Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

রাবেয়া খাতুন বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্রের বিদায়

রেজানুর রহমান
জীবনে এতো কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে একথা একবারও ভাবিনি। আনন্দ আলো এক যুগ অতিক্রম করেছে। এই দীর্ঘ পথে আনন্দ আলোর প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদমুখ অর্থাৎ কাভার স্টোরির আইডিয়া দিয়েছেন সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি, বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক, চ্যানেল আই এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর। মাসে আনন্দ আলোর দুটি সংখ্যা প্রকাশ হয়। কাভার স্টোরি নির্ধারনের ক্ষেত্রে কখনও কখনও সাগর ভাই-ই আইডিয়া তুলে ধরেন। অথবা আমি প্রস্তাব করলে তার পরামর্শ অনুযায়ীই কাভার স্টোরি নির্ধারণ করা হয়। এমনও হয়েছে সাগর ভাই দেশের বাইরে রয়েছেন। ফোনেই কাভার স্টোরির আইডিয়া নিয়ে কথা বলেছি। হয়তো এক সপ্তাহ ধরে নতুন কাভার স্টোরি নিয়ে ভাবছি। সাগর ভাই বড় জোর পাঁচ মিনিট সময় নিলেন। কাভার স্টোরির আইডিয়া চূড়ান্ত হয়ে গেল। ফলে কাভার স্টোরির ব্যাপারে অনেকটাই নির্ভার থাকি আমি। মাথার ওপর ফরিদুর রেজা সাগর আছেন। নির্ভরতার ছাদ। কাজেই আমার তো কোনো চিন্তা নাই। কিন্তু আনন্দ আলোর কাভার স্টোরি করা নিয়ে আমাকে যে এতো কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে সে জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
রাবেয়া খাতুন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখক। তিনি হঠাৎ করেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন। বাংলা ভাষার এই সেরা লেখককে ঘিরে আনন্দ আলোর একাধিক সংখ্যা প্রকাশ হওয়া উচিৎ। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলা ভাষার এই সেরা লেখক হলেন আমাদের মা। মায়ের হঠাৎ মৃত্যু সন্তানদের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে একথা সবাই জানেন ও বোঝেন। কাজেই মায়ের মৃত্যুর পর-পরই তাঁকে নিয়ে ছাপার অক্ষরে কিছু করতে যাওয়া সত্যিই অনেক কষ্টের। কঠিন পরীক্ষাও বটে। তাঁর ওপর রাবেয়া খাতুনের মতো সেরা লেখক, গুণী ব্যক্তিত্বের ওপর কিছু করতে যাওয়াও তো অনেক সাহস ও প্রজ্ঞার ব্যাপার।

আমার মনে হলো সম্পাদক হিসেবে এই সাহস ও প্রজ্ঞা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। সৌভাগ্যবশতঃ রাবেয়া খাতুনের স্নেহ পেয়েছি। তিনি আমাদের খালাম্মা। আমাদের মা। তাঁর ওপর ছাপার অক্ষরে কিছু করতে গিয়ে পাছে না ভুল করে ফেলি।
আমার মাথার ওপর নির্ভরতার বিশাল ছাদ হয়ে আছেন ফরিদুর রেজা সাগর। আনন্দ আলোর কোনো সিদ্ধান্তই তাকে ছাড়া কোনো দিন নেইনি। এবার কী করব? জিজ্ঞেস করব তাকে? কিন্তু কিভাবে? তিনি তো চিকিৎসার জন্য দুর দেশে অবস্থান করছেন। আমরা অনেকে খালাম্মার জন্য এখনও চোখের পানি সামলাতে পারছি না। আর মায়ের জন্য কতটা হাহাকার হচ্ছে আপন সন্তানদের সেটাতো সহজেই অনুমেয়। কল্পনায় বার বার সাগর ভাইয়ের মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম। যখনই কল্পনা করি তখনই বুক ফেটে কান্না আসে। পৃথিবীর প্রত্যেক সন্তানই তার মাকে ভালোবাসে। কিন্তু ফরিদুর রেজা সাগর যেভাবে তাঁর মাকে ভালোবাসেন শ্রদ্ধা করেন সেটা বিরল। মা-ছেলের এমন মায়াময় সম্পর্ক আমি আর দেখিনি। এক অর্থে মা রাবেয়া খাতুন ছিলেন ফরিদুর রেজা সাগরের সব চেয়ে ভালো বন্ধু। সে কথা রাবেয়া খাতুন জীবদ্দশায় বলেছেনও। “সাগর আমার জীবন সংগ্রামের অন্যতম সহযোগী। এক অর্থে ও আমার বন্ধুও বটে”।
আমি পড়ে গেলাম মহা ভাবনার মধ্যে। রাবেয়া খাতুনকে নিয়ে আনন্দ আলোর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হবে। সেখানে ফরিদুর রেজা সাগরের পরামর্শ ছাড়া কি ভাবে এগুবো আমি? আনন্দ আলোয় নিজের রুমে বসে একটি লেখা লিখছিলাম। হঠাৎ এলো গোলাম মোর্তুজার ফোন। বিশিষ্ট সাংবাদিক গোলাম মোর্তুজা। সাপ্তাহিক এর সম্পাদক। ফোনে কথা কেটে কেটে আসছিল। যতটুকু বুঝলাম তাতে মনে হলা রাবেয়া খাতুন সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। হ্যালো… রেজানুর ভাই…. শুনতে পাচ্ছেন? রাবেয়া খালাম্মার খবর কী? হ্যালো…
মোর্তুজার কথা শুনে ভয়ে বুকের ভিতরটা ছাৎ করে উঠলো। কোনো দুঃসংবাদ কী? সাথে সাথে আমীরুল ইসলামকে ফোন দিলাম। আমীরুলই দুঃসংবাদটা দিলেন। বললেন, ‘আমরা বনানীতে সাগর ভাইয়ের বাসায়। তাড়াতাড়ি আসেন…. ফোন রেখে কি করবো ভাবছি। কান্না সামলাতে পারছি না। সাগর ভাইকে কী একটা ফোন দিব? পরক্ষনেই মনে হল তাকে ফোন দিয়ে কি বলব? এতক্ষণে তার বুকের ভেতরটা তো কষ্টের নদী হয়ে গেছে। আহারে! মাকে ছেড়ে থাকতে হবে বলে অসুস্থতা সত্বেও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছিলেন না। এই তো মাত্র কয়েকদিন আগেই ২৭ ডিসেম্বর ছিল রাবেয়া খাতুনের জন্মদিন। মায়ের জন্মদিনে একটি হৃদয় ছোয়া লেখা লিখেছিলেন। ছোট্ট লেখা। অথচ অনেক মায়া আর শ্রদ্ধায় উজ্জ্বল প্রতিটি শব্দ।

Rabeya-Khatun

“একটা কথা রয়েছেÑ পরিবারের অবস্থান থেকে তৈরি হয় পরবর্তী প্রজন্ম। একটা পরিবার বা পরিবারের মানুষগুলো কীভাবে বেড়ে ওঠে তার উপর নির্ভর করে সেই পরিবারের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আর একটা পরিবার দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের মতো দেশে মায়ের উপর। মায়ের শিক্ষা, মা যেভাবে পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষিত করতে চান, জানাতে চান কীভাবে জীবন চলবে, ঠিক সেইভাবেই তৈরি হয় একটা নতুন প্রজন্ম।
আমরা চার ভাইবোন আজকে জীবনে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানটায় আমাদের মায়ের অবস্থান কোথায়! কথা ঘুরে ফিরে একটাইÑ বাঙালি পরিবারের মা এমন একটা অবস্থানে থাকে, সে অবস্থান থেকে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নির্ধারিত হয়। আজকে আমাকে যদি আমাদের মা সম্পর্কে বলতে হয়, তাহলে বলার তো অনেক কিছুই রয়েছে। মা তো মা-ই হয়। সব মা-ই একই রকম। একই গুণ কিন্তু তার মধ্যেও প্রত্যেকটি মায়ের আলাদা রূপ আছে। একটা কথা ভেবে আমি খুব অবাক হই, বিস্মিত হইÑ আজকে যখন আমার মেঘনার ছোট মেয়ে আমার নাতনি একটা সকাল কনার সঙ্গে কাটায়, কনা বলেÑ এক সকালে এত যন্ত্রণা দেয়। সেখানে আমরা চার ভাইবোন আমার মাকে কী পরিমাণ যন্ত্রণা দিয়েছি! কারণ প্রায় পিঠাপিঠি ভাইবোন আমরা। সেটা যদি এখন আমরা ভাবি, তাহলে আমি বিস্মিত হই। কিন্তু তারচেয়েও বড় বিস্ময় আমার কাছে, আমি যখন দেখি আমার মায়ের লেখা বইগুলো আলমারিতে সাজানো রয়েছে, বইগুলো শুধু যে আম্মার লেখা তাই নয়, অনেক অনেক বই আমি ছোটবেলায় দেখেছি। এই বইগুলো তিনি পড়েছেন, পড়িয়েছেন আমাদের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন।

টেলিভিশনের প্রায় সব অনুষ্ঠানই তিনি দেখেছেন। আমাদের দেখানোর ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, আম্মার যে বইগুলো রয়েছে সেই বইগুলো আমার ধারণা, এখন যদি কাউকে বলি যে, বইগুলো দেখে দেখে লেখো তাহলেও একজীবন লেগে যাবে শুধু সেটা কপি করতে। তাহলে আমার মা কখন আমাদের দেখলেন, কখন লিখলেন আর কখনই-বা আপনাদের সবার প্রিয় রাবেয়া খাতুন হয়ে উঠলেন। এই কখন সময়টা যদি খুঁজতে হয় তাহলে তো অনেক দশকের কথা বলতে হয়। এই এত লম্বা সময় ধরে তিনি কীভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন, অনেকের কথা ভাবছেনÑ সেটা আজকে তাঁর জন্মদিনে আমার জন্য আমাদের জন্য একটা বড় বিষয়।
সেজন্য এ অনেক বড় বিষয়ের সঙ্গে এই জন্মদিনে আমার মাকে অনেক শুভেচ্ছা। এখন আমার একটা আলাদা পরিবার রয়েছে। মেঘনার ছোট্ট মেয়েটি, যে এখন বলতে পারে না কথাÑ তার পক্ষ থেকেও অনেক অনেক শুভেচ্ছা।”
২৭ ডিসেম্বর ঘরোয়াভাবে মায়ের জন্মদিন পালন করে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান সাগর ভাই। নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস এর কয়েকদিন পর অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি মৃত্যু হয় রাবেয়া খাতুনের। বড় মেয়ে কেকা ফেরদৌসী ও বড় জামাতা মুকিত মজুমদার বাবু ছাড়া পরিবারের আর কেউই দেশে ছিলেন না।
রাবেয়া খাতুনের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর-পরই ছুটে গেলাম সাগর ভাইয়ের বনানীর বাসায়। ততক্ষণে সারা পৃথিবী জেনে গেছে রাবেয়া খাতুনের মৃত্যু সংবাদ। আমীরুল ইসলামকে দেখলাম বিদেশে সাগর ভাইয়ের সাথে কয়েকবার কথা বললেন। মন চাইছিল একবার সাগর ভাইয়ের সাথে কথা বলি। কিন্তু সাহস হল না। কী বলব তাকে? কান্না ছাড়া তো কিছুই প্রকাশ করতে পারব না। একবার মনে হলো কনা ভাবীর সাথে কথা বলি। পরক্ষনেই মনে হল, তিনি কি আমার ফোন ধরবেন? তাকেই বা কি বলব? প্রবাল ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। ফোন করব কী? এবারও নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। একবার মনে হল মামুন ভাইকে ফোন করি। পরক্ষনেই মনে হলÑ ফোন করে কি বলব? ফোন করার সাহস পেলাম না।
রাতে ঘুম হলো না। বার-বার খালাম্মার মায়াভরা মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। ফোন করলেই কী যে এক মায়ায় জড়িয়ে জিজ্ঞেস করতেনÑ কী লিখছ? বাংলা ভাষার সেরা লেখক আমাকে জিজ্ঞেস করছেনÑ কী লিখছ? কতজনের ভাগ্যে এমন মায়াময় প্রেরনা জোটে।
সেই ছোটবেলায় আমার শিক্ষক পিতার মুখে রাবেয়া খাতুনের নাম শুনেছিলাম প্রথম। ছোট বেলায় দেখতাম আব্বা সময় পেলেই বই অথবা পত্রিকা পড়তেন। প্রতি মাসেই প্রিয় কবি, লেখকের নতুন বই কিনতেন। বইয়ের সাদা পাতায় বই কেনার তারিখ এবং সেদিনের অনুভূতির কথা লিখে রাখতেন। সৈয়দপুর শহরে নামকরা একটি পত্রিকার দোকান আছে। নিউজ কেবিন নামেই পরিচিত। শহরের শিক্ষিত মানুষদের আড্ডা স্থল ছিল এই পত্রিকা বিক্রির দোকানটি। দোকানের মালিকের এক ছেলে পড়তো শহরের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাবর্ডিনেট কলোনী প্রাইমারী স্কুলে। আব্বা ছিলেন ওই স্কুলের জনপ্রিয় শিক্ষক। ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে শ্রদ্ধা ভরে ‘খেলার স্যার’ বলে ডাকতো। ছেলের স্কুলের শিক্ষক বলেই আব্বা নিউজ কেবিনে গেলে আলাদা সমাদর পেতেন। আব্বা নিউজ কেবিনে দাঁড়িয়েই সেদিনের দৈনিক পত্রিকা পড়তেন। তবে প্রতি সপ্তাহে চিত্রালী ও পুর্বাণী নামের সিনেপত্রিকা কেনা ছিল তার অভ্যাস। আর প্রতি মাসেই প্রিয় লেখকের বই কিনতেন। সম্ভবত আমি তখন ক্লাশ ফাইভের ছাত্র। একদিন দেখলাম আব্বা একটি বইপড়া নিয়ে দারুন ব্যস্ত। খাওয়ার সময়ও বইটি হাতে থাকে। ঘুমাতে যাবার আগেও বইটিকে হাত ছাড়া করতে চান না। বালিশের নীচে বই রেখে ঘুমান। এক ধরনের কৌতুহল জন্মায় আমার মাঝে। কিন্তু বড়দের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ছোটোদের নাক গলানোর কোনো মানে হয় না। সেজন্য খুব একটা আগ্রহ দেখাই না। কিন্তু আব্বাই বইটির নাম ও লেখকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আজ বইটির নাম মনে করতে পারছিনা। তবে লেখকের নাম স্পষ্ট মনে আছে। তিনি হলেন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখক রাবেয়া খাতুন। আব্বার আগ্রহেই আমি বই পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি এবং এক সময় রাবেয়া খাতুন, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, শওকত ওসমান, রাহাত খান, রশীদ হায়দার, রিজিয়া রহমান এবং ইমদাদুল হক মিলন আমার প্রিয় লেখক হয়ে ওঠেন। রাবেয়া খাতুনের মধুমতি উপন্যাস পড়ার পর থেকেই আমার ইচ্ছে জন্মায় জীবনে যদি সুযোগ পাই তাহলে একবার হলেও রাবেয়া খাতুনকে সামনা সামনি দেখব। তার পা ছুঁয়ে সালাম করবো। একদিন কথায় কথায় আমার ইচ্ছের কথা আব্বাকে বলেছিলাম। তিনিই সাহস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তোমার ইচ্ছে একদিন অবশ্যই পুর্ণ হবে।

একদিন সত্যি সত্যি স্বপ্নটা বাস্তবে ধরা দিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হয়েছি। সৌভাগ্যক্রমে তখনকার সময়ের দেশসেরা একমাত্র দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার’ হিসেবে যুক্ত হবার সুযোগ পেলাম। সাংবাদিক এবং লেখক হবো এই স্বপ্ন নিয়েই ঢাকায় এসেছিলাম। সে কারণে গণযোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন ইত্তেফাকে যুক্ত হই। ইত্তেফাকে কাজ করেছি একটানা ১৯ বছর। এর মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে পরিচয় হয় দেশের বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগরের সাথে। আমার ধারনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। আর দৈনিক ইত্তেফাক স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে কিভাবে হাটতে হয় তার সাহস যুগিয়েছে। আর ফরিদুর রেজা সাগর আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অবিচল থাকার অযুত প্রেরণা যুগিয়ে চলেছেন। একদিন কথায় কথায় দেশে একটি ভালো মানের বিনোদন পত্রিকা প্রকাশ করা যায় কিনা এব্যাপারে সাগর ভাইয়ের কাছে প্রস্তাব তুলেছিলাম। তিনি সেদিন কিছুই বলেননি। তবে বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ধরো, আমরা একটি বিনোদন পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তুমি ইত্তেফাক ছেড়ে আসতে পারবে?
সাথে সাথেই জবাব দিলামÑ হ্যা পারব।
ভেবে বল।
দৈনিক পত্রিকা মানেই তো তখনকার দিনে ইত্তেফাকই সেরা। প্রচার সংখ্যায় সবার শীষে অবস্থান। জনপ্রিয়তার একটা মোহ তো আছেই। তাছাড়া আছে পেশাগত নিশ্চয়তা। কিন্তু আমার মাঝে একটা অস্থিরতা কাজ করতো। ভালো মানের একটি বিনোদন পত্রিকার অস্থিরতা। পাশের দেশের একাধিক বিনোদন পত্রিকা আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয়। ওরা পারলে আমরা কেন পারব না? মূলতঃ এই জেদ থেকেই আমার উনিশ বছরের বিশ্বস্থ ঠিকানা ইত্তেফাক ছেড়ে দিয়ে যুক্ত হলাম ইমপ্রেসের বিনোদন পাক্ষিক আনন্দ আলোয় সম্পাদক হিসেবে। আমার পরিবার ও সাংবাদিক বন্ধুদের অনেকেই সেদিন অবাক হয়েছিলেন। ইত্তেফাকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটি পাক্ষিক বিনোদন পত্রিকায় যুক্ত হওয়া সত্যিকার অর্থে সাহসেরও ব্যাপার ছিল।
আসল কথায় আসি। আনন্দ আলোতে যুক্ত হওয়ার পরই মূলতঃ বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখক রাবেয়া খাতুনের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ ঘটে। আনন্দ আলোতে রাবেয়া খাতুনের একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার ছাপতে চাই। সাগর ভাইকে ইচ্ছের কথা জানালাম। সাথে সাথেই তিনি ফোনে রাবেয়া খাতুনের সাথে কথা বললেন। ‘আম্মা, আনন্দ আলো আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চায়। সম্পাদক রেজানুর রহমান নিজেই আসবে’।
বোঝা গেল রাবেয়া খাতুন সম্মতি দিয়েছেন। পরের দিন বিকেল ৩টায় সাগর ভাইয়ের ইসকাটনের বাসায় যাবো বলে সিদ্ধান্ত হল।
রাতে ঠিকমতো ঘুম হল না। প্রিয় লেখকের সাথে দেখা হবে। প্রশ্ন সাজালাম। কিভাবে প্রশ্ন গুলো করবো তার একটা মহড়াও দিলাম। কিন্তু পরের দিন প্রিয় লেখকের মুখোমুখি হওয়ার পর মনে হল খামাখা টেনশনে ছিলাম সারা রাত। দরজা খুলে দিয়েছিল কাজের মেয়ে। ড্রয়িংরুমে বসিয়ে দিয়ে সে চলে গেল বাসার ভিতর। তারপর এক গাদা নাস্তা নিয়ে এলো। হঠাৎ ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন রাবেয়া খাতুন। আমি বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। পোশাকে, চেহারায় বাঙালিয়ানার দ্যূতি ছড়িয়েছে। মুখে মায়া ছড়ানো হাসি।
কেমন আছো?
বললাম, ভালো আছি। তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। মনে হল তার পা দুটো যেন আমার মায়েরই পা। তিনিও আমার সামনে সোফায় বসলেন। মমতা ছড়ানো কণ্ঠে বললেন, মিষ্টি খাও!
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি নিজেই আনন্দ আলোর প্রসঙ্গ তুললেন। বললেন, তোমাদের পত্রিকাটা অনেক ভালো হচ্ছে।
সত্যি কথা বলতে কী দশ/পনের মিনিটের ব্যবধানে আমার সকল ভয়-ভীতি, জড়তা দুর হয়ে গেল। সাক্ষাৎকার পর্ব শুরু হল। বাংলা ভাষার সেরা লেখকের সাথে কথা বলছি। একবারও মনে হল না আজই তাঁর সাথে প্রথম মুখোমুখি দেখা। মনে হল কতদিনের চেনা। সত্যি তো রাবেয়া খাতুনকে অনেক দিন ধরে চিনি তার লেখার মাধ্যমে। তবে আজ নতুন একটা সম্পর্ক হল। তাকে খালাআম্মা বলে ডাকার সৌভাগ্য হল। খালাআম্মা তো মায়েরই সমান। কী যে আনন্দ হচ্ছে।
নানা প্রসঙ্গে, নানা বিষয়ে বহুবার রাবেয়া খাতুনের মুখোমুখি হয়েছি। কম কথা বলতেন। কিন্তু যা বলতেন তার সরটাই জরুরি। বাহুল্য পছন্দ করতেন না। অহেতুক প্রশংসায় বিরক্ত হতেন! বড় ছেলে ফরিদুর রেজা সাগরের সাথে ছিল তার গভীর বন্ধুত্ব। এক সময় তাঁর জীবন সংগ্রামের প্রেরণা শক্তি হয়ে ওঠেন বড় ছেলে ফরিদুর রেজা সাগর।
একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, সাগর আমার পাশে না দাঁড়ালে আমি হয়তো এতো কিছু করতে পারতাম না। ছোট্ট বয়সেই ও আমার সাথে অনেক সংগ্রাম করেছে। এক অর্থে ও আমার বন্ধুও বটে।
লেখালেখির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিভাজন মোটেই পছন্দ করতেন না রাবেয়া খাতুন। একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, এই যে নারী লেখক বলা হয়। এটা কেন? পুরুষের বেলায় কি পুরুষ লেখক বলা হয়? লেখক তো লেখকই। তার আবার বিভাজন কী?
ভালো কলম, ভালো কাগজে লিখতে পছন্দ করতেন রাবেয়া খাতুন। তবে লেখার সেই পুরনো টেবিলটাকেই অনেক ভালোবেসে ফেলেছিলেন। জীবন পাল্টেছে, বাসা পাল্টেছে। আসবাবপত্র বদল হয়েছে। শুধুমাত্র লেখার সেই টেবিলটার বদল হয়নি। আমার সৌভাগ্য হয়েছে ঐতিহাসিক ওই টেবিলের সামনে বসে রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে কথা বলার। জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার লেখার টেবিল সেই আগের মতোই….
আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এই টেবিলটাও আমার সংগ্রামী জীবনের অংশ। তাকে ছেড়ে থাকি কি করে?

Rabeya-Khatun

সহজ কথা যায় না বলা সহজে। ভেবেছিলাম রাবেয়া খাতুনকে ঘিরে অনেক কথা লিখব। কত স্মৃতি, কত কথা। সহজ-সরল জীবনাল্লেখ্য। কিন্তু সহজ কথা যায় না বলা সহজে।
৪ঠা জানুয়ারি রাবেয়া খাতুনের মরদেহ প্রথম নেওয়া হল বাংলা একাডেমিতে। ততক্ষণে ভীড় জমে গেছে দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতিকর্মী সহ বিশিষ্টজনদের। একাধিক মন্ত্রীও এলেন। সবার চোখে কান্না। দুপুরে মরদেহ আনা হল চ্যানেল আই প্রাঙ্গনে। অসংখ্য শোকাতুর মানুষ নামাজে জানাজায় অংশ নিলেন। যাকে দেখি তিনিই কাঁদছেন। বিকেলে বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হল বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনকে।
আমি তখনও একটা ঘোরের মধ্যেই আছি। বিশ্বাস হচ্ছিলো না রাবেয়া খাতুন নেই। বার-বার মনে হচ্ছিলো এটা দুঃস্বপ্ন। মন চাইছিলো সাগর ভাইয়ের সাথে কথা বলি। একবার ভাবি দুইবার পিছিয়ে যাই। কী বলব তাকে? সব চেয়ে বড় কথা তার সাথে কথা বলার সময় আবেগ ধরে রাখতে পারব না। কেঁদে ফেলব? তখন ব্যাপারটা হয়তো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাবে। হঠাৎ মনে হল রাবেয়া খাতুনের ওপর আনন্দ আলোর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হওয়া দরকার। এটা আনন্দ আলোর দায়িত্ব। কিন্তু সেজন্য তো পরিকল্পনা প্রয়োজন। কার সাথে পরিকল্পনা করব? সবাই তো শোকে মুহ্যমান। শ্রদ্ধাভাজন শাইখ সিরাজ, মুকিত মজুমদার বাবু ভাইয়ের সাথে কথা হল। কথা বললাম আমীরুল ইসলামের সাথে। আমীরুল কিছু পরামর্শ দিলেন। এবার সাহস করে ফোনে কথা বললাম সাগর ভাইয়ের সাথে। সাগর ভাই ফোনের ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই বুক ফেটে কান্না এলো আমার। কথা হল সামান্য! কিছু পরামর্শ দিলেন। শুরু হলো আনন্দ আলোর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের প্রস্তুতি।
প্রিয় পাঠক,
সবিনয়ে বলতে চাই রাবেয়া খাতুনের মতো কিংবদন্তী লেখকের ওপর আনন্দ আলোর একটি বিশেষ সংখ্যাই যথেষ্ট নয়। তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্মের ওপর ব্যাপক গবেষনা হওয়া প্রয়োজন এবং তরুণ পাঠকের মাঝে আরও বেশি বেশি রাবেয়া খাতুনকে উপস্থাপন করা জরুরি।
স্বল্প সময়ের মধ্যেও আনন্দ আলোর এই বিশেষ সংখ্যায় রাবেয়া খাতুনকে নিয়ে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের প্রতি রইল অনেক কৃতজ্ঞতা।
না ফেরার দেশে অনেক ভালো থাকবেন খালাম্মা। মাগো, অনেক ভালো থেকো…