Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

শাহ্‌জিয়ার স্থাপত্য ভূবন

স্থাপত্যশিল্পে এ দেশের নারীদের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ স্থপতি শাহ্‌জিয়া ইসলাম অনত্মন। এক সময়ে মনে করা হতো নারীরা শুধুমাত্র অফিসিয়াল কাজ আর ঘর সংসার সামলাবে। সে ধারণাকে ভুল বলে প্রমাণ করেছেন তিনি। নারীরাও পুরুষের পাশাপাশি সব কাজে সমান দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারে এটি প্রমাণিত হয়েছে তার কাজের মাধ্যমে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে মেধাবী শিক্ষার্থী শাহ্‌জিয়া ইসলাম অনত্মন কর্মজীবনেও রেখেছেন মেধার স্বাক্ষর। এবার শাহ সিমেন্ট সুইট হোমে তাকে নিয়ে এ প্রতিবেদন। লিখেছেন- মোহাম্মদ তারেক।

শাহ্‌জিয়া ইসলাম এ দেশের কৃতী আর্কিটেক্টদের একজন। দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শনীয় স্থাপনার কাজ করে তিনি অনেকের কাছে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। নারী বা পুরুষ নয় দক্ষতা, মেধা ও যোগ্যতা থাকলে যে কেউ ভালো কাজ করতে পারে এর জ্বলনত্ম উদাহরণ শাহ্‌জিয়া ইসলাম। স্বামী প্রখ্যাত স্থপতি মুসত্মাফা পলাশের পাশে থেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘ভিসত্মারা আর্কিটেক্টস’। যে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিনিয়ত বাসত্মবায়িত হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকর্ম। তারই নিদর্শনস্বরূপ উল্লেখ্য- দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শপিং মল বসুন্ধরা সিটি, পান্থপথের ইউনিক ট্রেড সেন্টার (ইউটিসি), গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেল, বসুন্ধরার গ্রামীণফোনের প্রধান কার্যালয়সহ অসংখ্য নান্দনিক স্থাপনার ডিজাইন। সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের গর্ব ‘র‌্যাডিসন বেভিউ হোটেল’ এর নাম। ইতিমধ্যেই যার ডিজাইন এবং নান্দনিকতা প্রশংসিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। এভাবেই আরো বহু দর্শনীয় ভবনের স্থাপত্যকর্মের সাথে জড়িত শাহ্‌জিয়া ইসলাম ও তাঁদের প্রতিষ্ঠান ‘ভিসত্মারা আর্কিটেক্টস’। নারী বা পুরুষ নয়, মানুষ হিসেবেই তিনি সর্বত্র তাঁর যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। শাহ্‌জিয়া ইসলামের জন্ম পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কিশোর বেলা কেটেছে নিউ ইস্কাটনে। মা শরীফুননেসা ছিলেন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষিকা। আর সে সুবাদে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যনত্ম তিনি ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলেই পড়াশোনা করেছেন। বাবা মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম আমেরিকান সরকারের ইউএসআইএস-এর ইনফরমেশন চীফ হিসেবে ২৫ বছর চাকরি করেছেন। এরপর ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক রিলেশনস অফিসার হিসেবে যোগ দেন। Shanta-Western-Tower-1শাহ্‌জিয়ার বাবা মুহাম্মদ নূরুল ইসলামই বাংলাদেশ পাবলিক রিলেশনস এসোসিয়েশনের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। একজন গুণী মানুষের মেয়ে হিসেবে শাহ্‌জিয়া ইসলাম বরাবরই চেয়েছেন ভালো কিছু করতে। সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্ম হওয়ায় নাচ ও গানের পাশাপাশি নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও তিনি সম্পৃক্ত থেকেছেন। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৭৯ সালে। ১৯৮১ সালে হলিক্রস কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বুয়েটের স্থাপত্যবিভাগে। বুয়েট থেকে ১৯৮৮ সালে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার-এ মেধা তালিকায় ৫ম স্থান অধিকার করেন। এরপরই শুরু করেন কর্মজীবন। এক সময় মেয়েরা বিভিন্ন সাইটে গিয়ে কাজ করতে পারবে না এ অজুহাত তোলা হতো। শাহ্‌জিয়া ইসলামই প্রথম নিজের আগ্রহে ‘প্রস্থাপনা’ নামের আর্কিটেক্ট ফার্মে যোগাযোগ করেন। তাঁর দৃঢ়তা আর একাগ্রতা দেখে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান আর্কিটেক্ট মিজানুর রহমান তাকে নিয়োগ দেন। নিজের যোগ্যতায় তিনি প্রমাণ করেন কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বলে কোনো ভেদাভেদ নেই। তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ওই প্রতিষ্ঠান অল্প দিনেই আরো ৭/৮ জন নারী আর্কিটেক্টকে নিয়োগ দেয়। সব বাঁধার পাহাড় ডিঙিয়ে শাহ্‌জিয়া ইসলাম ভিন্ন ধরনের কাজের প্রতি মনোনিবেশ করেন। শুধু স্থাপনার কাজই নয় মসজিদ, ট্রাক টার্মিনালসহ নানা ধরনের ভবন নির্মাণের ড্রইং ও সুপারভিশনের কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সালে ‘প্রস্থাপনা’ ছেড়ে দেন তিনি।

