Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ভালোবাসার সুখ দুঃখ

রেজানুর রহমান
যদি বলি ভালোবাসার জন্যই টিকে আছে আমাদের এই পৃথিবী তাহলে কী খুব একটা ভুল বলা হবে? মোটেই না। মূলত ভালোবাসাই টিকিয়ে রেখেছে এই পরিবার সমাজ, রাষ্ট্রকে। ভালোবাসার শক্তি অনেক। ভালোবাসা শব্দটিকে আমরা অনেকেই প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কের সাথে মিলিয়ে ফেলি। তাহলে বাবা-মেয়ে, বাবা-ছেলে, মা-মেয়ে, মা-ছেলে এই ধরনের পারিবারিক মধুর সম্পর্ক গুলোকে আমরা কী বলব? এই সম্পর্ক গুলোই তো ভালোবাসার মূল শক্তি! মূল অলংকার। বাবা-মা যখন ছেলে-মেয়েদেরকে জড়িয়ে ধরে আর্শিবাদ করে কপালে চুমু দিয়ে বলেÑ অনেক ভালো থাকিস! এর চেয়ে প্রেরনার শক্তি আর হয় না। ছেলে-মেয়েরা যখন বাবা-মায়ের আদর খোঁজে, এবং আদর পেয়েও যায় তখন মনে হয় অনন্তকাল বেঁচে থাকি। ভাই-বোনের মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে ভালোবাসার কারনে। অনেকে বলেন, রক্তের টানে ভালোবাসার শক্তি বাড়ে। যে পরিবারে ভাই-বোনের সম্পর্ক অনেক মধুর সেই পরিবারে ভালোবাসাই সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। পরিবারের ছোট্ট ভাইটি ঘরে ফেরেনি এখনও। দুশ্চিন্তায় মা-বাবা ছটফট শুরু করেছেন। বড় বোনের টেনশন আরও বেশি। বার বার ঘরের বাইরে যায়, রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। উৎকণ্ঠা নিয়ে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে এসে বলে এখনও তো এলো না। বিপদ হলো না তো…
এই টেনশনটা কেন হয়? ভালোবাসার কারনেই হয়। বোন রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিল। কোনো এক বখাটে তরুণ তাকে বিরক্ত করেছে। বাসায় ফিরে ঘরের দরজা বন্ধ করে বোন কাঁদতে শুরু করেছে। রাগে ক্ষোভে ভাইয়ের মাথায় রক্ত উঠে যায়। কে তোকে অপমান করেছে বল? আমি তার জিভ ছিড়ে নেব না! ভাই এমনই হুঙ্কার দেয় এবং বখাটে সেই তরুণকে হুমকিও দিয়ে আসে! হয়তো দুই পক্ষের মধ্যে মারামারিও হয়। এর পেছনেও ভালোবাসাই কাজ করে।
আর তাই আমরা ভালোবাসাকে শুধুমাত্র প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কের মাঝে আবদ্ধ রাখতে চাই না। তবে ভালোবাসার কথা বললে প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কটাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
প্রেম থেকেই ভালোবাসার সূত্রপাত। অতীতকালে চিঠি ছিল প্রেমের বাহন! প্রেমিক অথবা প্রেমিকার চিঠি পাওয়ার জন্য সে কী আকুল প্রতীক্ষা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একজন বড় ভাইকে দেখেছি প্রেমিকার চিঠি পাওয়ার জন্য কী যে আকুল প্রতীক্ষায় থাকতেন। একবার বোধকরি তার প্রেমিকার চিঠি আসতে দেরী হয়েছিল। বড় ভাইয়ের অবস্থা দিনকে দিন কাহিল হতে শুরু করে। সাধারনত দুপুরের দিকে ডাক পিয়ন হলের ছাত্রদের চিঠি বিলি করতে আসতো। সেই বড় ভাই সকাল ১০টা ১১টা থেকেই ডাক পিয়নের জন্য অপেক্ষা শুরু করতেন। ডাক পিয়নকে দেখা মাত্রই দৌড়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়াতেন। আমার চিঠি আছে? বলেই আকুল হয়ে উঠতেন। পিয়ন যখন বলতো, না আপনার চিঠি আসে নাই তখন বোধকরি রাজ্যের অস্থিরতা ঘিরে ধরতো তাকে। প্রেমিকার চিঠি না পাওয়ার বেদনায় মাথার চুল ও মুখের দাঁড়ি কাটতেই ভুলে যান তিনি। বন্ধুদের মাঝে তাকে ঘিরে দুশ্চিন্তা শুরু হয়। কিন্তু তিনি কারও কথাই শুনতে নারাজ। একটি চিঠির জন্য সে কী আকুল প্রতীক্ষা। এক পর্যায়ে নাওয়া-খাওয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়ম করতে শুরু করেন। ভাবটা এমন এজীবন রেখে কী লাভ?

হঠাৎ একদিন ডাক পিয়ন তার দরজায় কড়া নাড়ে। প্রেমিকার চিঠি এসেছে। প্রেমিকার চিঠি পেয়ে ওই বড় ভাই যেন শিশুর সরলতায় চঞ্চল ও আনন্দিত হয়ে ওঠেন। বার-বার প্রেমিকার চিঠি পড়েন আর আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। সেদিন সন্ধ্যায়ই সেলুনে গিয়ে মাথার চুল, মুখের দাঁড়ি কেটে ফেলেন। সবাই অবাক হয়ে দেখে পড়ার টেবিল আর ভার্সিটির ক্লাশে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই। হঠাৎ তার এই পরিবর্তনের কারণ কী?: পরে জানা যায়, তার প্রেমিকা চিঠিতে লিখেছে যদি তিনি (বড় ভাই)
তার মাস্টার্স পরীক্ষায় প্রথম হতে পারেন তাহলেই তাদের প্রেম টিকবে। বিয়েও হবে। অন্যথায় গুডবাই।
বলা বাহুল্য, ওই বড় ভাই মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছেন এবং ওই প্রেমিকার সাথে তার বিয়ে হয়েছে। দু’জনই এখন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। প্রসঙ্গক্রমে একদিন বড় ভাইয়ের প্রেমিকাকে (তাদের বিয়ের পর) জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাবী হঠাৎ বড় ভাইকে চিঠি লেখা বন্ধ করেছিলেন কেন? উত্তরে হাসতে হাসতে তিনি বলেছিলেন, আমি ওকে একটু বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। আমাকে ছাড়া সে বাঁচবে না, আমি যা বলবো সে তাই করতে রাজি আছে। চিঠিতে এসব কথা লিখতো। তখনই শর্তটা দেই…
এখন অবশ্য প্রেমের চিঠি নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে চিঠি যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন চলছে মোবাইলের এসএমএস-এ ভালোবাসার যুগ। অথবা ফেসবুকে চলে প্রেম প্রেম খেলা। একজনের অনেক বন্ধু অথবা বান্ধবী। সকালে হয়তো একজন অন্যজনকে লিখলো, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। বিকেলে অথবা সন্ধ্যায় শুরু হয়ে গেল ভাঙ্গনের গল্প! তুমি আমার সাথে আর যোগাযোগ রাখবে না। আই হেট ইউ… পরের দিনই হয়তো অন্য আরেকজনের সাথে শুরু হয়ে যায় প্রেম প্রেম খেলা! আবার হয়তো এই খেলাও ভেঙ্গে যায়।
মোবাইল সংস্কৃতি ভালোবাসার সম্পর্কটাকে অনেক ক্ষেত্রে সহজ করে তুলেছে। আগের জমানায় ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে হলে চিঠি লেখা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আর বর্তমান সময়ে যাকে ভালোবাসি তার মোবাইল ফোন নম্বরটা জানতে পারলেই হল। ব্যস শুরু হয়ে গেল ভালোবাসার গল্প। সম্পর্ক শুরু হতেও সময় লাগে না। ভাঙ্গতেও সময় লাগে না! একটি ছোট্ট গল্প বলি। ওরা ফুফাতো, মামাতো ভাই বোন। পরস্পরকে ভালোবাসে। মামার বাসায় বেড়াতে এসেছে ছেলেটি। তাকে থাকতে দেয়া হল একা একটি ঘরে। পাশেই অন্য একটি ঘরে মেয়েটি থাকে। রাতে দু’জনের মধ্যে শুরু হয়ে গেল টেলিফোন সংলাপ। ম্যারাথন সংলাপ চলছে তো চলছেই। কত যে কথা! এক পর্যায়ে দু’জনের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় ফোনেই কথা কাটাকাটি। তারপর ফোন বন্ধ করে দেয় দু’জন। একরাতের টেলিফোন সংলাপেই সম্পর্কের ইতি ঘটে দু’জনের। কী ঘটেছিল তাদের মাঝে? খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, প্রেমিক-প্রেমিকা দু’জনই একাধিক জনের সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছে। এই নিয়ে শুরু হয় কথা কাটাকাটি, এবং অবশেষে ব্রেকআপ।
কথা হচ্ছিলো একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে। প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, প্রেম শব্দটা এখন অনেক সস্তা হয়ে গেছে। আমার কাছে অনেক রোগী আসে যারা প্রেমে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে মেয়েদের সংখ্যা বেশী। যাদের অনেকেই প্রেমের খেলায় শারিরীক সম্পর্কে জড়ানোর পর যখন বুঝতে পারে যে ভুল করে ফেলেছে তখনই মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এজীবন রাখবো না… বলে চিৎকার চেচামেচি করতে থাকে। তিনি বলেন, মোবাইল প্রেম তরুণ-তরুণীদের জীবনকে নষ্ট করছে। এর বিরুদ্ধে পারিবারিক সচেতনতা প্রয়োজন। তা না হলে এক সময় হয়তো সামাজিক অস্থিরতা প্রকট হতে দেখা দিবে।
আগেই বলেছি ভালোবাসার অনেক শক্তি। তবে ভালোবাসায় নোংরামি ঢুকলে সে শক্তি আরও কাজ করে না। তরুণ-তরুণীর ভালোবাসার ক্ষেত্রে যখনই শরীর গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে তখনই বুঝবেন এই ভালোবাসায় অসততা ও নোংরামি ঢুকে গেছে। এই ভালোবাসা আর শক্তি হয়ে উঠবে না। বরং জীবনকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে ফেলবে। কাজেই ভালোবাসার সম্পর্ক গড়তে মেয়েদের, উচিৎ একটু সাবধানী হওয়া। ক্ষনিক মোহতে ভেসে জীবনকে বিলিয়ে দেয়ার নাম ভালোবাসা নয়। যাকে ভালোবাসবেন তাকে আগে যাচাই করুন। ক্ষনিক দেখায় অনেক কিছুই ভালো লেগে যেতে পারে। তাই বলে, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। এমন অবুঝ প্রেমে জড়াবেন না। দেখতে ফিটফাট। আসলে কিন্তু সদরঘাট। কারও সাথে সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রে এই কথাটি মনে রাখবেন। হঠাৎ করে সুপুরুষ একজন আপনার সামনে এসে দাঁড়াল। তার দামী গাড়ি আছে। দেখতে হ্যান্ডসাম। ওয়াও… তার ব্যাপারে খোঁজ খবর না নিয়েই কোনো সম্পর্কে জড়াবেন না!

