সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
আনন্দ আলো প্রতিবেদন
এবার ঈদে নাকি ব্লাকে সিনেমার টিকেট বিক্রি হয়েছে। এটাকে শুভ লক্ষণ বলছেন সিনেমা সংশ্লিষ্ট মানুষেরা। একসময় সিমেনা হলে সিনেমার টিকিট যাতে ব্লাকে বিক্রি না হয় সেজন্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্য নেওয়া হতো। হল কর্তৃপক্ষও নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা রাখতেন। টিকেট কালোবাজারীদেরকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করার ছবিও পত্র-পত্রিকায় ছাপা হতো। অথচ সেই টিকেট কালোবাজারী ব্যবস্থারই প্রশংসা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে সময়ে বিভিন্ন সিনেমা হলে টিকিট কেনার লোকই পাওয়া যায় না। অর্থাৎ দর্শক বিমুখ হয়েছে সিনেমার প্রতি সে সময়ে টিকিট কালোবাজারী হওয়া তো শুভ লক্ষণ। তার মানে আমাদের সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য সৱম্ভ চলচ্চিত্রের প্রতি দর্শকদের আগ্রহ বেড়েছে। সিনেমা হল মুখো হয়েছে সাধারন মানুষ। আমাদের সিনেমা তার হৃৎগৌরব ফিরে পেতে চলেছে। আনন্দ আলোর পক্ষ থেকে আমরা সেই সব দর্শকদের স্বাগত জানাই। যারা এবার ঈদে সিনেমা হলে ভীড় করেছেন। কারণ সিনেমার কাহিল অবস্থার কারনে আমাদের সংস্কৃতির আলো যেন ঠিকমতো জ্বলছিল না। এবার ঈদে সিনেমায় সম্ভাবনার আলো জ্বলেছে। এটা সত্যি শুভ লক্ষণ। অনেকদিন পর আমরা বোধকরি সিনেমায় আলোর পথেই হাঁটছি।
দুই.
একটি সহজ প্রশ্ন-কি এমন ঘটলো যে হঠাৎ করেই দৃশ্যপট পাল্টে গেল। শুধু ঢাকা শহর নয় দেশের বিভিন্ন এলাকায় হলে হলে দর্শকদের ভীড়। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে পজিটিভ রিপোর্ট। টিভি চ্যানেলে চ্যানেলে রিপোর্টারের মুখে শুধুই প্রশংসার সহজ সরল সুন্দর সুন্দর বাক্য- সিনেমার দর্শক ফিরেছে। হলে হলে দর্শকের দীর্ঘ লাইন আর উচ্ছ্বাসে ভরা মনৱব্য শুনে শুধুই প্রশ্ন জাগছে- কী এমন ঘটলো যে দর্শক অনেকদিন পর আবার হল মুখো হয়েছে। এটা কি কোনো জাদু? ছুঁ মনৱর ছুঁ বললাম আর দর্শক দৌঁড়াতে শুরু করলো সিনেমা হলের দিকে। যদি ছুঁ মনৱরই হয় তাহলে সেটা বলল কে? কোন জাদুকর? জাদুর কোঠাটা ঘষলো কে?
তিন.
সোহানুর রহমান সোহান। একজন জনপ্রিয় চিত্র পরিচালক। তিনি এবার ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ৪টি ছবি হলে গিয়ে দেখেছেন। তারপর একটি দৈনিক পত্রিকায় নিজের অনুভূতির কথা প্রকাশ করেছেন। তার মনৱব্য অনেকটা এরকম- ছবির ব্যবসা মন্দ যাচ্ছিল। চলচ্চিত্রের সবাই হা হুতাশ করছিলেন। স্বস্থির পরিবেশ এনেছে ঈদের চার ছবি। আমাকে হল মালিকরা জানিয়েছেন, ঈদে এখন পর্যনৱ (১৩ জুলাই) ১৫ লাখ মানুষ ছবি দেখেছে। এটা শুভ লক্ষণ।
জাকির হোসেন রাজু। আরেকজন জনপ্রিয় চিত্র পরিচালক। তিনিও বিভিন্ন হলে গিয়ে ঈদের ৪টি ছবি দেখেছেন। একই পত্রিকায় তিনি লিখেছেন, সিনেমা পাড়ায় আলোচনা-এমনিতেই সিনেমা চলছে না। এই অবস্থায় ঈদে এতগুলো ছবি মুক্তি দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? তাছাড়া একই তারকার তিন ছবি। এমনই শঙ্কা সবার মধ্যে। কিন্তু সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে দেখা দিয়েছে আশার আলো। ঈদের দিন থেকে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন সিনেমা হলে গিয়ে দেখলাম অনেক দর্শক হলের সামনে ভীড় করছে। কোনো কোনো সিনেমা হল গত কয়েক বছরের ব্যবসার রেকর্ড ভেঙ্গেছে। হল মালিক খুশি, প্রযোজক, পরিবেশক খুশি। চলচ্চিত্রে দেখা দিয়েছে নতুন আলোর ঝলকানি।
চার.
এবার আলোচনা করা যাক ঈদের ৪টি ছবি নিয়ে। প্রথমটির নাম সম্রাট। কাহিনী অনেকটা এরকম- একটা উপমহাদেশে একজন সম্রাট থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খলনায়ক তার কাজে বাধার সৃষ্টি করে। শুরু হয় হিংসা আর প্রতিহিংসার লড়াই। দ্বিতীয় ছবির নাম রানা পাগলা ইংরেজীতে দ্য মেন্টাল। কাহিনী অনেকটা এরকম- তিন খুনের আসামী শাকিব খানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শাকিবকে টর্চার সেলে টর্চার করা হয়। তারপর ফ্লাশব্যাকে দেখা যায় পুরো গল্প। তৃতীয় ছবির নাম- শিকারী। কাহিনী অনেকটা এরকম- শাকিবের বাবা একজন বিচারক। এক এলাকায় মাটির ভেতর অনেক শিশুর হাড়গোড় পাওয়া যায়। ধারনা করা হয় বিভিন্ন সময়ে যে সব শিশু অপহৃত হয়েছে, হারিয়ে গেছে অথবা নিখোঁজ হয়েছে তাদের কিডনি, চোখ বিক্রি করে কোনো এক চক্র ওই শিশুদের লাশ মাটি চাপা দিয়েছে। ঘটনায় জড়িতদের হোতার নাম রাহুল দেব। সে এক সময় চিনৱা করে বিচারককে খুন না করলে সব ফাঁস হয়ে যাবে। একজন বাংলাদেশী কিলারকে ভাড়া করা হয় বিচারককে খুন করার জন্য। ৪র্থ ছবির নাম- বাদশা দ্য ডন। কাহিনী অনেকটা এরকম- পরিবারের ছোট ছেলে বাদশা। অমিতাভের ছবি দেখে দেখে মনের ভেতর স্বপ্ন বোনে বড় হয়ে ডন হবে। ছেলের দুরনৱপনার কারনে বাবা তাকে হোস্টেলে পাঠায়। কিন্তু বাদশা হোস্টেলে যায় না। এক প্রতিবেশীর সাথে বাড়ি থেকে ভেগে যায়।
পাঁচ.
৪ ছবির কাহিনী বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যাবে কাহিনীর মধ্যে নুতনত্ব বলে তেমন কিছু নাই। তবে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে চমক আছে। প্রতিদিন সকালের নাসৱায় আমরা হয়তো পরাটা অথবা রুটির সাথে ডিম, ভাজি অথবা গরুর মাংস খাই। একই খাবার প্রতিদিন খেতে ভালো লাগে না। তবে খাবার পরিবেশনের ক্ষেত্রে যদি একটু ভিন্নতা থাকে তাহলে খাবারের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। ধরা যাক সকালের নাসৱায় পরাটা আর ডিমভাজি আর গরুর মাংসের সাথে জলপাই অথবা আমের আচার থাকল। সুন্দর প্লেটে তা পরিবেশন করা হলো। সাথে থাকল একবাটি সবজি অথবা সালাদ। খাবারের প্রতি সহজেই আগ্রহ দেখা দিবে। এবারের ঈদের ছবিতে তেমনই কিছু ভাবনার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। সিনেমায় দর্শক ফ্যান্টাসী দেখতে ভালোবাসে। সেটার প্রতিই এবার বেশী জোর দেয়া হয়েছে।
ছয়.
তবে এবার ঈদের ছবি ভালো ব্যবসা করার একটি অন্যতম কারণ হলো ওপর বাংলার শিল্পীদের উপস্থিতি। কলকাতার জনপ্রিয় নায়ক জিৎ ছিল এবার বাংলাদেশের ঈদের সিনেমায়। আরও ছিলেন জনপ্রিয় নায়িকা শ্রাবনৱী। কারও কারও ভাবনা এরকম- এবার ঈদের ছবি গুলোতে ভারত ও বাংলাদেশের শিল্পীদের যৌথ উপস্থিতি থাকায় প্রচারের আলো ছিল বেশ স্পষ্ট। কথায় আছে প্রচারেই প্রসার। সে কারনে দর্শক এবার হল মুখো হয়েছে।
সাত.
ঈদে সিনেমা হলের প্রতি দর্শকের ব্যাপক আগ্রহের আরও অনেক কারণ হয়তো থাকতে পারে। কারণ গুলো নিশ্চয়ই সিনেমা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ খুঁজে বের করবেন এবং সেই অনুসারে পরবর্তি পদক্ষেপও নিবেন। এবারের ঈদের ছবির ক্ষেত্রে জাজমাল্টি মিডিয়ার অনেক অবদান আছে। বলা যায় জাজ এর পজিটিভ উদ্যোগের আলোয় আমাদের সিনেমা এবার অনেকটাই গতি ফিরে পেয়েছে। কিন্তু আমাদের ভবিষৎ ভাবনা কি? হলে ফিরেছে দর্শক। কিন্তু তারা থাকবে তো? আবারও যাতে ফিরে না যায় সে ব্যাপারে আমাদের প্রস্তুতি কি? দেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে ‘ঈদের ছবি’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে জনৈক মহিলা দর্শকের মনৱব্য শুনে একটু যেনো অবাক হয়েছি। তিনি সহজ সরল স্বীকারোক্তি দিলেন- আমি ভারতের জিৎকে দেখার জন্য সিনেমা হলে এসেছি। এটাই যদি বাসৱবতা হয় তাহলে আমরা কি হলে ফিরে আসা দর্শককে সত্যি ধরে রাখতে পারব? বার বার কি জিৎকেই দেখতে আসবেন ঐ মহিলা?
বিতর্কে যেতে চাই না। সিনেমার দর্শক হলমুখী হয়েছে এটা শুভ লক্ষণ। এখন প্রয়োজন তাদেরকে কিভাবে ধরে রাখা যায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া। বাংলা সিনেমার জয় হোক।
আট.
এবার প্রত্যাশার কথা বলি। যারা মুখে বলি আমাদের দেশে সিনেমার দর্শক কমে গেছে তারা আসলে ঠিককথা বলি না। সিনেমার দর্শক আগে যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে। কিন্তু আমরা যারা সিনেমা বানাই তারা আসলে সময়কে খুব বেশী গুরুত্ব দিচ্ছি না। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে তাহলো দশ বছর আগের পৃথিবী আর বর্তমান সময়ের পৃথিবী এক রকম নয়। আগে ফেসবুক, ইন্টারনেট সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এতে আধিপত্য ছিল না। ফলে মানুষের পছন্দের ব্যাপারটা ছিল সীমিত। কম কিছুতেই অনেকের মন ভালো হয়ে যেত। যা দেখত সেটাই নতুন মনে হতো। আর এখন যা দেখে সেটাই যেন পুরনো। আগে দেখা হয়েছে। সে কারনে পুরনো কিছু দেখার জন্য দর্শক সিনেমা হলে যেতে তেমন একটা আগ্রহ দেখায় না। এবার নাকি সিনেমায় নতুন কিছু দেখেছে দর্শক। সেটা কাহিনী থেকে শুরু করে কারিগরী ব্যবস্থা, নির্মাণ শৈলী এমনকি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়েও নাকি নতুনত্বের ছোঁয়া ছিল। উদাহরণ স্বরূপ শিকারী ছবিতে শাকিব খানের গেটআপ। যা দেখে তরুণেরা এখন শাকিব খানকে ফলো করতে শুরু করেছে।
এটাই হলো সময়ের বাসৱবতা। তবে বাসৱবতার কথা তুলে আমরা যেন নিজেদের স্বকীয়তা না হারাই সেদিকেও নজর থাকবে সবার এই প্রত্যাশা রইল।