bashundhara-city-1তারপর ১৯৯৭ সালে স্বামী স্থপতি মুসত্মাফা খালীদ পলাশকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘ভিসত্মারা আর্কিটেক্টস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। শুরু থেকেই তিনি এ প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯৭ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া ‘ভিসত্মারা আর্কিটেক্টস’ এখন  বাংলাদেশের একটি অন্যতম নামকরা আর্কিটেক্ট প্রতিষ্ঠান। যাদের রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শনীয় স্থাপনার কাজ।

এ সব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন প্রথম পুরস্কারসহ আইএবি ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড। অত্যনত্ম বিনয়ী, পরিশ্রমী আর পেশার প্রতি সৎ থেকে তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে একজন অনুসরণীয় মানুষ হিসেবে বিবেচিত। তাঁর দেখাদেখি অনেক মেয়েই এ পেশার প্রতি আগ্রহী হয়ে  উঠেছেন। বলাবাহুল্য, বর্তমানে ‘ভিসত্মারা আর্কিটেক্টস’-এর অধিকাংশ আর্কিটেক্টই নারী। শাহ্‌জিয়া ইসলামের আজকের এ অবস্থানে  আসার পেছনে তাঁর বন্ধু এবং স্বামী মুসত্মাফা খালীদ পলাশের অবদান সবচেয়ে বেশি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বামী তাঁকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দিয়েছেন। স্বামী আর্কিটেক্ট মুসত্মাফা খালীদ পলাশ এবং দুই পুত্র নৈঋত ও ঈশানকে নিয়েই তাঁর সুখের সংসার। ঘর সংসারের পাশাপাশি পেশাগত অবস্থানকে তিনি সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও পিছিয়ে নেই তিনি। স্বামীর উৎসাহে বহুদিন পর হলেও আবার নিয়মিত সঙ্গীত চর্চা শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং পঞ্চকবির গানের তিনটি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে একটি মিক্সড অ্যালবাম। সেতারে সিদ্ধহসত্ম স্বামী পলাশ এখন সঙ্গীতেই বেশি স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এই দম্পতির জীবন এখন স্থাপত্যময়ের চেয়ে বেশি সঙ্গীতময়। এই গুণী স্থপতি সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। নিজেদের উদ্যোগে গড়া দেলভিসত্মা ফাউন্ডেশন থেকে প্রতিমাসে দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দিচ্ছেন এবং সুবিধাবঞ্চিত কিছু ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন। ভবিষ্যতে তিনি বাংলাদেশকে দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও ক্ষুধামুক্ত একটি রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান।