Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

এবারই  প্রথম উড়োজাহাজে উঠিনি!

তাঁকে বাংলা সিনেমার রাজকুমার বললে বোধকরি ভুল বলা হবে না। ওপার বাংলার মানুষ তিনি। কিন্তু এপার বাংলা অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশে অভিনেতা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়। পাঁচ বছর আগে ইমপ্রেস এর ‘মনের মানুষ’ ছবিতে অভিনয় করে এদেশের মানুষের মন কেড়ে ছিলেন। পাঁচ বছর পর আবার মন কাড়লেন শঙ্খচিল-এ অভিনয় করে। পরিচালক একজনই-গৌতম ঘোষ। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও বদলায়নি। বাংলাদেশ অংশে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও আশীর্বাদ চলচ্চিত্র এক সাথেই আছে। ‘মনের মানুষ’ এর অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও কেউ কেউ যুক্ত হয়েছেন শঙ্খচিল-এ। ‘মনের মানুষ’এর লালন এবার একজন স্কুল শিক্ষক। বাদল নামে অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। শঙ্খচিল বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছে। বৈশাখের প্রথম দিনে বাংলাদেশ ও ভারতের কলকাতায় একযোগে মুক্তি পেয়েছে শঙ্খচিল। বাংলাদেশে ছবিটির মুক্তি উপলক্ষে কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সংবাদ সম্মেলন, ছবির প্রিমিয়ার শো সহ নানা কর্মসূচি  পালনে দারুন ব্যসত্ম ছিলেন। এরই ফাঁকে আনন্দ আলোর সাথে বলেছেন কিছু কথা। তারই চুম্বক অংশ আনন্দ আলোর পাঠকের জন্য। লিখেছেন সৈয়দ ইকবাল

আনন্দ আলো: কেমন আছেন?

প্রসেনজিৎ: অনেক ভালো।

আনন্দ আলো: শঙ্খচিল এর প্রচারনায় অনেক সময় দিচ্ছেন। এব্যাপারে কিছু বলুন।

প্রসেনজিৎ: বর্তমান সময়ে এক সাথে দুই দেশে একটি ছবি মুক্তি দেওয়া সহজ কাজ নয়। অনেক দৌঁড় ঝাপ করতে হচ্ছে।

আনন্দ আলো: পাঁচ বছর আগে যৌথ প্রযোজনার ছবি মনের মানুষ এ অভিনয় করেছিলেন এবার করলেন শঙ্খচিল-এ অভিনয়। মনের মানুষ-এ অভিনয়ের জন্য নিজেকে দারুন ভাবে ভেঙ্গেছিলেন… অর্থাৎ নিজেকে বদলে ফেলেছিলেন। এব্যাপারে কিছু বলুন।

প্রসেনজিৎ : আমি নিজেকে বার বার বদলাচ্ছি গত আট-দশ বছর ধরে। গৌতমদা তখনই আমার কাছে লালন চরিত্রটা নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের ওখানে এমনকি বাংলাদেশেও হিরো বা হিরোইনের চেহারাটা তৈরি করে দেওয়া হয়। সেখানে আমি অল্প বয়সে নিজেকে ভাঙতে শুরু করেছি। এটা আমি অনেক আগে থেকে করে আসছি। এজন্যই ‘বাইশে শ্রাবণ’ কিংবা ‘মনের মানুষ’-এর মতো ছবি পেয়েছি। ‘মনের মানুষ’-এ কাজ করতে গিয়ে ভয় লেগেছিলো এই ভেবে- আমি বোধহয় পারবো না! কিন্তু গৌতমদা বিশ্বাস ধরিয়েছিলেন, আমি পারবো। পরিশ্রম করে খাটতে খাটতে ‘মনের মানুষ’ করে ফেললাম। পরে লোকজন তো আমাকে বলতে শুরু করলো- ‘আপনি অস্কার পেয়ে যাবেন কারণ বাংলাদেশের মানুষ আপনাকে লালন হিসেবে মেনে নিয়েছে।’ তবে একথা সত্য- লালনকে আমার মধ্য থেকে বের করতে অনেক সময় লেগেছিলো।

আনন্দ আলো : ‘মনের মানুষ’-এর পর বাংলাদেশে ‘শঙ্খচিল’-এ অভিনয় করলেন। সাতক্ষীরায় শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো?

প্রসেনজিৎ : এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। গৌতমদা আমাকে যখন বললেন সাতক্ষীরায় কাজ হবে তখন জানতে পেরেছি, কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে সাতক্ষীরায় যেতে অনেক সময় লাগে। আর কলকাতা থেকে সাতক্ষীরায় যেতে তিন ঘণ্টা লাগে, কিন্তু সড়কপথে যেতে হবে। আমি সিদ্ধানত্ম নিলাম, গাড়িতে চড়েই যাবো। এবারই প্রথম বিদেশে কোনো ছবির শুটিং করতে গিয়ে উড়োজাহাজে উঠিনি!

Prosenjit-1প্রথম একটা অভিজ্ঞতা হলো- গাড়ি থেকে নামলাম, নেমে পাঁচ’পা হাঁটলাম, তারপর ব্রিজ পার হয়ে একটা দেশ থেকে আরেকটা দেশে পৌঁছে গেলাম? দেখলাম ওখানেও আমাকে বুম্বাদা বলছে এবং আমাকে দেখার জন্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের ভালোবাসা অনেক পেয়েছি, অনেক রকমের ভালোবাসা পেয়েছি, রাত্রি সাড়ে তিনটা-চারটায় বের হয়ে দেখেছি, মহিলারা বেনারসি পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন! যে রাসত্মাটা দিয়ে আমি যেতাম, সেখানে অসংখ্য মানুষ ছিলো। আমি হয়তো এই পথ দিয়ে যাবো জেনে প্রত্যেকটা গ্রামের মোড়ে মোড়ে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতো।

গল্পের প্রয়োজনে গৌতমদা খুব ভোরের আলোটা ধরতে চাইতেন? কিছু কিছু জায়গায় আমার নামের প্ল্যাকার্ড নিয়ে কিছু জায়গায় আমার নামের ব্যানার আবার কিছু জায়গায় আমার ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি মানুষজনকে। ওখানে ১৫-১৬ দিন শুটিং করেছি। যে ক’দিনই কাজ করেছি, আমি যাওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করতাম, কথা বলতাম, তারপর যেতাম। বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) অনেক সহযোগিতা করেছে। নাহলে শুটিং করতে পারতাম না। তাদের সঙ্গে বসে সকালে চা আর বড়া ভাজা খেতাম।

আনন্দ আলো : জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিবো ফিরে’ কবিতা নিয়ে সাজানো গান রয়েছে ‘শঙ্খচিল’-এ। ছবিটিতে কবিতার প্রভাব কতোটা?

প্রসেনজিৎ : হ্যা শঙ্খচিল-এ কবিতা ব্যবহার করা হয়েছে। কখনও কখনও চিঠি ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু আমার চরিত্রটি শিক্ষকের, তাই গৌতমদা চরিত্রটির একটা আদল তৈরি করেছেন কবিতার মাধ্যমে।

আনন্দ আলো : বাদলের মতো চরিত্রে কাজ করাটাও তো আপনার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। এ চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তুতি হিসেবে আপনি বই পড়েছেন জেনেছি। এ ব্যাপারে কিছু বলুন।

প্রসেনজিৎ : আমাকে গৌতমদা কিছু বই দিয়েছিলেন ইতিহাস জানার জন্য। সেগুলো কিছু সহযোগিতা করেছে। আসলে আমাদের ছবিটা দেশভাগের আবহ নিয়ে তো, তাই আমি সেই ইতিহাস বহন করে বেড়ানো মানুষদের সম্পর্কে জানতে সময় নিয়েছি। আমার চরিত্রটা এমন একটা জায়গা থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, ফেলে আসা জায়গার প্রতি মানুষের যে টান, ইতিহাস, দুঃখ সেগুলো কেমন তা জানা জরুরি ছিলো। আমি যদি দশটা পরিবারের সঙ্গে কথা বলে থাকি, তাহলে আটটা পরিবারের কাছ থেকে কিছু না কিছু গল্প পেয়েছি। কারও বাড়ি নিয়ে, কারও বন্ধু, মা, বাবা, জমি নিয়ে; গল্প একটা না একটা আছেই। কিছু পরিবারের অর্ধেক মানুষ বাংলাদেশে আছেন। আবার বাংলাদেশের তেমন কিছু মানুষের আত্মীয়স্বজন হয়তো ভারতে থাকেন। তাদের প্রত্যেকেরই যাওয়া-আসা সেভাবে আর নেই। তবে মনের টানটা রয়ে গেছে। এখনও সবাই সবার খবর রাখেন। কীভাবে কাঁদছে দুই বাংলার মানুষ ভেতরের সেই যন্ত্রণাটা বুঝতে চেষ্টা করেছি। সেজন্য আমাকে পড়াশোনা করতে হয়েছে। বেশি জানতে হয়েছে মানুষের আবেগ। কারণ আমি সবসময় একটা বিষয় মনে রেখেছি- যতোক্ষণ না আবেগটাকে নিজের মধ্যে আনতে পারবো, ততোক্ষণ বাদলের মতো চরিত্র হয়ে উঠতে পারবো না। বাদল একটা বিশাল সংখ্যক বাঙালির প্রতিনিধি। গল্পে বাদল, লায়লা ও রূপসা- এই তিনজনের যে পরিবার, সেই পরিবার সীমানত্মবর্তী এক বাঙালির সংসারের প্রতিচ্ছবি, তাদের জীবন, অসিত্মত্ব রক্ষার লড়াই ফুটে উঠেছে শঙ্খলিএ।

আনন্দ আলো :  ‘শঙ্খচিল’কে আপনার জীবনের সেরা ছবি বলবেন?

প্রসেনজিৎ : আপনারা এটা জানেন, গত ছয়-সাত বছর ধরে আমি কি ধরনের ছবি করছি। ৩৩ বছর ধরে কাজ করে আমি বুঝেছি সবকিছুর ঊর্ধ্বে হলো পর্দায় আমরা কি দেখাবো। সেখান থেকে আমার মনে হয়েছে ‘শঙ্খচিল’ এমন একটা ছবি যা দুই বাংলায় শুধু আজকে নয়, বহু বছর ধরে টিকে থাকবে। আমার জীবনে আমি যদি দশটা ছবির নাম বলি এই মুহূর্তে, যে দশটা ছবি আমার জীবনে থেকে যাবে, তার মধ্যে ‘শঙ্খচিল’-এর বাদল চরিত্রটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাদল চরিত্রটা কোথাও মনে হয়েছে বাঙালির যন্ত্রণা, বাঙালির দুঃখ, বাঙালির রাগ, বাঙালির কষ্ট।

আনন্দ আলো : ‘শঙ্খচিল’ ছবিতে আপনি প্রযোজকও। এ কারণে আলাদা দায়িত্ব অনুভব করেছেন?

প্রসেনজিৎ : টাকা তুলতে হবে বলে প্রযোজনা করিনি। ‘শঙ্খচিল’-এর মতো সিনেমা করে যেতে চাই। ৩০-৪০ বছর পরও যেন পরবর্তী প্রজন্ম বলতে পারে এমন একটা ছবি হয়েছিলো। ইতিহাসে থেকে যাবে এ ধরনের একটা কাজের পাশে দাঁড়াব বলেই প্রযোজনায় যোগ দিয়েছি। আপনারা জানেন, ভারতের জাতীয় পুরস্কারে সেরা বাংলা ছবি হয়েছে ‘শঙ্খচিল’। এটা শুধু আমার একার অবদান নয়, টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে পুরো টিমের। এই কৃতিত্ব বাংলাদেশে ইমপ্রেস এর এবং আশীর্বাদ চলচ্চিত্রেরও। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকে বলে একটা ভালো ছবি হয়। তবে পুরস্কারের কথা ভেবে ছবি করি না। আসল হলো দর্শকের খুশি হওয়া।

আনন্দ আলো : দুই বাংলায় কি চলচ্চিত্রের বাজার বড় করা সম্ভব?

প্রসেনজিৎ: সম্ভব। আমি এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। ‘শঙ্খচিল’-এর প্রেরনায় আগামী দিনে আরও বেশকিছু যৌথ প্রযোজনার ছবি হবে। দুই বাংলার স্বার্থেই এটা করা উচিৎ। আমাদের কলকাতার প্রথম সারির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন। আবার বাংলাদেশের শিল্পীরা কলকাতায় গিয়ে কাজ করছেন। এই আদান-প্রদানটা খুব জরুরি।

হয়তো বাধা-বিঘ্ন থাকবেই। সিনেমা, গান, নাটক এমন বিষয় যেগুলোকে কখনও আটকানো যায় না। বিনোদনই পারে সব বাঁধা আর বিঘ্নকে মুছে দিতে। সেটারই একটা প্রচেষ্টা আমাদের ‘শঙ্খচিল’। নামটি এখানে মুক্তির প্রতীক।

প্রসেনজিৎকে পুরনো একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল। আপনারা ভারত থেকে যখন বাংলাদেশে আসেন তখন বোধকরি একবারও মনে হয় না ভারতের বাইরে আছেন। কারন আপনার দেশের সব টেলিভিশনই এখানে দেখতে পারেন। কিন্তু আমাদের বেলায় উল্টো হয়। আকাশ পথে ত্রিশ মিনিটের ব্যবধানে কলকাতায় নেমেই মনে হয় এক অচেনা জায়গায় এসেছি। সেখানে আমাদের টেলিভিশন নাই। সংবাদ পত্র নাই। সবই যেন অচেনা। এব্যাপারে কিছু বলবেন?

উত্তরে প্রসেনজিৎ যেন একটু ডিফেন্ট খেলার চেষ্টা করলেন। বললেন- না, না- এরকম কেন হবে? শিলীগুড়িতে কিন্তু আপনাদের টিভি চ্যানেল দেখা যায়। দুই বাংলায় টিভি চ্যানেল চালাতে একধরনের কারিগরী শর্ত আছে। আমি পুরোপুরি ব্যাপারটা জানিনা। তবে আমি বিশ্বাস করি টেলিভিশনকে পৃথিবীর কোথাও কেউ আটকে রাখতে পারবেনা। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি।

প্রসেনজিৎকে শেষ প্রশ্ন ছিল- বাংলাদেশ নিয়ে আপনার ভাবনা কি? উত্তরে তিনি বলেন, আমি ইতিপূর্বে বহুবার বলেছি। আগামীতেও বলে যাব। তাহলো পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের মধ্যে আমি কোন তফাৎ দেখি না। ভাষা, সংস্কৃতি সবই এক। আগেরবার ‘মনের মানুষ’ করতে এসে যাদেরকে পেয়েছিলাম এবার শঙ্খচিলেও তাদেরকে পেয়েছি। গৌতমদা, হাবিব ভাই, সাগর ভাই সবাই মিলেই তো এক সাথেই আছি। এক সাথেই থাকব আশা করি।