Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

প্রেম ছাড়া বিপ্লব হয় না- হেলাল হাফিজ, বিশিষ্ট কবি

রাজু আলীম
হেলাল হাফিজ বাংলাদেশের একজন আধুনিক কবি। তাঁর কবিতা সংকলন ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর ১২টি সংস্করণ প্রকাশিত হলেও এরপর গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর নিল্পিততা দেখা যায়। ২৬ বছর পর ২০১২ সালে আসে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কবিতা ‘একাত্তর’। তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতার দুটি পংক্তি ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ বাংলাদেশের কবিতাপ্রেমী ও সাধারণ পাঠকের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকে। তিনি সাংবাদিক ও সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কাজ করেছেন। ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম খোরশেদ আলী তালুকদার । মাতার নাম কোকিলা বেগম। ১৯৬৫ সালে নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাস করেন। ওই বছরই কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন পূর্বদেশে সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ। সে রাতে ফজলুল হক হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পড়ে সেখানেই থেকে যান। রাতে নিজের হল ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক) থাকার কথা ছিল। সেখানে থাকলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হতেন। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ইকবাল হলে গিয়ে দেখেন চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, লাশ আর লাশ। হলের গেট দিয়ে বেরুতেই কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা। তাকে জীবিত দেখে উচ্ছ্বসিত আবেগে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন নির্মলেন্দু গুণ। ক্র্যাকডাউনে হেলাল হাফিজের কী পরিণতি ঘটেছে তা জানবার জন্য সে দিন আজিমপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন কবি গুণ। পরে নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের দিকে আশ্রয়ের জন্য দুজনে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেন। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তার কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশিত হয়। কবিতার জন্য পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ বৈশাখী মেলা উদযাপন কমিটির কবি সংবর্ধনা, যশোহর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার, নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেদ দাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা প্রভৃতি। কবিতায় তিনি ২০১৪ সালের বাংলা একাডেমী পুরষ্কার লাভ করেন। দীর্ঘ বিরতির পরে এই বছর প্রকাশিত হয়েছে তার কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। সম্প্রতি জাহিদ নেওয়াজ খানের পরিকল্পনা, ও সোমা ইসলামের উপস্থাপনায় চ্যানেল আই এর টু দ্য পয়েন্ট অনুষ্ঠানে নানা প্রসঙ্গে কথা বলেন তিনি।
আনন্দ আলো: ১৯৮৬ সাল- যে জলে আগুণ জ্বলে প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর আপনি আরেকটি নতুন কবিতার বই আপনার পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন। এই বইয়ের নাম- বেদনাকে বলেছি কেঁদো না। ৩৪ বছর পরে ৩৪টি কবিতা এবং এই বইয়ে একটি কবিতা বাড়তি আছে ৩৫টি কবিতা। কেন এতো দীর্ঘ সময় পরে আবার বই লিখলেন? আর এই ৩৫ নম্বর কবিতাটি কার কবিতা?
হেলাল হাফিজ: ১৯৮৬ সালে আমার যে জলে আগুণ জ্বলে যখন বের হয় তখন আমি টগবগে তরুণ। আর শুধু আমি না? তৎকালিন এই ভুখন্ড তখন তার শরীরে অনেক ক্ষত নিয়ে- ক্ষতটা কেন? একটা সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই ভুখন্ড স্বাধীন হয়েছিল। ১৯৬৭ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত এই ১৭ বছর লেখালেখি করে আমি যে জলে আগুণ জ্বলে বের করেছিলাম। আর যে জলে আগুণ জ্বলে বের হওয়ার পরে এই ৩৪ বছর পরে এই ৩৪ টি কবিতা দিয়ে দ্বিতীয় বই বের করলাম। এই দীর্ঘ বিরতির সবচেয়ে বড় কারণ তিনটি। প্রথমত- আমি খুব কম প্রতিভাবান। দ্বিতীয় কারণ- যে জলে আগুণ জ্বলের যে খ্যাতি। এটা আমাকে ভেতরে ভেতরে অসম্ভব কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। আমি মানুষের ভালবাসাকে এই জনপ্রিয়তাকে ধরে রাখতে পারবো কিনা আমার দ্বিতীয় বইয়ে? এছাড়া কাব্যগুণের বিচারে সেটা কতোটুকু যে জলে আগুণ জ্বলের কাছাকাছি হবে? মানে একটা ভীতি আমার ভেতরে কাজ করেছিল। আর সবচেয়ে বড় কারণ হলো- গদ্য অনেক সময় একটু জোর করেও লেখা যায়। মানে টেবিলে বসলাম রুটিন করে। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে সেটা হয় না। কবিতা অন্তর থেকে উৎসারিত না হলে হয় না। কবিতা শুধু মগজের বিষয় নয়? মন এবং মগজের সংমিশ্রণ না হলে সেই কবিতা মানুষের মনকে ষ্পর্শ করবে না। তাই যে কবিতা মানুষকে ষ্পর্শ করবে না, আন্দোলিত করবে না, আলোড়িত করবে না- সেই কবিতা লেখা না লেখা তো একই কথা। এই জন্যে আমি অপেক্ষা করেছি অনেক দিন।
আনন্দ আলো: এই তিনটা কারণের মধ্যে বড় কারণ কি ওটাই? দুই নম্বর কারনটি- ওই যে ৩৪ বছর আগের যে জলে আগুণ জ্বলে এর জনপ্রিয়তা যদি না পায়?
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ। এটা একটা বড় কারণ তো বটেই। আমি ছোট্ট একটি কবিতা পড়তে চাই। প্রথম কবিতাটি এই জন্যে পড়ছি তার কারণ এখন আমার সাথে এখানে যে দুজন আছেন। এই কবিতাটি তাদেরই দৃশ্য কাব্য। কবিতাটি হচ্ছে- ঢেউ। বিনা জলে বিনা সমীরণে দেখো দেখো কতো ঢেউ করিতেছে মনে।
আনন্দ আলো: আপনার নতুন কবিতার বই বেদনাকে বলেছি কেঁদো না। এখানে অনেকগুলো কবিতা এক লাইনের। হেলাল হাফিজ কেন এক লাইনের কবিতা লিখছে? তার মধ্যে ২৩ পৃষ্ঠায় আপনি লিখেছেন- ওড়না কবিতাটি। তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ।ওড়না কেন প্রেমের জায়নামাজ হয়ে গেলো? শাড়ির আঁচল কোথায় হারিয়ে গেলো কবির জীবন থেকে?
হেলাল হাফিজ: এই পংক্তি কি তোমার মনে আলোড়ন তোলেনি?
আনন্দ আলো: অবশ্যই তুলেছে। আপনি যা লেখেন তা সবাইকে আলোড়িত করে?
হেলাল হাফিজ: তুলেছে। এখন এই হ্রস্ব কবিতা লেখার মূল কারণ হচ্ছে প্রযুক্তি।অর্থ্যাৎ আইটি- ফেসবুক, অ্যান্ডয়েড মোবাইল, আই ফোন- বিশ্বের সেরা নেশা এখন অ্যান্ডয়েড মোবাইল। সমস্ত পৃথিবীতে সব বয়েসি মানুষের হাতে এই অ্যান্ডয়েড মোবাইল ক্রিয়াশীল। এটা আমাকেও প্রভাবিত করেছে। আমি আমার অবসর জীবনে অনেকটা সময়ই এখন ফেসবুকের সামনে বসে থাকি। প্রযুক্তি আমাকে বাধ্য করেছে কথা কমিয়ে ফেলতে। কম কথায় কিভাবে মানুষকে আকৃষ্ট করা যায় এবং আমার বক্তব্য অল্প কথায় কিভাবে মানুষের কাছে পৌছানো যায়? আমরা এসএমএস তো খুব ছোট করেই করি- তাই না?
আনন্দ আলো: মানুষ তো টাকা পয়সা জমায়। কিন্তু হেলাল হাফিজ নাকি মানুষ জমায়? কেন আপনি টাকা পয়সা না জমিয়ে মানুষ জমান?
হেলাল হাফিজ: এটাও প্রেম ও দ্রোহের একটা অংশ মাত্র। কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে যে, বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে দ্রোহের বা প্রতিবাদের বা বিপ্লবী কবিতা কোনটা? তাহলে সেটা নজরুলের বিদ্রোহীও নয় কিংবা আমার নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়ও নয়।সেটি হলো- যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।নয় কি? এটিই তো সবচেয়ে বড় বিদ্রোহের কবিতা। অর্থ্যাৎ প্রেমিক না হলে বিপ্লবীও হওয়া যায় না? প্রেমটাই বড়। বিপ্লবী হওয়ার জন্যেও প্রেম প্রয়োজন। এই যে মানুষ জমানো এটাও প্রতিবাদেরই একটি ভাষা। এই যে আমাদের সমাজ নষ্ট ভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন আমরা অতলের দিকে যাত্রা করেছি।এর পেছনে তো যে কয়েকটি বড় কারণ আছে তার মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে টাকা। বিত্তের নেশায় মানুষ উন্মাদ হয়ে গেছে।আমাদের অর্থনীতির পরিধি এখন বড় হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক বড় হয়েছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে এই টাকা উপার্জনের প্রতিযোগিতা। তা ন্যায় পথেই হোক বা অন্যায় পথেই হোক। এই যে প্রবৃত্তি মানুষের তার বিরুদ্ধেই এই কথাটা প্রেমের ভঙ্গিতে আমি বলেছি। প্রেম তো শুধু এন্টিসেপটিক চুমু নয়। একটা কবিতা বলি-
আমাকে উষ্টা মেরে দিব্বি যাচ্ছো চলে। বা পায়ের চারু নথে চোট লাগেনি তো? ইশ করেছো কি? বসো না লক্ষিটি।ক্ষমার রুমালে মুছে শরীর ক্ষতে এন্টিসেপটিক দুটো চুমো দিয়ে দিই? এটা যে শুধু প্রেমের কবিতা তা কিন্তু নয়। এটি প্রতিবাদেরও কবিতা। কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ? কিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ? এই যে দিনে দুপুরে রাতে আপনার আমার মেয়ে ধর্ষিত হচ্ছে বোন ধর্ষিত হচ্ছে।
আনন্দ আলো: তার মানে এক কবিতার মধ্য দিয়ে কবি শুধু প্রেম ও দ্রোহ আনেননি সমাজের অভিশাপকেও নিয়ে এসেছেন?
হেলাল হাফিজ: আমি আগেই বলেছি- প্রেম ছাড়া বিপ্লবও হয় না। বিপ্লব করতে হলেও প্রেমের প্রয়োজন।
আনন্দ আলো: আপনার পেশা কি কবি? আপনি যতো পয়সা কামিয়েছেন কবিতা বিক্রি করে তার চেয়ে বেশি পয়সা কামিয়েছেন জুয়া খেলে?
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ। কিছুদিন আমি তো আমার জীবিকা নির্বাহ করেছি এই গ্যাম্বলিং দিয়ে। সেটা অনেক আগের কথা। ১৯৭৫ সালে। তখন আমি পূর্বদেশে সাহিত্য সম্পাদক ছিলাম। তো ওই কাগজ বন্ধ হলো। মাত্র ৪ টা কাগজ ছিল। কিন্তু তৎকালিন সরকার সবাইকে চাকরি দিয়েছিল। আমাকেও চাকরি দিয়েছিল। ইনফরমেশন মিনিস্ট্রিতে। আমি যেহেতু সরকারি চাকরি করবো না তাই রিগ্রেট করেছি। তাই কিছুদিন বেকার জীবন যাপন করতে হয়েছে। তখন আমি জাতীয় প্রেস ক্লাব কার্ড রুমে গ্যাম্বলিংয়ে একটু জড়িয়ে গেলাম। আমি এটাকে ষ্পোর্টস হিসেবে নেইনি। এক সময় জীবিকা নির্বাহের পথ হিসেবে জুয়াকে বেছে নেই। তুমি ঠিকই বলেছো-সেই সময় চাকরির উপার্জনের চেয়ে আমার বেশি উপার্জন ছিল জুয়া খেলায়।
আনন্দ আলো: আপনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দূর থেকে একজনকে দেখে অড্রে হেপবার্ন বলতেন- কে সে?
হেলাল হাফিজ: হা-হা-হা। তিনি আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন সে লিকলিকে। তোমরা ছবিতে দেখেছো- বঙ্গবন্ধুর বুকের ভেতরে সে তার মাথাটা জড়িয়ে রেখেছে। সে তখন তরুণী। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি দেখলেই তাকে অড্রে হেপবার্ন ডাকতাম।