Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গান নয় জীবন কাহিনী

রেজানুর রহমান
বিটিভিতে গানের রেকর্ডিং হবে। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সঙ্গে অনেক শিল্পী উপস্থিত। রেকর্ডিং-এর ক্ষেত্রে বেশ তাড়াহুড়া অবস্থা। শিল্পী দাঁড়ালেন। যন্ত্রসঙ্গীরা প্রস্তুত। প্রযোজক প্যানেল থেকে ফাইভ ফোর… অ্যাকশন বলা মাত্রই গান শুরু। একটার বেশি ‘টেক’ নেয়ার সুযোগ নাই।
বন্যার গানও এক টেকেই ধারণ করা হলো। গান গাওয়া নিজের মনপূত হয়নি বন্যার। আরেকটু সময় পেলে বোধকরি ভালো হতো। মনকে কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছিলেন না। অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী অজিত রায়। তাকে ব্যাপারটা বললেন। অজিত রায় ব্যাপারটাকে মোটেই গুরুত্ব দিলেন না। বরং বন্যাকে সাহস দিয়ে বললেন, চিন্তা করো না। গান ভালো হয়েছে।
তবুও মনকে প্রবোধ দিতে পারছিলেন না বন্যা। রাতে বাসায় ফিরে যাবার সময় আবারও মনে হলো গান ভালো হয় নাই। ফিরে এলেন বিটিভিতে। তখন সেদিনের শুটিং শেষ। যে যার মতো ফিরে যাচ্ছিলেন। অজিত রায়কে সামনে পেয়ে বন্যা আবার একই কথা বললেন, গানটা আবার গাইতে চাই।
অজিত রায় বললেন, ঠিক আছে আগামীকাল সকাল ১১টায় আসো। দেখি কি করা যায়। রাতে ঘুম হলো না রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার। পরের দিন সকাল ১১টার মধ্যে বিটিভি ভবনে হাজির হলেন। কিন্তু সারাদিনেও নতুন করে গান রেকর্ডিং-এর সুযোগ মিলল না। তবে অজিত রায় আবারও একই কথা বললেন, চিন্তা করো না। গান ভালো হয়েছে। তবুও বাসায় ফিরে বন্যা আশ্বস্ত হতে পারলেন না। একটি গানের জন্য রাতে কাঁদলেন তিনি।
তবে আনন্দের কথা বন্যার সেদিনের গানটি অনেক ভালো হয়েছিল। বিটিভির অনুষ্ঠানে গানটি প্রচারের পর ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। তবুও বন্যার বক্তব্য গানটি সেদিন আরো ভালো হতে পারতো।
গানের জন্য একজন শিল্পীর এই যে এত মায়া তা আবার প্রকাশ পেল সেদিন কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে চ্যানেল আই-এর বহুল আলোচিত অনুষ্ঠান গানে গানে সকাল শুরুর বিশেষ দুটি পর্বে। ৫ম রানার চ্যানেল আই বীচ ফুটবল উৎসব উপলক্ষে পৃথিবীর দীর্ঘতম সাগর সৈকত কক্সবাজারে ‘গানে গানে সকাল শুরুর’ বিশেষ এই দুটি পর্ব সাজানো হয়েছিল। দুটি পর্বে ফুটবল উৎসবে অংশগ্রহণকারী মন্ত্রী, সাংসদ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রাক্তন খেলোয়াড়রা, স্পন্সর প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তারা সরাসরি উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান দুটির মূল আকর্ষণ ছিল বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব, চিত্রশিল্পী ও সংগঠক আফজাল হোসেনের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত কন্যা রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার মুখোমুখি ভাব বিনিময় পর্ব। গানের ফাঁকে ফাঁকে বরেণ্য দুই শিল্পী সমসাময়িক অনেক ঘটনা, সাগর প্রকৃতি, মানবিক সম্পর্ক, শিল্পীর দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং সঙ্গীতের নানান বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে মতবিনিময় করেন। সাগর, সৈকতে উন্মুক্ত মঞ্চের এই অনুষ্ঠানটি আয়োজনগত ভাবেতো বটেই বিষয় বৈচিত্র্যও ছিল অনবদ্য। দেশ-বিদেশের কোটি কোটি মানুষ অনুষ্ঠান দুটি উপভোগ করেন। অনের্কে মন্তব্য ছিল গান নিয়ে টেলিভিশনভিত্তিক এমন হৃদয়ছোঁয়া অনুষ্ঠান সচরাচর দেখা যায় না।
অনুষ্ঠানে গানের ফাঁকে ফাঁকে জীবনের অনেক কথা বলেছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। যার সবটাই গান শুধু গান নিয়েই ঘটেছে। এক্ষেত্রে মানবিক বিশ্লেষণ নিয়ে সূত্রধরের ভ‚মিকা পালন করেছেন নন্দিত নির্মাতা আফজাল হোসেন। দুই বরেণ্য শিল্পীর আন্তরিক কথোপকথনের মাধুর্যে অনুষ্ঠান দুটি ইতিহাসের এক সুন্দর জানালা খুলে দিয়েছে। অনুষ্ঠানে ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিল’ এই গানটি গাওয়ার পর বন্যার প্রতি আফজাল হোসেনের প্রশ্ন ছিল এই যে আপনি গানটি গাইলেন… আপনার হিয়ার মাঝে কি কোনো কষ্ট আছে?
বন্যা স্বভাবসুলভ উত্তর দিলেন এভাবেÑ যখন গান গাই তখন কেন যেন মনে হয় আরেকটু ভালো করে গাইতে Bonnar-Gaan-1পারলে ভালো হতো। একটা কষ্টের কথা বলি। আমার বাবা মারা গেছেন। আমি তখন আমেরিকায়। বাবার মৃত্যু সংবাদ শোনার পরও ফিরতে পারছি না দেশে। ফ্লাইটের টিকেট পাওয়া যাচ্ছিল না। কষ্টে অস্থিরতায় বুক ফেটে যাচ্ছে। নিজেকে কোনোমতেই শান্ত করতে পারছি না। ওখানে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে গান শেখাতাম। তারা আমাকে বলল, আজ আর গানের দরকার নেই। কিন্তু আমি হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে বললাম, চলো গান গাই। সবাই কিছুটা অবাক। তবে গান ধরলো। গান গাওয়ার সময় দেখছি আমার চোখে পানি। কাঁদছি আর গান গাইছি। ঘণ্টাতিনেক গান গাইলাম। তারপর মনের ভেতরটা হালকা হলো। গান এভাবেই আমাকে স্বস্তি দেয়, সান্ত¡না দেয়। বিপদে সাহস যোগায় বললেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।
গান চলছে। আফজাল হোসেন এক পর্যায়ে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে প্রশ্ন করলেন, আপনার গান আমরা শুনি, পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ শোনে। আপনি কখনো নিজেকে গান শোনান?
উত্তরে একটু যেন ভাবলেন বন্যা। তারপর মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বললেন, গান আমার কাছে উপাসনার মতো। নিজেকে কখনো গান শোনাই না। তবে অস্থির লাগলে, কখনো নিজেকে বিভ্রান্ত মনে হলে গানের কাছে যাই। তখন আমার গান আমাকে পথ দেখায়। গান আসলে অনুভবের বিষয়।
গানের পাশাপাশি দুই শিল্পীর মধ্যে ভাব বিনিময় চলতেই থাকে। প্রসঙ্গক্রমে বরেণ্য শিল্পী সুবীর নন্দীকে ঘিরে একটি প্রেরণাদায়ক ঘটনার কথা উল্লেখ করেন আফজাল হোসেন। একবার একটা বিজ্ঞাপনের জন্য সুবীর নন্দীর গান দরকার। ৩০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন। সারাদিন সুবীর দাকে নিয়ে শুটিং করা হলো। সন্ধ্যায় কাজ শেষ হয়েছে। সবাই মোটামুটি রিল্যাক্স। রাত ১০টায় হঠাৎ ফিরে এলেন সুবীর দা। বললেন, আফজাল গানটা ভালোমতো হয়নি। আমি আবার গাইব।
গান ও জীবনের এমন অনেক গল্পই সেদিন শুনিয়েছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও আফজাল হোসেন। গানের ফাঁকে ফাঁকে দুজনের বলা গল্পগুলো প্রেরণা হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল শ্রোতা দর্শকের বুকের মাঝে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন অপু মাহফুজ।
সমুদ্র পাড়ের অনিন্দ্য সুন্দর এই গানের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানবিক বোধের এক সুন্দর বার্তা ছড়িয়ে গেছে সবার মাঝে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কোটি কোটি বাংলা ভাষাভাষি মানুষের মাঝে। শুধু বীচ ফুটবলকে কেন্দ্র করেই নয় আরো নানা উপলক্ষে কখনো কক্সবাজার কখনো কুয়াকাটা, কখনো সেন্টমার্টিনে এ ধরনের অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে পরামর্শ দেন সকলে।