Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

সিনেমার মানুষের হাতে সিনেমা নাই-চঞ্চল চৌধুরী

আমাদের মঞ্চ ও টিভি নাটক এরিনায় তিনি আলাদা এক বৈশিষ্ট্য নিয়ে অভিনয় করে যাচ্ছেন গত ১৭ বছর ধরে। তার অসাধারণ হাস্যরসাত্মক নাট্যাভিনয় দেখে টিভি সেটের সামনে থেকে দর্শকদের চোখ সরে না। তার অভিনয়ে কি যেন কি একটা আছে। নিখাদ এই অভিনেতা মঞ্চে যেমন তুখোড়, টিভি নাটকে তেমনি শক্তিমান, চলচ্চিত্রে তিনি অসাধারণ। গত ১০ বছরে তার ৫টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। গৌতম ঘোষের মনের মানুষ, গিয়াস উদ্দিন সেলিমের মনপুরা, তৌকীর আহমেদের রূপকথার গল্প, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর টেলিভিশন এবং সর্বশেষ ৩০ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেয়েছে অমিতাভ রেজার আয়নাবাজি। বলছি কমপ্লিট অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর কথা। চলচ্চিত্র, নাটক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নানা বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন আনন্দ আলোর সঙ্গে। লিখেছেন জাকীর হাসান।

আনন্দ আলো: আয়না বাজি নিয়ে আপনার অনুভূতির কথা বলুন। ছবিতে আয়নাবাজ কে?

চঞ্চল চৌধুরী: আয়নাবাজি অমিতাভ রেজার প্রথম চলচ্চিত্র। অমিতাভ রেজা একজন গুণী নির্মাতা। তিনি অসংখ্য জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেছেন। নির্মাতা হিসেবে আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ। তার একটি নাটকে আমি কাজ করেছি। বিজ্ঞাপনেও কাজ করেছি ছবিতে অভিনয় করার পর। প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে তিনি তার মতো নিজের মধ্যে একটি স্বপ্ন লালন করেছেন। সেই স্বপ্নকে তিনি যখন দর্শকদের সামনে হাজির করতে তিনি আমাকে ছবিতে অভিনয় করার অফার দেন। আমি তার ছবিতে অভিনয় করার প্রসৱাব পাওয়ার পর এক কথায় রাজি হয়ে যাই। কারণ তার সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা ও আকাঙক্ষা দুটোই অনেক বেশি ছিল আমার। আমি সব সময় চাই ভালো নির্মাতার সঙ্গে ভালো কাজ করতে। ভালো নির্মাতা না হলে ভালো কাজ করা সম্ভব নয়। ভালো গল্প, ভালো কোআটিস্ট, ভালো আয়োজন একটি ছবির জন্য খুবই জরুরি। আমাদের চলচ্চিত্রে এখন একটা খারাপ সময় যাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু ভালো ছবি হচ্ছে। মৌলিক গল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের ছবি হয় কালেভদ্রে। তো সেই জায়গা থেকে অমিতাভ যখন এই সিনেমা বানানোর কথা বললেন তখন আমার স্বপ্নগুলো আমি দেখতে শুরু করেছিলাম। এই ভাবেই অমিতাভের সঙ্গে আয়নাবাজি ছবিতে আমার কাজ করা। প্রধান যে চরিত্র আয়না এটি আমার জীবনে যত চরিত্রে কাজ করেছি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বা অন্যতম একটি।

নাটক আমাকে অহরহ করতে হয়। মাসে ২০ দিন নাটকের শুটিং করতে বাধ্য হই। কিন্তু চলচ্চিত্রকে আমি বরাবরই আলাদা করে রাখার চেষ্টা করেছি। আমার সর্বশেষ আত্মতুষ্টি না হলে চলচ্চিত্রে কাজ করি না। সেই হিসেবেই বেছে বেছে কাজ করা। এ কারণেই আমি গত ১০ বছরে ৫টি ছবিতে অভিনয় করেছি তার মানে দুই বছরে একটি করে ছবিতে অভিনয় করেছি। আয়নাবাজির আয়না হচ্ছে আমি নিজে। এদেশের ১৭ কোটি মানুষের একজন প্রতিনিধি। ছবিতে যার জীবন যুদ্ধ ফুটে উঠেছে অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে।

আনন্দ আলো: আপনি এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন আয়নাবাজি শুধু ছবি নয় আমার কাছে একটি গন্তব্য যেখানে আমি পৌঁছাতে চাই। এতে কি বোঝাতে চেয়েছেন?

চঞ্চল চৌধুরী: একজন অভিনেতা হিসেবে ভালো একটি চরিত্রে ভালো অভিনয় করার ইচ্ছা আমার অনেক বেশি। আমরা সবাই এমন একটি গন্তব্য খুঁজি যেখানে নিজের পরিচয়টাকে নতুন করে সাজাতে চাই, নতুন পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই। একটি ভালো চরিত্রে অভিনয় করা মানে আরেকটি সত্তার জন্ম হওয়া, নতুন গন্তব্যে যাওয়া। আরেকটি ঠিকানা খুঁজে পাওয়া। সেই হিসেবে মনে করি আগে যতগুলো কাজ করেছি সেই জায়গা থেকে আয়নাবাজি হচ্ছে আমার গন্তব্য। এই গন্তব্যে পৌঁছার পর আবার হয়তো নতুন পথে যাত্রা শুরু হবে। সেখান থেকে আরেকটা গন্তব্যে পৌঁছাবো এটাই হচ্ছে আমার টার্গেট।

আনন্দ আলো: অভিনয়ে আপনার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। যা দেখে দর্শকরা আনন্দ পায়। প্রতিটি অভিনয় শিল্পীর কি এই বৈশিষ্ট্য বা ঢং থাকা জরুরি?

চঞ্চল চৌধুরী: আসলে প্রত্যেক শিল্পীরই তো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। তেমনি আমারও আছে। চরিত্র অনুযায়ী আমি হাস্যরসাত্মক বিষয়টি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করি সব সময়। নাটক, সিনেমা, গান হচ্ছে বিনোদন। কর্মময় জীবনের একটু অবসর সময়ে মানুষ বিনোদন করতে পছন্দ করে। নাটক সিনেমার অভিনয় দেখে দর্শকরা কখনো হেসে কখনো চোখের পানি ফেলে বুকের ভারটা নামায়। এটা হলো- একজন অভিনয় শিল্পীর দায়িত্ব। কাটখোট্টা অভিনয় করলে দর্শক হাসবেও না কাঁদবেও না সেই অভিনয় করে তো লাভ নেই।

অনেকই আবার মনে করেন নাটক মানেই শুধু হাস্যরসাত্মক ও মজার বিষয়। বর্তমান সময়ের নাট্যকার অভিনয় শিল্পীরাও তাই মনে করেন। জীবন তো শুধু হাসি তামাশার নয়। এই হাসি তামাশা করতে গিয়ে অনেক সময় অভিনয় হয়ে যাচ্ছে ভারামো। অনেক টিভি নাটকে এই ভারামো পূর্ণতা পাচ্ছে।

আনন্দ আলো: অনেকদিন পর অর্থাৎ মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর টেলিভিশন-এরপর আপনার অভিনীত আয়নাবাজি মুক্তি পাচ্ছে। এই ছবি নিয়ে আপনার প্রত্যাশার জায়গাটা কেমন?

ayna-baziচঞ্চল চৌধুরী: আমি ১৭ বছর ধরে অভিনয় করছি টিভি নাটক, সিনেমা ও মঞ্চে। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক প্যর্টানের অনেক বিশ্লেষনধর্মী কাজ করেছি। সর্বশেষ কাজ করেছি আয়নাবাজি চলচ্চিত্রে। এরপর আর কোনো সিনেমায় কাজ করা হয়নি। আমার ঝুলিতে কিছু প্রাপ্তি আছে যেগুলো নিয়ে আমার পথ চলা। সেই জায়গা থেকে বলছি যে আয়নাবাজিতে আয়না চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের কাছে প্রাপ্তির জায়গা, ভালো- বাসার জায়গা থেকে কিছুটা অর্জন করবো। এই যে ১৭ বছরের অভিনয়ের আলোকে আমি আমার শ্রম মেধা দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি আয়নাবাজিতে আয়না চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে তার একটা অর্জন অবশ্য অর্জিত হবে।

এই প্রশ্নের উত্তরে আরো কিছু যুক্ত করতে চাই আমাদের দেশের জায়গাতে রয়েছে অস্থিরতা ও হড়োহুড়ি। সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে বিশৃংখলা যেমন সমাজে, পরিবারে এবং শিল্পাঙ্গনে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটছে যে একটি লোক গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করছে আসলে সেই লোক এই কাজের উপযুক্ত নয়। যেমন নাটকের মানুষের হাতে নাটক নাই, সিনেমার মানুষের হাতে সিনেমা নাই। এরকম প্রত্যেকটা সেক্টরে যোগ্যমানুষর হাতে যথাযথ কাজ নেই। এরমধ্যে পরিপূর্ণ সুফল আশা করা ঠিক নয়। তার পরও এগিয়ে যেতে হবে।

আনন্দ আলো: আপনি এ পর্যন্ত পাঁচ পরিচালকের ৫টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এত কম ছবি করার কারণ কি?

চঞ্চল চৌধুরী: আমি আগেই বলেছি ভালো গল্প, ভালো নির্মাতার ছবি করে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আমার আগে থেকেই। অর্থ বিত্তের জন্য আমি আমার ক্যারিয়ার নষ্ট করতে পারব না। আমি যে পাঁচটি ছবি করেছি সেই ছবি ৫টি এ দেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে স্থান করে নেয়ার মতো ছবি। এই ছবি গুলোতে অভিনয় করে কিন্তু আর্থিক ভাবে লাভবান হইনি। শুধু আমি নই এর মধ্যে দু’তিনটি ছবির পরিচালক প্রযোজক ও শিল্পীদেরও কিন্তু স্যাক্রিফাইজ করতে হয়েছে। নিজের অনেক মূল্যবান সময় এবং পরিবার থেকে সময় কেড়ে নিয়ে শুধু ভালো সিনেমায় অভিনয় করার তাগিদে নিজেকে শপে দিয়েছি। তবে আমি প্রশানিৱ পেয়েছি ভালো ছবিতে কাজ করতে পেরেছি বলে। যে কাজ দেখে দর্শকরা মুগ্ধ হয়েছেন এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তির জন্যই সব কিছু ত্যাগ করেএগিয়ে যাচ্ছি।

আনন্দ আলো: মঞ্চ, টিভি, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, বিজ্ঞাপন চিত্র সব মিডিয়ায় আপনার স্বাচ্ছন্দ বিচরণ রয়েছে। একজন সৃজনশীল অভিনেতার কি সব মিডিয়ামে বিচরণ করা জরুরি?

চঞ্চল চৌধুরী: অবশ্যই জরুরি না। আমি অভিনয় শিল্পী শখে গান গেয়েছি। নিজের জন্য গেয়েছি। আমার গানের ৪/৫টি অ্যালবামও প্রকাশ হয়েছে। তার মধ্যে একটি সলো বাকিগুলো মিক্সড। এসব হয়েছে শখের বসে গাইতে গাইতে। প্রফেশনাল শিল্পী হিসেবে নয়। তবে গান রেকডিং করার সময় অনুভব করেছি গান আসলে শেখার পর গাইতে হয় সেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমার নেই। এর পর গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

আনন্দ আলো: আপনার অভিনীত নাটক বা সিনেমা নিয়মিত দেখেন?

চঞ্চল চৌধুরী: অনএয়ারের সময় নাটক দেখা হয় না। তবে আমার অভিনীত নাটক অবশ্য দেখি অবসর সময়ে। আগে সিডি বা ভিডিডি নিয়ে দেখতাম এমন ইউটিউবে দেখি বা পেনড্রাইভে নিয়ে বাসায় বা গাড়িতে বসে বসে দেখি। যেমন ঈদের সময় ৩/৪ দিন বন্ধ পাওয়া যায় ওই সময় প্রচুর নাটক দেখা হয়। নাটক গুলো দেখে নিজেই নিজের বিচার করি।

আনন্দ আলো: বেশ ক’মাস আপনি নাটকের কাজ কম করছেন?

চঞ্চল চৌধুরী: আমি তিন মাস ছিলাম অস্ট্রেলিয়ায় ওখানে মঞ্চ নাটকের শো ছিল। তারপর আয়নাবাজি সিনেমা নিয়ে ব্যস্ততা গেছে। এ মাসে যাব আমেরিকা। সব মিলিয়ে নাটকের কাজ অবশ্যই কম হচ্ছে।

আনন্দ আলো: জনশ্রুতি আছে আমাদের দেশের টিভি নাটক দর্শকরা দেখে না বললেই চলে। আপনার ব্যাখ্যা কী?

চঞ্চল চৌধুরী: আমাদের টিভি নাটক দর্শক দেখে না বললে ভুল হবে। তবে তুলনামূলক ভাবে আগের চেয়ে কম দেখে। কারণ আমাদের দেশের যে কয়টি টিভি চ্যানেল রয়েছে তাদের বিশাল দর্শক শ্রেণীর জন্য যে কোয়ালিটির নাটক নির্মাণ করা দরকার সেটা আমরা করতে পারছি না। তবে দর্শক কেন নাটক দেখে না সেটা খুঁজে বের করা দরকার এবং এই দায় নির্মাতা প্রযোজক অভিনেতা অভিনেত্রী কলাকুশলী সবাইকে নিতে হবে। আমাদের দেশের সবগুলো চ্যানেলের ফরমেট একই। লোগো অফ করলে বোঝার উপায় নেই কোনটা কোন চ্যানেল। দর্শক বিমুখতার এটাও একটা কারন। আর পার্শ্ববর্তী দেশের কথা বললেন ওদের নাটকের মানটা তারা ধরে রেখেছে। গল্প, কাহিনি ও অভিনয়ে হের ফের হলেও নির্মাণে ওরা আপোস করছে না। তবে আমাদের দেশের চ্যানেলগুলোর হাতেই রয়েছে মানসম্পন্ন নাটক নির্মাণও প্রচারের জিয়নকাঠি। তারাই পারে নাটকের মান বাড়াতে ও কমাতে। চ্যানেলগুলো যদি ইচ্ছে করে এই নাটকটির মান ভালো না এটা চালানো যাবে না। তাইলে কারো কি সাধ্য আছে সেটা প্রচার করার।

আনন্দ আলো: পরিবারের সদস্যদের সময় দেন?

চঞ্চল চৌধুরী: পরিবারের সদস্যদের সময় দেয়াই তো মুশকিল। শিল্পীরা সত্যিকারেই ছন্নছাড়া ও গৃহত্যাগী। আমার গুরু মামুনুর রশীদ আরন্যকে কাজ করার শুরুতে বলেছিলেন, শিল্পীর আসলে ঘর হয় না। তারা বহিমিয়ান, এই জগৎটা আলাদা। এই শিল্পের জগতে যদি কেউ বিচরণ করতে চায় তাহলে বাস্তব যে জগৎ তার সঙ্গে দূরত্ব রাখতে হবে। আমাকে যদি নুন তেলের হিসাব কষতে হয় তাহলে শিল্পের চর্চাও ভাবনার ছেদ পড়বেই। তারপরও আমার স্ত্রী এক সনৱানকে নিয়ে আমাকে সুন্দর কিছু সময় কাটাই কিন্তু সেই সুযোগটা খুব কম পাই।

আনন্দ আলো: চারুকলা থেকে পাস করে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছিলেন এক সময়। এখন অভিনয় ছাড়া আর কিছু করেন?

চঞ্চল চৌধুরী: ধানমিন্ডর সোডা, ইউডা, কোডাতে আমি চারুকলার শিক্ষক ছিলাম ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত। তখন শুধু মঞ্চ নাটকে কাজ করেছি। এরপর ২০০৭ থেকে টিভি নাটকের অভিনয়ে ব্যস্ত হওয়ার পর শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমি অভিনয় ছাড়া আর কিছু করি না, করতে ভালোও লাগে না। তবে শিক্ষকতা আমার খুব পছন্দের।