Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ব্যস্ত শিল্পীদের মাস এখন চল্লিশ দিনে! -মামুনুর রশীদ

আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ করে মঞ্চ নাটক, টিভি নাটক, পথ নাটক, নাটকের নানাবিধ গবেষণাধর্মী কাজ করে চলেছেন তিনি। বিশেষ করে প্রানিৱক মানুষের জীবন প্রবাহ, হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য, পৌরাণিক বিষয়, রাজনৈতিক মতাদর্শ, মহান মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা, সাহিত্য, নৃ-জনগোষ্ঠী, আদিবাসী মানুষের জীবনচরিত তুলে এনেছেন তার বহু নাটকে। শুধু লেখায় ও নির্মাণেই নন, তিনি এদেশের অভিনয় জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং চলচ্চিত্রের একজন বিশিষ্ট অভিনেতা ও সমালোচক। এ দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক নাট্যচর্চার পুরোধা ব্যক্তিত্ব এই গুণী মানুষটি মামুনুর রশীদ। দেশের সাম্প্রতিক সময়ের টিভি নাটক, মঞ্চ নাটক, চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক নানান প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন আনন্দ আলোর সঙ্গে। লিখেছেন জাকীর হাসান

আনন্দ আলো: কেমন আছেন?     মামুনুর রশীদ: ভালো থাকার চেষ্টা করছি। শুধু আমাদের দেশে নয় সারা বিশ্বেই ভালো থাকার ক্ষেত্রে চলছে চরম অস্থিরতা। এর মধ্যেও ভালো থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। যে ইন্ডাস্ট্রিতে আমি কাজ করি, আমার যে কাজের ক্ষেত্র সেখানেও আছে নানান অস্থিরতা। মঞ্চ নাটকের কথা বলি, এই মাধ্যম তো এখন দর্শক শূন্য। জীবনের নিরাপত্তা যেখানে হুমকির মুখে সেখানে নাটক দেখতে আসা মানে বিপদ ডেকে আনা। তবুও আমাদের নাটকের দর্শকরা যথেষ্ট সাহসী। তারা সমস্ত বিপদ উপেক্ষা করে নাটক দেখার চেষ্টা করে।

আনন্দ আলো: অভিনেতা মামুনুর রশীদের চেয়ে একসময় নাট্যকার মামুনুর রশীদ বেশি শক্তিশালী ছিলেন?

মামুনুর রশীদ: একটা সময় অবশ্যই নাট্যকার হিসেবে শক্তিশালী ছিলাম তো বটেই। কিন্তু কালক্রমে অভিনয় ও নাটক লেখা দুইটি বিষয় একটি জায়গায় নিয়ে এসেছি। তবে ইদানিং টেলিভিশন নাটক লেখার সুযোগ তো আমার জন্য কমে গেছে। যে ধরনের নাটক এখন টিভির জন্য লেখা হচ্ছে আমি তো এই নাটক লিখতে পারব না। এটা আমার বিরাট সীমাবদ্ধতা। না লেখার কারণে এক্ষেত্রে আমার চর্চা কমে যাচ্ছে, বিচরণ কমে যাচ্ছে। সেটাও একটা সংকট। এখন নাটক নিয়ে তো আলোচনাই হয় না। আমি যদি খারাপ নাটকও লিখি সেই নাটক দর্শক দেখে আমাকে বকা দিবে না। অর্থাৎ ভালো নাটক লিখলেও আমাকে কেউ প্রশংসা করবে না, খারাপ লিখলেও কেউ বকা দিবে না। কারণ আমাদের নাটকই তো দর্শকরা দেখছে না।

আনন্দ আলো: বিটিভির যুগে নাটক লেখায় ও অভিনয়ে যে সৃজনশীলতা ছিল বর্তমান সময়ে কারো কারো মধ্যে কি সেই আলো দেখতে পান?

মামুনুর রশীদ: কিছু কিছু তরুণ নাট্যকার ও পরিচালক আছে যারা ভালো করতে চায়। কিছু কিছু অভিনয় শিল্পী আছে যারা ভালো করার চেষ্টা করে কিন্তু কোথায় যেন একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে। এই গণ্ডগোলের মধ্যে ভালোটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

আনন্দ আলো: এর পরিবর্তন কী হবে না?

মামুনুর রশীদ: পরিবর্তনের কথাতো অনেকেই বলে। আমি মনে করি এই প্রতিবন্ধকতার মূলে রয়েছে অনেক কারণ। তার মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে বাজেট। আমি প্যাকেজ নাটক প্রযোজনায় এসে ১ ঘণ্টার নাটক শুরু করেছিলাম ৫ লাখ টাকায়। ধারাবাহিক নাটকের প্রতিটি বিশ মিনিটের পর্ব করেছি আড়াই লাখ টাকায়। এটা বলছি যখন জীবন যাত্রার ব্যয় অনেক কম ছিল তখনকার কথা। এখন বাজেট কমতে কমতে কোথায় নেমে এসেছে তা সবাই জানে। আমি তো এখন প্রযোজনা করতে ভয় পাই। সবশেষে বিটিভিতে একটি নাটক প্রযোজনা করেছিলাম সেই নাটকে ক্ষতি হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। বিভিন্ন চ্যানেলে নাটক করেছি সেখানে ৪০ লাখ টাকা বাকি ছিল সেই টাকা একটু একটু করে চার বছরে পেয়েছি। এভাবে ক্ষতি দিয়ে তো নাটক প্রযোজনা করা যায় না। তাই বাধ্য হয়ে অভিনয় করে জীবনটা চালিয়ে নিচ্ছি।

আনন্দ আলো: একটা সময় আপনি ‘সময় অসময়’, ‘শিল্পী’ ‘সুন্দরী’র মতো ব্লক বাস্টার নাটক করেছিলেন। এখন কি সেই ধরনের নাটক লেখা বা প্রযোজনা করতে ইচ্ছে হয় না?

মামুনুর রশীদ: না করার প্রথমত দুটি কারণ একটি বাজেট অন্যটি উৎসাহ। তবে ইচ্ছে তো হয়ই। কিন্তু আমি চাইলেই তো হবে না। চ্যানেলগুলো শিল্প সম্মত নাটক নিয়ে মাথা ঘামায় না। চ্যানেলগুলো সারা বছর ধরে পরিকল্পনা করে ঈদের নাটক নিয়ে প্রতিযোগিতা করার। ঈদে শত শত নাটক প্রচার হয়। সেই নাটকগুলো একই রকম। আমি এবার ঈদের সময় ঢাকায় ছিলাম। মনটা খুব খারাপ ছিল নানা কারণে তার মধ্যে গুলশানের জঙ্গি হামলা আমাকে বেশি ব্যথিত করেছিল। কোথাও যাইনি ঘরে বসে ঈদের নাটকগুলো দেখেছি। নাটকগুলো দেখে খুব আঘাত পেয়েছি, ব্যথা পেয়েছি। নাটক দেখে মনে হয়েছে আজকের নাট্যকাররা, প্রযোজকরা বা চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ভালো নাটক প্রচারে আগ্রহী নন। প্রচুর টাকা ব্যয় হয়েছে নাকটগুলো নির্মাণে। কিন্তু গল্পের মধ্যে শক্তি নেই, নির্দিষ্ট কয়েকজন অভিনেতা অভিনেত্রী অভিনয় করেছে। তাদের অভিনয়ের মধ্যেও কোনো সৃজনশীলতা নেই, কেমন যেন একটা ভাড়ামো, কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা। সবাই হাসির নাটক করতে চায়। এর কোনো মানে আছে। একসময় ঈদে বিটিভিতে সিরিয়াস নাটক হত হাসির নাটকও হত। এছাড়াও আছে বিজ্ঞাপনের আধিক্য। আমার নিজের অভিনীত নাটকই তো দেখি না। কাকে কি বলবো।

আনন্দ আলো: বর্তমানে দেশে ২৮টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল সক্রিয় আছে। তবুও দর্শক বিদেশি চ্যানেলের নাটক দেখছে। আপনার ব্যাখ্যা কী?

মামুনুর রশীদ: আমার বাড়িতেও বিদেশি চ্যানেল দেখে সবাই। আমার নাটক দেখে না। আমাদের নাটকের গল্পে ও অভিনয়ে বোধহয় দুর্বল জায়গায় আছি। এই দুর্বলতার মূলে রয়েছে আমাদের অস্থিরতা। আমরা হুড়াহুড়ির মধ্যে আছি। শিল্পীদের চেয়ে পরিচালক বেশি এবং শিল্পীদের চেয়ে চ্যানেল বেশি। এতগুলো নাটক দিয়ে ভরানো সম্ভব নয় যে রিসোর্স আছে আমাদের। পরশু দিন যাকে নাটকে কাজ করতে দেখেছি আজকে হঠাৎ দেখছি তাকে ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করতে। ঠিকমতো শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না সে হয়ে যাচ্ছে নাটকের হিরো হিরোইন। এই যে প্রয়োজন সেটাতে গিয়ে হুড়াহুড়ি করতে হচ্ছে। কনফিডেন্ট লোকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কনফিডেন্ট পরিচালকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এগুলো অনেক বড় সংকট।

আনন্দ আলো: সার্বিকভাবে আমাদের নাটকের অবস্থা এখন কেমন?

মামুনুর রশীদ: সব চ্যানেলই চায় হাসির নাটক প্রচার করতে। তার মানে মজার নাটক। এই মজা খুঁজতে গিয়ে আমাদের সমস্যাটা বাড়ছে। আমরা একটি নাটক করবো নাটকে কি দেখতে চাই ভালো গল্প, ভালো ফটোগ্রাফি, ভালো মিউজিক এইতো চাওয়া। মিউজিক আজকাল হয় না। একটা সময় সারারাত জেগে নাটকের মিউজিক করতাম মিউজিক ডিরেক্টরের সঙ্গে বসে। এখন নাটকের এডিটরই এখান ওখান থেকে ধারকর্জ করে নাটকে মিউজিক জুড়ে দেয়। মিউজিক ডিরেক্টরের কোনো প্রয়োজন হয় না। তাই সমস্ত জায়গায় একটা হুড়াহুড়ি। এর মধ্যে কি ভালো কোনো কাজ হয়? ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের এই প্রাচ্য দেশ জাপান থেকে বহু দেশ পর্যনৱ ধীরে ধীরে সৃজনশীল কাজ করা এবং কথা বলার একটা অভ্যাস গড়ে উঠেছে। কোনো তাড়াতাড়ি হুড়াহুড়ি ছিল না কখনো। কিন্তু এই হুড়াহুড়িটা কি করে যে আমদানি হয়ে গেল বিশ্বায়নের বদৌলতে বুঝতে পারলাম না এবং হঠাৎ করে আমরা ওয়েস্টার্ন হয়ে গেলাম। সামনের বাসায় কি হচ্ছে আমরা জানি না, খবরও রাখি না। এপার্টমেন্ট কালচার শুরু হওয়ার পর দুচোখ মেলে মানুষ দেখতে পাই না আমরা। আগে একটা ভাঙা বাড়িতে থাকতাম, সেখানে কত মানুষ আসত, সিকিউরিটি ছিল না, কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হত। এখনতো মানুষই দেখি না। এখন শত সিকিউরিটির মধ্যে হাজারও সমস্যা। টেলিভিশন মিডিয়ায় যারা  কাজ করে তারা তো মহা ব্যস্ত। সারা দিন রাতে অবসর নেই। একেক জন তিন চারটি সিরিয়ালের কাজ করেন প্রতিদিন। এই ব্যস্ত শিল্পীদের মাস হয় চল্লিশ দিনে।

আনন্দ আলো: আগেকার টিভি নাটকের গল্প একটি পরিবারকে ঘিরে আবর্তিত হত। এই সময়ের নাটকে পরিবার খুঁজে পাওয়া যায় না। মা-বাবা ছাড়া অন্যান্য চরিত্র থাকে না। কিন্তু কেন?

মামুনুর রশীদ: শুধু পরিবার কেন আমার নাটকে পুরো একটি গ্রামের মানুষ ইনভলব হত। একটি মৃত্যু ঘটনা ঘটেছে নাটকে। সেই পরিবারকে গ্রামের মানুষ কতভাবে কত আপন মনে করে শানৱ্বনা দিচ্ছে পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছে বিপদে আপদে। সময় অসময় নাটকে মধু পাগলার ফাঁসি হয়ে যায়। এ খবর পেয়ে গ্রামের মানুষের কি যে আকুতি। কি যে অস্থিরতা মনে হয়েছে যেন বাস্তবের কোনো ঘটনা। এটাতো জীবন ছিল। আগে গ্রামের কোনো ছেলে এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করলে গ্রামের হাটে মাইকিং করা হত অমুকের ছেলে ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেছে। এই ঘোষণার পর যার যা আছে তাই দিয়ে ছেলেটাকে সাহায্য নয় ভালোবাসা দিত। অনেকে সংসার খরচ থেকে ছেলেটাকে কিছু একটা উপহার দিত। যার কিছুই ছিল না সেও গামছায় বেঁধে দুমুঠ চাল দিয়ে বলতো আমি কিছুই দিতে পারলাম না চাল কটা রাখেন। এখন এটা কল্পনাও করা যাবে না। আগের দিনের নাটকে মামা, চাচা, দাদা, দাদু, ভাবী, নানা, নানু থাকতো। এখন বাবা থাকলে মাকে মৃত দেখানো হয় একটি ছবি ঝুলিয়ে। শিশু শিল্পীদের তো নাটক সিনেমায় রাখাই হয় না। সময় অসময় নাটকে গোলাম সোহরাব দোদুল শিশু শিল্পী জালালের চরিত্র করেছিল আজ সে কত ভালো বড় পরিচালক হয়েছে। তাই বলি বেশি বেশি শিশু শিল্পীদের নাটক সিনেমায় কাজ করানো উচিত। যাতে অল্প বয়সে তাদের গ্রুমিংটা হয়।

আনন্দ আলো: এ কারণেই কি আমাদের নাটক দর্শক আকৃষ্ট করতে পারছে না?

Mamunor-Rashid-1মামুনুর রশীদ: জি বাংলা বা স্টার জলসা আমাদের দেশের দর্শকরা কেন দেখে? ওরা একটি অখণ্ড পরিবারকে নাটকে তুলে ধরে। এই ধরনের পরিবার কিন্তু ওদের সমাজে নেই। আমাদের আগে ওদের সমাজে যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে কিন্তু নাটকে যৌথ পরিবারের স্বপ্নটাকে তুলে ধরে। তবে ওরা নাটকে যে ভুল করে সেটা হলো- হিংসা বিদ্বেষ, পরকীয়াকে নাটকে সামনে নিয়ে আসে। আমি প্রায় বলি, এই দুটি চ্যানেলের নাটক দেখার পর আমাদের দেশে ডিভোর্স আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে এবং দেশে গত ১০ বছরে যত ডিভোর্স হয়েছে তার আশিভাগ এই ধরনের নাটকের প্রভাবে হয়েছে। আমাদের নাটকে আগে দেখানো হত হ্যাপী ফ্যামিলি। আমাদের উদ্দেশ্যই ছিল নাটকের মাধ্যমে এদেশের সুখী পরিবারের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা। আগে নাটকে দেখানো হত পরিবারে কোনো সংকট দেখা দিলে মামা, খালু, ভগ্নিপতি এসে সংকট সমাধানের চেষ্টা করতো। এখন এই ধরনের আত্মীয়রা সংসারে এসে ঝামেলা পাকায়। আগে নাটকে বন্ধু একটা বড় ভূমিকা করতো। এখন নাটকে কোনো বন্ধু নেই। এখন কোনো নাটকে বন্ধু রাখা হয় অবিশ্বাস, জটিল ও আপাংতেয় হিসেবে। বন্ধুর মতো একটি পবিত্র ও ভালোবাসার সম্পর্ক তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। এই ধরনের চরিত্র দেখে কিশোর যুবারা বন্ধু সম্পর্কে ভ্রানৱ ধারণা পোষণ করছে। এখন আর আমাদের নাটকে কারো কোনো ত্যাগ দেখানো হয় না। এ কারণেই বলি নাটকে আমাদের সুখী পরিবার দেখানো উচিত। ভেঙে যাওয়া পরিবার জোড়া লাগা দেখানো উচিত। আজকে মূল্যবোধহীন বিদেশি নাটক দেখে দেখে পরিবার ভেঙে মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে কারো কোনো খেয়াল নেই। না সমাজপতিদের না সরকারের। আমাদের দেশের নাটকে কিন্তু এখনো ভালো কিছু ট্রেন্ড আছে। আমরা যদি সচেতন হই তাহলে এই ট্রেন্ড সৃজনশীলভাবে নাটকে উপস্থাপন করলে দর্শক নিশ্চয় দেশের নাটকের দিকে চোখ ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু কেউ কেউ এই ট্রেন্ডকে নষ্ট করতে চাইছে। এখনো কিন্তু আমাদের গ্রামকে অসাধারণভাবে নাটকে উপস্থাপন করা হয় এবং মানুষের সারল্যকে তুলে আনা হয়। কিছু নাটকে কিছু নির্মাতা আবার গ্রামের সহজ সরল মানুষকে নিয়ে কমেডি করার চেষ্টা করে বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের কৌলিন্য আভিজাত্য আত্মসম্মানবোধ নিয়ে যদি আমি ভারামো করি এবং স্থূল কিছু করার চেষ্টা করি তাহলে জঘন্য কাজ হবে। গ্রামই যে আমাদের মূল্যবোধ ও অনুপ্রেরণার জায়গা সে সম্পর্কে ছোট একটি বিষয় বলি, আগে দেখতাম গ্রামের একটি বাড়িতে বা আত্মীয়র বাড়িতে কেউ দুপুর বেলায় এলে না খেয়ে যেতে দিত না বয়জ্যেষ্ঠরা। আমিও চেষ্টা করি দুপুর বেলায় আমার বাসায় কেউ এলে কাউকে না খাইয়ে যেতে দেই না। আমি এই বিষয়টি শিখেছি কিন্তু আমার পরিবার থেকে। এখন কি সেই কালচার আছে। আমার একটা দুঃখ এই সমস্ত কালচার নিজের চোখের সামনে ধ্বংস হতে দেখলাম। গত ২০/২৫ বছরে এই অবক্ষয় হয়েছে। এতে আমাদের সমাজ সংসারের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের জীবনের প্রেরণা বলতে কিছু নেই। জীবনের প্রেরণা হচ্ছে সম্পর্কে।

আনন্দ আলো: আমাদের মূলধারার চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা এখন কেমন?

মামুনুর রশীদ: চলচ্চিত্রের একটা সময় স্বর্ণযুগ ছিল। তখন হিন্দি, উর্দু, কলকাতার বাংলা ছবি আসতো। তার মধ্যে থেকে একজন জহির রায়হান, ফতেহ লোহানী, মহিউদ্দিন ভাইয়ের জন্ম। তারপর নারায়ণ ঘোষ, মিতা, খান আতাউর রহমান এলেন। খান আতার নবাব সিরাজউদ্দৌলা তো তদানিনৱন পশ্চিম পাকিসৱান, পূর্ব পাকিসৱান ও ভারতে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যাকে বলে স্ম্যাশ। শুধু এই ধরনের সৃজনশীল শিক্ষিত পরিচালকেরই জন্ম হয়নি একের পর এক অ্যাক্টর তৈরি হয়েছে। টেকনিশিয়ান তৈরি হয়েছে। বেবী ইসলাম, আব্দুস সামাদ, সাধন রায়, অরুণ রায়, আব্দুল লতিফ বাচ্চু। এই ধরনের গুণী ক্যামেরাম্যান চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছে। বশির ভাই ও এনামুল হক নামে চলচ্চিত্রের নামকরা এডিটর ছিলেন। তারা অসাধারণ কাজ করেছেন। এই সব অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানদের কারণে আমরা জীবন থেকে নেয়া, কাঁচের দেয়াল, কখনো আসিনির মতো অসংখ্য কালজয়ী ছবি পেয়েছি। সত্তরের দশক পর্যনৱ সাহিত্য নির্ভর থেকে মৌলিক গল্পের অনেক কালজয়ী ছবি পেয়েছি। আশির দশকে এসে চলচ্চিত্রের অধঃপতন শুরু হয়। নকল গল্পের ছবি, কাটপিস, অশ্লীলতা এখন যৌথ প্রযোজনার নামে বিদেশি ছবি আমদানি হচ্ছে। জানি না চলচ্চিত্রের আগামী ভবিষ্যৎ কী?

আনন্দ আলো: আপনি কিছুদিন আগে গৌতম ঘোষের শঙ্খচিল ছবিতে অভিনয় করেছেন। এর আগেও বেশ কিছু ভালো ছবির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অভিনয় করেছেন কিন্তু নিয়মিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন না কেন?

মামুনুর রশীদ: গৌতম ঘোষের অসাধারণ একটি ছবি শঙ্খচিল। এ ছবিতে অভিনয় করে আত্মতৃপ্তি পেয়েছি। এ ধরনের ছবিতো খুব একটা হচ্ছে না। ভালো গল্পের ভালো নির্মাণের কিছু লোবাজেটের ছবি হয় মনের টানে সেই সব ছবিতে অভিনয় করি। কিন্তু সিনেমায় পেশাগতভাবে অভিনয় করা সম্ভব হয় না মূলধারার ছবি ভালো অবস্থা নেই বলে। তাই আমার জীবিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে টিভি নাটকে। সেটা একঘণ্টার নাটকও নয় অভিনয় করতে হয় ধারাবাহিকে। এই ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় না করলে জীবন জীবিকা কঠিন হয়ে পড়বে। এর মধ্যে শুনেছি সিনেমার অবস্থা ভালো হচ্ছে। যদি সিনেমার সুদিন ফিরে আসে তবে নিয়মিত অভিনয় করার ইচ্ছা আছে।

আনন্দ আলো: একটা সময় সিনেমা হলই ছিল এ দেশের মানুষের বিনোদনের প্রধান জায়গা সেটা আমরা হারিয়ে ফেললাম কীভাবে?

মামুনুর রশীদ: প্রেমের প্রথম শুরুটা হত সিনেমা হলে। দুজনে হলে বসে সিনেমা দেখার মধ্যদিয়ে। এই যে একটা রোমান্টিক রিলেশনের জায়গা ছিল এখন আর সেই সংস্কৃতিটা নেই, আমরা হারিয়ে ফেলেছি। চলচ্চিত্রের অধঃপতনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সবাই মিলে সপ্তাহে অনৱত একদিন সিনেমা দেখে আনন্দ করার উপলক্ষ হারিয়ে ফেলেছি আমরা। এর বহুবিধ কারণ আছে। যেমন এখন অনেকগুলো স্ক্রীন, সিনেপ্লেক্সের স্ক্রীন, টিভি স্ক্রীন, ইউটিউব স্ক্রীন এবং মোবাইল স্ক্রীন। এত স্ক্রীনের ভিড়ে সিনেমা স্ক্রীন প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।

আনন্দ আলো: আমাদের তরুণ প্রজন্ম কি সঠিক পথে এগুচ্ছে বিশেষ করে নির্মাণে ও অভিনয়ে?

মামুনুর রশীদ: এগুচ্ছে আবার পিছিয়েও আছে। পিছিয়ে আছে জ্ঞান ও মেধায়। জ্ঞান ও মেধা তৈরি হয় পড়ালেখা থেকে। যে পরিমাণ পড়াশোনা করা দরকার তা এ সময়ের তরুণরা করছে না। পড়াশোনা না করলে মেধামনন সৃষ্টি হবে না। এই দিকে সংকট রয়েছে। আমি মনে মনে ভাবছি অনেক বড় একজন অভিনেতা হব। এই যে বড় অভিনেতা হতে গেলে আমার যে যোগ্যতা ও মেধা দরকার সেটা আছে কি না এবং এর জন্য আমি প্রস্তুত কি না। সেই প্রস্তুতি ও যোগ্যতার অভাব আছে অনেক তরুণের মধ্যে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে এখনো একটা পর্যায় আছে কিন্তু টিভি মিডিয়ায় সেটা অনুপস্থিত এবং চলচ্চিত্রে ভিষণভাবে অনুপস্থিত। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই সেটা হলো আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরম্পরা তৈরি হচ্ছে না। পরম্পরা তৈরি হলে ভালো হত। শঙ্খচিল ছবিতে অভিনয় করার সময় ছবির কলকাতার ড্রেসারের সঙ্গে কথা হয় আমার। সে বলল, আমার বাবা এবং দাদা ড্রেসার ছিল। ও যখন আমাকে ধুতি ও পাঞ্জাবি পরাতো তখন ওর হাতের স্পর্শে গত ষাট সত্তর বছরের একটা স্পর্শ পেতাম। আমাদের দেশেতো এটা হওয়া সম্ভব নয়। দেখা গেল ড্রেসারের ছেলে প্রযোজক হয়ে গেছে বা অন্য পেশায় চলে গেছে।

আনন্দ আলো: মঞ্চ নাটকের দর্শক কমেছে বলে অনেকে বলছেন। এ ব্যাপারে আপনার মনৱব্য কি?

মামুনুর রশীদ: এটা সত্য যে মঞ্চের দর্শক বাড়ছে না। যে দর্শক নিয়ে আমরা আশির দশকে যাত্রা শুরু করেছিলাম তখন প্রচুর দর্শক মঞ্চ নাটক দেখতে আসতেন। দুই হাজার সালে নতুন হল হলো শিল্পকলায় তখনো দর্শকদের জোয়ার দেখেছি। থিয়েটারে কিন্তু এরকম হয়। জোয়ার আসে আবার হঠাৎ ভাটা হয়। দেশে সন্ত্রাস, রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলেতো দর্শক কমে যাবেই। আর দর্শক নাটক দেখতে আসবে কি করে এত যানজটের মধ্যে। যেমন মিরপুরে গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জের দর্শকরা মূলত যানজটের কারণে আসতে পারে না। আগে এই অঞ্চলের মানুষের বৃহদ একটি অংশ মঞ্চ নাটক দেখতে আসত প্রতিদিন। আগে মফস্বল শহর থেকে দর্শকরা মঞ্চ নাটক দেখতে আসতো। বিশেষ করে ঢাকার আশেপাশের জেলা শহর থেকে প্রচুর দর্শক আসত। এখন নানাবিধ কারণে তারা আসে না।