Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা

জীবন থেকে নেয়া বাংলাদেশ নির্মিত অনেক দিন আগের একটি সিনেমা। অবশ্য তখন আমাদের এই প্রিয় মাতৃভ‚মি স্বাধীনতা লাভ করেনি। তবে বলা যায় এই একটি সিনেমা আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছে। একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কাহিনীর মাঝে ছিল স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তোলার আন্দোলন। প্রতীকী অর্থে ছবিটির মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেরও প্রেরণা ছড়িয়ে যায়।

মাঝে মাঝেই দেশের কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি দেখানো হয়। এখনও কত জীবন্ত কাহিনী। ছবির প্রতিটি চরিত্র এতটাই বিশ্বস্ত যে, নায়করাজ রাজ্জাককে কখনই মনে হয়নি তিনি অভিনয় করছেন। আনোয়ার হোসেন, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিল, আমজাদ হোসেন, রোজী সামাদ আর সুচন্দাকে কখনই মনে হয় না ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী। বরং বেশি করে মনে হয় সবাই যেন এক একজন বিশ্বস্ত চরিত্র। তাদের জীবনেই ঘটনাগুলো ঘটছে। এই তো সেদিন একটি টেলিভিশন চ্যানেলে ‘আলোর মিছিল’ ছবি দেখতে দেখতে কেঁদে ফেললেন একজন বয়স্ক মানুষ। ছবিতে নায়করাজ রাজ্জাক আর ববিতার মধ্যে মামা ভাগ্নীর সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে রাজ্জাক ও তার সহযোদ্ধারা দেশের বিরাজমান অস্থির পরিস্থিতি মেনে নিতে পারে না। চোরাচালানসহ সামাজিক অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়। ফলে ভাইয়ের শত্রæ হয়ে ওঠে। ছবির এক জায়গায় আছে বড় ভাইয়ের অন্যায় কর্মকাÐের প্রতিবাদ করেছে ছোট ভাই। বড় ভাই তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ছোট ভাই বাড়ি থেকে চলে যাবার সময় আদরের ভাগ্নী কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠেÑ ছোট মামা যাসনে! সেই ভাগ্নীই দুর্বৃত্তদের গুলিতে মারা যায়। তখনই ছোট মামার স্মৃতিতে বারবার ভেসে ওঠে সেই করুণ আর্তি… ছোট মামা যাসনে… ছবির এই দৃশ্যে কাঁদছিলেন ভদ্রলোক। প্রসঙ্গ তুলতেই বললেনÑ ছবিটি যতবার দেখি ততবারই কাঁদি। তখনই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা মনে পড়ে। ভদ্রলোক বারবার আক্ষেপ করে বললেনÑ মুক্তিযুদ্ধ করে একটা দেশ স্বাধীন হলো। অথচ এই যুদ্ধ নিয়ে আমাদের দেশে ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘আলোর মিছিল’ অথবা ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এর মতো জীবন ঘনিষ্ঠ কাহিনীর আর কোনো ছবি পেলাম না। এর মাঝে স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর ছবি যে হয়নি তা বলব না। কিন্তু খুব কি আলোচিত হয়েছে? প্রাণ ছুঁয়েছে দর্শকের?

Aguner-PoroshMoniএই যে একজন দর্শক প্রাণ ছুঁয়ে যাবার কথা বললেন এটাই হলো আসল কথা। সিনেমা যদি দর্শকের প্রাণ না ছোঁয়, হৃদয়কে স্পর্শ না করে তাহলে তো কাজের কাজ কিছুই হবে না। তবে হ্যাঁ সিনেমা  নির্ভর করে চলমান সময়ের ওপর। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর ছবি বানাতে গেলে সময়ের কথাও ভাবতে হবে। ধরা যাক ৭১ এর মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরকে সময় ভেবে একটি ছবি বানানো হবে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? প্রিয় বাংলাদেশ তো বদলে গেছে। সেই মাঠ ঘাট, নদী নালা, শহর বন্দর, সবুজ প্রকৃতি, বিস্তৃত প্রান্তর কিছুই তো আর আগের মতো নাই। তাহলে সিনেমায় কীভাবে দেখাব ৭১ কে?

