Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

সবুজ ছোঁয়া লাগুক প্রাণে : মুকিত মজুমদার বাবু

আদিকাল থেকে মানুষ তার শিকার প্রবৃত্তিকে দমন করতে পারেনি। আজো শিকার মানেই আনন্দ। শিকার মানেই উৎসব। মানুষ সভ্যজগতের বাসিন্দা হয়েও গা থেকে মুছে ফেলতে পারেনি আদিমতার কালি। কয়েকযুগ আগেও বাঘ শিকার ছিল সাহসিকতার পরিচায়ক। রাজ-রাজাদের গল্প উঠলেই নানী-দাদীরা আজো বন্যপ্রাণী শিকারের বর্ণনা আকর্ষণীয় করে বলেন শিশুদের মনে আনন্দ দেয়ার জন্য। রাজ-রাজাদের পর জমিদারি প্রথাতেও চল ছিল শিকারের। বন্যপ্রাণী শিকার ছিল অবসরের বিনোদন কিংবা বংশপরম্পরায় অতীত ঐতিহ্যকে ধরে রাখার প্রয়াস। অনেক জমিদার কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তি বাঘ শিকার করে তার গায়ে পা রেখে বন্দুক হাতে ছবি আঁকিয়ে বীরত্বের সেই স্মরণীয় মুহূর্তকে ধরে রাখতেন। আভিজাত্য আর মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে বৈঠকখানার দেয়ালে টাঙিয়ে রাখতেন বাঘের চামড়া, হরিণের শিঙসহ হাতির দাঁতের কারুকাজ করা নানা বিলাসী সামগ্রী। অনেক রাজা-জমিদার আবার শখ করে বাঘ-হরিণ-হাতিসহ নানা প্রজাতির জীবজন্তু পুষতে ভালোবাসতেন।

কয়েক যুগ আগেও বাঘ শিকারিকে সরকারিভাবে পুরস্কৃত করা হতো। অভিনন্দন জানানো হতো। সমাজের মানুষ তাঁকে সমীহ করত। সময়ের কাঁটায় অনেক বেলা গড়িয়েছে। আজ আর সেই রাজা নেই। বিলোপ ঘটেছে জমিদার প্রথারও। শিকারের জন্য এখন কাউকে পুরস্কৃত করা হয় না। উৎসাহিত কিংবা অনুপ্রাণীত করা হয় না। বিবেকবান মানুষের কাছে শিকারি এখন একজন ঘৃণিত মানুষ, বিবেক বর্জিত মানুষ। মানুষ আজ বুঝতে শিখেছে মানুষ আর প্রকৃতি একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতি মানুষ ছাড়া টিকে থাকলেও প্রকৃতি ছাড়া মানুষ টিকে থাকতে পারে না। মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রকৃতিকে অবশ্যই টিকিয়ে রাখতে হবে। কেননা মানুষ প্রকৃতির সন্তান। সেই পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদেই মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংস না করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রণয়ন করেছে আইন। প্রচলন হয়েছে প্রকৃতিবিষয়ক বিভিন্ন দিবস। এই দিবসসমূহ প্রবর্তিত হয়েছে ওই বিষয় সম্পর্কে জানতে ও জানাতে। দিবসের পাশাপাশি রয়েছে প্রকৃতিবিষয়ক মেলা। সরকারিভাবে সারা দেশে পালন করা হয় বৃক্ষ মেলা। এছাড়া পাখি মেলা, প্রজাপতি মেলা, শুশুক মেলা, প্রকৃতি উৎসবসহ নানা মেলা প্রকৃতি সংরক্ষণে আমাদের প্রয়োজনের তাগিদেই আয়োজন করা হয়। তেমনি সময়ের দাবিতে দেশের ইতিহাসে বেসরকারিভাবে প্রথম বিষয়ভিত্তিক আয়োজন ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন-চ্যানেল আই প্রকৃতি মেলা’।

‘সুন্দর প্রকৃতিতে গড়ি সুস্থ জীবন’- এই শ্লোগানকে ধারণ করে চ্যানেল আই কার্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপিত হয় ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন-চ্যানেল আই প্রকৃতি মেলা’, যা শুরু হয়েছিল ২০১২ সাল থেকে। এ মেলাতে প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ উঠে আসে বিভিন্ন ব্যতিক্রমী আয়োজনের মধ্য দিয়ে। প্রকৃতির সুর সঙ্গীত নানা ব্যঞ্জনায় ভিন্নমাত্রা নিয়ে ধরা দেয় মেলা প্রাঙ্গণে। থাকে অভিনব ক্যারেক্টার শো, যা নানা তত্ত্ব ও তথ্যের মাধ্যমে সময়ের প্রেক্ষিতে হাজির করা হয় দর্শকদের সামনে। পেঁচা, শুশুক, ব্যাঙ, বাঘ, হরিণ, শকুনসহ (প্রাণীর পোশাকে মানুষ) নানা প্রাণী তাদের ওপর মানবসৃষ্ট দুঃখ-বেদনা ও সমস্যার কথা তুলে ধরে। ক্যারেক্টার শো ছাড়াও সচেতনতা সৃষ্টিতে মেলায় অংশগ্রহণ করেন দেশের প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা প্রকৃতিবিষয়ক বিভিন্ন তথ্যের পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেন মানুষের ভেতর জন্ম নেয়া বিভিন্ন কুসংস্কারের নানা দিক। থাকে প্রাণপ্রকৃতি নিয়ে ছবি প্রদর্শনী, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সামুদ্রিক মাছের স্টল, জীবন্ত প্রজাপতি ঘর, পাখিদের নিয়ে তথ্য-উপাত্ত। বাংলাদেশের নদ-নদীর কথাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের পসরা সাজিয়ে বসে দেশের নানা স্থান থেকে আসা নার্সারিগুলো। প্রকৃতি নিয়ে গ্রামীণ ঐতিহ্যের গানে চলে খ্যাতিমান শিল্পীদের প্রকৃতিবন্দনা। গানের সাথে থাকে নানা সাজের নাচের আয়োজন ও মুকাভিনয়। নানা প্রজাতির ফলদ, বনজ ও ওষুধি গাছে মঞ্চ ও মেলাপ্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে সবুজে মোড়ানো একখণ্ড- সাজানো বাগান। মৃদু বাতাসে থর থর কাঁপে গাছের পাতা। ভালো করে কান পাতলে শোনা যায় কবিতার ছন্দ ও তাল।

সবুজের চাদরে ঢাকা সোনার বাংলা আজ সবুজ হারিয়ে বিবর্ণ। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের ফলে আমরা হারাতে বসেছি রূপসী বাংলার রূপের ঐতিহ্য। দেশের প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করতে, পরিবেশকে বাঁচাতে, প্রকৃতির ভয়াবহ বিপর্যয় রুখতে প্রকৃতি সংরক্ষণের কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। তাই ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন-চ্যানেল আই প্রকৃতি মেলা’ সারা দেশের মানুষের মাঝে প্রকৃতি রক্ষার বার্তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে।

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন