Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণই আমাদের ব্রত

মুকিত মজুমদার বাবু, চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, পরিচালক, চ্যানেল আই

আমরা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। লক্ষ্য স্থির করে। দিক নির্দেশনা দেয়। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এ দেশের অতীত গৌরব আমাদের গৌরবান্বিত করে। সোনার বাংলা বলে অহংকার বোধ করি। রূপসী বাংলা বলে গর্ববোধ করি। বুকের গভীরে প্রকৃতির প্রতি মমতা জাগে। সামিল হই প্রকৃতির সুখ-দুঃখে। ভালোবেসে প্রকৃতির ভাষা বোঝার চেষ্টা করি। অনুভব করি প্রকৃতির সাথে আমাদের অস্তিত্বের টান। আমাদের বুকের ভেতরে লালিত বাংলাদেশের নৈসর্গিক অবয়ব। যেখানে আছে বহতা নদীর বুকে তরতর করে বয়ে চলা রঙিন পালতোলা নৌকা, ষড়ঋতুর স্বচ্ছন্দ আবর্তন, ভোরবেলাতে পাখির কিচির-মিচিরে ঘুম থেকে জেগে ওঠা, ভরা বিলের আয়নাজলে কিশোরীর মুগ্ধ বিস্ময়ভরা মুখ আর কোচরভর্তি শালুক, বটের শীতল ছায়ায় শরীর জুড়াতে থাকা শ্রান্ত কৃষকের চোখে সোনালি স্বপ্নের আবাদ। এখনো চোখ বন্ধ করলে ভেসে ওঠে ছেলেবেলার সেই ধুলো ওড়ানো মেঠোপথ, শিশিরধোয়া দূর্বাঘাসের ডগায় সূর্যের আলো মাখা টলটলে মুক্তদানা। চারদিকের ঢেউ খেলানো সবুজের মনোরম দৃশ্য।
সচেতনতার অভাবে আজ প্রকৃতি বির্বণ; মলিন। হাতেগোনা স্বার্থান্বেষী মানুষের কারণে স্বপ্নের অপরূপ বাংলার চোখে এখন জলের ধারা। এই জল মুছে দিতে প্রকৃতিকে ভালোবেসে সংরক্ষণের প্রত্যয় নিয়েও এগিয়ে আসছে অনেকে। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতার আলোয় আলোকিত করে তুলছে কোনো কোনো সংগঠন। তেমনই একটি সংগঠন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নির্মিত দেশের প্রথম গবেষণাধর্মী ও তথ্যবহুল প্রকৃতিবিষয়ক প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ‘প্রকৃতি ও জীবন’। চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত এ অনুষ্ঠান তৃণমূল পর্যায়ে পরিবেশ সম্পর্কিত সচেতনতাবৃদ্ধিসহ প্রকৃতির সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সৃষ্টিতে কাজ করছে।
২০০৪ সালে প্রথম ‘প্রকৃতি ও জীবন’ অনুষ্ঠান নির্মাণের পরিকল্পনা মাথায় আসে। সে সময় সংযুক্ত আরব-আমিরাতে অনুষ্ঠিত হওয়া ‘চ্যানেল আই পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড’ -এর মূল দায়িত্ব ছিল আমার। ভিন্নমাত্রা আনতে আমি ওই অনুষ্ঠানে যোগ করি ‘রোড টু শারজা’। যার মাধ্যমে আরব-আমিরাতের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য তুলে ধরা হয়। দেখানো হয় মরুভূমির দেশটাকে সবুজ করার জন্য তাদের কী প্রাণান্ত চেষ্টা! কাজটা করতে গিয়ে আমি মনে মনে একটু হোঁচট খাই। কোটি কোটি ডলার খরচ করে ওরা মরুভূমির বুকে জলাশয় তৈরি করছে, জীববৈচিত্র্য বাড়াতে অন্যদেশ থেকে পশুপাখি আনছে। অথচ আমরা জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে নানানভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। অপরিকল্পিত নগরায়নের মাধ্যমে প্রকৃতিকে হুমকির সম্মুখীন করছি। গাছ কেটে উজাড় করছি। পরিবেশ দূষিত করছি। গর্ব করার মতো এ দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ করে তুলছি বিপন্ন। আমাদের অমিত সম্ভাবনা রয়েছে প্রকৃতির সম্পদকে কাজে লাগানোর। তা না করে আমরা দেশকেই করছি মহাদুর্যোগের সম্মুখীন। নাগরিক কোলাহলে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পাখির কলতান। সোঁদা মাটির গন্ধের বদলে ইটভাটা আর যানবাহনের কালো ধোঁয়ার বিষবাষ্প আচ্ছাদিত করছে আমাদের ফুসফুস। অপরিকল্পিত নগরায়নে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে সবুজঘেরা চারপাশ। কাটা পড়ছে গাছ। আশ্রয় হারাচ্ছে পাখি। ভরাট হচ্ছে নদী। জলজপ্রাণীর ঘটছে দ্রুত বিলুপ্তি। নিজেদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে আমরা প্রাকৃতিক সমৃদ্ধিকে অবিবেচকের মতো ধ্বংস করছি।
দেশের বিপন্ন প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন। প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে মৌলিক গবেষণা, প্রকৃতির নানান উপাদানের গুরুত্ব সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন, বিপন্ন প্রতিবেশ, বন্যপ্রাণী ও সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের নিরন্তর পথচলা। এই ফাউন্ডেশনের অন্যতম কার্যক্রম প্রকৃতি ও জীবন প্রকৃতিবিষয়ক প্রামাণ্য অনুষ্ঠান। ‘সুস্থ প্রকৃতিতে গড়ি সুন্দর জীবন’ এ শ্লোগানকে সামনে রেখে ‘প্রকৃতি ও জীবন’ অনুষ্ঠানের এগিয়ে চলছে। ২০১০ সালের ১ আগস্টে শুটিং, ইনডোর ও অন্যান্য সেগমেন্ট যুক্ত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারিত হয় প্রকৃতি ও জীবনের প্রথম পর্ব। শুটিং করা ছিল চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশের দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় শুটিংয়ের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে আমাদের। কখনো খাবার সংকট হয়েছে, কখনো পানি পাইনি, কখনো বা থাকার কোনো জায়গা ছিল না, কখনো বা যোগাযোগ ছিল একেবারেই অপ্রতুল। পদে পদে জোঁক, এটুলি, পোকা-মাকড়ের কামড় খেতে হয়েছে। তবু থেমে থাকেনি অনুষ্ঠান নির্মাণের কাজ। একবার বাদুড়ের ছবি ধারণ করতে সংকীর্ণ গুহাপথ পাড়ি দিতে হয়েছে ক্রল করে। পরে দেখা গেল ওই প্রজাতির বাদুড় বাংলাদেশে প্রথম আবিষ্কার করেছে প্রকৃতি ও জীবন দল। বগা লেকের পাশে প্রায় ২০ফুট খাড়া ওই গুহামুখে নামা ছিল অসম্ভব। কচিবাঁশ আঁকড়ে, গভীর গর্তের খাড়া দেয়ালে পা ঠেকিয়ে নামতে হয়েছিল আমাদের। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে অসংখ্যবার। ছবি ধারণ করতে গিয়ে এক হাঁটু কাদায় মাখামাখি হতে হয়েছে অনেকবার, পাহাড়ি বনে বন্যহাতির তাড়া খেতে হয়েছে, হাত ভেঙেছে কারো, আর্দ্র আবহাওয়ায় জ্বরে ভুগতে হয়েছে, বনদস্যুদের পাল্লায় পরে সব হারাতে হয়েছে আমাদের। একবার তো বিষাক্ত সাপ নিয়ে সে কি কা-! সাপ দেখে সবাই মারতে যায়। কিন্তু আমরা গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে শান্ত করি, শেষে পাই সাপের অসাধারণ ফুটেজ। আগে তো ড্রোন ছিল না। টপশর্ট নিতে জাহাজের মাস্তুলে পর্যন্ত উঠতে হয়েছে আমাদের। এমনকি আন্ডার-সি ফুটেজ নিতে গিয়ে ভয়ঙ্কর হাঙরের মুখেও পড়তে হয়েছে আমাদের দলকে। একবার তো সুন্দরবনে বাঘের গর্জন শুনে ফুটেজ নিতে চলে যাই গভীর বনে। বাঘের দেখা না পেয়ে একবুক হতাশা আর আতঙ্ক নিয়ে ফিরতে হয় সেদিন।
আজ প্রকৃতি ও জীবনের একেকটি পর্বে উঠে আসে সাগরসম বিশাল হাওরের জীববৈচিত্র্য। বঙ্গোপসাগরের তলদেশের বিস্ময়কর রাজত্ব। হাজার হাজার পরিযায়ী পাখির রঙবাহারি রূপ। জলের বন রাতারগুলের মনোমুগ্ধ সৌন্দর্য। জলসীমাতে ঝাঁকবেঁধে ঘুরে বেড়ানো ডলফিনসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর জীবনাচারণ। এসব পর্বের গাথুনী দেখে দর্শকরা মুগ্ধ। কারণ, তাদের ধারণা ছিল ন্যাশনাল জিওগ্রাফি কিংবা ডিসকভারি চ্যানেলেই বুঝি এমন দৃশ্যের দেখা মেলে। কিন্তু ‘প্রকৃতি ও জীবন’ অনুষ্ঠান তাদের সে ভুল ভাঙায়। একঝাঁক নির্ভীক তরুণ প্রমাণ করেছে, আমাদের প্রাণ-প্রকৃতিতেও রয়েছে জীববৈচিত্র্যের বিপুল সম্ভার।

মূলত সকলের একাগ্রতার কারণে অনুষ্ঠানটি আজ দর্শকপ্রিয়। একই সঙ্গে প্রকৃতি সংরক্ষণের বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশসহ ৬টি মহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কোটি মানুষের বুকে জন্ম নিচ্ছে প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রত্যয়, অঙ্গীকার, ব্রত। ইতোমধ্যে প্রচারিত হয়েছে প্রকৃতি ও জীবনের ৩২৫টি পর্ব। ২৫ থেকে ৩০ মিনিট ব্যাপ্তির প্রামাণ্য অনুষ্ঠানের শুরুতেই থাকে বিশেষ তথ্যচিত্র। এরপর বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে আলোচনা পর্ব। এখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবেশবিদ, গবেষক ও প্রকৃতিপ্রেমীরা অংশগ্রহণ করে থাকেন। এদের মতামত পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণে দিক নির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। থাকে তথ্যবহুল সেগমেন্ট। কুইজ পর্বে থাকে প্রচারিত পর্বের ওপর প্রশ্ন। এসএমএস পাঠিয়ে কুইজের উত্তর দিয়ে প্রতিনিয়ত অংশগ্রহণ করছেন সমাজের বিভিন্নস্তরের মানুষ। অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সকলকে সম্পৃক্ত করতে পারছি এটাই আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।
প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে নিয়মিত প্রকৃতিবিষয়ক বিভিন্ন দিবস নিয়ে পর্ব ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। উদযাপিত হয় বর্নাঢ্য প্রকৃতিমেলা। প্রকাশিত হয় নিয়মিত শিক্ষামূলক প্রকৃতিবিষয়ক প্রকাশনা।
প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করার জন্য জাতীয় পরিবেশ পদকসহ বেশ কিছু সম্মাননা আমরা পেয়েছি। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়ে আনন্দিত ও উৎসাহিত হয়েছি। কী পেলাম সেটা বড় কথা নয়। কী দিতে পারছি সেটাই বড় কথা। আমার বিশ্বাস, এই প্রজন্মের শিশু-কিশোর-যুব’র হাত ধরে দিন বদলাবে। আজকে যারা কচিকাঁচা, আজকে যারা নতুন, কালকে তারা উজ্জ্বল আগামী। এদের ভেতর প্রকৃতি সংরক্ষণের বীজ বুনে দিতে প্রকৃতি ও জীবন প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্ব নিয়ে ডিভিডি, বই, লিফলেট ইত্যাদি বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে বিভিন্ন স্কুল প্রোগামগুলোতে। সম্মিলিত ও আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সচেতনতার বোধটা জাগ্রত করাটাই ‘প্রকৃতি ও জীবন’ অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য। তবে প্রকৃতি সংরক্ষণে জনগণ দিন দিন যেভাবে সচেতন হচ্ছে এটা আমাকে আশার আলো দেখায়। মানুষের যে বোধে নাড়া দেয়ার দরকার ছিল, সচেতন করার দরকার ছিল, আমি বলব সেই বোধকে আমরা জাগ্রত করতে পারছি। জনগণের মধ্যে সচেতনতার বীজ বপন করতে সক্ষম হয়েছি। আজ পরিবেশ নষ্ট হলে তারা প্রতিবাদ করছে। বিকল্প পথ বাতলে দিচ্ছে। এখন বন উজাড় হলে মানুষ প্রতিবাদ করছে। নদী দূষণের কারণে আন্দোলন করছে। বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প জায়গা নিয়ে ফেলে রাখলে মানুষ সোচ্চার হচ্ছে। পাখি শিকার করা অনেক কমে গেছে এবং মানুষ পাখি রক্ষায় এগিয়ে আসছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের দিক থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে এখন জৈবসার-কীটনাশক ব্যবহার করছে। মানুষ নিজের ইচ্ছায় সাগরের সৈকত পরিষ্কার করছে। আমার মনে হয় সচেতনতার বিষয়টি আমরা অনেকটা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পেরেছি। এতে তৃপ্ত হওয়ার কিছু নেই। কেননা, একদিকে গড়ছে, অন্যদিকে ধংস হচ্ছে। ধংসের পাল্লা ভারী। আমাদের ব্রতÑ গড়ার পল্লাকে ভারী করে তোলা।
লেখক: মুকিত মজুমদার বাবু
চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন