেখলাম গাজীভবনে। লন্ডন থেকে এসেছেন। হাতে ব্রেসলেট, গায়ে টি-শার্ট, জিন্স পরেছেন। ঝকঝকে তকতকে একটা লোক। তাকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একজন লেখক এত সুন্দর। আমি এরপর থেকেই গোপনে সৈয়দ হককে অনুসরণ করতে থাকলাম। প্রেমের ক্ষেত্রে হক ভাই যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় কিছু পরিবর্তনের ফাঁকে ফাঁকে আমরা প্রেমের আসল সৌন্দর্যটা হারিয়ে ফেলেছি। বাঙালি প্রেমের যে অনুভব তার প্রকাশ দেখি না। আমাদের তরুণবেলায় অবস্থা কী ছিল? ভালোবাসি কথাটা বলতেই তো ৩/৪ বছর লেগে যেত। চিঠি লিখতে হতো। চাকর চিঠি দিয়ে আসত। সেই চিঠি যদি গার্ডিয়ানের হাতে পড়ে তাহলে বিপদ হবে। আড়ালে আবডালে দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যাবে। এই অবস্থার মধ্যে আমাদের তরুণবেলা কেটেছে। এমনও তো হয়েছে দুজন দুজনকে ভালোবাসে। কিন্তু বলা হয়নি। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল। পরে হয়তো মেয়েটি একদিন ছেলেটিকে বলল, আপনাকে আমার খুব ভালো লাগত। কিন্তু বলা হয়নি। ছেলেটা হয়তো তখন উত্তর দিল, আমি তোমার জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করেছি। প্রেমের এই স্বাভাবিক সৌন্দর্য এখন আর নাই। মোবাইলে মুহ‚র্তে বলছি ভালোবাসার কথা। আবার বলছি ঘৃণার কথা।
ফারজানা ব্রাউনিয়া: লেখালেখির ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার ব্যাপারটা একটু বলবেন। প্রেম কী এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ?
ইমদাদুল হক মিলন: লেখালেখির ক্ষেত্রে নিজের প্রতি আগে প্রেম জন্মাতে হবে। যদিও বাংলাভাষার অনেক কবিই বলেছেন আমি একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে কবিতা লিখতে শুরু করি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে বলেছেনও আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম। সরাসরি বলতে পারিনি বলে তার উদ্দেশে একটা কবিতা লিখি। এটা ঠিক আছে। এটা ঘটতেই পারে। হক ভাইও নিশ্চয়ই এরকম প্রেমে পড়ে কবিতা লিখেছেন। সেটা হতে পারে আনোয়ারা সৈয়দ হকের প্রেমে পড়ে। আমার বেলায় এমনটা ঘটেনি। আমি একটি ছেলের প্রতি ঈর্ষা করে মূলত লেখালেখি শুরু করি। ছেলেটি লিখছে। ওর লেখা কাগজে ছাপা হয়। ওর যোগ্যতা কি আমার চেয়ে বেশি? দেখি না চেষ্টা করে। শুরু হলো লেখালেখি। যখন নামডাক হতে শুরু করল তখন দেখলাম চারপাশে যারা একটু কিশোরী তরুণী, তারা কেউ কেউ একটু তাকিয়ে দেখে। লেখক কবিদের ক্ষেত্রে একটা ঘটনা ঘটেই থাকে। এটাকে সৌভাগ্যও বলা যেতে পারে। তাদের প্রতি নারীদের প্রচন্ড আগ্রহ থাকে (হক ভাই এ ব্যাপারে আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবেন) তবে বিয়ে করতে চায় না। কারণ এরা খাওয়াবে কি? তবুও মনে মনে চায়, একটা সম্পর্ক হোক। ভালো লাগা ঘটুক। সেটা বহুবার হলেও প্রকাশ করে।
সৈয়দ শামসুল হক: (কথা কেড়ে নিয়ে) প্রেমে পড়ে অথবা কোনো নারীর উৎসাহে কবিতা লেখা, এটাই মূলত ঘটে। তবে উপন্যাস অথবা গল্প লেখকের বেলায় এটা ঘটে বলে আমার মনে হয় না।
ইমদাদুল হক মিলন: (মৃদু হেসে প্রতিবাদের সুরে) হক ভাই আমি আপনার একজন প্রিয় লেখকের কথা বলি, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে চারজন নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। অবিরাম প্রেম করার পর চারজনকেই তিনি বিয়ে করেছেন।
ফারজানা ব্রাউনিয়া: এবার একটি অন্য প্রসঙ্গে আসি। চলচ্চিত্র একটি বড় মাধ্যম। তুলনামূলকভাবে সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ হতো। এখন কেন হয় না?
সৈয়দ শামসুল হক: যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তারাই এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন।
ইমদাদুল হক মিলন: হক ভাইয়ের মতের সঙ্গে সুর মিলিয়েই বলি, সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণে মানসিক পরিবর্তন জরুরি। আবার অনেক উপন্যাস আছে যা ভালো চলচ্চিত্র হতে পারে। কেউ চাইলে তা করতে পারেন। নূরজাহানও তো চলচ্চিত্র হতে পারে। নদী উপাখ্যান, ভ‚মিপত্র, রূপনগর নিয়েও সিনেমা হতে পারে।
ফারজানা ব্রাউনিয়া: সাহিত্যকে মূলধারা এবং জনপ্রিয় ধারা বলে কেউ কেউ আলাদা করতে চান। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
ইমদাদুল হক মিলন: সাহিত্যের আবার জনপ্রিয় ধারা কী? এটা আমি ঠিক বুঝি না। একজন লেখক গল্প-উপন্যাস লিখবেন, পাঠক কী গ্রহণ করছে তাই দেখার বিষয়। কেউ জনপ্রিয় লেখক হবার জন্য লেখেন বলে আমি মনে করি না। হক ভাইয়ের অনেক লেখা আছে খুবই পাঠকপ্রিয়। কিছু লেখা আছে পাঠকপ্রিয়তা পায়নি। কিন্তু যাদের কাছে পেয়েছে তারা প্রত্যেকে এমন শ্রেণীর মানুষ সাধারণ হাজার পাঠকের প্রত্যেকের গুরুত্ব বেশি।
Milon-Brownia-1সৈয়দ শামসুল হক: জনপ্রিয়তার কথা বলা হচ্ছে, এটা কোনজন? কার কাছে? জনপ্রিয়তা সংখ্যা দিয়ে মাপা হয়। কিন্তু এটা ঠিক না। ১ লাখ মানুষ বইটি পড়েছে কাজেই এটা জনপ্রিয়। কিন্তু একটি বইকে যদি ১০০ জন পন্ডিত ভালো বলেন, ওজনে কোনটার দাম বেশি হবে? জনপ্রিয় শব্দটা অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তিকরভাবে প্রকাশ পায় অনেক সময়। শরৎচন্দ্র জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক এটা অনেকেই যখন বলেন, তখন সেইজন এবং হুমায়ূন আহমেদ যখন জনপ্রিয় লেখক এইজন একইজন কিনা এটাও কিন্তু বুঝে দেখার বিষয়। কাজেই জনপ্রিয়তা এই শব্দটি বিভ্রান্তিকর। এটা উচিত নয় ব্যবহার করা। আমি বরং ক্ষুণœ হই যখন হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনকে বলা হয় জনপ্রিয় লেখক। কাগজেও দেখি। আমার মনে হয় এই শব্দটি লেখককে অবমূল্যায়ন করছে। তারা লেখক কিনা এ বিচার কিন্তু জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করবে লেখার গুণের ওপর।
ফারজানা ব্রাউনিয়া: তাহলে ব্যাপক পাঠকের ভালো লাগা কিছুই না?
সৈয়দ শামসুল হক: আমি সে কথা বলছি না। একটা লেখা দশজনেরই ভালো লাগবে এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। দশজনের মধ্যে তিনজনের ভালো লাগবে, দুইজনের ভালো লাগবে না, চারজন পড়বেই না। একজন লেখকের ওপর ক্ষেপে যেতে পারে। জনগণের জন্য তুমি যখন কিছু করবে তখন এটা মেনে নিতেই হবে। হ্যাঁ, কিছু লেখক আছেন জনপ্রিয়তার মোহে কখনো কখনো ট্রাপে পড়ে যান। যখন দেখেন অনেক পাঠক তাকে পছন্দ করছে, হুমড়ি খেয়ে বই কিনছে। তখন ভাবেন আগামীতেও এই রকম আরেকটা বই লিখতে হবে। তখনই লেখার মান খারাপ হয়ে যায়। লেখার মানের প্রশ্ন ওঠে। একজন লেখক নিজেকে কেন একটা বৃত্তে আবদ্ধ করবেন। তিনি নিজেকে অনবরত অতিক্রম করবেন। এটাই হওয়া উচিত।
ইমদাদুল হক মিলন: হক ভাইয়ের এই কথার সঙ্গে আমি একশভাগ একমত। আমার নিজের জীবনে এমনটি ঘটেছে। কীভাবে ঘটল? লেখালেখির একটা পর্যায়ে যখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এটাই হবে আমার জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম। তখন প্রকাশকদের সঙ্গে আমার চুক্তি হলো প্রত্যেক মাসে আমি একটা করে বই লিখব। তারা আমাকে নির্ধারিত অংকের টাকা দিবে। এটা দিয়ে আমি চলব। একটা উপন্যাস লিখলাম ও রাধা ও কৃষ্ণ। প্রেমের উপন্যাস। মনোদৈহিক সম্পর্ক-টম্পর্ক আছে। অন্যরকম ব্যাপার। দুতিন মাসের মধ্যেই সেই প্রকাশক আমার কাছে হাজির ভাই ঐরকম আরেকটা বই লিখে দেন। ট্রাপটা কিন্তু এভাবেই শুরু হয়। অর্থের হাতছানি আছে। লেখক ভাবেন আগেরটা হয়তো ৫ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে পরেরটা নিশ্চয়ই ৭ হাজার কপি বিক্রি হবে। এইভাবে কিন্তু লেখকরা ফাঁদে পড়েন। আমি নিজে এই ফাঁদে পড়েছিলাম। বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে আমি নিজেকে বদলালাম। নূরজাহান লিখলাম।
সৈয়দ শামসুল হক: মিলনের শেষ কথা থেকেই আসি। নিজেকে বদলানো মানে নিজেকে অতিক্রম করা। আগেরটা থেকে পরের লেখাটা অন্যরকম একেবারেই আলাদা হয়ে ওঠা।
প্রসঙ্গক্রমে একটা বিষয়ে বলি। মানুষের গল্প কিন্তু মাত্র গুটিকয়েক। যেমন এক. যে মানুষটিকে এখন দেখছি সে আগেও ছিল না। পরেও আসবে না। দুই. সময়। কোন সময়ে এই গল্পটা বলছি। মিলন আমার একটা গল্পের কথা বলেছেÐ নীলদংশন। এটি ’৭১ সালে আমাদের দেশে যুদ্ধের সময়কার গল্প। এখানে সময়টা বড় ফ্যাক্টর ছিল। শেষ কথাÐ চাপের মুখে মানুষের উত্থান। প্রেম ভালোবাসা নিয়ে আমাদের আড্ডার শুরুতে অনেক কথা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের দুটো প্রেমের উপন্যাসের কথা বলি। এক. রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা। দুই. শরৎচন্দ্রের দেবদাস। বাঙালিকে এ ব্যাপারে বলতে হবে না। দেবদাস তারা পড়েছে। সিনেমা দেখেছে। আর শেষের কবিতা? শিক্ষিত বাঙালি মাত্রই একবার পড়েছে। দুটোই প্রেমের কাহিনী। আলাদা কোথায়? শেষের কবিতা আলাদা এখানেÐ যাকে ভালোবাসা যায় তাকে বিয়ে করতে হবে এমন কোনো কথা নাই। প্রেম এবং সংসার দুটো আলাদা ব্যাপার। অন্যদিকে দেবদাস? আজকের বাস্তবতায় বিশ্লেষণ করো। একটা ছেলে একটা মেয়েকে পাচ্ছে না। কী করবে? হয়তো এসিড ছুড়বে। অতদূর না গেলেও বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করবে। কিন্তু দেবদাস নিজেই নিজেকে ধ্বংস করেছে। পায়নি বলে অন্যের ক্ষতি করেনি।
ইমদাদুল হক মিলন: খুব চমৎকার ব্যাখ্যা হক ভাই। অসাধারণ।
সৈয়দ শামসুল হক: ধন্যবাদ।
ফারজানা ব্রাউনিয়া: লেখালেখিকে কি পেশা হিসেবে নেয়া সম্ভব? প্রথমে সৈয়দ শামসুল হক
সৈয়দ শামসুল হক: লেখালেখিতো সার্বক্ষণিক একটা কাজ। শুরু থেকেই আমি এটাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছিলাম। এখনোতো দেখছি হুমায়ূন আহমেদ ও মিলন লেখকের আর্থিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে। এই তালিকায় আরও অনেকে আছেন।

সম্পর্কিত