Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

স্বপ্ন ভাঙ্গলেও সাহস বেড়েছে

সাব্বিরের এই মাথা নীচু করে বসে থাকা ছবিটা প্রতীকি অর্থে অনেক কিছুই তুলে ধরেছে। প্রথম আলোয় প্রকাশিত ছবিটির ক্যাপসনে লেখা হয়েছে- অপরাজিত ৬৪ রানের দুর্দানৱ এক ইনিংসেও জেতাতে পারলেন না দলকে। উইকেটে বসে পড়লেন হতাশ সাব্বির রহমান। আর তখনই তাকে সানৱ্বনা দিতে এগিয়ে এলেন বিজয়ী দলের জো রুট। এটাতো খেলার আনুষ্ঠানিক অংশ। এটাই হলো ক্রিকেটের শিষ্ঠাচার। পরাজিত দলকে সানৱ্বনা দেয়া ক্রিকেট সংস্কৃতিরই অংশ। তবে এই যে সানৱ্বনা দেয়ার ভঙ্গি তার মাঝেও কী লুকিয়ে থাকে না জেদের বহিঃপ্রকাশ। যেমন ছবিটির ক্যাপসন যদি এমন হয়- কী খুবতো ফালাফালি করল্যা। শেষ পর্যনৱ হারাইতে পারলা? আবার এরকম- ‘তোমার জন্য সত্যি দুঃখ হচ্ছে। কী চেষ্টাটাই না করল্যা। ভুইল্যা যাও। আজ হয় নাই। নিশ্চয়ই কাল হবে… ছবিটির ক্যাপসন নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না। খেলায় জয় পরাজয় থাকবেই। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় লড়াই করে হেরেছি নাকি খেলার আগেই হেরে বসে আছি? হ্যা গর্বের সাথে বলতে পারি আমরা লড়াই করে হেরেছি। আমরা বলব এটা এক অর্থে জিতে যাওয়া। দীর্ঘদিন ধরে টেস্ট খেলার মধ্যে ছিল না বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। সে কারণে অনেকের ধারণা ছিল এবার বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশ ভালো করবে না। কারন টেস্টে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অভিজ্ঞতা কম। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সব ধারনা পাল্টে দিয়েছে। অনেকের ধারনা ছিল চট্টগ্রামে প্রথম টেস্ট হয়তো পাঁচদিনে গড়াবে না। কিন্তু এই ধারনাও ভুল প্রমানিত হয়েছে। বাংলাদেশকে যেখানে গুরুত্বের মধ্যেই রাখা হয়নি সেখানে বাংলাদেশ তো প্রথম টেস্টে জিতে যাচ্ছিলো প্রায়। ইংল্যান্ড দল চট্টগ্রাম টেস্ট জয়ের পর বলেছে এটি তাদের দলের একটি স্মরণীয় সাফল্য। হ্যা, চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের সাফল্যও কম নয়। একটি জাতীয় দৈনিকে লেখা হয়েছে ‘স্বপ্ন ভাঙ্গলেও সাহস বাড়ল।’ সত্যি সত্যি সাহস বেড়েছে বাংলাদেশের। খেলা শেষে দেশের আরেকটি একটি জাতীয় দৈনিকে সাব্বির রহমান সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। আনন্দ আলোর পাঠকদের জন্য তা পত্রস্থ করা হলো-

প্রশ্ন: প্রথমেই নিষ্ঠুর একটা প্রশ্ন- মাঠে হেরে যাওয়ার মুহূর্তটির অনুভূতি কী ছিল?

সম্পর্কিত

সাব্বির: খুব খারাপ লেগেছে। এখনো লাগছে। জিততে পারলে তো অবশ্যই ভালো হতো। তবে এখনকার কথা যদি বলেন, আমি বলব আমরা অনেক ভালো খেলেছি। ইংল্যান্ডের মতো টিমের বিপক্ষে খেলা…ওরা অনেক টেস্ট খেলে আর বাংলাদেশ টেস্ট খেলতে নেমেছে কত দিন পর। তারপরও আমরা প্রথম চার দিন তো সমানে সমানেই লড়েছি।

প্রশ্ন: কাল রাতে ঘুম হয়েছে?

সাব্বির: (হাসি) হ্যাঁ, ঘুমিয়েছি তো। তবে কয়েকবার ঘুম ভেঙেছে। প্রতিবারই মনে হয়েছে, ১৬ কোটি মানুষ আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে আছে।

প্রশ্ন: তাইজুলকে আগলে না রেখে ওকে যেখানে স্ট্রাইক দিয়েছেন, অনেকে এটির সমালোচনা করছে। আপনার চিনৱাটা কী ছিল?

সাব্বির: তাইজুল যখন নেমেছে, তখনো আমাদের ৫২ রান (আসলে ৪৮) লাগে। ওকে স্ট্রাইক না দিলে আজ (কাল শেষ দিনে) হয়তো আমাদের আরও ৪০-৪৫ রান লাগত। আমি কোচকে মেসেজ পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, কী করব। তাইজুলকেও জিজ্ঞাসা করেছি, ‘দোস্ত, তুই পারবি না?’ ওর আত্মবিশ্বাস ছিল। ও রান করায় আমার ওপর থেকেও চাপটা একটু কমে গিয়েছিল। আমি একাই সব দায়িত্ব নিয়ে নিলে বাড়তি কিছু করতে গিয়ে আমিই হয়তো আউট হয়ে যেতাম। তাইজুল তো ভালোই ব্যাটিং করছিল। ওর দুর্ভাগ্য, আউট হয়ে গেল!

প্রশ্ন: এত সব উত্থান-পতন, নাটকীয়তার পর টেস্টটা শেষ পর্যনৱ আপনাদের এই জুটিতেই স্থির হয়ে গিয়েছিল। ব্যাটিং করার সময় একে অন্যকে কী বলছিলেন?

সাব্বির: আমাদের লক্ষ্য ছিল, দিনটা যেন পার করতে পারি। পরদিন ২-৩ ওভার খেলে ফেললে ইংল্যান্ড চাপে পড়ে যাবে। জানতাম, এক ঘণ্টা ব্যাটিং করতে পারলেই আমরা জিতে যাব। ১৫ মিনিটেই তো ১২ রান (আসলে ১০) হয়ে গিয়েছিল। যেভাবে রান আসছিল, আর ৫-৬ ওভার খেলতে পারলেই হয়ে যেত। হলো না!

প্রশ্ন: প্রথম টেস্ট ম্যাচেই তো অনেক কিছু দেখে ফেললেন। তা সবচেয়ে আলাদা মনে হলো কোনটিকে?

সাব্বির: শুধু টেস্ট ম্যাচ কেন, ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টির কথাও যদি বলেন, আনৱর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে ঘরোয়া ক্রিকেটের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এনসিএল ও বিসিএলে চার দিনের ম্যাচ খেলেছি। ওখানেই দেখেছি, ২-৩টা উইকেট পড়লেই ম্যাচের রং বদলে যায়। তবে সেটিতে কোনো চাপই থাকে না। রান হলে হবে, না হলে নাই। আনৱর্জাতিক ক্রিকেট সে তুলনায় অনেক কঠিন।

প্রশ্ন: এই টেস্টে উইকেটও তো ব্যাটিংয়ের জন্য অনেক কঠিন ছিল। এমন উইকেটে খেলেছেন আগে?

সাব্বির: ঘরোয়া ক্রিকেটে তো এমন উইকেটেই আমরা খেলি। সব ম্যাচে হয়তো না, তবে এমন উইকেটে আমি আগেও খেলেছি। বল কখনো লাফিয়ে ওঠে, নিচু হয়ে যায়। ও সবে আমার খুব একটা সমস্যা হয়নি। আমি যেটা বুঝেছি, বাইরের বল ঠিকমতো জাজ করতে পারাটাই এখানে আসল। এর সঙ্গে যার যেটা শক্তির দিক, তার সেভাবেই খেলা উচিত। আমি যেমন মারার বল পেলে মেরে দিয়েছি।

প্রশ্ন: এ ধরনের উইকেটে খেলে থাকতে পারেন, কিন্তু এমন বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে তো খেলেননি এর আগে, তাই না?

sabbir-1সাব্বির: তা খেলিনি। মজাই লেগেছে। আসলে বড় টিমের বিপক্ষে খেলার মজাই আলাদা। তবে আমি কিন্তু বল দেখে খেলেছি। কে বোলিং করছে ব্রড, না মঈন আলী, এটা মাথায়ই নিইনি। স্টোকস যেমন দারুণ রিভার্স সুইং করিয়েছে, আমাদের ব্যাটসম্যানদের কাছে ওকেই হয়তো সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছে। তবে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। আর প্রথম ইনিংসে ভালো কিছু করতে না পারার পরই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, দ্বিতীয় ইনিংসে ভালো করতেই হবে। প্রমাণ করতে হবে, আমি টেস্ট ক্রিকেট খেলতে পারি। অনেকেই বলছিল, আমি টেস্টে ভালো করতে পারব না।

প্রশ্ন: সেটি হয়তো আপনি স্ট্রোক প্লেয়ার বলেই বলেছে। কিন্তু স্ট্রোক প্লেয়াররাও তো টেস্টে সফল হয়েছে। যেমন শেবাগ…

সাব্বির: শেবাগ তো আছেই, ম্যাক্সওয়েলের কথাই ধরুন না। টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট থেকে ও টেস্টে ভালো খেলেনি? আমাকেও প্রথমে টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট বানিয়ে দেওয়া হলো। এরপর ওয়ানডেতে সুযোগ পেলাম। ২৭টি ওয়ানডে খেলার পর আমি হয়ে গেলাম টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডে স্পেশালিস্ট। টেস্ট ক্রিকেটটা কেমন বোঝার জন্য আমি তাই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। আমি নির্দিষ্ট কোনো ফরম্যাটের স্পেশালিস্ট হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। আর টেস্ট খেলাটা ছিল আমার একটা স্বপ্ন।

প্রশ্ন: তরুণ ক্রিকেটারদের যেখানে টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডের দিকেই বেশি ঝোঁক, সেখানে আপনি টেস্ট খেলার জন্য এত ব্যাকুল হয়েছিলেন কেন?

সাব্বির: আমি তো মনে করি, সব খেলোয়াড়েরই স্বপ্ন থাকে টেস্ট খেলার। মাথায় টেস্ট ক্যাপ পরার। আমার কাছে টেস্ট ক্রিকেটই ১ নম্বর। টেস্ট প্লেয়ার শুনতেই তো কত ভালো লাগে! চট্টগ্রামেই সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় খুব ভালো হয়েছে। আমার টি-টোয়েন্টি ডেব্যু এখানে, ওয়ানডে ডেব্যুও। তিন ফরম্যাটেই একই মাঠে ডেব্যু।

প্রশ্ন: প্রথম ইনিংসে স্টোকসের বল লেগেছিল আপনার হেলমেটে। ওটি কি আরও ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে টেস্ট ক্রিকেট কতটা কঠিন?

সাব্বির: ওটা হেলমেটের ওপর দিয়েই গেছে, আমার কোনো সমস্যা হয়নি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে, স্টোকস এসে আমার কী অবস্থা জানতে চেয়েছে। পরদিন নাশতা করার সময়ও খোঁজখবর নিয়েছে। মাঠে ইংল্যান্ডের প্লেয়াররা একটুও ছাড় দেয় না, তবে মাঠের বাইরে ওরা খুব ভালো। আর স্টোকস ও রুট তো আমার বন্ধু। আন্ডার নাইনটিনে ওদের সঙ্গে খেলেছি। সব মিলিয়ে বলব, অনেক কিছু শিখলাম। পরের টেস্টে তা কাজে লাগাতে পারব।

প্রশ্ন: কী শিখলেন?

সাব্বির: শিখেছি তো অনেক কিছুই। তবে সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা হলো টেস্টে ভালো করতে হলে মানসিকভাবে খুব শক্ত হতে হবে। আর এখানে প্রতিটি বলই পরীক্ষা। খুব ফোকাসড থাকতে হয়। ফোকাসটা এক মুহূর্তের জন্যও নড়তে দিলেই সর্বনাশ।

প্রশ্ন: টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডের পর টেস্টেও ভালো শুরু হলো। আজ থেকে ৫ বছর পর, ১০ বছর পর নিজেকে কোথায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন?

সাব্বির: খুব বড় স্বপ্ন নয়। আমি লেগ স্পিন বল করতে পারি। নিজেকে অলরাউন্ডার হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। যাতে দলের জন্য ব্যাটিং-বোলিং দুটিতেই অবদান রাখতে পারি। দলে জায়গা নিয়ে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে। আমি চাই, সাব্বিরকে সবাই যেন দলে অপরিহার্য মনে করে।