Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

তিনি নায়ক তিনি ভিলেন তিনিই কৌতুক

মমতাজউদদীন আহমদ: যুক্তরাষ্ট্র মানে অতি পরিচিত আমেরিকা এখন আনন্দ উত্তেজনা ও কৌতূহলে টগবগ করছে। পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যে সামনের নির্বাচনের উত্তাল ঢেউ এসে সকাল বিকাল আছাড় খেয়ে পড়ছে। এমনিতে মার্কিনীরা আমুদে হইহুল্লোড়ি জাতি। একটু কিছু হলেই ঘরবাড়ি ছেড়ে পথে নেমে পড়ে। যেমন- তাদের বেহিসেব আয় নিয়ে, তেমনি বেহিসেবি তাদের আমোদ আহলাদ। স্বাধীনতা দিবস, ধন্যবাদ দিবস, প্রেসিডেন্ট দিবস, ক্রিসমাস দিবস এলেই হলো- মার্কিনীরা সব ছেড়ে ছুড়ে বনজঙ্গলে ছুটে যায়। অস্থির চাঞ্চল্য তাদের মগজে আর মেজাজে।

এমনিতে হাই হ্যালোতে বেশ সদাশয় কিন্তু মন মেজাজ খিঁচড়ে থাকলে বন্দুক নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। মাথার ঘায়ে পাগল শানৱশিস্ট যুবক কি প্রবীণ কোনো কোলাহলী জমায়েতে ঢুকে ধাঁই ধাঁই ধুমধাম করে দশ বিশকে ফেলে দিল। রক্তে ভাসলো জমায়েত। যদি সম্ভব হয়, যে গুলিবাজ হত্যা করলো, সে নিজেকেই ধাঁই করে গুলি করে আত্মঘাতী হয়ে যাবে।

এরকম আক্‌ছার ঘটছে। পরিতাপও হচ্ছে, সনৱানহারা জননী কাঁদছে, হোয়াইট হাউস উদ্বিগ্ন হচ্ছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যদি খুন খারাবি বন্ধের জন্য অস্ত্র রোধের আইন করতে চায়, তেমনি হইচই- না, তা হবে না। তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। এমন লঙ্ঘন মেনে নেবে না।

মার্কিনীরা মানবাধিকার নিয়ে বড় স্পর্শকাতর। শির দেব কিন্তু আমামা দেব না। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কিছুতে ‘গান কন্ট্রোল’ আইন করার এতটুকু উদ্যোগ মানবে না। এসব তিলিশমাতি বাদ দাও। আমার নিজেকে রক্ষার জন্য অস্ত্র দরকার। তুমি কেহে, যে আমার অস্ত্র কেড়ে নেবে। ওসব চলবে না। যে যার তাই থেকে গেল। বারাক ওবামার ‘গান কন্ট্রোল’ ভণ্ডুল হয়ে গেল। অস্ত্র নিয়ে খেলতে মার্কিনীরা আনন্দ পায়। পথে পথে আড়ালে আবডালে ন্যাংটো মেয়ের নাচ চলছে, চলুক এটাও তো একরকম জীবন। এই করে যদি কারো জীবন জীবিকা চলে, তাহলে তুমি কেহে লাটের পুতলাট, তুমি কেন এমন মজাদার তামাসা বন্ধ করতে লেগেছ। এসব চলবে না। যা চলছে চলুক। সব সময় মনে রাখবে, আমরা এদেশে খোলামেলা সমাজ, আমাদের মধ্যে ইংরেজের মতো কেতা পাবে না। আমরা ঘোমটার নাচ ঘোমটা টেনে নাচি না। যা করি তা প্রকাশ্যে দশজনের চোখের ওপরে করি। তোমার দেখতে মন্দ লাগে, তুমি ভাগো। এখানে মাতবরী করতে এসো না। আমি মনের সুখে নাচব, জামা কাপড় খুলে, শীতের রাতে, টাইম স্কোয়ারে ফুর্তিফার্তি করব, তুমি এক গোবেচারা, মায়ের আঁচল ধরা পুত, তুমি ঘর ছেড়ে শীতের কুয়াশায় খোলা ময়দানে এসো না। সর্দিকাশি নিমোনিয়া নিয়ে ধুকুধুকু করবে। যাও যাও, ঘরের কোনে বসে থাক, আমাদের নাচানাচি ফাটাফাটির মধ্যে এসো না। তোমাদের বিচার বিবেচনা নিয়ে আমরা খোলা মেলা মার্কিনী, আমাদের বিচার করোনা না। দগ্ধে দগ্ধে মরবে। আমরা ঘর ছাড়া ছন্ন ছাড়া জাতি, দুরনৱ আমাদের জীবন, দুর্বার আমাদের ছুটে চলা।

এমন দুরনৱ দুর্বার জাতির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এসেছে। এবার আফ্রো আমেরিকান ওবামা যাবে। আসবে সাদা চামড়া। একদিকে হিলারী অন্যদিকে ট্রাম্প। হিলারী বিল ক্লিনটনের ঘরনী, তিনি আবার ওবামা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।

আর আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি হলেন ধনকুবের। অগাধ তার সম্পদ। রিয়েল স্টেটের রমরমা ব্যবসা। আরো মেলারকম বাণিজ্য। এখনকার বউ হলো তিন নম্বর। আগের দুজনের সঙ্গে ভালো যাচ্ছিল না। তারা চলে গেছে। তিন নম্বরে থিতু হয়েছেন। পরে কী হয় ট্রাম্পও জানে না। থাকলে থাকবে না থাকলে চলে যাবে। কুচ পরোয়া নাই। এরকমই তো হয়। দুর্বিনীত ডন জুয়ান ট্রাম্প। কথাবার্তা বলেন লাগাম ছাড়া। খই ফোটার মতো কথা। যখন যা মনে আসে, ধাঁই ধাঁই করে বলে দিলেন। টিপিক্যাল মার্কিনী।

তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারী বেশ সংযমী কথা বলেন। তবে মাপজোক করে। বেফাঁস কথা বলে ফেঁসে যেতে চান না।

ট্রাম্প বিতর্কে যতই হারছেন, ততই তার মেজাজ লাগাম ছাড়া বেপরোয়া ভাব নিচ্ছে। কেবল আজকে না, পাঁচসাত বছর আগের আলাপে এক মহিলাকে বলেছেন, এসব ধানাই পানাই রাখ, আমার কথা হলো সাফ কথা। যদি আমি তারকা হই তবে যেকোনো রমণীকে যে কোনো প্রস্তাব দিয়ে বগল দাবা করতে পারি। তাতে কোনো রমণী বেজার হবে না। তার সঙ্গে যাচ্ছেতাই করো।

একথা তো খুবই সাংঘাতিক কথা। রীতিমতো মান হানিকর। এরকম কথা যে বলে, সে লোক দেশের প্রেসিডেন্ট হলে একটা মহা গণ্ডগোল, মানে মহামারি আকারে রমণী বিপণ্ন হবে।

এতে ট্রাম্প পড়েছেন ঝামেলাতে। তার নিজের দলেরই পুরুষ, রমণীরা এমন কি তার তিন নম্বর বউ পর্যনৱ আপত্তি করেছেন। ট্রাম্প তখন তড়িঘড়ি ক্ষমা চেয়ে নিলেন। তাতেই হয়েছে আরো ঝামেলা। ঝম ঝমা ঝম বৃষ্টি পড়ার মতো দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে রমণীরা এক এক করে অনেক লুকানো কথা চাউর করে দিয়ে ট্রাম্পের ট্রাম গাড়ির চাকা অচল করে ছেড়েছে। কেউ বলছে, উড়োজাহাজে পাশাপাশি সীটে যাচ্ছি। ট্রাম্প অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরে আমাকে প্রায় কাবু করে ফেলেছিল।

কেউ বলেছে, ট্রাম্প আমাকে পিছন থেকে গুঁতো মেরেছে। কেউ বলেছে ট্রাম্প আমাকে জোর করে চুমু খেয়েছে, ধর্ষণ পর্যনৱ করেছে।

তার মানে হলো রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের দফারফা হওয়ার অবস্থা। মানে তিনি লেজে গোবরে নাস্তানাবুদ হয়ে চলেছেন। আর তো জেতার আশা নাই।

কিছুকাল ট্রাম্প এসব কেলেংকারি শুনেছেন, এখন সরাসরি ঘোষণা করছেন ঝুট, সব ঝুট হায়। আমি ফুলের মতো পবিত্র, এসব ঘাঁটাঘাঁটির ঘটনা কখনো ঘটেনি।

সব কিছু হলো হিলারীর কাণ্ড। আর তাকে মদদ দিচ্ছে কাগজওয়ালারা। তারা ঘুষ দিয়ে বজ্জাত মেয়েদেরকে আমার পিছনে লেলিয়ে দিয়েছে। হাম ওসব মানে ওরকম কখনই নাহি হ্যায়। আমি পবিত্র।

কিন্তু কাগজওয়ালারা মহা ত্যাঁদোর। তারা তো ট্রাম্পকে ছাড়বে না। ওসব রমণী ঘাঁটাঘাঁটির সত্যতা প্রমাণ করার জন্য ছবিসহ ট্রাম্পকে মাটিতে শুইয়ে দিতে লেগেছে। ছবিগুলো সবই আলিঙ্গনের ছবি। অসভ্য ট্রাম্প বড় খেলুড়ে আদমী। ট্রাম্প তবু বলছেন, সব কিছু বানোয়াট আর ছ্যাঁচড়ামি। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছেন। কিন্তু কাগজতো ছাড়ছে না।

এদিকে ভোটাররা মজা পেয়ে গেছে। এমন জমজমাট ঘটনা তো, মজাদার রসময় ঘটনা। যতই আলোচনা হবে ততই আমের রস বের হবে। ভোটাররা যাকে ভোট দেবার তাতো দেবেই কিন্তু মজাদার রসময় বিচরণ চেটেপুটে খাবে বোনাস হিসেবে। তাই হচ্ছে। আমেরিকার আমোদ প্রিয় মজাদার পাবলিক ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘রমণী বিলাস’ নিয়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে রস উপভোগ করছে।

মজা আর মজা। বহুকাল আগে ‘বাহার’ সিনেমাতে গান ছিল, ‘দুনিয়াকো মজা লেলে, দুনিয়া তুমহারা হায়জী, দুনিয়া তুমহারা হায়।’ গানটার সঙ্গে তখনকার সদ্য নতুন নায়িকা বৈজয়নৱীমালা দারুণ ক্ষিপ্র এক নৃত্য নেচেছিলেন। তাতেই হিট হয়ে গেল ছবিটি। এক দর্শক তিন চারবার সে নাচের জন্য দেখেছে।

নিউইয়র্কে একটি দীর্ঘকাল চলা মঞ্চনাটক দেখেছি। সেটা শীতের, সময় ডিসেম্বর মাস। নাটকের নাম ‘ক্যালকাটা ওহ ক্যালকাটা’। ক্যালকাটা নামের জন্য গেলাম, ওমা এত রীতিমতো বিপ্লব। নাটকে সাত পুরুষ আর সাত রমণী। তাদের সংগমের ব্যাপার নিয়ে নাটক। সংগম তো নয়, সংগম নিয়ে ঠাট্টা। সবাই বস্ত্রহীন, সবাই মিলন পিয়াসী। কিন্তু নাটকটি মোটেও কড়কড়ে নোংরা নয়। সেক্স নিয়ে তামাসা। তাতে জীবনের অনৱরালে জীবনের কামনা আছে বেদনা আছে। কিন্তু সেদিন দর্শক ছিল না। শীতের বরফ ঢাকা রাত। কে যায় নাচানাচি দেখতে। আর ন্যাংটো পুরুষ রমণীর নাচতো নতুন কিছু নয়।

আমি এখন একটা ভিন্ন সুরের কথা বলতে চাইছি। ঘটনার প্রবাহ ও গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছে, হিলারি বনাম ট্রাম্প নির্বাচন প্রতিযোগিতাতে বর্তমান দুনিয়ার সংকট, সিরিয়ার যুদ্ধ, উত্তর কোরিয়ার পরমাণু শানিৱ অর্জন, মধ্যপ্রাচ্যের অবিরাম মৃত্যু সংকট নিয়ে কথাবার্তা তেমন নাই। কেবল কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি। ‘আমি যদি খারাপ তাহলে তুমিও খারাপ’, ‘তুমি খারাপ তোমার স্বামী খারাপ’। এসব নিয়েই ঠোসাঠুসি চলছে।

মার্কিনীরা অবশ্য এসব দেখেশুনে মজা পায়। তারা নিশ্চিনৱ, মহাসাগর আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে কেউ যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করতে আসবে না। যুদ্ধ হবে কেবল এশিয়ায় আর ইউরোপে। চলুক চলুক। আমেরিকা যুদ্ধের বাইরে আছে। দমাদম অস্ত্র বিক্রি হচ্ছে। মুনাফার পাহাড় জমছে- তাতেই মার্কিনীরা মহাখুশি। পঁয়তাল্লিশতম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কে জিতল আর কে হারলো, তা নিয়ে তাদের খুব একটা ভাবনা হয় না। ‘ক’ সেও ভালো ‘খ’ সেও ভালো। তবে আমাদের দেশে জঙ্গি পাঠিওনা, তাতেই আমাদের স্বসিৱ। মার্কিনীদের তাতেই মহাসুখ।

কিন্তু আমার কথা ভিন্ন। আমাদের ছায়াছবিতে ভিলেন কিংবা নায়কের একটা স্বরূপ নির্ণয় হয়েই আছে। নায়ক মুখ বাঁকা ভিলেনকে বেধড়ক পেটাবে আর সবশেষে অক্ষত নায়ক নায়িকাকে নিয়ে গান গাইতে গাইতে চলে যাবে। এইতো ছকবাঁধা খেলা। নায়ক নায়িকার তাতেই সুখ, দর্শকেরও সুখ। এমন ছক কাটা ঘরে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিবেচনা করা হয়- মানে ট্রাম্প সাহেবকে যদি নায়ক অথবা ভিলেন ভাবা হয়- বক্তৃতা করার সময় তার শরীরী অঙ্গভঙ্গি মানে ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ যদি নকল করা হয় তবে খেলা বেশ জমবে। ট্রাম্পের আরো একটা মূল্যবান সম্পদ হলো-তার রেশমি চুল, রেশমি চোখের পাপড়ি, তার রেশমি হালকা মোছ- সব মিলিয়ে বেশ কৌতুক কৌতুক ঢঙ আছে। তবে তাই হোক, একের মধ্যে তিন। তিনিই নায়ক, তিনি ভিলেন আবার তিনিই কৌতুক।

চমৎকার হবে কিন্তু। তবে আর শাকিবকে লাগবে না, সওদাগরকেও লাগবে না আর টেলি সামাদকেও রাগবে না। প্রযোজক এক খরচে তিন চরিত্র পেয়ে গেলেন। মাঝে মধ্যে ট্রাম্প ঠোঁট ছুঁচলো করে কেবল গ্রেট বা ফ্যানটাসটিক এবং জঘন্য মহিলা বলবেন, তাতেই হাউসফুল। ধুম ধাড়াক্কা লেগে যাবে। বিচলিত ট্রাম্প, অবিচলিত ট্রাম্প পর্দাতে রাগে এদিক সেদিক করবেন, হিলারিকে আঙুল দেখিয়ে বলবেন, মিথ্যা, লাই, নেভার। হিলারি মজা পেয়ে হাসবেন। তাতেই খেলা জমে বরফ।

বাংলাদেশের সিনেমা কি ট্রাম্পের মতো এমন ফ্যানটাসটিক শিল্পীকে কাস্ট করবে? সুযোগ কিন্তু হারানো যাবে না। না হলে হলিউড বলিউড এই কালারফুল কলাবিদকে নিয়ে ছবি বানিয়ে ফেলবে। সুপার হিরো হবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নতুন করে ভেসে উঠবেন, গ্রেগরিপেক আর মার্লোব্যান্ডো। জয় জয়কার ট্রাম্প। ইউ আর দী গ্রেটেস্ট অফ দী গ্রেটস ট্রাম্প তুমি এগিয়ে চল- আমরা আছি, আছিতো। সবই কেরামতালির কেরামতি।