আবার একই কথা তরুণদের বেলায়ও প্রযোজ্য। মেয়েটি দেখতে সুন্দরী। ডানাকাটা পরী। এই মেয়েকে পেলে জীবন ধন্য হয়ে যাবে। এমন ভাবনায় হঠাৎ করেই কারও সাথে সম্পর্কে জড়াবেন না! আগে খোঁজ-খবর নিন। যাকে পছন্দ করছেন সে আপনার বন্ধু হবার যোগ্য কিনা অথবা আপনি তার বন্ধু হবার যোগ্যতা রাখেন কিনা এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পর সিদ্ধান্ত নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
ছোট্ট একটি গল্প বলি। সত্য গল্প। একটি ছেলে পছন্দ করে একটি মেয়েকে। আইয়ুব বাচ্চুর কনসার্ট দেখতে গিয়ে দু’জনের পরিচয়। তারপর এক বছর চুটিয়ে প্রেম। শারিরীক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে। মেয়েটির শরীরে মা হওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করে মেয়েটি। অথচ ছেলেটি তখনও বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত নয়। অপরাগতার কথা জানায় সে মেয়েটিকে। মেয়েটি এবার আত্মহত্যা করার হুমকি দেয়। বাধ্য হয়ে বাবা-মায়ের অমতেই বিয়ে করে ফেলে ছেলেটি। সে ছিল বাবা-মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান। বাবা-মায়ের ভবিষ্যৎ জীবনের খুটি। ছেলে বিয়ে করবে। সুন্দর একটা বউ আসবে সংসারে। বুড়ো বুড়িকে সন্তানের মতো আগলে রাখবে। এরকম কত স্বপ্নই না দেখেছিল তারা।
কিন্তু বাস্তবতা হলো ওই ছেলে এখন আর বাবা-মায়ের সাথে থাকে না। আলাদা বাসা নিয়েছে। একটা সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে। কিন্তু ভালোবাসা তো ভাঙ্গনে বিশ্বাস করে। তবুও ভাঙ্গছে ভালোবাসার সংসার। সিটি করপোরেশনের একটি সুত্র জানিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে শহুরে মানুষের মাঝে ডিভোর্স এর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়তে শুরু করেছে। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই প্রবনতা বেশী দেখা যাচ্ছে। এমনও দেখা যাচ্ছে বিয়ের ২/৩ মাস পরই অনেকে বিচ্ছেদে জড়াচ্ছে। অথচ ভালোবেসেই তারা বিয়ে করেছিল। হয়তো লক্ষ কোটিবার তারা পরস্পরকে বলেছিলÑ আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচ না। অথচ কত সহজেই না বিচ্ছেদে জড়াচ্ছে।
একজন মনোবিজ্ঞানীর মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়ানো অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। অনেকে হঠাৎ শারিরীক সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে বিয়ের ব্যাপারে চাপ শুরু হয়ে যায়। ভালো-মন্দ কোনো কিছু না বুঝেই অনেকে বিয়ের সম্পর্কে জড়ায়। এর পরই শুরু হয় আসল সমস্যা। প্রেম করার সময় পরস্পরের প্রতি হয়তো কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু বিয়ের পরই শুরু হয় পরস্পরের প্রতি নানান অভিযোগ! তুমি আমাকে একথা বরতে পারলে? এ ধরনের একটি কমন বাক্যই হয়ে ওঠে বিচ্ছেদের কারণ। তখন ভালোবাসা কাঁচের মতো ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। ভালোবাসা শব্দটিই তখন অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়ায়।
কিন্তু ‘ভালোবাসা’ শব্দটিতো কোনো অপরাধ করেনি। এই শব্দটি মোটেই অপরাধী নয়। অপরাধী হলাম আমরা। যারা এই শব্দটাকে অন্ধকার, অসৎ পথে ব্যবহার করি।