Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

বন্ধুরা বুড়োদের ব্যান্ড বলে ভালই লাগে!-নকীব খান

জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক নকীব খান। তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান দিয়ে মন জয় করেছেন শ্রোতাদের। ১৯৮৫ সাল থেকে রেনেসাঁর সঙ্গে পথে হাঁটছেন। শুরু করেছিলেন জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলস দিয়ে। এরপর গান করে চলেছেন প্রায় তিন যুগ ধরে এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন সঙ্গীতের নানান শাখায়। আধুনিক, ক্লাসিক্যাল এবং লোকগীতি সব ধরনের গানের এক উজ্জ্বল তারকা নকীব খানের সঙ্গে কথা হয় সম্প্রতি এক বিকেলে আনন্দ আলো’র কার্যালয়ে। তারই চুম্বক অংশ লিখেছেন-মোহাম্মদ তারেক

আনন্দ আলো: রেনেসাঁ ত্রিশ বছরপূর্ণ করেছে। আপনার অনুভূতি কেমন?

নকীব খান: ৩০ বছর ধরে আমরা মিউজিকে আছি এটা অনেক ভালো লাগার একটা ব্যাপার। সবচেয়ে বড় কথা আমরা যখন শ্রোতাদের সামনে যাই কিংবা স্টুডিওতে লাইভ শো করি তখন ভক্তদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পাই তা দেখে মনে হয় ৩০ বছরে আমাদের অর্জন অনেক। আমরা কিছু ভালো গান উপহার দিতে পেরেছি। দর্শক এখনো সেই গান গুলোর জন্য আমাদেরকে মনে রেখেছে। অসম্ভব ভালো লাগে এসব ভেবে। গত ২৯ বছরে বাংলাদেশের শ্রোতাদের কাছে রেনেসাঁ ব্যান্ড গানের মাধ্যমে সুনাম ধরে রাখতে পেরেছে। মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছি, মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছি এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় স্বার্থকতা বলে মনে করি।

আনন্দ আলো: এই দীর্ঘ পথ চলায় শ্রোতাদের প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছেন বলে মনে করেন?

নকীব খান: আমরা অনেক ভাগ্যবান যে নিজস্ব পছন্দ ও রুচিবোধে তৈরি গান দিয়েই শ্রোতাদের কাছাকাছি আসতে পেরেছি। জনপ্রিয়তার কথা কখনোই চিনত্মা করিনি। বরং কথা ও মেলোডির ওপর জোর দিয়েছি সব সময়। এত দীর্ঘ সময় ধরে শ্রোতারা আমাদের সঙ্গে আছেন, আমাদের গান শুনছেন, তাঁদের ভালোবাসা পেয়েছি। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আর ব্যর্থতা যদি বলেন, তাহলে বলব আমাদের অ্যালবামের সংখ্যা খুবই কম। ৩০ বছরে আমরা মাত্র ৪টি অ্যালবাম প্রকাশ করতে পেরেছি। দর্শকদের চাহিদা আমাদের কাছে অনেক। সেটা আমরা পূরণ করতে পারিনি। এটা আমাদের অনেক ব্যর্থতা। আমরা মেটাল রক এ ধরনের অ্যালবাম করতে পারিনি এটাও ব্যর্থতা।

আনন্দ আলো: অনেকেই বলে থাকেন রেনেসাঁ তো এখন বুড়োদের ব্যান্ড। এ বিষয়টি নিয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাই?

নকীব খান: বন্ধুদের কেউ যখন মজা করে রেনেসাঁকে বুড়োদের ব্যান্ড বলে, ভালোই লাগে। ব্যান্ডের প্রত্যেকেরই বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে। এই বুড়ো হওয়ার মধ্যে কিন্তু একটা গৌরব আছে, শানিত্ম আছে। ব্যান্ড করে একসঙ্গে তিন দশক পার করে দিয়েছি। এটা সত্যিই আমাদের জন্য অনেক আনন্দের।

আনন্দ আলো: আপনি নিজে চাকরি করছেন। আবার গানেও আছেন নিয়মিত। সমন্বয় করেন কীভাবে?

নকীব খান: আমাদের সবারই একই অবস্থা। কোনো কিছুর প্রতি মানুষের যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে সমস্যা হয় না। এক্ষেত্রে আমার চেষ্টা শতভাগ। আমি যখন অফিসে থাকি তখন শতভাগ নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করি। আর যখন মিউজিক করি তখন শুধু মিউজিক নিয়েই চিনত্মা করি।

আনন্দ আলো: আপনার ও শাকিলা জাফরের একটি ডুয়েট অ্যালবাম করার কথা ছিল। সেটার খবর কী?

নকীব খান: দেড় বছর আগে একটি গানের কাজ শেষ করেছি। রেকডিং হয়েছে। এরপর সবগুলো গানের সুরের কাজ করেছি। সময় বের করতে পারছি না। তাই এখনো শেষ করতে পারিনি। আশা করি এই বছরে অ্যালবামটি শ্রোতাদের হাতে তুলে দিতে পারব।

আনন্দ আলো: আপনার সুর ও সঙ্গীতে ন্যান্সির গাওয়া নতুন একটি গানের মিউজিক ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। কেমন রেসপন্স পাচ্ছেন?

নকীব খান: ‘আমি ছুঁয়ে দিলেই’ শিরোনামে আসিফ ইকবালের লেখা গানটির ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। এটি আমার প্রথম মিউজিক ভিডিও। খুব ভালো সাড়া পাচ্ছি গানটির জন্য।

আনন্দ আলো: অনেকেই বলেন এখন গান মিউজিক ভিডিও নির্ভর হয়ে গেছে। আপনার অভিমত কী?

নকীব খান: ভালো গান শ্রোতারা সব সময়ই শোনে। এখন গানের ধারার পরিবর্তন হয়েছে। শ্রোতারা গানের সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও দেখতে অভ্যসত্ম হয়ে গেছে। এটাকে আমি নেতিবাচক ভাবে দেখি না। গান প্রচার ও প্রসারের জন্য এটি ভালো একটি পন্থা।

আনন্দ আলো: বর্তমানে আপনি নতুন কী কী কাজ করছেন?

নকীব খান: গত বছর ফাহমিদা নবীর ‘ইচ্ছে হয়’ নামের একটি অ্যালবামের কাজ করেছিলাম। এই অ্যালবামের অনেক সাড়া পাচ্ছি। বর্তমানে নতুন কিছু কাজ করছি। আমি কোনো সময়ই বেশি কাজ করি না। নিজের ভালোলাগা থেকে বেছে বেছে কাজ করার চেষ্টা করি।

আনন্দ আলো: আপনার কী মনে হয় আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ঠিক পথে চলছে?

নকীব খান: আমার তো মনে হয় না ঠিক পথে চলছে। মূল সমস্যা হরো পাইরেসি। কম্পানিগুলো যারা অ্যালবাম বের করত তাঁরাও গুটিয়ে ফেলছে। একটি অ্যালবাম করে তাঁর লগ্নিও উঠে আসে না। সাথে সাথে পাইরেসি হয়ে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়াগুলোতে চলে যাচ্ছে গানগুলো। ফলে মানুষ এখন আর সিডি কিনে গান শুনে না। যে কারণে অডিও ইন্ডাস্ট্রি এখন প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি। তবে আমি আশাবাদী ইন্ডাস্ট্রিতে আবার সুদিন আসবে।

আনন্দ আলো: একসময় ব্যান্ড সঙ্গীতে শ্রুতিমধুর গান হতো। সেটা এখন আর হচ্ছে না কেন?

নকীব খান: এর পেছনে আসলে অনেকগুলো কারণ আছে। একটা মূল কারণ হচ্ছে যারা ব্যান্ড করছেন তাঁরা বিভিন্ন সমস্যায় আছেন। কোনো কনসার্ট নাই। আগে রেগুলার কনসার্ট হতো এখন হয়না। রেগুলার সিডি বের হতো সেটা হচ্ছে না। এখন আমাদের অনেকগুলো টিভি চ্যানেল হয়েছে। আগে ব্যান্ড ফোকাসের অনুষ্ঠান হতো। কিন্তু এখন সে ধরনের অনুষ্ঠান হচ্ছে না। যুগটাই যেন কেমন অস্থির। তাই অস্থির টাইপের গান হচ্ছে। আগের গানগুলো কালউত্তীর্ণ হয়ে যেত। আর এখন আমরা সেধরনের কালউত্তীর্ণ গান পাচ্ছি না। সেখানে আমাদেরও দুর্বলতা আছে। যারা মিউজিশিয়ান তাদের দুর্বলতা আছে। হয়তো আমরা ভালো কিছু দিতে পারছি না। আমি শ্রোতাদের কোনো দোষ দিচ্ছি না। তাঁদের কিন্তু চাওয়া পাওয়া আছে। আমরা সেটা দিতে পারছি না। ভালো গান তৈরি হচ্ছে কিন্তু তাঁদের কাছে গানগুলো পৌঁছাচ্ছে না।

আনন্দ আলো: অনেক সময় দেখা যায় রেনেসাঁর গানগুলো স্টেজে বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যে কেউ গাইছে। যেখানে তাল, লয়, ঠিক থাকছে না। এ ব্যাপারে আপনার কী মনত্মব্য?

নকীব খান: সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তাঁরা তো আমাদের গান পরিবেশন করছে। ভালো লাগছে বলেইতো গাইছে। নতুন যারা আছে তাঁদের প্রতিভা প্রকাশ করার কামনায় আমাদের গান গাইছে। দর্শকদের চাহিদা আছে বলেই তাঁরা স্টেজে গাইছে। দু’টিই জিনিসই পজেটিভ। তবে ভালো করে গান গাইতে হলে প্র্যাকটিসের ব্যাপার আছে, চর্চার ব্যাপার আছে।

আনন্দ আলো: বর্তমান সময়ের ব্যান্ড এবং গায়ক-গায়িকাদের নিয়ে আপনার মূল্যায়ন-

নকীব খান: আমাদের দেশে অনেক মেধাবী মিউজিশিয়ান আছে। কিন্তু সবার মধ্যেই অস্থিরতা দেখা যায়। তরুণরা নিয়ম ভেঙে নতুন নিয়ম গড়বে। এটাই স্বাভাবিক। আমরা যখন তরুণ ছিলাম আমরাও সেটা করেছি। অনেকেই অনেক ভালো কাজ করছে। এ প্রজন্মের শিল্পীরা অনেক শটকাট কাজ করছে। ষ্টার হওয়া সহজ, টিকে থাকা কঠিন। এটা অনেকেই বোঝে না। টেকনোলজি আসবে। আমি টেকনোলজিকে সাধুবাদ জানাই। এটার ব্যবহার করতে হবে সুন্দরভাবে। যুগের চাহিদা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। কেউ যদি মেধার চেয়ে টেকনোলজিকে বেশি ব্যবহার করে, তা খুবই দুঃখজনক। আমার মনে হয় তরুণরা তুলনামূলক ভাবে সাধনা কম করে।

আনন্দ আলো: অনলাইনে গান রিলিজ হওয়ার প্রক্রিয়াটা আপনি কীভাবে দেখেন?

নকীব খান: এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। এখন যে মাধ্যমগুলো আছে তার মধ্যে ডিজিটাল সবচেয়ে পাওয়ারফুল। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে অন্য জায়গায়। আমরা যেভাবে গান শুনছি, তাতে আমার মনে হয় সেটা স্থায়ী হওয়া মুশকিল। কারণ গানশোনার যে সাউন্ড কোয়ালিটি থাকা দরকার সেটা পাচ্ছে না। স্থায়ীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আমার কাছে মনে হয় আমরা যতই ডিজিটালি অ্যালবাম রিলিজ করি না কেন, ফিজিক্যালিও দরকার আছে।

আনন্দ আলো: নিজের গাওয়া কোন গানগুলো সবচেয়ে প্রিয়?

নকীব খান: আমার গাওয়া গান তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সুর করা গানই বেশি। আমি সুর করতে বেশি স্বচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমার কাছে নিজের সুর করা সব গানই প্রিয়। জীবনে ভালোলাগা ছাড়া গান করিনি। ভালোলাগা গানের মধ্যে রয়েছে-‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’, ‘ভালো লাগে জ্যোৎস্না রাতে’, ‘ও নদীরে’, ‘হৃদয় কাদা মাটি কোনো মূর্তি নয়’, ‘ভুলে গেছ তুমি’, ‘নদী এসে পথ’, ‘তুমি কি আজ বন্ধু’, ‘ওরে ছোট্টবেলার সাথীরে’, ‘ঘুম নেই’, ‘আচ্ছা কেন মানুষগুলো’, ‘আজ যে শিশু’, ‘ননাইয়া ননাইয়া’, ‘আঁরার দেশত যাইও তুমি’ এরকম বহু গান আছে কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব।

আনন্দ আলো: ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ গানটির নেপথ্যের কারিগর ছিলেন আপনি। এব্যাপারে কিছু জানতে চাই।

নকীব খান: আসলে গানটা লেখা হয়েছিল আমার কলেজ জীবনে। সময়টা ছিল ’৭৬/’৭৭ সালের দিকে। গানের সুর করার পর থেকেই আমি বিশ্বজিৎ- এর মতো কাউকে খুঁজছিলাম। মানে যার গলায় নতুনত্ব আছে, আছে আবেগ। আমার মনে হয় বিশ্বজিৎ গানটিকে অসম্ভব সুন্দরভাবে গেয়েছে। সুরকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে বিশ্বজিৎ।