Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ঢাকা হোক সবুজে ঢাকা-মুকিত মজুমদার বাবু

‘এই যে জীবন দেখছো এ জীবন আমার নয়

আমি বেঁচে আছি বৃক্ষের জীবনে,

পাখি, ফুল, ঘাসের জীবনে…’

-মহাদেব সাহা

পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ উপভোগ করে বেঁচে থাকার মধ্যে অনাবিল এক আনন্দ আছে। আর এই আনন্দ তখনই আমরা হৃদয়াঙ্গম করতে পারি যখন প্রকৃতির কাছে যাই, তার সান্নিধ্য পাই। সবুজ দেখলে আমাদের মনটাও সবুজের মতো সুন্দর, অসীম, উৎফুল্ল, স্নিগ্ধ, তরুণ হয়ে যায়। ফুলে ফুলে মৌমাছির গুঞ্জন শুনলে, সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়া ফুলকে স্পর্শ করলে, তার সুবাস নিলে মনের কালো আকাশটাও রঙিন হয়ে ওঠে। পাখির কলকাকলি কানে এলে বেসুরো মানুষের কণ্ঠেও আসে সুর। নদীর কলতান কানে এলে বৃষ্টি দিনের ময়ূরের মতো নেচে ওঠে মন। আকাশের বিশালতা মনের বিশালতাকে বাড়িয়ে দেয়। পাহাড় মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়। নদী শেখায় অবিরাম ছুটে চলতে। বৃক্ষ শেখায় শান্ত, ধীর, স্থির আর ধৈর্য ধরতে। প্রকৃতিই আমাদের শিক্ষক। প্রকৃতিই আমাদের পালক। প্রকৃতির সুধা পান করেই আমরা আমাদের অসিৱত্ব পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রেখেছি সেই আদিকাল থেকে। প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে আমাদের অসিৱত্ব কল্পনা করা যায় না। অথচ এই প্রকৃতি থেকে আমরা দিন দিন বিছিন্ন হয়ে পড়ছি, বিশেষ করে শহুরে জীবনে। শুধু রাজধানী ঢাকা শহরই নয়, দেশের অধিকাংশ শহরে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আমাদের তপ্ত শরীর শীতল করতে পারি না। বুক ভরে নিতে পারি না নির্মল বাতাস। আমাদের বাড়িগুলোতে কোনো ফলের গাছ নেই, ভেষজ গাছ নেই, এমনকি কোনো ফুল গাছেরও জায়গা হয় না। আমরা মায়াবী মাধবী জ্যোৎস্নার আলোয় গোসল করতে ভুলে গেছি। বৃষ্টিতে ভেজা ভুলে গেছি। ফুলের গন্ধ নিয়ে মন ভালো করতে ভুলে গেছি। পাখির গান শুনতে ভুলে গেছি। সকাল-সন্ধ্যার আবিররঙা আকাশ দেখতে ভুলে গেছি। প্রকৃতির ভালোবাসা থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গেছি।

সভ্যতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রকৃতিকে গলা টিপে হত্যা করছি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিক্ষা গ্রহণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কর্মসংস্থানসহ নানা কারণে মানুষ ধাবিত হচ্ছে শহরের দিকে। বাড়তি জনসংখ্যার জন্য ডোবা-পুকুর-খাল ভরাট করে, ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার করে, বাড়ির আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছ কেটে, রাতারাতি গড়ে তুলছি বসত-বাড়ি, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল। পরিবেশবান্ধব আবাসনের কথা বলে অপরিকল্পিত কংক্রিটের জঙ্গল তৈরি করছি। শহরের কলেবর বাড়াতে গিয়ে শহরটাকে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছি। গ্রামের অকৃত্রিম সৌন্দর্যকে কৃত্রিমতা দিয়ে ভরে দিচ্ছি। শান্ত শহরতলীতে দেখতে দেখতে আকাশছোঁয়া বাড়ি-ঘর উঠছে। যানবাহনের গগন বিদীর্ণ করা শব্দে কান ঝালাপালা হচ্ছে। বিষাক্ত ধোঁয়ায় আকাশ ভারী হয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নানা রকমের জটিল ও কঠিন অসুখে। যে সুখের জন্য আমরা পরিবেশ নষ্ট করছি, সেই সুখই আমাদের জীবনের চরম সর্বনাশ ডেকে আনছে।

