Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আহা, আজি এ বসন্তে-মুকিত মজুমদার বাবু

‘যখন খেতের ধান ঝরে গেছে
খেতে খেতে পড়ে আছে খড়
আম বাঁশ ডুমুরের পাতাগুলো মাঠে মাঠে করে মর্মর
ফাগুন ঘাসের ঘ্রাণে ফড়িং এ জীবনের গন্ধ ভালোবাসে…’
প্রকৃতির কোলেই যুগ যুগ ধরে মানুষ হয়ে আসছে লালিত-পালিত। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বন্ধন জন্ম-জন্মান্তরের। প্রকৃতির অমৃতসুধা পান করেই পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকে প্রাণ। প্রকৃতিই দান করে মানুষের মনুষত্ব, তার শিক্ষা। অবলীলায় তাই স্বীকার করতেই হবে আমরা প্রকৃতিরই সন্তান। প্রকৃতির ভালো-মন্দের সঙ্গে আমাদের রয়েছে গভীর যোগসূত্র। প্রকৃতি রুগ্ন, রুক্ষ, বৈরী থাকলে তার প্রভাবে প্রভাবিত হই আমরা। প্রকৃতি শান্ত, ¯িœগ্ধ, রঙিন থাকলে মানুষের মনেও ছড়িয়ে যায় সেই শান্ত রঙিন ¯িœগ্ধতা।
প্রকৃতিতে রঙ বাহারি ফুল ফুটলে মানব প্রকৃতিও চঞ্চল হয়ে ওঠে। চারপাশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ থাকলে দেহ-মনে পরিলক্ষিত হয় তার প্রভাব। ষড়ঋতুর এ দেশে মানব প্রকৃতিও চলে তারই গতিতে। গ্রীষ্মের খরতাপে যেমন পুড়ে অঙ্গার হয় প্রকৃতি তেমনি অঙ্গার হয় মানুষের মন ও শরীর। ঘন ঘোর বরষায় যখন চারদিকে বৃষ্টির আঁধার নামে তখন মানুষের মনও খুঁজে ফেরে সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। মাঠে মাঠে সোনালি ধানের হাসির ঝিলিকের সঙ্গে যোগ হয় কৃষকের হাসি। হেমন্তের স্বচ্ছতা, ¯িœগ্ধতা আর রাতের চাঁদের মিষ্টি আলো মানুষের মনকে নিয়ে যায় অন্য দেশে, অন্য ভুবনে। শীতের হিমেল দাঁতের কামড় যখন প্রকৃতির গায়ে লাগে; প্রকৃতি তখন নিজেকে গুটিয়ে নেয়, ঠিক মানুষও তাই। এরপর আসে বসন্ত। বারো মাসের ফাল্গুন-চৈত্র। ষড়ঋতুর শেষ ঋতু। প্রকৃতিতে বসন্ত বিরাজ করে রঙে রঙিন হয়ে, রঙের পরশ বুলিয়ে। মানুষের মনকেও রাঙিয়ে তোলে তার বিত্ত-বৈভব দিয়ে। শীতের আড়ষ্টতা ভেঙে প্রকৃতি যেমন প্রাণ ফিরে পায় তেমনি বসন্তে মানব প্রকৃতি জেগে ওঠে শান্ত, ¯িœগ্ধ, মন উত্তল করা বর্ণিল এক ফুরফুরে অনুভূতি নিয়ে। নতুন দিনের নতুন সকালের আলো সঞ্চার করে নতুন আশার, ভালোবাসার। অপ্রতিরোধ্য যৌবন ফিরে আসে প্রাণ-প্রকৃতিতে। পুরোনোকে ঝেড়ে ফেলে নতুনের মোড়কে জেগে ওঠে প্রাণ। বসন্ত তাই হয়ে ওঠে ঋতুরাজ বসন্ত। কবিকণ্ঠে উচ্চারিত হয়Ñ
‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,
এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়…’
ঋতুরাজ বসন্তের রূপ-সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় যুগ যুগ ধরে রচিত হয়েছে প্রবন্ধ, গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বসন্ত বাঁধা পড়েছে প্রাণের বাঁধনে।
“ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে
পাগল করে…”
আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে প্রকৃতির চিত্র যেমন চিত্রিত হয়েছে তেমনি চিত্রিত হয়েছে মানবপ্রকৃতির অন্তরাত্মার কথা, মুগ্ধতার অপার বিস্ময়ের কথা। বসন্ত দিনের প্রকৃতিতে রঙের আল্পনা এঁকে দিয়ে যায় অর্জুন, অপরাজিতা, বকুল, আশোক, আকন্দ, আলোকলতা, কাঠালীচাঁপা, কুরচি, গুলঞ্চ, জংলি বাদাম, শিমুল, শিরীষ, মুচকুন্দ, মেহেদি, রক্তকরবী, পলাশ, তমাল, ভাঁটফুল, মহুয়া, নাগকেশর, নিম, মাধবীলতা, পদাউক, পারুলসহ আরো অনেক ফুল। বর্ণিল পাখা মেলে দিয়ে ফুলে ফুলে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায় প্রজাপতি, আম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় মৌ মৌ সুগন্ধির মুকুল, কোকিলের কুহু কুহু ছন্দতোলা ঢেউ জাগানিয়া উচ্ছ¡াস, দিগন্ত বিস্তৃত বোরো ধানের গাঢ় সবুজ খেত, গানের পাখি ‘বউ কথা কও’ এর সুমধুর সুর, লতাগুল্মের পত্রপুষ্পে সুশোভিত সৌন্দর্যই মিটিয়ে দেয় মনের ক্ষুধা। বাংলা হয়ে ওঠে সোনার বাংলা, রূপসী বাংলা।
বসন্তকে মনে-প্রাণে ধারণ করতে এ ঋতু উৎসব-পালা-পার্বণে থাকে জমজমাট। ফাল্গুনী পূর্ণিমা, অষ্টমী ¯œান, চড়কপূজা, দোলযাত্রা, গাজন উৎসব, মাতুয়া মেলা ইত্যাদি। রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় বসন্তের প্রথম দিনটিতে আয়োজন করা হয় বসন্ত উৎসব। এ দিনে প্রকৃতির সঙ্গে মানবপ্রকৃতিও বিচরণ করে স্বপ্নের আঙিনায়।
প্রকৃতিতে যেমন বসন্ত আসে। বসন্ত আসে মানবপ্রকৃতিতেও। কিন্তু সময়ের বহমান ধারায় বসন্ত আসলেও আগের মতো সেই জৌলুসে ধরা দেয় না আমাদের কাছে। ফ্যাকাশে হওয়া এ বসন্তের দায় আমরা কেউই এড়িয়ে যেতে পারি না।
লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন