সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
একটি সিনেমার ভালো-মন্দ নির্ভর করে আসলে দর্শকের ওপর। এজন্য সিনেমা হলে যেতে হবে আপনাকে। সিনেমা হলে গেলেই আপনি বুঝে নিতে পারবেন সিনেমাটি কেমন হয়েছে? যদি দেখেন দর্শক ক্ষণে ক্ষণে হাততালি দিচ্ছে আবার কখনও পিনপতন নীরবতা, পাশেই কেউ কেঁদে কেটে অস্থির অথবা হঠাৎ হঠাৎ হাসির ফোয়ারা ছুটছে… তাহলেই বুঝবেন সিনেমাটি ভালো হয়েছে। দর্শক পছন্দ করেছে।
অনেকদিন পর সিনেমা হলে গিয়ে একটি নতুন সিনেমা দেখলাম। সিনেমাটির নাম ‘অজ্ঞাতনামা’। তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ইমপ্রেস টেলিফিল্ম-এর এই ছবিটি ইতীমধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। কান ফ্যাস্টিভেলের বাণিজ্যিক শাখায় প্রদর্শিত হয়েছে ছবিটি। সে কারণে দেশের মানুষের আগ্রহ বেশি চলচ্চিত্রটির প্রতি। সিনেমা হলে গিয়ে সেই বাস্তবতাও টের পেলাম। বলছিলাম দর্শকের হাততালির কথা। হ্যাঁ ‘অজ্ঞাতনামা’ প্রদর্শন শুরুর পরই দর্শকের হাততালি পেলাম। কখনও কখনও দর্শক নিশ্চুপ। হঠাৎ দেখলাম আমার পাশে বসা একজন দর্শক হু হু শব্দে কাঁদছেন। কিছুক্ষণ পর সেই দর্শকই হো…হো… শব্দে হাসছেন। তার মুখে হাসির ফোয়ারা ছুটছে।
তাহলে ঘটনা কি দাঁড়াল? অজ্ঞাতনামা একটি ভালো ছবি হয়েছে? হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে বলা যায় তৌকীর আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’ একটি ভালো ছবি হয়েছে। মানবিক বোধ সম্পন্ন একটি ভালো সিনেমা বলা যায় অজ্ঞাতনামাকে।
এই ছবিতে নাচ নাই, সিনেমার তথাকথিত ফর্মুলা অনুযায়ী ৪/৫টা গান নাই, ঢিসুম ঠাসুম স্টাইলের মারামারি দৃশ্য নাই, অহেতুক ভাড়ামী সদৃশ্য কৌতুক দৃশ্য নাই, অতঃপর নায়ক-নায়িকার মিল হইল এমন দৃশ্য নাই। তবুও ‘অজ্ঞাতনামা’ একটি ভালো ছবি।
হলে বসে ছবি দেখা শেষ করে সবেমাত্র বেড়িয়েছি। একজন দর্শককে জিজ্ঞেস করলাম- কেমন দেখলেন? তিনি আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন- আপনি কেমন দেখলেন?
তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম নেগেটিভ মন্তব্য করবো। বলব ভালো না। এই সিনেমা ভালো লাগে নাই। নাচ নাই, গান নাই, মারামারি নাই…
বললামও তাই। ভদ্রলোক বেশ ক্ষুব্ধ হলেন। বললেন- এসব কি বলছেন আপনি? এত সুন্দর একটা ছবি আপনার ভালো লাগেনি? নাচ গান থাকলেই কি ছবি ভালো হয়? ছবিতে কাহিনি থাকতে হয়। অভিনয় লাগে। অজ্ঞাতনামায় একটি মানবিক কাহিনি আছে। আর অভিনেতা-অভিনেত্রী দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। সিনেমা হলে ছবি দেখতে বসে আমি কখনও কাঁদি নাই। আজ কাঁদলাম। ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয় দেখে কান্না চেপে রাখতে পারিনি।
ভদ্রলোক চলে গেলেন। তার অনুভূতির সঙ্গে আমার অনুভূতির অনেক মিল পেলাম।
ফজলুর রহমান বাবু দেশের টিভি মিডিয়ায় একজন জনপ্রিয় অভিনেতা। বড় পর্দারও তিনি দুর্দান্ত অভিনয় করেন। অজ্ঞাতনামায় তিনি নিজেকে আরেকবার প্রমাণ করেছেন। তার অভিনয় সৌকর্যে দর্শক অভিভূত। ছেলে বিদেশে থাকে। দীর্ঘ দিন তার কোনো খবর নাই। হঠাৎ খবর আসে ছেলে মারা গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাবা-মা আত্মীয়-স্বজন হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠেন। আবার কেউ অধিক শোকে পাথর হয়ে যান। ছেলের মৃত্যু সংবাদ শুনে বাবু সত্যি সত্যি পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। তার নির্বাক, নিঃশব্দ অভিব্যক্তি দর্শককে তুমুল ভাবে নাড়া দেয়। পর্দায় বাবু কাঁদেন না। কিন্তু তাকে দেখে দর্শক সারীতে অনেকে কেঁদে ফেলেন।
শুধু ফজলুর রহমান বাবু নয় এই ছবির সকল পাত্র-পাত্রীই দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। শহীদুজ্জামান সেলিম, মোশাররফ করিমের কথা বিশেষ বলা দরকার। একজন আদম পাচারকারী অন্যজন পুলিশ। দুজনের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক। সিনেমার পর্দায় দুজনে দর্শককে যেমন হাসিয়েছেন তেমনি মানবিক অনেক প্রশ্নের মুখোমুখিও দাঁড় করিয়েছেন। একজন পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শতাব্দী ওয়াদুদ। চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন তিনি।
অজ্ঞাতনামায় একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করেছেন আমাদের চলচ্চিত্রের মূলধারার জনপ্রিয় অভিনেত্রী নিপুণ। নাচ গান বিহীন একটি চলচ্চিত্রে তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন অনন্যরূপে। এই ছবিতে নিপুণকে নতুনভাবে আবিষ্কার করবেন দর্শক।
অজ্ঞাতনামার কাহিনির পাশাপাশি লোকেশনও অনেক সুন্দর। নদী মাতৃক বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য এই ছবিতে উঠে এসেছে। পাশাপাশি উঠে এসেছে নদী তীরের মানুষের জীবন ধারণের বাস্তবচিত্র। ছবির অন্যসব অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দেখে একবারও মনে হয়নি তারা অভিনয় করছেন। মনে হয়েছে তারা সবাই বাস্তবেরই চরিত্র।
যারা দেশের সিনেমা নিয়ে অযথাই হতাশা প্রকাশ করেন। কথায় কথায় বলেন আমাদের কিছুই হচ্ছে না। তাদেরকে ইমপ্রেস-এর নতুন ছবি তৌকীরের অজ্ঞাতনামা দেখার জন্য অনুরোধ করছি। বাংলাদেশের সিনেমার জয় হোক।
রেজানুর রহমান