Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

নায়করাজকে ছোঁয়ার ক্ষমতা আমার নিজেরও নাই : রাজ্জাক

নায়ক হিসেবে তিনি পেয়েছেন ‘রাজ’ উপাধি। নামের সঙ্গে মিলিয়ে তাকে ডাকা হয় নায়করাজ রাজ্জাক। অভিনয় করেছেন তিনশোর অধিক ছবিতে। তিনি এক জীবনত্ম কিংবদনত্মী অভিনেতা। কিন্তু পরিচালক হিসেবে তিনি কেমন? এ সম্পর্কে নিশ্চয়ই অনেকেরই আগ্রহ আছে। নায়করাজ আনন্দ আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন শুধু তার পরিচালনার জীবন নিয়ে। আসুন শুনি পরিচালক রাজ্জাকের কথা- লিখেছেন কামরুল আহসান

আনন্দ আলো: নায়ক হিসেবে এক নম্বর ছিলেন। অভিনেতা হিসেবে কিংবদনিত্মর স্বীকৃতি পেয়েছেন। পরিচালনায় এলেন কেন?

রাজ্জাক: জীবনে তো একটা অদল-বদল ঘটেই থাকে মানুষের। প্রত্যেকটা কাজেরই একটা লক্ষ্য থাকে। প্রথম অভিনয় শুরু করেছিলাম স্টেজে। সেখান থেকে চলচ্চিত্রে এলাম। পরিচালনার শখ আমার প্রথম থেকেই ছিল। এই শখ থেকেই অভিনয়ের পাশাপাশি আমি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি কামাল আহমেদের সঙ্গে। আর পরিচালনাটা একটা নেশা। এর জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি থাকতে হয়। পুরো ছবিটাই পরিচালকের মাথায় থাকতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে পরিচালনাটা অনেক চ্যালেঞ্জিং একটা ব্যাপার। তাছাড়া অভিনয় করতে করতে একটা একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল। অভিনয় আমি যথেষ্ট করেছি। তাই মনে হলো পরিচালনায় আসি। যেহেতু কাজটা আমি জানি।

আনন্দ আলো: আপনার প্রথম পরিচালিত ছবি কোনটি?

ananta-prem-1972রাজ্জাক: অননত্ম প্রেম। ১৯৭২-৭৩ সালে করেছি। অবশ্য ইচ্ছে ছিল না এত তাড়াতাড়ি পরিচালনা করার। কিন্তু যেহেতু একটা সেন্টিমেন্টের ব্যাপার ছিল তাই করে ফেলেছি আর কি…

আনন্দ আলো: এ পর্যনত্ম মোট কতগুলো ছবি পরিচালনা করেছেন? এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবির নাম বলবেন?

রাজ্জাক: ১৮টি। মৌ চোর, বদনাম, অভিমান, সৎ ভাই, চাঁপা ডাঙ্গার বউ, বাবা কেন চাকর। সবগুলো ছবিই আমার নিজস্ব প্রোডাকশন থেকে করা। বাইরের ছবিতো আমি করি না। একটাই করেছিলাম উত্তর ফাল্গুনী। সামনে আরেকটি বাইরের প্রোডাকশনের ছবি করেছি ইমপ্রেস টেলিফিল্মের আয়না কাহিনী।

আনন্দ আলো: নায়ক হিসেবে আপনি যতখানি সফল, যে পর্যায়ে গেছেন, পরিচালক হিসেবে কী মনে হয় কতখানি সফল হয়েছেন?

রাজ্জাক: নায়ক হিসেবে আমি যেখানে গেছি পরিচালক হিসেবে সেখানে যেতে পারব না। সে সময়ও আমার নেই। আর নায়করাজকে ছোঁয়ার মতো ক্ষমতা কারো নেই। আমার নিজেরও নেই।

আনন্দ আলো: আমাদের চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলুন।

রাজ্জাক: মাঝখানে আমরা খুব হতাশার মধ্যে ছিলাম। কয়েক বছর আগে খুব খারাপ ছিল অবস্থা। অশ্লীলতা একদম ক্যান্সারের মতো আঁকড়ে ধরেছিল। তারপর কাটপিস, পাইরেসি ইত্যাদি কারণে চলচ্চিত্র ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছিল। তখন অনেক গুণী অভিনেতা অভিনেত্রী চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে গেছেন। যা হোক এখন আবার চলচ্চিত্রে সুস্থতা ফিরে এসেছে। সবাই কাজ করতে এসেছে। নতুন নতুন ছেলেমেয়েরাও আসছে। আমার মনে হয় আমাদের বর্তমানে চলচ্চিত্র বেশ ভালোর দিকেই যাচ্ছে।

আনন্দ আলো: এই যে আমরা ভালো বলছি। অশ্লীলতা নেই বলেই ভালো কিন্তু ভালো লক্ষণ কী? একটি ছবি কেন ভালো হয়?