আমাদের গ্রামগুলো এখনো তুলনামূলক ভালো আছে। সেখানে গাছ-গাছালিঘেরা বাগান আছে। বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা-নদী আছে। গ্রামের মানুষ এখনো নদ-নদী, পুকুর-ডোবা কিংবা হাওর-বাঁওড়ে গোসল করে, সাঁতার কাটে। ফসলের মাঠে কাজ করা কৃষক কিংবা ক্লান্ত পথচারী এখনো গাছের শীতল ছায়ায় বিশ্রাম নিয়ে ক্লানিৱ দূর করে। এখনো গ্রামের মানুষের সকাল-সন্ধ্যা নামে পাখির গানে। রুপালি জ্যোৎস্না দেখে এখনো তারা মুগ্ধ হয়। এখনো গ্রামের প্রকৃতি আমাদের মুগ্ধ করে। পক্ষান্তরে, রাজধানীর রমনা পার্ক, ওসমানী উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, সংসদ ভবন, চিড়িয়াখানা, চন্দ্রিমা উদ্যান, ঢাকা সেনানিবাস, বাহাদুরশাহ পার্ক ছাড়া তেমন কোনো গাছপালা আচ্ছাদিত সবুজের সমারোহ চোখে পড়ে না। যেটুকু প্রকৃতির ছোঁয়া আছে তাও নানা কারণে দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের লোভের কারণে বসত-বাড়ি নির্মাণের সময় প্রকৃতির জন্য কোনো জায়গা ফাঁকা রাখছি না। নগরবিদদের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকৃতির জন্য জায়গা রেখে নির্মাণ কাজ হচ্ছে কি না তার তদারকিও যথাযথ হচ্ছে না। সবুজায়ন ও সবুজ সংরক্ষণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উদাসীনতাও রয়েছে। ভবিষ্যৎ না ভেবে স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক সময় বৃক্ষ নিধন করা হয়, যা শহরগুলোর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার অপরিকল্পিতভাবে রাস্তার দু’ধারে, পার্কে, উদ্যানে, সড়কদ্বীপে, ব্যক্তিগত বসত-বাড়িতে বৃক্ষরোপণ করা হয়, যা শহরবাসীর জন্য হুমকি। শহরগুলোর সৌন্দর্য বর্ধন করতে গিয়ে পুকুর, গাছের গোড়া ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করে দেয়া হয়, যা মোটেও প্রকৃতিবান্ধব নয়। শহরের গাছগুলোতে লোহা গেড়ে বিভিন্ন সাইনবোর্ড, ফুটপাতের দোকানীদের তাঁবুর রশি বাঁধা, পার্ক, উদ্যানের ভেতরে বিশেষ দিনে অনুষ্ঠানের আয়োজন শহরের প্রকৃতির জন্য মোটেও শুভ ইঙ্গিত নয়।

পৃথিবীকে ভালো রাখার জন্য, আমরা ভালো থাকার জন্য, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথচলা যাতে কণ্টকাকীর্ণ না হয় সে জন্য আমাদের প্রকৃতিকে ভালো রাখতে হবে। বসবাসের উপযুক্ত দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। পরিবেশবান্ধব শহরের জন্য মোট আয়তনের ২০ ভাগ গাছপালা থাকা দরকার। কিন্তু ঢাকায় রয়েছে মাত্র আট ভাগ। সবুজ ঢাকা গড়তে সিটি করপোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্সের ওপর ১০ শতাংশ ছাড় দিয়ে ছাদে বাগান তৈরিতে উৎসাহ দিচ্ছে। ছাদে বাগান করলে একদিকে যেমন বাড়ির তাপমাত্রা কম থাকে অন্যদিকে বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ হ্রাস পায়। আবার বিষমুক্ত টাটকা শাক-সবজি ও ফল-মূল খাওয়া যায়। ইট-পাথরের এই শহরে গাছ-গাছালিঘেরা একটা ছাদে বসে সূর্য ওঠা, সূর্য ডোবা কিংবা চাঁদের ভরা যৌবন দেখতে কার না ভালো লাগে! ক্লান্ত মনের সঙ্গে শরীরটাও সতেজ হয়ে ওঠে প্রকৃতির এমন সান্নিধ্য পেলে।

শহরের পথ চলতে গিয়ে যানজট, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণের পাশাপাশি মনটাকে প্রফুল্ল করার উপাদানও চোখে পড়ে ইদানিং। শহরের বিভিন্ন সড়কদ্বীপ এবং রাস্তার দু’ধারে রঙ-বেরঙের সুন্দর ফুল ফুটে আছে। আবার কোনো কোনো ওভারব্রিজে টবে করে লাগানো হয়েছে সৌন্দর্য বর্ধন করা ফুলের গাছ। এখনো এই শহরে কৃষ্ণচূড়া ফোটে, জারুল ফোটে, পাখি গান গায়। কিন্তু দালান-কোঠার ভিড়ে প্রকৃতির রাজত্ব খুবই কম।

সিটি করপোরেশন থেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। পরিছন্ন শহর গড়ার তাগিদে ইদানিং বিভিন্ন স্থানে ডাস্টবিন বসানো হচ্ছে। কিন্তু তদারকির অভাব আর জনগণের অসচেতনতার কারণে ভালো ফলাফল দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। এছাড়া হাজারিবাগের ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরিত করারও জোর তৎপরতা চলছে। শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনেও কাজ চলছে। তবে হারিয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার হলে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে শহরবাসী।

ঢাকাকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সিটি করপোরেশন। নিঃসন্দেহে এটা একটা ইতিবাচক দিক। তবে সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে এ উদ্যোগ সফল করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে শহরবাসীর এগিয়ে আসতে হবে। ঢাকাকে বাঁচাতে, আমাদের বাঁচতে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষার জন্য পরিবেশবান্ধব ঢাকা গড়া এখন সময়ের দাবি।

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন