Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

শ্রদ্ধা ভালোবাসায় কোথাও কেউ নেই

রেজানুর রহমান
সবাই অপেক্ষায় ছিলেন প্রিয় অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের জন্য। একটু যেন দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে অনুষ্ঠানের প্রযোজক মাহবুবা ফেরদৌসের মনে। তিনি বার-বার বিটিভির মহাপরিচালক হারুনুর রশীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন। একটু নিশ্চয়তা খোঁজার চেষ্টা। কারণ আসাদুজ্জামান নূর না এলে যে অনুষ্ঠানটিই জমবে না। ইতিমধ্যে বিটিভির এই ঈদ অনুষ্ঠানের জন্য একে একে হাজির হয়েছেন বিশিষ্ট অভিনেতা মাসুদ আলী খান, লাকী ইনাম, সুবর্না মুস্তাফা, লুৎফর রহমান জর্জ, আব্দুল কাদের, বিজরী বরকত উল্লাহ, খায়রুল আলম সবুজ এবং অনুষ্ঠানের উপস্থাপক বিশিষ্ট অভিনেতা, নির্মাতা আফজাল হোসেন। বিটিভির এক সময়ের বহুল আলোচিত টিভি ধারাবাহিক হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ এর অভিনেতা অভিনেত্রীরা ঈদের এক আড্ডা অনুষ্ঠানে নাটকটি নিয়ে কথা বলবেন বলে হাজির হয়েছেন বিটিভির গেস্টরুমে। বিটিভিতে ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারবাহিকটি যে সময়ে চলছিলো সে সময়ে নাটকটির পাত্র-পাত্রীরা সহ নেপথ্যের কর্মীরাও হয়ে উঠেছিলেন একটি পরিবারের সদস্য। নাটকটিকে ঘিরে কতই না সুখ দুঃখের কাহিনী জমা হয়ে আছে। সে কথাই বলবেন সবাই। অনুষ্ঠান ধারনের আগেই বিটিভির গেস্ট রুমে শুরু হয়ে গেল জমজমাট আড্ডা। কখনও ‘কোথাও কেউ নেই’ টিভি ধারাবাহিক সম্পর্কে স্মৃতিচারণ, কখনও বা সমসাময়িক টিভি নাটক সম্পর্কে মন্তব্যের ঢেউ খেলে যাচ্ছিলো। একথা সে কথা। কত যে কথা জমে আছে সবার মাঝে। প্রিয় অভিনেতা আব্দুল কাদের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হঠাৎ হঠাৎ টুকরো স্মৃতির ঝাপি খুলে ধরছিলেন আর তাতেই হেসে কুটি কুটি সবাই। এক সময় মাসুদ আলী খান তাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাটাতেই আছেন তো নাকি? বাটা মানে আন্তর্জাতিক খ্যাত পাদুকা কোম্পানী। এক সময় বাটায় গুরুত্বপুর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন আব্দুল কাদের। পরে বাটা ছেড়ে নতুন একটি কোম্পানীতে যুক্ত হন। সেখান থেকে অবসর নিয়েছেন। ভেবেছিলেন এবার নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিবেন। কিন্তু প্রিয়তমা স্ত্রীর কথায় সে পথে আর পা বাড়াননি। সে কথাই বললেন সবাইকেÑ “আমার স্ত্রী আর চায় না আমি চাকরি অথবা ব্যবসা নিয়ে মেতে থাকি। তাই অখÐ অবসর কাটাই। খাই দাই ঘুরে বেড়াই হা: হা: হা:”
প্রসঙ্গক্রমে শিল্পীদের বিদেশ ভ্রমণের কথা উঠতেই আব্দুল কাদের আবারও স্মৃতির ঝাপি খুলে বসলেন। “আমরা একবার নাটকের প্রয়োজনেই জাপানে গিয়েছিলাম। সাথে ছিলেন নূর ভাই। জাপানে পৌঁছে একটা সমস্যায় পড়লাম। ইমিগ্রেশনে আমাদেরকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার মাঝে মাঝে আসে আমাদের সাথে হাসি মুখে কথা বলে চলে যায়। নূর ভাই তার হ্যান্ড ব্যাগে নাটকের কস্টিউম সাথে নিয়েছিলেন। লাগেজ হারিয়ে গেলেও যেন কস্টিউম সাথে থাকে। সে জন্যই এই সতর্কতা। কী ভেবে যেন নূর ভাই নাটকের কস্টিউম পরিধান করলেন। সাথে সাথেই জাদুর মতোই দৃশ্যপট পাল্টে গেল। ইমিগ্রেশনের লোকজন দৌড়ে এসে খুশি হয়ে বলতে লাগলো ‘ইউ আর আটিস্ট। নো প্রবলেম… গো… গো…”

আব্দুল কাদের এমন ভাবেই ঘটনাটা বর্ণনা করছিলেন যে শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। এমন সময় স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে হই চই করতে করতেই গেস্ট রুমে ঢুকলেন প্রিয় অভিনেতা খায়রুল আলম সবুজ। পাল্টে গেল পরিবেশ। তখনও অনুষ্ঠানের উপস্থাপক আফজাল হোসেন এসে হাজির হননি। বিটিভির মহাপরিচালক হারুনুর রশীদ অনুষ্ঠানের প্রযোজক মাহবুবা ফেরদৌসকে বার-বার সাহস যোগাচ্ছিলেন। চিন্তা করো না আফজাল ভাই সময় মতোই এসে যাবেন। বলতে বলতেই গেস্ট রুমে উপস্থিত হলেন প্রিয় অভিনেতা উপস্থাপক আফজাল হোসেন। আনন্দে আবার হইচই শুরু করে দিলেন সকলে। একটু পরেই সবাইকে অবাক করে দিলেন প্রিয় অভিনেতা ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বহুল আলোচিত চরিত্র বাকের ভাই অর্থাৎ আসাদুজ্জামান নূর। প্রসঙ্গক্রমে এই তথ্যটি সংযোজন করছি যে, আসাদুজ্জামান নূর জীবনে অনেক টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন। কিন্তু ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের মতো এতে জনপ্রিয়তা আর কোনো নাটকে পাননি। ‘কোথাও কেউ নেই’ এর বাকের ভাই হিসেবেই এখনও দেশের মানুষ তাকে সম্মোধন করে। আড্ডা, আলোচনায় দেখা পেলেই একজন অন্যজনকে বলে ‘ঐ যে দ্যাখ বাকের ভাই যায়…’ একটি টেলিভিশন নাটকের বিশেষ চরিত্রের ফাঁসী হবে। নাটকে ফাঁসী দেখানো হবে। তাই নিয়ে কত ঘটনাই ঘটেছিল। সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি পাড়া মহল্লা থেকেই ¯েøাগান উঠেছিল “বাকের ভাইয়ের ফাঁসী হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে”। নাটকটির শেষ দৃশ্য যেদিন বিটিভিতে প্রচার হয় তার আগেই প্রযোজক বরকত উল্লাহ ও নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের বাসার সামনে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নাটকে বাকের ভাইয়ের বিশ্বস্থ সহযোগী বদির স্বাক্ষীতে বাকের ভাইয়ের ফাঁসী হয়। সে কারণে বদি রুপী আব্দুল কাদেরের প্রতি প্রচন্ড খেপে গিয়েছিল অনেকে। আর তাই জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় ডায়েরী করেছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা আব্দুল কাদের।
হাওয়া মে উড়তা যায়ে…
একটি গানও বিশেষ সময়কে ধারন করে। যেমন হাওয়া মে উড়তা যায়ে… ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে এই গানটি বাজানো হতো। ফলে গানটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে এতই জনপ্রিয়তা পায় যে, গানটি বাজলে অনেকেই দূর অতীতে ফিরে যান। সেদিন বিটিভির স্টুডিওতে হঠাৎ করেই গানটি বেজে ওঠে। সাথে সাথে বিটিভির ঐতিহ্যমন্ডিত সময় ভেসে উঠে স্মৃতির বিশাল আয়নায়। পুরানো ঢাকার একটি রাস্তায় রিকসা থেকে নামলেন উপস্থাপক আফজাল হোসেন। রিকসার ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। রিকসাওয়ালা রিকসা নিয়ে চলে গেল। আফজাল হোসেন সামনে পা বাড়াতেই সাক্ষাৎ পেলেন ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের অন্যতম একটি চরিত্র মুনা রুপী সুবর্না মুস্তাফা ও বাকের ভাই রুপী আসাদুজ্জামান নূর ও তার দুই সাগরেদ আব্দুল কাদের এবং লুৎফর রহমান জর্জের সাথে। সেই পরিচিত ভঙ্গিতে চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতেই দুই সহয়োগীকে সাথে নিয়ে বাকের ভাই বিটিভির আড্ডা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন। সাথে সাথেই হই চই পড়ে গেল!
যে কথা বলা জরুরি

‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের শিল্পীদের আড্ডা অনুষ্ঠানটি ইতিমধ্যেই বিটিভির পর্দায় দেখেছেন অনেকে। কাজেই আড্ডায় যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে তার বর্ণনা এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করার প্রযোজন মনে করছি না। তবে স্বীকার করতেই হবে বিটিভির ঈদ অনুষ্ঠানমালায় এটিই ছিল একটি আলোচিত অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা সকলেই দেশের ব্যস্ততম তারকা। ধারনা করাই যায় বহুদিন তারা হয়তো এভাবে এক সাথে সাক্ষাতের সুযোগও পাননি। বিটিভি এই সুযোগ করে দিয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের টিভি নাটকের অতীত গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকটি কেন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই। তারা সকলেই অভিন্ন সুরে বলেছেন, আমরা অভিনয় শিল্পীরা নাটকটির জন্য একটি পরিবার হয়ে উঠেছিলাম বলেই নাটকটি এত সাফল্য পেয়েছে। পাশাপাশি গুরুত্বপুর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছে নাটকের কাহিনী। হুমায়ূন আহমেদ এতটাই বিশ্বস্ততার সাথে নাটকটি লিখেছেন যে শিল্পীরা সহজেই নাটকটিতে স্ব-স্ব চরিত্রে ‘ইনভলব’ হতে পেরেছেন। আড্ডায় প্রিয় শিল্পীরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, বর্তমান সময়ে টিভি নাটকের মান অনেক নীচে নেমে এসেছে। টিভি নাটক নিয়ে গৌরব ও অহংকার করার মতো পরিবেশ নাই বললেই চলে।
প্রিয় পাঠক, আসুন এবার আমরা একটা বিতর্ক অনুষ্ঠানে ঢুকে যাই। একথা স্বীকার করতেই হবে যে ‘কোথাও কেউ নেই’ বিটিভির এই ধারাবাহিক নাটকটি সেই সময় ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। একটি টিভি নাটকের বিশেষ চরিত্রের ফাঁসী হবে, তাই নিয়ে সারাদেশে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হবে এটা কি ভাবা যায়? অথচ সেটাই ঘটেছিল। একবার কল্পনা করুনতোÑ বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে হুমায়ূন আহমেদের কাহিনী নিয়েই বিটিভিতে একটি নতুন ধারাবাহিক নাটক শুরু হলো। প্রযোজক বললেন, নাটকের আগে রিহার্সেল জরুরি। কলটাইমে নাটকের সেটে আসা জরুরি। চরিত্র অনুযায়ী কস্টিউম ও প্রপস শিল্পীদেরকেই জোগাড় করতে হবে। বেশী না এই তিনটি শর্তই কী আমাদের শিল্পীরা মানতে রাজি? ‘কোথাও কেউ নেই’ এর আড্ডায় সম্মানীত যে শিল্পীরা উপস্থিত ছিলেন তারাও কী এই নিশ্চয়তা দিতে রাজি হবেন? একথা ভুললে চলবে না যে, ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকটি জনপ্রিয়তা পাবার পিছনে অনেক কারণ ছিল। তার মধ্যে অন্যতম হলো শিল্পীদের আন্তরিক অংশগ্রহণ। নাটকের শুটিং এর আগে একাধিকবার রিহার্সেল হয়েছে। কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীর জন্য প্রযোজককে বসে থাকতে হয়নি। আজকের সময়ে এটা কী ভাবা যায়? তাহলে আরেকটি ‘কোথাও কেউ নেই’ নির্মাণ কী সম্ভব?
ফলাফল কী দাড়াল? অতীত নিয়ে আমরা কী শুধুই অহংকার করবো? আমাদের বর্তমানও একদিন অতীত হবে। সেই অতীত কী পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অহংকারের হবে? এই নিশ্চয়তা কী আমরা দিতে পারি?