Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

শরিফের ফ্রি আর্কিটেকচারাল ডিজাইন সার্ভিস!

মোহাম্মদ তারেক

ছেলেটির বয়স কতইবা হবে। আট অথবা নয়। প্রতিদিনই স্কুলে যাওয়া-আসার পথে তাকিয়ে থাকত উঁচু উুঁচ বিল্ডিংয়ের দিকে। আর টেলিভিশনে বিভিন্ন ভবনের উদ্বোধন করার সময় ওই ভবনের মডেলের দিকে তাকিয়ে থাকত। আর স্বপ্ন দেখত, আহ! এমন একটি বাড়ির ডিজাইন যদি করতে পারতাম। ছেলেটির লালিত স্বপ্ন শেষমেশ বাস্তবে রূপ লাভ করে। তার নাম মো: জিয়াউল শরিফ। ইট, কাঠ, বালু ও কংক্রিটের মাঝেই তিনি খুঁজে ফেরেন প্রকৃতির সান্নিধ্য। আর তাই প্রতিটি স্থাপনায় থাকে সবুজের ছোঁয়া। ঘর-বাড়ি প্রতিটি ডিজাইনের ক্ষেত্রে আলো, বাতাস, সবুজসহ প্রকৃতিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে মেঝ স্থপতি জিয়াউল শরিফ। গ্রামের বাড়ি মাগুড়া জেলায়। জন্ম নানা বাড়ি রাজশাহীতে। কিন্তু তার বেড়ে উঠা ঢাকায়। বাবার নাম এম এম শহীদুল্লাহ। তিনি অ্যাডভোকেট ছিলেন। মা মৃত: মিসেস শিরিন শহিদ। স্কুল জীবন থেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ঘাসফুল খেলাঘর আসর করতেন। গান গাওয়ার প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড নেশা, বইপড়া, ছবি আঁকা ছিল তার পছন্দের বিষয়। অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন। তবে মিউজিকের ওপর ঝোকটা ছিল অনেক বেশি। ঘাসফুল খেলাঘর আসরের ছেলে-মেয়েদেরকে গান শিখাতেন তিনি। বুয়েটে পড়াকালীন সময়ও কালচারাল প্রোগ্রামের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রায়ের বাজার হাইস্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৯১ সালে। ১৯৯৩ সালে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে। ৪র্থ বর্ষে ছাত্র থাকাকালীন সময়ে কিছু দিন পার্টটাইম কাজ করেন বশিরুল হক এন্ড অ্যাসোসিয়েট এবং ইন্ডিজেনাস আর্কিটেক্টসএ। তার প্রিয় শিক্ষক সামসুল ওয়ারেস স্যার। লুই কানের স্থাপত্য নিয়ে গড়ে ওঠা আমাদের জাতীয় সংসদ ভবন তার প্রিয় স্থাপত্যকর্ম। জিয়াউল শরিফ ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন ২০০৩ সালে। পাস করে বের হওয়ার পর পরই তিনি প্রজেক্ট পার্টনার হিসেবে যোগদেন বন্ধু স্থপতি যাবের এর ফার্মে। তারপর স্থপতি উত্তম সাহার তত্ত্বাবধানে ‘নন্দন আর্কিটেক্টস’-এ যোগদেন। সেখানে তিনি উত্তম সাহার সঙ্গে র‌্যাংগস নিকেতনসহ বেশ কিছু বড় বড় প্রজেক্টে কাজ করেন। দেড় বছর চাকরি করার পর ২০০৬ সালে তিনি ইউনিক হোটেল এন্ড রিসোর্ট এ স্থপতি হিসেবে যোগদেন ফাইভ স্টার হোটেল ওয়েস্টিন ঢাকায়। প্রজেক্টের কাজ শেষ হওয়ার পর ২০০৮ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘ভূ-মাত্রা কনসালটেন্টস’ নামের একটি ফার্ম। এই ফার্মে অভিজ্ঞ স্থপতিসহ ২৫ জন কর্মী নিয়ে কাজ করে চলেছেন তিনি।

shah-cement-2ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের নামকরা হোটেল, হসপিটাল, কমার্শিয়াল টাওয়ার, অফিস বিল্ডিংসহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে বিজয়নগরে নাভানা গ্রুপের হাইরাইজ বাণিজ্যিক ভবন, জামালপুরের রায়ান টাওয়ার, বেক্সিমকো গ্রুপের ডি.টি. এইচ আপলিংক স্টেশন, গেন্ডারিয়ায় সিটিগ্রুপের আজগর আলী হসপিটালের ইন্টেরিয়র, গুলশান-২ এ ওয়েস্টিন হোটেলের কিছু অংশের ইন্টেরিয়র, কনকর্ড গ্রুপের কনকর্ড মোজ্জামেল ভিলা, সিক্সসিজন হোটেলের ইন্টেরিয়র, রাজশাহীর জুডিয়াক টাওয়ার, চট্টগ্রামের ভিস্তারা আর্কিটেক্টস এর সঙ্গে রেডিসন বেভিউ হোটেলের পাবলিক এরিয়ার ইন্টেরিয়র, গুলশান-২ এ নাভানা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যানের অ্যাপার্টমেন্টের ইন্টেরিয়র, বিভিন্ন জায়গায় টপ-ক্লিন আউটলেটের ইন্টেরিয়রসহ অসংখ্য বিল্ডিংয়ের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন।

shah-cement-1বর্তমানে বেশ কিছু নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন স্থপতি জিয়াউল শরিফ। সেগুলো হলো রাজশাহীর থ্রি স্টার হোটেল ‘রিভার ভিউ’, নিকুঞ্জের হোটেল গ্রেসটুয়েন্টি ওয়ান, বনানীর হোটেল নর্থ গেইট, মি: জাভেদ রেসিডেন্স ইত্যাদি। স্থপতি মো: জিয়াউল শরিফ তার সব কাজ স্থাপত্যনীতি ও রাজউকের নিয়ম মেনেই করেন। ২০০৩ সালে তিনি বিয়ে করেন তিনি। স্ত্রীর নাম মিসেস মোহসিনা আজাদ। তিনি একজন নারী উদ্যোক্তা। স্থপতি জিয়াউল শরিফ বলেন, আমরা বিশ্বাস করি একটি খোলামেলা ঘর। যেখানে আলো বাতাস ঢোকে এমন একটি ঘরে বড় হওয়া ছেলে-মেয়ে আর একটি অন্ধকার, ঘিঞ্জি, আলো বাতাস ঢোকে না- এমন ঘরে বড় হওয়া ছেলে-মেয়েদের চিনৱা ভাবনায়, মন মানসিকতায় আর শারীরিক গঠনে অনেক ফারাক থাকে। যে ঘরে আলো বাতাস ঢোকে না, সারাদিন ইলেকট্রিক লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হয় সে রকম ঘরে থাকা মানুষ নানা ধরনের অপুষ্টি ও অসুখ-বিসুখে ভুগে থাকে। এমন অন্ধকার ঘরে বড় হওয়া ছেলে-মেয়েরা নিজের ভবিষ্যৎ এবং দেশ ও সমাজের জন্য ভালো কাজ করার চিনৱা ও মন-মানসিকতা হারিয়ে ফেলে। তাই আমরা চাই, আপনার আমার ছেলে মেয়েরা এমন ঘরে বড় হোক, যেখানে আলো বাতাস shah-cement-3ও সুন্দর পরিবেশ থাকবে। যেখান থেকে সে সুস্থ, সুন্দর মন ও শরীর নিয়ে বড় হতে পারে। সে নিজের ভবিষ্যতের জন্য এবং দেশ ও সমাজের জন্য ভালো কাজ করার চিনৱা করতে উৎসাহ পাবে। তিনি আরো বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি যে, দেশের বড় বড় নগরীর বিভিন্ন অংশে যত্রতত্র ঘন বসতি এবং বাসা-বাড়ি গড়ে উঠছে। যা আলো বাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি করছে। এসব ক্ষেত্রে বাড়ির নকশাবিদ হচ্ছেন বাড়ির মালিক নিজেই। যিনি প্রফেশনাল নকশাবিদ নন। যিনি আলো বাতাস, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এগুলো নিয়ে কিছুই ভাবেন না। তিনি কোনো রকমে একটি বসবাসের জায়গা নির্মাণ করতে চান। কিন্তু তার এই চাওয়া থেকে তিনি নিজের ও তার পরিবারের এবং আশেপাশের মানুষের ও পরিবেশের অনেক ক্ষতি করে ফেলেছেন নিজের অজানেৱই। যা নিজের জীবন ও ভূমিকম্পের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু এভাবে যখন অনেকগুলো মানুষ এরকম বসবাসের কথা চিনৱা করেই যত্রত্রত নির্মাণ কাজ করে যাচ্ছে। তখন একটু একটু করে অনেক বড় ক্ষতি করছেন অনেক মানুষের এবং পরিবেশের। অথচ যদি এই যত্রতত্র নির্মাণগুলো একজন প্রফেশনাল নকশাবিদ করতেন তাহলে হয়তো তার তত্ত্বাবধানে একটু গুছিয়ে এগুলো নির্মাণ করা যেত। আলো, বাতাস, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং একই সঙ্গে স্ট্রাকচারাল, অগ্নি ও ভূমিকম্প- ঝুঁকি বিষয়গুলো মাথায় রেখেই হয়তো নকশাটি তৈরি হত। সর্বোপরি এসব কারণে যা হচ্ছে, তা মানুষের স্বাস্থ্য, তথা সমাজ ও পরিবেশের জন্য অনেক ক্ষতিকর। এই ক্ষতির দিকটি মাথায় রেখে এবং সমাজের প্রতি দায়ত্ববোধ থেকে ভূ-মাত্রা কনসালটেন্স প্রফেশনালদের ডিজাইন সার্ভিস নিতে অসামর্থ্য গণমানুষদের জন্য চালু করেছে ‘ফ্রি আর্কিটেকচারাল ডিজাইন সার্ভিস। যা প্র-বোনো সার্ভিস নামে পরিচিত। এই প্র-বোনো সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে খুলনায় আরতি রাণী মণ্ডলের আবাসিক ভবন, কুষ্টিয়ায় আমিনুল ইসলামের আবাসিক ভবনসহ আরও বেশ কিছু প্রজেক্ট।

বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি কাজে নজর দেন স্থপতি জিয়াউল শরিফ। এই স্থপতি তার কাজ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে ভালোবাসেন। পেশার কাছে দায়বদ্ধ থেকে সেটাকে সততার সঙ্গে শেষ করতে চেষ্টা করেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থপতি জিয়াউল শরিফ বলেন, অনেকে মনে করেন স্থাপত্য পেশা ও স্থপতিরা কেবলমাত্র সমাজের বিত্তশালীদের জন্য কাজ করে থাকেন। কিন্তু ভূ-মাত্রা কনসালটেন্স সমাজের এই ধারণাটা ভেঙে স্থাপত্য সেবাকে পৌঁছে দিতে চায় সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমি চালু করেছি ফ্রি আর্কিটেকচারাল ডিজাইন সার্ভিস। ভবিষ্যতেও আমি এই বিষয়টি নিয়ে আরও জোরালোভাবে কাজ করতে চাই এবং প্রতিষ্ঠিত করতে চাই একটি শ্লোগান ‘ইৗঋঔঅকঋ উকখৗঋ এৃৗ ঋেৃীেঋ’।