Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

শুটিং সিডিউল আমরা কি তৈরি!

আনন্দ আলো প্রতিবেদন: দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার বিনোদন পাতায় হেড লাইনটি দেখে চমকে গেলাম। ভুল ছাপা হয়নি তো? আমাদের চলচ্চিত্রের অন্যতম নায়ক শাকিব খান বলেছেন ‘ঘুম থেকে উঠতে হতো ভোর ছয়টায়। অর্থাৎ তিনি প্রতিদিন ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠতেন শুটিং এ যাবার জন্য। তবে এই ঘটনা দেশে নয়, বিদেশে। পাশের দেশ কলকাতায়।

পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রতিদিন শুটিং শুরু হতো সকাল ৭টায়। এ কারনে ঘুম থেকে উঠতে হতো ভোর ছয়টায়। প্রতিটি দৃশ্য করার আগে মহড়া করতে হয়েছে। আর গানের শুটিং এর দুইদিন আগে থেকে নাচের মহড়া। সব কিছুই নিয়মের মধ্যে। কাজও গোছানো। পেশাদার হলে যা হয় আর কী!

চমৎকার কথা। শাকিব খানের মুখে এত সুন্দর কথা শুনে খুব ভালো লাগল। তার এই বক্তব্যকে ঘিরে অনেকের সাথে কথা বলেছি। প্রায় সবাই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। অভিন্ন সুরে বলেছেন- ‘তাকে জিজ্ঞেস করবেন তো এই যে তিনি বিদেশে এত নিয়মের কথা বললেন, দেশে এইভাবে নিয়ম মানবেন তো? দেশে শুটিং এর জন্য ভোর ৬টায় উঠবেন?

যৌক্তিক প্রশ্ন। শাকিব খান আমাদের দেশের অন্যতম ব্যসত্ম চলচ্চিত্র তারকা। তার একটি কথায় এই দেশের চলচ্চিত্রের অনেক কিছুই বদলে যেতে পারে। কিন্তু কেন কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।

শাকিব খান শিল্পীদের ভোর ৬টায় ওঠার কথা বলেছেন। তিনিও নিজেও ভোর ৬টায় উঠেছেন। ধারনা করাই যায় শাকিব খানদের মতো শিল্পীরা যখন ভোর ৬টায় শুটিং এর জন্য ওঠেন তখন অন্যদেরকে আরও আগে উঠতে হয়। কেউ কেউ হয়তো ভোর ৪টা, ৫টায় ওঠেন।

বিদেশে এই নিয়ম মানলে দেশে মানতে ঝামেলা কোথায়? সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক জনপ্রিয় নায়ক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। গৌতম ঘোষ পরিচালিত ইমপ্রেস টেলিফিল্ম এর ছবি শঙ্খচিল’ এর নায়ক তিনি। আনন্দ আলোয় তিনি একটি সাক্ষাৎকার দেন। এই সাক্ষাৎকারেও তিনি ভোর ৪টায় ওঠার কথা বলেছেন। ‘গৌতমদার শুটিং মানেই নিয়মের মধ্যে সব কিছু চলে। ভোর ৪টায় উঠতে হতো… তারপর মেকআপ নিয়ে ছুটতাম লোকেশনের দিকে…।

তার মানে আমরা নিয়ম মানি? অবশ্য সেটা জায়গা ভেদে। কলকাতায় এক নিয়ম। আর ঢাকায় অন্য নিয়ম। শুধু শাকিব খানই নয় কলকাতায় যারাই শুটিং করতে যান তারাই ঢাকায় ফিরে নিয়মনীতির কথা জোরেশোরে বলেন- জানেন ওরা কিন্তু সময়ের ব্যাপারে খুবই কড়া। সকাল ৭টা মানে ৬টা৫৯ মিনিট। এক মিনিট নড়চড় হলেই জবাবদিহি করতে হয়। কয়েক মাস আগে কলকাতা থেকে ঢাকায় ফেরার পথে নেতাজী শুভাষচন্দ্র বোস এয়ারপোর্টে দেখা হয়েছিল বিদ্যা সিনহা মীম এর সাথে। কথায় কথায় শুটিং প্রসঙ্গ উঠলো। মীম কলকাতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। জানেন, ওরা নিয়ম মেনে চলে বলেই সব কিছুতে এগিয়ে আছে। ওদের সব কিছুই গোছানো। সব কিছুই প্রফেশনাল…

আমাদের প্রশ্ন ওরা প্রফেশনাল। আমাদের হতে দোষ কোথায়? কেউ কি আমাদের পথে বাধা? কেউ কি ঝামেলা করছে আমরা যাতে প্রফেশনাল না হই? এই তো কয়েকদিন আগে আনন্দ আলোয় এসেছিলেন এই সময়ে জনপ্রিয় তরুণ চিত্র পরিচালক রেদওয়ান রনি ও নাট্য নির্মাতা রহমতুল্লাহ তুহিন। কথায় কথায় একই প্রশ্ন তুলে ছিলাম- আমাদের ‘প্রফেশনাল’ হতে দোষ কোথায়? রহমতুল্লাহ তুহিন বললেন- ভাই জানি না এই ইন্ডাস্ট্রিতে আমার কথার কোনো দাম আছে কিনা। তবুও বলি। আমরা ততক্ষণ পর্যনত্ম ‘প্রফেশনাল’ হতে পারব না যতক্ষণ পর্যনত্ম শিল্পীরা কথা ও কাজে আনত্মরিক হবেন। ২৫ বছর ধরে এই ইন্ড্রাস্ট্রিতে কাজ করছি। শিল্পীদের নিয়ে আমি হতাশ। শিল্পীদের অনেকেই শিডিউল মেইনটেইন করতে চান না। সকাল ১০টায় ‘কল’ থাকলেও অনেকে আসেন ১১টা ১২ টার দিকে। এসেই মেকআপ রুমে ঢুকে যান। মেকআপ রুমে চলতে থাকে মোবাইলে আড্ডা। কথা বলছে তো বলছেই। কথা যেনো ফুরায় না। ভাই আমি জোর দিয়ে বলতে চাই শিল্পীরা যতক্ষণ পর্যনত্ম না আনত্মরিক হবেন ততক্ষণ পর্যনত্ম এই দেশে টিভি নাটক ও সিনেমায় প্রফেশনালিজম আনা যাবে না। অসম্ভব…

এই প্রতিবেদনের খাতিরে আমরা উত্তরা ও এফডিসিতে একদিন অসুসন্ধান চালাই। উত্তরায় বেশ কয়েকটি বাড়িতে টিভি নাটকের শুটিং হয়। ৩টি শুটিং হাউজে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সকাল ১০টায় ‘কল’ থাকলেও বেলা ১২টায়ও মূল চরিত্রের শিল্পী আসেননি। সকাল ১০ টায় এফডিসিকে অনেকটাই ফাঁকা পাওয়া গেল। চলচ্চিত্রের কোনো শুটিং নেই। তবে একাধিক টিভি চ্যানেলের স্টুডিও বেইজড শুটিং আছে। শুরু হবে ১২টার পর।

যে যাই বলুক শুটিং শিডিউল মেনে চলার ওপরই নির্ভর করে একটি টিভি নাটক অথবা চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ। কলকাতায় বেড়িয়ে এসে প্রায় সকল শিল্পীই একথা বোঝানোর চেষ্টা করেন- ওরা বেশ প্রফেশনাল। সময়ের ঘড়ি মেনে চলে। কিন্তু তারাই দেশে ফিরে নিয়মের তোয়াক্কা করেন না। নাম প্রকাশে অন্নিুক একজন নাট্য পরিচালক বললেন- শুটিং শিডিউল নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। আমাদের শোবিজে কেউ তো কারও কথা শোনে না। একজন জনপ্রিয় শিল্পীর উদাহরণ টেনে তিনি বললেন- আগের দিন তাকে বার বার অনুরোধ করা হলো- ভাই দশটার মধ্যে স্পটে আসতে হবে। তিনি কথাও দিলেন। বললেন- চিনত্মা করবেন না। আমি দশটার আগেই হাজির হয়ে যাবো। পরের দিন তিনি শুটিং স্পটে আসেন বেলা ১টায়। এসেই প্রডাকশন বয়ের সাথে ধমকাধমকি শুরু করে দেন। ভাবটা এমন দেরী করে এসে তিনি কোন অন্যায় করেননি। বরং সকাল ১০টায় তাকে ডেকে আমরাই অন্যায় করেছি। সেদিন ১০টা সিকোয়েন্স করবো বলে সিন্ধানত্ম নিয়েছিলাম। টেনেটুনে ৪টি সিকোয়েন্স করা সম্ভব হয়। বলেন এইভাবে ভালো কাজ করা সম্ভব?

একজন শিল্পীর সাথে শুটিং শিডিউল নিয়ে কথা হলো। তিনিও বিরক্ত। বললেন- আমাদের এখানে যতক্ষণ পর্যনত্ম না নিয়মনীতি তৈরি হবে, যতক্ষণ পর্যনত্ম না আমরা নিয়মের মধ্যে দাঁড়াব ততক্ষণ কাজের কাজ কিছুই হবে না। অনেকেই শিল্পীদের ব্যাপারে অভিযোগ করেন। অনেক শিল্পী নাকি কল টাইমে শুটিং স্পটে আসেন না। কথাতো সত্যি! তিনি কলটাইমে আসবেন কি করে? আগের রাতে তাকে যদি ৩টা/৪টা পর্যনত্ম কাজ করতে হয় তাহলে পরের দিন তিনি উঠবেন কখন? তার তো ঘুমও দরকার। প্রশ্ন তুলতে পারেন আপনি রাত ৩টা ৪টা পর্যনত্ম শুটিং করেন কেন? উত্তর একটাই- পরিচালক এমনভাবে ধরেন যে না করা যায় না। অবশ্য ঐ শিল্পীই স্বীকার করলেন শুটিং এ নির্ধারিত সময়ে না আসার ক্ষেত্রে উপরোক্ত কারনই মূল সমস্যা নয়। সমস্যা হলো আমাদের মন মানসিকতা। আমরা অনেকে ইচ্ছে করেও দেরী করে শুটিং স্পটে যাই। আবার তাড়াতাড়ি চলে আসার জন্য অহেতুক তাড়া দিতেও ভুল করিনা।

আবারও শাকিব খানের প্রসঙ্গ তুলতে চাই। তার ব্যাপারে বাংলাদেশের নির্মাতাদের কারও কারও অভিযোগ আছে। অভিযোগ একটাই- শাকিব খান সময় মতো শুটিং স্পটে আসেন না। কিন্তু কলকাতার প্রসঙ্গ তুললে তো সেটা মনে হয় না। কলকাতায় শাকিব খান যদি ভোর ৬টায় শুটিং এর জন্য ঘুম থেকে উঠতে পারেন, সকাল ৭টায় শুটিং স্পটে হাজির হতে পারেন তাহলে সেটা ঢাকায় কেন সম্ভব নয়?

এব্যাপারে শাকিব খানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- কলকাতায় পেশাদারিত্বের কথা বললেন। ঢাকায় এর অভাব কেন দেখি? শাকিব খানের উত্তর- আমাদের এফডিসির নিয়মের মধ্যেই তো অনেক সমস্যা। সরকারী নিয়ম অনুযায়ী সকাল ৯টার আগে অফিস খোলে না। আমাদের এখানে কারিগরী জ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে…

শাকিব খানের এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা কতখানি সে বিতর্কে আমরা যেতে চাই না। তবে আমরা মনে করি আমাদের কথা ও কাজের মধ্যে মিল রাখাটা জরুরি। আরও জরুরি নিয়ম মানার মন-মানসিকতা।

এই যে শাকিব খান বললেন- কলকাতায় তিনি ভোর ৬টায় শুটিং এর জন্য ঘুম থেকে উঠতেন। সকাল ৭টার মধ্যে শুটিং স্পটে হাজির হতেন। ঢাকায় কি তিনি সেটা করবেন? শাকিব খান আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। কলকাতায় ছবির শুটিং এর আগে তিনি মহড়ায় অংশ নিতেন। বাংলাদেশে অর্থাৎ নিজ দেশে এটা কি তিনি করেন? শুধু শাকিব খান কেন আমরা অন্যরাও কি নাটক সিনেমার শুটিং শুরুর আগে একবারের জন্য মহড়া করি?

তবে শেষ পর্যনত্ম এটাই সত্য- শাকিব খানেরা যদি এইসব নিয়ম মানতে শুরু করেন তাহলে আমাদের ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রির চেহারাই বদলে যাবে। কিন্তু সেজন্য কি আমরা প্রস্তুত?