উপায় আছে। ঐ যে বললাম সময়কে বিবেচনায় রেখে ছবি বানানো দরকার। ৪৬ বছর পর আজকের বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়েছে। আজও কি ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো আর একটি ছবি হতে পারে না? অথবা আর একটি আলোর মিছিল? অবশ্যই হতে পারে। এজন্য দরকার বর্তমান সময়কে বিবেচনায় রেখে সিনেমার পর্দাকে আলোকিত করা। কিন্তু সেটা কি হচ্ছে? একটা সত্য তুলে ধরি। আমাদের ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’ এই বাক্যটি পুরনোদের কাছে যতটা আপন তরুণদের কাছে ততটা নয়। কারণ ইতিপূর্বে তরুণদের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রকৃত তথ্য, উপাত্ত তুলে ধরা হয়নি। স্বাধীনতার বিকৃত ইতিহাস পড়ানো হয়েছে শিশু-কিশোর ও তরুণদেরকে। যার ফলে আলোর মিছিল ছবি দেখে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য যখন কাঁদে তখন হয়তো তরুণ কোনো সদস্য এই কান্নার মানে খুঁজে পায় না। অথচ এই কান্নাতো সবাইকেই ছুঁয়ে যাবার কথা। এই পরিবর্তনটা সিনেমার মাধ্যমেই আনা সম্ভব। অনেকে বলে এদেশের তরুণেরা দেশের নাটক, সিনেমা দেখতে তেমন আগ্রহী নয়। তাদেরকে পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই। তারা দেশেরটা না দেখলেও অন্য কারওটা তো নিশ্চয়ই দেখে। কেন অন্যেরটার প্রতি তারা আগ্রহী? এই ব্যাপারে সিনেমা সংশ্লিষ্ট সকলেরই ভাবনা চিন্তা প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি যেটা জরুরি তাহলো তরুণদের মাঝে একটা আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করা। মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস বড়দের মুখে একই সুরে একই মায়ায় উচ্চারিত হলেই তরুণদের মাঝে বিশ্বাসের জায়গা পোক্ত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

ফ্লাশব্যাক

১৯৭০ সালে প্রয়াত চিত্রপরিচালক জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি। এর পরের বছরই শুরু হয় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম।

গত ৪৬ বছরে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনভিত্তিক বেশকিছু সিনেমা নির্মিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ফকরুল আলমের পরিচালনায় নির্মিত হয় ‘জয়বাংলা’ নামের একটি সিনেমা। একই বছর প্রয়াত চিত্রপরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘ওরা ১১ জন’ নামে একটি আলোচিত সিনেমা। এটি বেশ আলোচনায় উঠেছিল সে সময়। একই বছর সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘অরুনোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, আনন্দ’র পরিচালনায় ‘বাঘা বাঙালী’, মমতাজ আলীর পরিচালনায় ‘রক্তাক্ত বাংলা’ নামে তিনটি আলোচিত সিনেমা নির্মিত হয়। ১৯৭৩ সালে প্রয়াত পরিচালক আলমগীর কবীর নির্মাণ করেন ‘ধীরে বহে মেঘনা’ নামে একটি সিনেমা। একই বছর প্রয়াত খান আতাউর রহমান ‘আবার তোরা মানুষ হ’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করে সেই সময়ের অস্থিরতার একটি ছবি দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরেন। একই বছর আলমগীর কুমকুম ‘আমার জন্মভ‚মি’ ও কবীর আনোয়ার ‘শ্লোগান’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন।

১৯৭৪ সালে প্রয়াত পরিচালক নারায়ণ ঘোষমিতা ‘আলোর মিছিল’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। একই বছর চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘সংগ্রাম’ নামে একটি সিনেমা। ‘কার হাসি কে হাসে’ শিরোনামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন আনন্দ। মোহাম্মদ আলীর পরিচালনায় নির্মিত হয় ‘বাংলার ২৪ বছর নামে’ একটি সিনেমা। ১৯৭৬ সালে হারুন-উর-রশীদ নির্মাণ করেন ‘মেঘের অনেক রঙ’ নামে একটি আলোচিত সিনেমা। ১৯৮১ সালে শহীদুল হক খান ‘কলমীলতা’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। ১৯৮১ সালের পর প্রায় ১২ বছর দেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো সিনেমা নির্মিত হয়নি। ১৯৯৩ সালে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ শিরোনামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন হারুন-উর-রশীদ। একই বছর নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্মাণ করেন ‘একাত্তরের যীশু’। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে কাজী হায়াত নির্মাণ করেন ‘সিপাহী’ নামে একটি নতুন সিনেমা। প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন তার বহুল আলোচিত সিনেমা ‘আগুনের পরশমনি’। তানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করেন ‘নদীর নাম মধুমতি’। ১৯৯৭ সালে খান আতাউর রহমান ‘এখনো অনেক রাত’ শিরোনামে এবং চাষী নজরুল ইসলাম ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ নামে দুটি সিনেমা নির্মাণ করেন। ১৯৯৮ সালে নাজির উদ্দিন রিজভী ‘৭১ এর লাশ’, ২০০০ সালে শামীম আখতার ‘ইতিহাস কন্যা’, ২০০১ সালে এম সালাউদ্দিন ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা’ ২০০২ সালে শামীম আখতার ‘শিলালিপি’, প্রয়াত তারেক মাসুদ ‘মাটির ময়না’ ২০০৪ সালে তৌফির আহমেদ ‘জয়যাত্রা’ হুমায়ূন আহমেদ ‘শ্যামল ছায়া’ চাষী নজরুল ইসলাম ‘মেঘের পরে মেঘ’, ২০০৬ সালে চাষী নজরুল ইসলাম ‘ধ্রæবতারা’, মোরশেদুল ইসলাম ‘খেলাঘর’, ২০০৭ সালে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ‘স্পার্টাকাস’, ২০০৮ সালে তানভীর মোকাম্মেল ‘রাবেয়া’, ২০১০ সালে মুশফিকুর রহমান গুলজার ‘নিঝুম অরণ্যে’, ২০১১ সালে মোরশেদুল ইসলাম ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ‘গেরিলা’, রুবাইয়াত হোসেন ‘মেহেরজান’, শাহজাহান চৌধুরী ‘আত্মদান’, আনোয়ার শাহাদাত ‘কারিগর’, ২০১২ সালে বদরুল আলম সৌদ ‘খÐ গল্প ৭১’, মাসুদ আখন্দ ‘পিতা’, ২০১৩ সালে তানভীর মোকাম্মেল ‘জীবন ঢুলী’, মিজানুর রহমান শামীম ‘৭১ এর গেরিলা’, ২০১৪ সালে মনসুর আলী ‘৭১ এর সংগ্রাম’, জাহিদুর রহিম অঞ্চন ‘মেঘমল্লার’, গোলাম মোস্তফা শিমুল ‘অনুকোশ’, সাদেক সিদ্দিকী ‘হৃদয়ে ৭১’, শাহ আলম  কিরণ ‘৭১ এর মা জননী’, ২০১৫ সালে মানিক মানবিক নির্মাণ করেন ‘শোভনের স্বাধীনতা’ নামে স্বাধীনতা আন্দোলন ভিত্তিক কাহিনীর সিনেমা।

Cinema-1মহান মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নিয়ে দেশে বেশকিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’, তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ সেই সময় বেশ আলোচনায় এসেছিল।

আমরা মনে করি স্বাধীনতাভিত্তিক এই সিনেমাগুলো তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় মাঝে মাঝে প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকা দরকার। শুধু ২৬ মার্চ অথবা ১৬ ডিসেম্বরে নয় বছরের অন্যান্য দিনেও যে কোনো উৎসব পার্বনে স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর নির্মিত সিনেমা দেখানো যেতে পারে। বর্তমান সময়ে প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টি মিডিয়া প্রজেকশনের ব্যবস্থা আছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাসের একটি নির্ধারিত দিনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা নিতে পারে। ফলে বছরে ১২ মাসে ১২টি সিনেমা দেখার সুযোগ পাবে ছাত্র-ছাত্রীরা। পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানেও মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ধরা যাক আপনার বাসায় বিশেষ আয়োজনে অতিথিরা আসবেন। সংখ্যায় ২৫/৩০ জন। প্রোগ্রাম শিডিউলে আপনার ড্রয়িং রুমেই সিনেমা দেখার ব্যবস্থা রাখতে পারেন।