Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আমার বাবা পৃথিবীর সেরা মানুষ! : সম্রাট

নায়করাজ রাজ্জাকের তিন ছেলে দুই মেয়ে। বড় ছেলে বাপ্পারাজ চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা ও নায়ক। মেঝো ছেলে বাপ্পিরাজ একজন সফল ব্যবসায়ী। সবার ছোট সম্রাট। রাজ্জাক পরিচালিত ‘বাবা কেন চাকর’ ছবির মাধ্যমে নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সম্রাট। প্রথম ছবি সুপার হিট ব্যবসা করার পর নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন সম্রাট।
বড় মেয়ে শম্পা বিয়ে হওয়ার পর অকালে মৃত্যুবরণ করেন। ছোট মেয়ে ময়না নায়করাজের সঙ্গে ‘জোকার’ ছবিতে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এরপর আর কোনো ছবিতে তাঁকে দেখা যায়নি। ময়না বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন।
নায়করাজ রাজ্জাকের ছেলে-মেয়েরা বাবা অনত্মপ্রাণ। বাবাকে ছাড়া সনত্মানরা কিছু বুঝতে চান না। সমাজে আজকাল এমন পরিবার পাওয়া বিরলও বটে। আভিজাত্যের মধ্যে বড় হয়ে আনত্মর্জাতিক মানের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তারা ভুল পথে পা বাড়ায়নি। বরং রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়ে সনত্মানরা আদর্শ পরিবার গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। নায়ক রাজের বড় দুই ছেলে সংসার ও ব্যবসা নিয়ে বেশি ব্যসত্ম থাকায় ছোট ছেলে সম্রাট বাবা-মায়ের সঙ্গে বেশি সময় কাটান। এক বিকেলে আনন্দ আলোর কাছে বাবা রাজ্জাক সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন নায়ক সম্রাট। তারই চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য।
আমার তখন সব কিছু বোঝার বয়স বয়নি। ছোট্ট আমি একটু একটু কথা বলতে শিখেছি। ওই সময় বাবার কাছে অনেক তারকা আসতেন, পরিচালক প্রযোজকরা আসতেন। চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক কথা বলতেন। আমি বাবার কোলে বসে সে সব শুনতাম কিন্তু বুঝতামনা। স্কুলে যখন যেতে শুরু করি তখন অভিনয়, পরিচালনা, ফিল্মক্যান, স্ক্রীপ্ট, সিডিউল, রিলিজ ইত্যাদি একটু আধটু বুঝতাম।
বাবার শত ব্যসত্মতা থাকলেও আমাদের কিন্তু ঠিকই সময় দিতেন। রাতে সবাই মিলে ডাইনিং টেবিলে বসে মজার মজার খেতে খেতে বাবা তার সারাদিনের ঘটে যাওয়া গল্পগুলো বলতেন। আমরা তন্ময় হয়ে শুনতাম। খোঁজ-খবর নিতেন কার কেমন পড়াশোনা হচ্ছে, কে কেমন রেজাল্ট করেছে। এমাসে কার কি বায়না আছে, খুব মনোযোগ দিয়ে এসব শুনতেন।
বাবার সময় সুযোগ বুঝে কখনো লংড্রাইভে বেড়াতে যেতাম, সবাই মিলে কখনো রেস্টুরেন্টে খাওয়া হতো, কখনো আবার সবাই মিলে যেতাম বিদেশে বেড়াতে। যদিও এখনো নানান দেশে ঘুরতে যাওয়া হয়। এই নববর্ষের (২০১৬) দ্বিতীয় দিন এক সপ্তাহের জন্য ঘুরতে গিয়েছিলাম কলকাতায়।
বাবা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেলিব্রেটি। এটা তিনি তার কোনো কথায় বা কাজে বুঝাতে চান না। ঢাকার বাইরে বেড়াতে গেলে রাসত্মার পাশে টং দোকানে চা খেতে বসে যান। তাকে দেখে কেউ চিনে ফেললে তাদের সঙ্গে আনত্মরিকভাবে কথা বলতে থাকেন। বাসায় বাবা সারাক্ষণ আনন্দময় সময় কাটাতে পছন্দ করেন। গম্ভীর বা রাগী মুখ বাবার একেবারে পছন্দ নয়। তিনি যদি কখনো রাগও করেন তবে সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এখন একটু আবেগপ্রবণ হয়ে গেছেন। অল্পতে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন। বাবা খুব ভোজন রসিক, খেতে খুব পছন্দ করেন বিশেষ করেন দেশি সব খাবার দাবার। দেশি মাছ ও মাংস তার প্রিয়। সাম্প্রতিক সময়ে অসুখ থেকে সেরে উঠার পর বেছে বেছে খাচ্ছেন। বাবাকে আসলে বলা যায় খাঁটি বাঙ্গালী। একেবারে মাছে ভাতে বাঙ্গালী। তার কাছে দেশটা আগে, দেশের মানুষ আগে তারপর অন্যকিছু। দেশের কোনো সাফল্যের কথা টিভিতে দেখলেই বাবা কেঁদে ফেলেন। দেশ ও মাকে তিনি একই পাল্লায় মাপেন। দেশের প্রতি মমত্ববোধ, দায়বদ্ধতার বিষয়গুলো আমাদেরও শিখিয়েছেন।
বাবার পুরনো চলচ্চিত্রগুলো যখন ডিভিডিতে বা টিভিতে দেখি তখন একটি কথা আমার বার বার মনে হয় তা হলো আজকে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে যে স্টাইল নায়করা ছবিতে প্রদর্শন করছেন আমার বাবা পঞ্চাশ বছর আগে তা দেখিয়েছেন। তার আধুনিকতা, তার স্টাইল, ড্রেস সবকিছু আমাদের কাছে এখনো ঈর্ষণীয়। ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘অননত্ম প্রেম’, ‘রংবাজ’ ছবি যখন দেখি তখন মনে হয় এখনকার ছবিতে নায়কের সেই স্মার্টনেস কোথায়? মুভমেন্ট, ক্যামেরালুক, চাহনি এবং ভয়েস সব কিছুতে এক্সট্রা অর্ডিনারী একটা ব্যাপার ছিল বাবার মধ্যে। বাবা সাধারণ একটি বিষয় ছবিতে অসাধারণ করে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। আমার কাছে বাবার ভয়েসটা অসাধারণ লাগে। যেখানে যে ধরনের ভয়েস দিতে হবে সেখানে সেভাবেই ভয়েস দিতেন।
আমার স্ক্রীপ্ট ও পরিচালনায় একটি নাটক প্রচার হবে চ্যানেল আইতে বাবার জন্মদিন উপলক্ষে ২৩ জানুয়ারি। দীর্ঘ দুই বছর পর বাবা এই নাটকের মাধ্যমে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। নাটকের কয়েকটি দৃশ্যে বাবার কয়েকটি রিয়্যাকশন শট দরকার ছিল। বাবাকে বলার পর তিনি আগে ডায়ালগ পড়লেন। তারপর রিয়্যাকশন থ্রো করলেন। আমি দেখে অবাক হয়ে যাই। দীর্ঘদিন পর ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু ডায়ালগ পড়ে কীভাবে তিনি এই রিয়্যাকশন দিলেন সেটা অজানাই রয়ে গেছে। বাবার চেহারাটাই আসল। ডায়ালগ অনুযায়ী নিজের চোহারাকে কিভাবে যেন পরিবর্তন করে নেন। যখন হাসেন তখন সত্যিই হাসি দেখে আনন্দ হয় আবার যখন কান্নার দৃশ্যে অভিনয় করেন তখন দর্শকেরও কান্না পায়। রাগের কোনো দৃশ্যে অভিনয় করে ভয় পাইয়েও দিতে পারেন। আসলেই তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ শিল্পী।
বাবা আমার কাছে পৃথিবীর সেরা মানুষ। তার মতো ব্যক্তিত্ব, তার মতো আধুনিক, তার মতো ন্যায়পরায়ণ মানুষ আমার চোখে দ্বিতীয়টি নেই। বাবা সনত্মানদের প্রতি যে কর্তব্য পালন করেছেন বিগত দিনগুলোতে এবং এখনো যে ভাবে আমাদের আগলে রেখেছেন তা দেখে মাঝে মধ্যে মনে হয় আমরা কি বাবার প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারছি? বাবা আমাদের কখনো গায়ে হাত তুলেননি কিন্তু তিনি কড়া শাসন করেছেন দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ পিতার মতো করেই।
অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন বাবা ও অভিনেতা হিসেবে নায়করাজ রাজ্জাক কেমন? আমি তফাৎটা খুব ভালোভাবে ডিফাইন করতে পারি না। বাবা আমাদের কাছে একজন আদর্শবান মানুষ, কর্তব্যপরায়ণ এবং দায়িত্বশীল। অভিনেতা হিসেবেও বাবা যেন তেমনই। খুবই সচেতন দায়িত্ববান, কাজের প্রতি একনিষ্ট। ব্যক্তিজীবন ও অভিনয় জীবন দু’জায়গাতেই তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকেন সব সময়। তার ৭৫তম জন্মদিনে এইটুকু বলতে চাই বাবা আমরা আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি।