Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

মোশাররফ করিম এক অসামান্য দৃষ্টান্ত!

মামুনুর রহমান

সন্তান বাবার ভক্ত হবেন এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া যারা ছোটবেলা থেকে বাবার সুখ বা দুঃখের সময়টি দেখে বড় হয় তাদের কাছে বাবা নামের মানুষটার কদর একটু বেশি থাকে। মোশাররফ করিমের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বাবার নেওটা। বাবা যা করবেন তাই তাকে করতে হবে। বাবার পিছে পিছে ঘোরা ছিল মোশাররফ করিমের অভ্যাস। অনেকদিন এমনও হয়েছে মাঠে বা বাড়িতে কোথাও খেলছেন দূর থেকে বাবাকে যেতে দেখেছেন। ব্যস হয়ে গেল খেলার মাঝখানে বিরতি। দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতেন। যতদিন বাবা নামের এই মানুষটি বেঁচে ছিলেনÑ একমাত্র তিনিই ছিলেন প্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিমের সেরা বন্ধু। ছেলে বেলা থেকেই মোশাররফ করিম বাবা যা যা করতেন তাই তাই করার চেষ্টা করতেন তিনি। তাঁর বাবা যদি চা পানের সময় শব্দ করতেন মোশাররফও তাই করতেন। মোশাররফ বিশ্বাস করেন তাঁর বাবাকে অনুকরণ করতে গিয়েই অভিনয় শিখেছেন তিনি। ভিষণ আফসোস নিয়ে মোশাররফ প্রায়ই স্যুটিং এ বলেন, বাবা বেঁচে থাকলে স্যুটিং এ নিয়ে আসতাম। অন্য সবার মতো বাবা আমার স্যুটিং দেখে হেসে ফেলতেন, আর আমি সেই ছেলে বেলার মতোই দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতাম।
১৯৮৯ সালে থিয়েটারে কাজ শুরু করেন তিনি। বাংলা নাটকের কীর্তিমান অভিনেতা তারিক আনাম খান নাটকের নতুন দল তৈরি করতে যাচ্ছেন। খবর পেয়ে রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণ করেন তিনি। সবে মাত্র এইচএসসি পরীক্ষা দেয়া একজন সাধারণ মানুষ। যোগ্যতা বলতে ঐটুকুই। রেজিস্ট্রেশন ফরমে সেটিই উল্লেখ করে চলে আসেন। রেজাল্ট যেহেতু হয়নি। অডিশনের যোগ্যতা তার নেই সেটা জেনেই রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণ করেন তিনি। ভাইভায় এই কথা গুলোই বলেন তিনি।
১ হাজার চারশত জনের মধ্যে বাছাই করে ২৫ জনকে নাট্যকেন্দ্রে কাজের সুযোগ দেয়া হয়। সেখানে তিনিও ছিলেন একজন। এক নাগাড়ে মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন টানা ষোল বছর। এর মধ্যে ছোট ছোট চরিত্রে কাজের সুযোগ এসেছিল। সেগুলোতেও কাজ করেছেন মন দিয়ে। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকেই নিয়মিত হয়ে ওঠেন টেলিভিশনের পর্দায়। মোশাররফ হোসেন নামটিতে নিজেই পরিবর্তন এনে নাম দেন মোশাররফ করিম। করিম নামটি যুক্ত করার কারণটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি জানান- তাঁর বাবার নাম ছিল খলিফা মোহাম্মদ আবুল করিম। তাই বাবার নামের শেষাংস আর বাবার দেয়া নিজের নামের প্রথমাংশ রেখে নাম করেন মোশররফ করিম। তাঁর অভিনীত নাটক ক্যারম তুমুল আলোচিত হলে একের পর এক নাটকের অফার আসতে শুরু করে। তবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর এই নাটকটিতে অভিনয় করতেই চাননি তিনি। সেই একই সময়ে থাইল্যান্ডে গিয়ে স্যুটিংয়ের প্রস্তাব এসেছিল একজন পরিচালকের কাছ থেকে। বিদেশে গিয়ে স্যুটিং! জীবনে প্রথমবার বিদেশে যাবেন বলে কথা। কিন্তু স্ত্রী জুঁই বুঝিয়ে বলেন মোশাররফকে। ক্যারমের স্ক্রীপ্ট গাঁথুনি অসাধারণ- তুমি এ নাটকটি করো। স্ত্রীর এই কথাটি রেখেছিলেন মোশাররফ আর তাই তো আজ কোটি হৃদয়ে বসবাস করছেন তাঁর অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে। ক্যারমের কেন্দ্রীয় চরিত্রটা চমৎকার ভাবে যেমন মোশাররফকে প্রমান করেছিল তেমনি মোশাররফও প্রমান করলেন তিনি কতটা দক্ষ অভিনেতা। ক্যারম এ অভিনয়ের আগে সৈয়দ আওলাদ পরিচালিত ‘হেফাজ ভাই’ নাটকে মূল চরিত্রে অভিনয় করে ছিলেন মোশাররফ করিম।
আড়িয়াল খাঁ’র পিঙ্গল কাঠিতে জন্ম নেয়া মোশাররফ যখন ছোট তখনই নিশ্চয়ই ভাবেননি দেশ সেরা অভিনেতা হবেন। শুধু তিনি কেন তার পরিবারেরও কেউ কখনোই তা ভাবতে পারেননি। কিন্তু মোশাররফ করিম আজ দেশ সেরা অভিনেতার একজন। কিভাবে হলেন উপরে যা বলেছি সেগুলোই কি ঢের হয়েছে। নিশ্চয়ই নয়। এর ভেতরে রয়েছে আরও অনেক অজানা ঘটনা। চলুন জানি সেগুলো।
মোশাররফ করিমের বাবা ছিলেন একজন যাত্রা দলের অভিনয় শিল্পী। পরিবারের অনুমতির বাইরে গোপনে অভিনয় করেছেন অসংখ্য যাত্রা পালায়। আবুল করিম স্বপ্ন দেখতেন দেশের সেরা অভিনেতা হবেন। কিন্তু স্বপ্ন দেখলেই তো আর বাস্তবে ধরা দেয় না। সংসারের চাপে আবুল করিম যাত্রা থেকে নিজেকে সরিয়ে বরিশালের পিঙ্গল কাটিতে শুরু করেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেই আবুল করিমের ৮ম সন্তান মোশাররফ করিম। জন্ম ১৯৭১ সালের ২২ আগস্ট।
ছেলে বেলা থেকেই ভীষন ভালো আবৃত্তি করতে পারতেন তিনি। শিখিয়েছিলেন তাঁর বাবা। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানেই মোশাররফ করিমের গুরুত্ব। একদিকে আবৃত্তিতে প্রথম পুরস্কার অন্যদিকে অভিনয়ে জোরে হাত তালির শব্দ। এদিকে পরিবারের অন্যরা মোশাররফের এমন হয়ে ওঠার বিষয়টাকে মোটেই ভালো চোখে দেখছিলেন না। অভিনয়ের ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার ভেবেছিলেন তারা। সামনা সামনি ছেলেকে সাহস দেয়ার উৎসাহ কখনোই দেখাননি আবুল করিম কিন্তু খুব বেশি বকাঝকাও করেননি কখনো।
ঢাকায় তারিক আনাম খানের গ্রুপ নাট্যচক্রে চান্স পাওয়ার গল্পটা আগেই বলেছি। তবে জানানো হয়নি নাটকের চর্চা চালাতে, নাটকের মানুষদের সাথে মিশতে যেসব অর্থের প্রয়োজন হতো সেগুলোর যোগান আসতো কিভাবে। মোশাররফ খুব ভালো গণিত বোঝাতে জানতেন। ঢাকায় এসে নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি টিউশনি করেছেন দীর্ঘ দিন। নাট্যকেন্দ্রে তারিক আনাম খান ছাড়াও মোশাররফ সাহচর্য পান জাহিদ হাসান, ঝুনা চৌধুরী, তৌকির আহমেদ এর।
কথায় বলে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, ঠিক তাই হয়েছিল মোশাররফ করিমের জীবনে। অভিনয় জীবনের শুরুর দিকে অনেকটা সময় মোশাররফকে দেখা গেছে পাসিং শট দিতে। যেখানে থাকতো না কোন সংলাপ। থাকতো না কোন অভিনয়ের সুযোগ। স্যুটিং ইউনিটের বাস কিংবা মাইক্রোর শেষ সিটে বসেছেন দীর্ঘদিন। কারন সেটাই তার বসার জায়গা। ধীরে ধীরে নাটকের সংলাপ যখন জুটতে শুরু করলো সেখানেও চরিত্র গুলো খুবই ছোট ছোট। কখনো বাড়ির চাকরের চরিত্র বা নায়কের বন্ধুর ছোট্ট এক চরিত্র। হীরার ব্যবসায়ী নাকি হীরা চিনে নিতে পারে। ঠিক মোশাররফকে চিনে নিলেন মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। আর বাকী টুকু সবার জানা।