Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

কিছু গান ভবিষ্যতের জন্য তুলে রেখেছি -সুবীর নন্দী

সুবীর নন্দী এক নামেই যার পরিচিতি। দরদী কণ্ঠের আধুনিক বাংলাগানের অবিস্মরণীয় এই কণ্ঠ শিল্পী ৪৩ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গান গেয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি। বেতার থেকে টেলিভিশন। তারপর চলচ্চিত্রে একের পর এক সুরের মায়া ছড়িয়েছেন। জনতা ব্যাংকে চাকরি করেছেন দীর্ঘদিন। বেশ কিছু সঙ্গীতভিত্তিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনাও করেছেন। আধুনিক সঙ্গীতের পাশাপাশি তিনি গেয়েছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ভজন, কীর্তন এবং পল্লী গীতিতেও উজ্জ্বল আলো ফেলে চলেছেন। সম্প্রতি তার সঙ্গে কথা হয় এক বিকেলে। তার চুম্বক অংশ লিখেছেন- মোহাম্মদ তারেক

আনন্দ আলো: সঙ্গীত জীবনের ৪৩ বছর পার করলেন। আপনার অনুভূতি জানতে চাই?

সুবীর নন্দী: ৪৩ বছর ধরে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করছি গান পাগল মানুষদের প্রতি। যাদের ভালোবাসা না পেলে ৪৩ বছর গান বাজনা করা সম্ভব হতো না। দেখতে দেখতে কখন যে ৪৩ বছর চলে গেল ভাবতেই অবাক লাগছে।

আনন্দ আলো: সঙ্গীতের দীর্ঘ পথচলায় শ্রোতাদের প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছেন বলে মনে করেন?

সুবীর নন্দী: প্রত্যাশার কথা যদি বলতেই হয় তাহলে চেষ্টা করেছি। কিছুটা হয়তো সফল হয়েছি বলে এখনো গান গাইতে পারছি। আমার অনেক গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আমি মনে করি ক্রেডিটটা গীতিকার ও সুরকারদেরও।

আনন্দ আলো: গানকে সঙ্গী করে আপনার বেড়ে ওঠা নিয়ে কিছু বলুন?

সুবীর নন্দী: আমার সঙ্গীত চর্চাটা শুরু মায়ের কাছে থেকে। আমাদের পরিবারে মা আর বড় ভাই গান গাইতেন। সঙ্গীতে তালিম পাই মায়ের কাছে। তখন আমার বয়স ৭/৮ বছর। বড় ভাইকে দেখতাম ওসত্মাদের কাছে গান শিখতে। মাকে বললাম আমিও ওসত্মাদের কাছে গান শিখব। মা বললেন, এখন তুমি আমার কাছেই গান শেখ। আরেকটু বড় হও তারপর ওসত্মাদের কছে শিখবে। পরে ওসত্মাদ নায়েব আলী খান সাহেব আমাকে গান শেখান। আমার বাবাও গান পছন্দ করতেন। আমাদের বাসায় ছিল প্রচুর গ্রামোফোনের রেকর্ড। বাসায় থাকলেই বাবা রেকর্ড বাজিয়ে দিতেন। গান বিষয়টাও বোধহয় পরবর্তীতে আমাকে গায়ক হতে প্রভাবিত করেছে।

আনন্দ আলো: আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনার মনত্মব্য?

সুবীর নন্দী: সঙ্গীতাঙ্গনের বর্তমান অবস্থা বেশ ভালো। আমিতো নতুন প্রজন্মের অনেক শিল্পীর মধ্যেই অসীম সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। অনেক সিনিয়র শিল্পী বলে থাকেন, আমাদের এখানে আগের মতো গান হয় না। আমি মনে করি আগের মতো গান না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ সময় বদলে গেছে। সিনিয়র শিল্পীরা গেয়েছেন তাদের যুগের গান। সেই গান আজকের সময়ের শিল্পীদের কণ্ঠে না মানানোটাই স্বাভাবিক। সময়ের সাথে সঙ্গীতের ধারা বদলাবে, এটাকে আমি স্বাগত জানাই। সঙ্গীত নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে, এটাকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই।

আনন্দ আলো: প্লে-ব্যাকে আপনাকে একদমই দেখা যায় না। এর কারণ কী?

সুবীর নন্দী: এখন বেশির ভাগ চলচ্চিত্রে নতুন নতুন সঙ্গীত পরিচালক কাজ করছেন। নতুন শিল্পীদের সঙ্গে বেশি কাজ করছেন তারা। এ কারণে চলচ্চিত্রের গানে দেখা যায় না। এটা সময়ের দাবি। নতুনরা আসবে, কাজের মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করবে এটাই স্বাভাবিক।

আনন্দ আলো: চলচ্চিত্রের গানে পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন?

সুবীর নন্দী: হ্যাঁ। অনেক পরিবর্তন এসেছে। সুর, কথা, কম্পোজিশন সব কিছুই পাল্টেছে। এ পরিবর্তনের মধ্যেও অনেক শ্রুতিমধুর গান হচ্ছে। যা সময় উপযোগী বলে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

আনন্দ আলো: আধুনিক বাংলা গানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এতে পাশ্চাত্যের প্রভাব আজকাল বেশি চোখে পড়ছে। এটাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখছেন?

সুবীর নন্দী: আমি সম্পূর্ণ একমত যে আধুনিক বাংলা গানে বর্তমানে পাশ্চাত্যের প্রভাব পড়েছে। প্রতিটি শিল্পে ভাঙা গড়ার খেলা চলে। আমাদের সঙ্গীতেও এখন সেটা চলছে। এই ভাঙাগড়ার মধ্য থেকেই গড়ে উঠবে নতুন নতুন আঙ্গিক।

আনন্দ আলো: এক সময় গান ছিল শুধু শোনার বিষয়। এখন দেখার বিষয়ও হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার মনত্মব্য?

সুবীর নন্দী: কথাটার সঙ্গে আমি একমত। অতীতে তো দেখার মাধ্যম ছিল না। শুধু ছিল শোনার মাধ্যম। রেডিওতে গান শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। তারপর দেখার মাধ্যম এলো টেলিভিশন। যিনি গান গাইছেন তাকেও দেখার প্রয়োজন হলো। এখন মানুষ গান শুধু শুনে তৃপ্তি পায় না। যিনি গান গাইছেন তাকেও দেখতে চান। আর একটা কথা তো প্রচলিত আছেই প্রথম দর্শনে যাকে ভালো লাগে, তার সবই ভালো। কাজেই দেখার ব্যাপারটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে গানের ক্ষেত্রে সুর আর বাণী প্রধান। সুর ভালো না হলে গানের ক্ষেত্রে সবই বিফলে যাবে।

আনন্দ আলো: আজকাল অনেক শিল্পীকে দেখা যায় সঙ্গীতাঙ্গনে এলেই সবকিছু জয় করতে চান। তাদের এই প্রবণতার ভবিষ্যৎ কী?

সুবীর নন্দী: এই প্রবণতার ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার। গান সাধনার বিষয়। এখানে হুট করে সব কিছু জয় করা যায় না। চর্চা ছাড়া গান হয় না। হয়তো চমক দেখিয়ে এক বা দুই সিজন টিকে থাকা সম্ভব। কিন্তু চর্চা আর সাধনা না থাকলে সেই চমক টেকসই হবে না।

আনন্দ আলো: আজকাল দেখা যায় গানের ক্ষেত্রে গলার চেয়ে বাদ্যযন্ত্র বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রবণতার ভবিষ্যৎ কী?

সুবীর নন্দী: গানের তো বিভিন্ন শাখা আছে। প্রতিটি শাখার আলাদা নাম আছে। এখন বাদ্যযন্ত্র প্রধান গানের একটা আলাদা নাম দেয়া দরকার। গান যদি হয় তাহলে গলাটা বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। গলার সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র যাবে বলেই সঙ্গীতশাস্ত্রে এটাকে বলা হয় যন্ত্রানুষঙ্গ।

আনন্দ আলো: বর্তমান সময়ের শিল্পীদের গান দীর্ঘজীবী হচ্ছে না কেন?

সুবীর নন্দী:  দীর্ঘজীবী যে একেবারেই হচ্ছে না তা নয়। হয়তো একটু সময় লাগছে। দেখা যাবে এখনকার গানগুলো এক সময় কালজয়ী হয়ে গেছে। এখনো অনেক ভালো গান হচ্ছে। হয়তো এর সংখ্যাটা একটু কম।

আনন্দ আলো: ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’… গানটির প্রেক্ষাপট জানতে চাই।

সুবীর নন্দী: এই গানটি গীতিকার প্রয়াত নজরুল ইসলাম বাবু সুর করার জন্য শেখ সাদী খানের হাতে দেন। এই গানটি গাওয়ার আগে অনেক তর্ক-বির্তক হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এটা কেমন কথা- পৃথিবীতে প্রেম নেই। সাদী ভাই গানটি সুর করার পর জোর দিয়ে আমাকে বললেন, এই গানটি আপনার কণ্ঠে ভালো লাগবে। আপনি গানটি গাইবেন।

আনন্দ আলো: আপনার অনেক জনপ্রিয় গান আছে। কিন্তু জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও কিছু গান গাওয়া থেকে আপনি সব সময়ই বিরত থাকেন। এটার কারণ কী?

সুবীর নন্দী: আমার কিছু পছন্দের গান আছে যেগুলোকে আমি আগলে রাখতে চাই। কারণ এ ধরনের কম্পোজিশন আর হবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। এখন সব ভালো গান যদি একেবারে ছেড়ে দেই, তাহলে বিপদে পড়ে যেতে পারি। ভবিষ্যতে কী গাইব। তাই কিছু ভালো গান আমি পরবর্তীকালে গাওয়ার জন্য তুলে রেখেছি।

আনন্দ আলো: আমাদের দেশে অনেক শিল্পী আছেন শেষ বয়সে তারা অর্থকষ্টে ভোগেন, এটা কেন হয়?

সুবীর নন্দীর: বিভিন্ন পেশার লোক নানা উপায়ে তাদের কাজের যোগ্য পারিশ্রমিক আদায় করে নেন। এজন্য তারা সংগঠিত। আমরা শিল্পীরা নিজেদের পাওনা আদায়ে মনোযোগী নই। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। শিল্পীদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিজেদেরও ভাবতে হবে। পাশাপাশি দেশেরও শিল্পীদের প্রতি কিছু দায়িত্ব রয়ে যায়।

আনন্দ আলো: আপনার কাছে পরিবার কী?

সুবীর নন্দী: পরিবার আমার কাছে নিজের দেহের একটা অংশ।

আনন্দ আলো: আপনার পরিবার সম্পর্কে কিছু বলুন?

সুবীর নন্দী: স্ত্রী পূরবী আর কন্যা মৌ, নাতিনকে নিয়ে আমার পরিবার। মৌ বেশ ভালো গান গাইত। কিন্তু ইদানীং সে গান ছেড়ে দিয়েছে। এ ছাড়াও আমার আরেকটা পরিবার আছে। আমাদের দেশে যারা গান করে তাদের সবাইকে নিয়েই আমার সেই পরিবার।