সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
শাইখ সিরাজ
পরিচালক ও বার্তা প্রধান চ্যানেল আই
আঠারো পেরিয়ে উনিশে পা। এবার গন্তব্য কোথায়? এরকমই কিছু প্রশ্ন নিয়ে চ্যানেল আই-এর পরিচালক ও বার্তা প্রধান এবং গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ শাইখ সিরাজের মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের চুম্বক অংশ প্রকাশ করা হলো।
আনন্দ আলো: উনিশ বছরে পা দিল চ্যানেল আই। কোন ভাবনা বা উদ্দেশ্য নিয়ে চ্যানেল আই-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল?
শাইখ সিরাজ: প্রথম দিন থেকেই আমাদের চিন্তা-ভাবনা ছিল যে এটি গণমানুষের চ্যানেল হবে। সবার কথা বলবে। দেশ প্রেমিক সকল মানুষ যেন মনে করে এটি আমার টেলিভিশন। আমিও এর সঙ্গে জড়িত আছি। এর আগে দেশের কোন টেলিভিশন চ্যানেল নিয়ে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো প্রত্যাশা ছিল না। তবে অনেক আকাক্সক্ষা ছিল। আমার টেলিভিশন আমাদের কথা বলবে, আমাদের সংস্কৃতি গুরুত্ব পাবে… মানুষের প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থার চিত্র ফুটে উঠবে। আমরাও সেটাই চেয়েছিলাম। সেদিক বিবেচনায় ১৮ বছর পার করে দু’ধরনের অর্জনের কথা ভাবতে পারি। এক. চ্যানেল আই-এর পর্দা মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরী করতে পেরেছে। দুই. চ্যানেল আই-এর ভবনটিকে কেন্দ্র করে মানুষের আসা যাওয়ার একটি জায়গা তৈরি হয়েছে। যেটাকে বলতে পারি একটা সংযোগ সেতু…
আনন্দ আলো: ১৮ বছর পর কি মনে হচ্ছে? ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের মিল কেমন?
শাইখ সিরাজ: ১৮ বছর পর সত্যিকার অর্থে একটা ভাবনা চলে এসেছে যে, বর্তমান বাস্তবতায় এতবড় টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে না। বিদেশি টিভি চ্যানেল সমূহের আগ্রাসন আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলো বিদেশি টিভি চ্যানেলের বাণিজ্যিক ভাবনার সঙ্গে তাল মিলাতে পারছে না। অনুষ্ঠানের মান ভালো করার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অর্থ জোগাতে ব্যর্থ হচ্ছে অধিকাংশ দেশীয় টিভি চ্যানেল। অর্থলগ্নি করলেও ফেরত আসে না। অথবা ফেরত না আসার ভয় থাকে। অনেক ক্ষেত্রে স্পন্সর অথবা বিজ্ঞাপন দাতার চাপে ফরমায়েশী অনুষ্ঠান করতে গিয়ে অনুষ্ঠানের মান ঠিক রাখা যায় না। জনগণমুখি অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয় না। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী অনুষ্ঠান হয় না। যখন একটি টিভি চ্যানেল তার আয়ের নিজস্ব একটি উৎস খুঁজে বের করতে পারবে তখন সে সাহস পাবে। এজন্য পে চ্যানেল জরুরি। পে চ্যানেল হওয়া মানে টিভি চ্যানেলটি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পাবেই। ফলে চ্যানেলটি নিজের অনুষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে সজাগ হয়ে উঠবে। কারণ অনুষ্ঠান ভালো না হলে দর্শক চ্যানেলটি সাবসক্রাইব করবে না। সে কারণেই পে চ্যানেল হলে অনুষ্ঠানের মান বৃদ্ধির তাগিদ দেখা দিবে।
আনন্দ আলো: বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বিকাশমান ধারায় ‘সংবাদ’ অনুষ্ঠান বেশ জনপ্রিয়। এর কারণ কি বলে মনে করেন?
শাইখ সিরাজ: হ্যাঁ, একথা সত্য প্রতিটি টিভি চ্যানেলে সংবাদ বেশ জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। টেলিভিশন চ্যানেল সমূহের সংবাদ প্রতি মুহূর্তে আমাদেরকে ‘আপডেট’ দিচ্ছে। দেশ-বিদেশের জরুরি খবর সহজেই জানতে পারছি। তবে টেলিভিশন চ্যানেল সমূহে সংবাদের গুণগতমান, সংবাদ উপস্থাপনের ব্যাপারে আমরা আধুনিক হলেও গুণগতমান এখনো বাড়েনি। আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মি বাংলাদেশ এর স্বাধীনতার পর থেকে অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে দেশের প্রচার মাধ্যম তথা সংবাদ মাধ্যমেও এর স্বাধীনতা আজকের জায়গায় এসে পৌঁছেছে। যতটুকু বিকাশ হয়েছে সেটা পুরোপুরি গণমাধ্যমের নিজের অর্জন বলা যায়। তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় আমরা টেলিভশন চ্যানেলগুলোতে যে ধরনের, সংবাদ পাচ্ছি, শুনছি… সেটা কি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করছে? বিকাশমান গণতান্ত্রিক ধারায় আমাদের টেলিভিশন সমূহের সংবাদ কতটা কার্যকর ভ‚মিকা রাখতে পারছে? এসব প্রশ্ন থেকেই যায়। আমার ধারণা টেলিভিশন চ্যানেল সমূহ থেকে আরও বেশি স্বাধীন মতামতের খবর শুনতে চায় মানুষ। সংবাদে মানুষ আরও বেশি কিছু জানতে চায়। তবে এখানে একটা বিষয় খুবই জরুরি। তাহলো এতগুলো টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ প্রবাহকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষ, প্রশিক্ষিত পর্যাপ্ত জনবল আছে কি না? প্রশিক্ষণ দেয়ার মতো নির্ভর যোগ্য কোনো ইন্সটিটিউট অথবা প্রতিষ্ঠানও নাই। কাজেই অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে আমাদেরকে কাজ করতে হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা বিজ্ঞাপন দাতাদের কাছেও হার মানছি। অর্থাৎ ফরমায়েশি নিউজও করছি। ফলে আমার মনে হয় আমরা যেটুকু এগিয়ে ছিলাম তার চেয়ে এখন অনেক পিছিয়েছি। তবে আমি আশাবাদী সময়ের প্রয়োজনে এই গ্যাপ অথবা সংকট সীমাবদ্ধতা যাই বলি না কেন একদিন দূর হয়ে যাবে।
আনন্দ আলো: দেশে এত টেলিভিশন চ্যানেল। বিষয় ভিত্তিক চ্যানেল নাই কেন? যেমন খেলাধুলা… কৃষি বিষয়ক…
শাইখ সিরাজ: হ্যাঁ দেশে বিষয় ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল খুবই জরুরি। পর্যটন, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিষয় ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল হয়ে যাওয়ার এখনই সময়। তা নাহলে আমরা অনেক পিছিয়ে যাব।
আনন্দ আলো: প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলে নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমা প্রচার হয়। তবুও দেশের এক শ্রেণির দর্শক অন্যদেশের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানের প্রতি অনুরক্ত। কেন?
শাইখ সিরাজ: এর নানাবিধ কারণ রয়েছে। একথাতো সত্য আমাদের টেলিভিশন চ্যানেল সমূহে অনুষ্ঠানের কনটেস্ট ততোটা উন্নত নয়। আমরা একটি অনুষ্ঠানের পিছনে সাধারণত যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করি তা অনুষ্ঠান ভালো করার জন্যও যথেষ্ট নয়। আবার একথাও সত্যি কম বাজেটেও ভালো অনুষ্ঠান নির্মাণ সম্ভব। যদি কনটেন্ট ভালো হয় তাহলে সম্ভব। ভাবতে হবে টেলিভিশন অনুষ্ঠান আমাদেরকে যেন কুশিক্ষা না দেয়। আমরা পাশের দেশের যে সব টিভি অনুষ্ঠানের প্রতি ইঙ্গিত করছি সেগুলো আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে শোভন নয়। ঐসব নাটক অথবা অনুষ্ঠান আমাদের সমাজকে রিপ্রেজেন্ট করে না। তারপরও অনেকে বলতে চান দর্শক নাকি এ ধরনের অনুষ্ঠান চায়। এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হচ্ছে দর্শক চাইলেই তো আমরা অবিবেচকের মতো যা খুশি তাই দেখাতে পারি না। দর্শকের রুচিবোধ তৈরি করার দায়িত্বও কিন্তু আমাদের। এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও আন্তরিক হতে হবে।
আনন্দ আলো: চ্যানেল আই নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
শাইখ সিরাজ: পরিকল্পনা করে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা আসলেই কঠিন কাজ। আমাদের দেশের অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, রাজনীতির প্রবাহমান ধারার সঙ্গে পরিবেশ, প্রকৃতিসহ আরও অনেক কিছু জড়িত। প্রতিটি বিষয়কে মাথায় রেখেই কিন্তু টেলিভিশনে কনটেন্ট তৈরি হয়। আরেকটি জরুরি বিষয় হলোÑ তথ্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে গেøাবাল পরিস্থিতি ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। আগে বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে বদলটা হয়তো চোখে পড়তো এক বছর অথবা দু বছর পর এখন সেটা চোখে পড়ে হয়তো প্রতি মাসে। এমনকি প্রতি সপ্তাহেও। এই যে মানুষের জীবন ব্যবস্থার দ্রæত পরিবর্তন ঘটছে সেখানে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে পথ চলা মুশকিল। তবে হ্যাঁ সময়ের সঙ্গে হাঁটতে, চলতে চ্যানেল আই অনেক অগ্রগামী তা ইত্যেমধ্যেই প্রমানিত সত্য। টেলিভিশন চ্যানেল সমূহে গতি সঞ্চারী নানা ধরনের অনুষ্ঠান দরকার। তরুণেরা একাজে সহায়তা করতে পারে। চ্যানেল আই সব সময় তারুণ্যকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। আর তাই অতীতের মতো তারুণ্যের ওপরই আমরা ভরসা করতে চাই।