রাজ্জাক: ভালো ছবি মানে একেবারে আলতু ফালতু ছবি হচ্ছে না। হ্যাঁ, হয়তো আমাদের ছবি আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে যাচ্ছে না। কিন্তু আমাদের কালচার অনুযায়ী যেসব ছবি হয় সেসব ছবি হচ্ছে। বিশেষ করে নতুনরা যারা আসছে তাদের নিয়ে আমি খুব আশাবাদী। নতুনদের দরকার। ওরাই ভালো করবে। এখন ওদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে আমরা যদি টিকিয়ে রাখতে পারি এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি। আর সময় উপযোগী ভালো ছবি তো অবশ্যই হচ্ছে। ছবির গল্প ভালো হচ্ছে। নির্মাণ ভালো হচ্ছে।

আনন্দ আলো: কিন্তু একটা কথা প্রচলিত হয়ে গেছে যে আমাদের চলচ্চিত্র একটা নির্দিষ্ট ফর্মুলার মধ্যে আবদ্ধ…

রাজ্জাক: পৃথিবীর সব চলচ্চিত্র ফর্মুলার মধ্যে আবদ্ধ। হলিউডের, বলিউডের ছবিও ফর্মুলা মেনেই চলে।

আনন্দ আলো: কিন্তু হলিউড, বলিউডের ছবিতে অনেক বিষয় বৈচিত্র্য আছে। সাইকোলজিক্যাল ছবি হচ্ছে, ফিলোসফিক্যাল ছবি হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের ছবি শুধু প্রেম, ক্ষুধা, অভাব এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

রাজ্জাক: আমাদের দর্শক কারা? তাদের যেমন দর্শক আছে আমাদের তো তেমন দর্শক নেই। এখন তাদের সাথে তো আমাদের তুলনা করলে হবে না। আমাদের কথা ভাবতে হবে, আমাদের অবস্থা অনুযায়ী। আমাদের দেশে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা কতজন? এখন আমাদের দেশে একটা সায়েন্সফিকশন বানালে কটা লোক বুঝবে? কটা লোক হলে গিয়ে ছবিটা দেখবে? আমাদের চলচ্চিত্র দেখে কারা? নিম্ন মধ্যবিত্তরা। মধ্যবিত্ত দর্শকরাও এখন আর হলে যায় না। সমাজের একেবারে লোয়ার ক্লাশ দর্শক আমাদের ছবি দেখে। সুতরাং তাদের চাহিদা অনুযায়ী কিছুটা ফর্মুলা ধরনের ছবিতো হবেই।

আনন্দ আলো: এ কথাটা দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে, শিক্ষিত লোকজন বাংলা ছবি দেখে না। তো তাদের দেখানো যায় না কেন? তাদের দেখার মতো ভালো ছবি হচ্ছে না কেন? ভালো ছবি হলে তারা কেন দেখবে না?

রাজ্জাক: দেখবে না, এসব শিক্ষিত লোকজন তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল টাইপের। বাংলা ছবি দেখাকে তারা গর্হিত কাজ মনে করে।

আনন্দ আলো: চলচ্চিত্র তো বিশাল একটা গণমাধ্যম। চলচ্চিত্র শিল্প আপনার দৃষ্টি থেকে কী? আর্ট না ইন্ডাস্ট্রি?

রাজ্জাক: চলচ্চিত্র আর্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি দুটোই। ব্যবসা না থাকলে তো আর্টও থাকবে না। বিশাল অংকের টাকা ইনভেস্ট করতে হয় এর পেছনে। চলচ্চিত্রকে সারা পৃথিবীতেই বড় গণমাধ্যম বলে। কিন্তু শুধু মাস্টারি করলেই হবে না। যারা ছবি দেখতে হলে যায় তারা বিনোদন উপভোগ করতেই যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায় না। তারপরও ভিন্নরকম কিছু ছবি হয়। সারা পৃথিবীতেই হয়েছে। আমাদের এখানেও কিছু হয়েছে। কিন্তু আমার যেটা মনে হয় চলচ্চিত্র এখন শুধু এন্টারটেইনমেন্টের মধ্যে আবদ্ধ। হলিউড, বলিউড সারা পৃথিবীতেই।

আনন্দ আলো: পরিচালক হিসেবে আপনাকে কারা প্রভাবিত করেছেন?

রাজ্জাক: আমাকে একজনই প্রভাবিত করেছেন। আমাকে যিনি নায়ক বানিয়েছিলেন। জহির রায়হান সাহেব। তার কাছ থেকেই আমার যত সব এচিভমেন্ট। তার অনুপ্রেরণাতেই আমি আজ এতদূর এসেছি। তার ছবিতে অভিনয় করেছি। কিন্তু তার সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে আমি থাকতাম। চিত্রনাট্য লেখা থেকে শুটিং, গান রেকর্ডিং, ডাবিং, এডিটিং তিনি যখন যা করতেন আমি তার পাশাপাশি সবসময় ঘুরতাম। একটা স্বপ্ন ছিল তো আগে থেকেই যে একদিন পরিচালক হব। তো পরিচালনার সবকিছু তার কাছ থেকেই আমি গিলে খেয়েছি।

আনন্দ আলো: জহির রায়হান সম্পর্কে আরো কিছু বলুন। তার হারিয়ে যাওয়াটা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য কতখানি ক্ষতি হয়েছে?

coverরাজ্জাক: জহির রায়হান সম্পর্কে বলার মতো আর নতুন কিছু নেই। তিনি আমার ওসত্মাদ, আমার গুরুজন। এতটুকুই বলতে পারি যে তিনি থাকলে আমাদের চলচ্চিত্রের আজকে এ অবস্থা হতো না। এতদিনে আমাদের চলচ্চিত্র বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যেত। জহির রায়হান একজনই। এ রকম ডিরেক্টর আর হবে না। এরকম ব্যক্তিত্বও আর হবে না।

আনন্দ আলো: আমাদের দেশে বিকল্পধারা নামে একটি চলচ্চিত্র ধারা আছে। যারা ঠিক এফডিসিকেন্দ্রিক ছবি বানায় না। এই ধারা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

রাজ্জাক: আমি বিকল্পধারা বা মূলধারা বলে কোনো কিছু মানি না। যারা ছবি বানায় তারা ছবিই বানায়। এর মধ্যে দুএকজন একটু অন্যরকম ছবি বানায়। চলচ্চিত্রের ভাষা একটাই। এখন বিকল্পধারা বলে একদল লোক একটু অন্যদিকে চলে। এফডিসিকেন্দ্রিক ছবি বানায় না বলে গর্ববোধ করে। তাদের ওই চলাই শেষ হয়ে যাবে। তারা কখনো মেইনস্ট্রিমে আসতে পারবে না। তারা হয়তো ভাবে যা হোক আমরা ফেস্টিভ্যালে যাচ্ছি, দুএকটা আনত্মর্জাতিক পুরস্কার পাচ্ছি। তারা যদি সেটাই মনে করে তাতে তো আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের কোনো উপকার হলো না। এদেশের দর্শকও তৈরি হলো না। তারা একটি ছবি তৈরি করছে। কে দেখছে? মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক দেখছে। দেশের সাধারণ মানুষ তাদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাতে লাভ কী? তাদের উচিত এমন ছবি বানানো যাতে এদেশের দর্শক বাড়ে। কিন্তু তারা তা না করে একটি ছবি বানিয়ে বগলে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি মনে করি তাদের এফডিসিতে আসা উচিত। তাতে দেশের উপকার হবে।

আনন্দ আলো: এখন ডিজিটাল ফিল্ম নামে নতুন একটা টেকনোলজি এসেছে। অনেকে নাটক বানিয়ে বলছে ফিল্ম। এ বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?

রাজ্জাক: না, এটা অন্যায়। নাটক বানিয়ে তো ফিল্ম বলা যাবে না। ফিল্ম ইজ ফিল্ম। ডিজিটাল ক্যামেরায় শুট করে সেটা থার্টি ফাইভে কনভার্ট করতে হবে। এখন টেকনোলজি এত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে যে একটা সময় হয়তো সবাই ডিজিটাল ক্যামেরাতেই শুট করবে। কিন্তু সেটা শুধু ডিভিডিতে দেখলেই তো হবে না। বড় পর্দায় দেখার মতো ব্যবস্থা করতে হবে। ফিল্মের যে আলাদা একটা ভাষা আছে সেটা মানতে হবে।

আনন্দ আলো: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

রাজ্জাক: তোমাকেও ধন্যবাদ।