সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
বাপ্পা মজুমদার জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। দীর্ঘ সঙ্গীত ক্যারিয়ারে শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রকাশ হয়েছে বাপ্পার নতুন একক অ্যালবাম। এটি তার ১২তম একক অ্যালবাম। আধুনিক, ক্লাসিক্যাল, লোকগীতি এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত সব ধরনের গানের এক উজ্জ্বল তারকা বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে কথা হয় আনন্দ আলোর। লিখেছেন- মোহাম্মদ তারেক
আনন্দ আলো: আপনার নতুন একক অ্যালবামটি সম্পর্কে কিছু বলুন?
বাপ্পা মজুমদার: আমার নতুন একক অ্যালবামের নাম ‘বাপ্পা মজুমদার’। এটি আমার ক্যারিয়ারের প্রথম সেলফ টাইটেল অ্যালবাম। চারটি গান দিয়ে সাজানো হয়েছে এই ইপি অ্যালবামটি। চারটি গানের মধ্যে ‘দেহের আগুন’ নামের একটি প্রচলিত লোক গান আছে। গানটি সম্ভবত বিজয় সরকারের লেখা ও সুর করা। অন্য তিনটি গান মৌলিক। গানগুলো হলো- ‘যে ব্যথা আমার বুকে’, ‘নিঃসঙ্গতা’ ও ‘মনের বিজ্ঞাপন’। গানগুলো লিখেছেন বিশিষ্ট গীতিকার শাহান কবন্ধ। মৌলিক গানগুলোর সুর এবং সব গানের সঙ্গীতায়োজন আমারই করা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিকভাবে আমার নতুন একক অ্যালবামটি প্রকাশ করেছে সনি ডিএডিসি। এছাড়া বাংলাদেশের দু’একটি প্ল্যাটফর্ম থেকেও পাওয়া যাচ্ছে অ্যালবামটি। সনি ডিএডিসির ব্যানারে প্রকাশিত এ অ্যালবামের গানগুলো তাদের সব প্ল্যাটফর্মে থাকবে।
আনন্দ আলো: আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যালবাম প্রকাশ হওয়ার আনন্দ কেমন?
বাপ্পা মজুমদার: গান করছি বহুদিন ধরে। কিন্তু কোনো দিন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজ করা হয়নি। এবারই প্রথম। এটা আমার জন্য একটা বিরাট সম্মানের ব্যাপার। এটাকে বাংলাদেশের সঙ্গীতের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণও বলতে পারি। তরুণদের জন্যও একটা দরজা খুলে গেল বলে আমি মনে করছি।
আনন্দ আলো: অ্যালবামের গানগুলো তৈরির সময় কোন্ বিষয়গুলো মাথায় কাজ করেছে?
বাপ্পা মজুমদার: আমার গানের যে স্টাইল আছে, তা মাথায় রেখেই কাজ করেছি। প্রতিটি গান আমার সন্তুষ্টি নিয়েই করেছি। আমি মনে করি শ্রোতাদের কথা মাথায় রেখে নয়, আমার কাজে যদি আগে নিজে সন্তুষ্ট না হই, তাহলে শ্রোতারাও সন্তুষ্ট হতে পারবেন না। আমি চেষ্টা করেছি বিষয়টা যেন মানসম্মত হয়।
আনন্দ আলো: ‘বাপ্পা মজুমদার’ অ্যালবামটি নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
বাপ্পা মজুমদার: এটি আমার প্রথম আন্তর্জাতিক অ্যালবাম। সে হিসেবে এটি নিয়ে প্রত্যাশাও রয়েছে বেশ। খুব যত্ন সহকারে ভালো কিছু গান তৈরি করেছি। সবমিলিয়ে অ্যালবামটি নিয়ে আমি বেশ আশাবাদী। অ্যালবামের গানগুলো শ্রোতাদের মনে দাগ কাটবে বলেই আমার বিশ্বাস।
আনন্দ আলো: বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের সম্মেলন নিয়ে একটি থিম সং করেছেন। কেমন সাড়া পেয়েছেন?
বাপ্পা মজুমদার: থিম সংটি যারা শুনেছেন তারাই প্রশংসা করেছেন। দেশের বৃহৎ রাজনীতিক দলের জন্য থিম সংই করাটা ছিল একটু ভাবনার বিষয়, গবেরও বটে। এখন সময় ‘বাংলাদেশের, এখন সময় আমাদের’, শিরোনামে এই গানে আমার সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছে পারভেজ, এলিটা ও কনা।
আনন্দ আলো: এ সময়ে আর কী কী কাজ করেছেন?
বাপ্পা মজুমদার: প্রথম আলোর ১৮ বছর পূর্তি উপলক্ষে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতাটি নিয়ে একটি গান করেছি। সুর ও সঙ্গীত আমারই করা। গানটিতেও আমার সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছেন কনা, পারভেজ এলিটা। শ্রোতাদের কাছে গানটি বেশ প্রশংসিত হয়েছে। এছাড়া শঙ্কর দা পর্যটনের উপর একটি ডকুমেন্টারি করছেন। এটার মিউজিক করলাম।
আনন্দ আলো: সম্প্রতি আপনার ‘তুমি নাই’ গানের ভিডিওটি ইউটিউবে প্রকাশিত হয়েছে। গানটির জন্য কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
বাপ্পা মজুমদার: গানটির মুখ- ‘শ্যামলিতে তোমার কথা ভাবতে ভাবতে যাই/ শের শাহ রোডে এসে দেখি তোমার দেখা নাই/ ফুল কিনবো বলে আমি শাহ্বাগে গিয়ে/ তোমার জন্য কিনে আনি সবুজ রঙা টিয়ে/ টিয়ে হাতে অবাক কিছু লক্ষ্য তাই/ টিএসসির ওই জনঅর্যণে নাই তুমি নাই’- এমন কথার গানটি লিখেছেন শেখ রানা। কণ্ঠ দেয়ার পাশাপাশি সুর সঙ্গীত আমারই করা। রানার কাছ থেকে যখন কথা পাই তখন অন্য রকম এক চিত্র কল্প ভেসে উঠছিল চোখে। পরিকল্পনা ছিল গানটির কথা যে স্থানগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে ভিডিওতে সে স্থান গুলো দেখানো হবে। অনেক কষ্ট হয়েছে, তবে শেষ পর্যন্ত ভিডিওটি প্রকাশ করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। ঢাকার বিভিন্ন লোকেশনে একজন প্রেমিকাকে খুঁজে বেড়ানোর গল্প তুলে ধরা হয়েছে এই গানে। এরই মধ্যে ভিডিওটি যারা দেখেছেন তাদের অনেকে প্রশংসা করেছেন।
আনন্দ আলো: নতুন কোনো মিউজিক ভিডিওর কাজ করবেন কী?
বাপ্পা মজুমদার: ‘দেহের আগুন’ লোক গানটির স্টুডিও ভার্সন করা হবে। আর ‘নিঃসঙ্গতা’ গানের ‘বিহাইন্ড দ্য সিন’ (গান তৈরির পেছনের গল্প) নিয়ে একটা ভিডিও তৈরি করা হবে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এখন আর ভিডিও না করলে কেউ গান শুনছে না। আমার কথা হচ্ছে, অবশ্যই ভিডিওর প্রয়োজন আছে, তবে সেটা গানের থেকে জরুরি না।
আনন্দ আলো: ব্যান্ড তারকা জেমস বলেছেন এখনকার গান নাকি ‘প্লাস্টিক মিউজিক’ হয়ে গেছে। এটা নিয়ে আপনিও একমত পোষণ করেছেন। এখান থেকে বের হয়ে আসার উপায় কী?
বাপ্পা মজুমদার: আমি শুনেছি এই মন্তব্য করেছেন জেমস। কিছু দিন আগে তিনি একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সবই প্লাস্টিক মিউজিক হয়ে গেছে। জেমসের এই মন্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত। আমরা যেভাবে গান করি, বাজাই, রেকর্ড করি তাতে সর্বোপরি মানুষের মাঝে আবেদন দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু যখনই একজন গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক প্লাগিং নির্ভর হয়ে যায়, তখন সেটা অবশ্যই প্লাস্টিক মিউজিক। এখন তেমনটাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ইদানিং লুপ ব্যবহার করে গানের সব যন্ত্রানুষঙ্গের আবেদন দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে করে সঙ্গীত পরিচালক ও শিল্পীর নিজস্বতা বলতে কিছুই থাকে না। একজন শিল্পী বা সঙ্গীত কর্মীর হাতে বাজানোর জাদু কেমন কিংবা কণ্ঠটা কেমন তা শ্রোতারা আর শুনতে পারছে না। এই ধরনের কাজে কারোরই কোনো কৃতিত্ব নেই। এটা মেশিনের কৃতিত্ব। যতখানি সম্ভব নিজে বাজিয়ে যদি করা যায় তাহলে বিষয়টার মধ্যে নেচারাল ফিল পাওয়া যাবে। আমরা যদি ড্রামস, গিটার বেজটা বাজাই তখন গানটার মধ্যে প্রাণ ফিরে পাবে। আমরা চেষ্টা করলে কিন্তু পারবো, যতখানি সম্ভব শ্রোতারাও মিউজিকের প্রকৃত ফিলটাও পাবেন। একেবারেই কম্পিউটার নির্ভর না হয়ে আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আনন্দ আলো: অনেকেই বলেন গান এখন ভিডিও নির্ভর হয়ে গেছে। আপনার অভিমত কী?
বাপ্পা মজুমদার: অনেকাংশেই সত্য। কারণ গান তো এখন আর শোনার বিষয় নয়। দেখার বিষয় হয়ে গেছে। সেই কারণে এখন সবাই গান করার সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও বিষয়টা চিনৱা করে। মানুষের সাদ পাল্টেছে, মানুষের ধরনটা পাল্টেছে। গান এখন অনেক বেশি ভিডিও নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে মনে হয় ভিডিওর আগে গানটার প্রাধান্য অনেক বেশি পাওয়া উচিত। গানটা যদি ভালো হয়, গানটা যদি সঠিক প্রচার হয়, তাহলে সেই গান শ্রোতারা নিশ্চয়ই পছন্দ করবে।
আনন্দ আলো: এখন আর কেউ ১০/১২টি গান দিয়ে অ্যালবাম প্রকাশ করছে না। একটি দুটি সিঙ্গেল করে প্রকাশ করছে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
বাপ্পা মজুমদার: এখনকার শ্রোতাদের গান শোনার ধরনটা পাল্টে গেছে। এখন আর কেউ পুরো অ্যালবাম কিনতে চায় না। কেন চায় না আমি জানি না। আমরা যারা গান করি তাদের জন্য এটা খুব দুঃখের ব্যাপার। এক দিক থেকে বলব যে, অ্যালবামে অল্প গান করার একটা সুবিধা আছে। তাতে করে অল্প সংখ্যক গান হলে প্রায় সবগুলো গানই ফোকাস পায়। একটা অ্যালবামে যখন অনেক গানের সংখ্যা ছিল তখন গান শোনার ধরন ছিল একরকম। এখন গান শোনার ধরনটা পাল্টেছে। তাই খুব বেশি গানে তারা ফোকাস করতে পারছে না। আমার কাছে মনে হয় যে, অল্প সংখ্যক গান হলে গানগুলোর প্রতি শ্রোতারা হয়তো একটু বেশি মনোযোগ দিতে পারত।
আনন্দ আলো: প্রথম বারের মতো আপনি একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। সেটার কী খবর?
বাপ্পা মজুমদার: ‘সত্তা’ ছবির পুরো কাজটি আমি করেছি। এটি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আমার প্রথম কাজ। প্রথম যখন শুরু করেছিলাম তখন এক্সসাইটমেন্টটা অনেক বেশি ছিল। এখনো অনেক আছে। আশা করছি ছবির গানগুলো সবার ভালো লাগবে।
আনন্দ আলো: ছবির গান করাটা কেমন এনজয় করছেন?
বাপ্পা মজুমদার: ভালো এনজয় করছি। বিভিন্ন গল্পের কারণে ছবির গানে নিজেকে ভাঙার সুযোগ থাকে। নিজের অ্যালবামের মতো এখানে চাপ নেই। নানা রকম ভাবে খেলা যায়।
আনন্দ আলো: নতুন কোনো চলচ্চিত্রে গান করছেন কী?
বাপ্পা মজুমদার: খুব শিগগিরই ইমন সাহার সঙ্গীত পরিচালনায় একটি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেব। এছাড়াও বেশ কয়েকটি ছবিতে কাজ করার কথা বলছে।
আনন্দ আলো: চলচ্চিত্রের গানে পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন?
বাপ্পা মজুমদার: হ্যাঁ। অনেক পরিবর্তন এসেছে। সুর, কথা, কম্পোজিশন সবকিছু পাল্টেছে। পরিবর্তনের মধ্যেও অনেক শ্রুতিমধুর গান হচ্ছে। যা সময় উপযোগী বলে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
আনন্দ আলো: অডিও ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা কেমন মনে হচ্ছে?
বাপ্পা মজুমদার: ভালো না। দীর্ঘদিন ধরে অডিও ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা খারাপ। এখন সবাই ডিজিটাল মিডিয়ার দিকে ফোকাস করছে। আগে যেমন ক্যাসেটে গান শুনতাম, সিডিতে গান শুনতাম। এখন তো সিডির প্রচলন নেই বললে চলে। সিডি প্লেয়ারও কারোর বাসায় পাওয়া যায় না। সেই জায়গা থেকে আসলে সিডির ব্যবহারটাও কমে গেছে। স্বাভাবিকভাবে সিডি প্রকাশ হচ্ছে না। এটাও একটা কারণ। সেই অর্থে আমি বলব যে অডিও ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা নিঃসন্দেহে ভালো না। কিন্তু ডিজিটাল মিডিয়া যদি প্রপারলি এটাকে মনেটরিং করা হয়। প্রপারলি একটা ফ্রেমের মধ্যে আনা হয় তাহলে আমার মনে হয় সবাই লাভবান হবে।
আনন্দ আলো:‘বাপ্পা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’এর কী খবর?
বাপ্পা মজুমদার: আমাদের মূল জায়গা হচ্ছে স্টেজ। আমরা বিভিন্ন জায়গায় স্টেজ শো করে যাচ্ছি নিয়মিত। ‘বাপ্পা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ এর নতুন অ্যালবামের কাজ শুরু করেছি। পাঁচটি গান নিয়ে অ্যালবামটি করবো। এরই মধ্যে তিনটি গানের রেকডিং সম্পন্ন করেছি। বাকি দুইটি গানের কাজ শেষ হলে অ্যালবামটি প্রকাশ করবো।
আনন্দ আলো: ব্যান্ড দলছুটের কী খবর?
বাপ্পা মজুমদার: দীর্ঘদিন যাবৎ দল ছুটের সঙ্গে পারফর্ম করা হচ্ছে না। ইচ্ছা আছে নতুন বছরের শুরুর দিকে ব্যান্ডের নতুন অ্যালবামের কাজ শুরু করব। কিন্তু দলছুটের জন্য যে ধরনের লিরিকের প্রয়োজন, সেই লিরিকগুলো যথা সময়ে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই ধরনের কথা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত দলছুটের কিছু করতে পারছি না।