Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

নায়ক যখন মহানায়ক

শহীদুল হক খান: রাজ্জাক, নায়ক রাজ্জাক, নায়করাজ রাজ্জাক এই তিনে মিলে তিনি ১৬ কোটি মানুষের নন্দিত একজন মানুষ ছিলেন। যার অভিনয়, যার ব্যক্তিত্ব, যার পর্দা উপস্থিতি, যার স্টাইল ছোট-বড় সকলকে আকর্ষণ করেছে। বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি ছেলেদের কাছে, মেয়েদের কাছে, ছোট-বড় মাঝারি সবার কাছে আইডল হিসেবে, স্বপ্ন নায়ক হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। পশ্চিমবাংলার উত্তম কুমারের উত্তরসূরি, বিশ্বজিতের সাদৃশ্য ধারণ করে আমাদের প্রথম সুপারহিরো রহমানের স্নেহধন্য হয়ে তিনি একের পর এক শত শত ছবিতে অভিনয় করেছেন। নায়ক হিসেবে তার মতো এত বেশি ছবি সারা পৃথিবীতে কেউ করেছেন কি না তার দৃষ্টান্ত বিরল।

সেই সুদূর অতীতে, রাজ্জাক যখন আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন, কলকাতার টালিগঞ্জ পাড়ার খুব কাছাকাছি বাঁশদ্রোনী এলাকা থেকে এই দেশে এসেছিলেন কর্মের সন্ধানে। আমি তখন সাতরং পত্রিকার সম্পাদক। রাজ্জাক থাকতেন ফার্মগেটের কাছাকাছি গ্রীণ রোডে রাস্তার পশ্চিম পাশে একটা একতলা বাড়িতে। বিভিন্ন জায়গায় নাটক করতেন। আমি গিয়েছিলাম তার সাক্ষাৎকার নিতে। সাক্ষাৎকার নিলাম। সাক্ষাৎকারের সংগে তিনি একটি ছবি দিলেন। কলারওয়ালা টাওয়েল গেঞ্জি গায়ে অত্যন্ত সুদর্শন লাগছিল। রাজ্জাকের এটাই ছিল এদেশে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম সাক্ষাৎকার এবং প্রথম মুদ্রিত ছবি। এই ছবির ওই সময়ের রাজ্জাককে নায়ক হিসেবে শুধু পরিচিত করল তাই নয় তিনি হয়ে উঠলেন সেই সময়ের যুবকদের কাছে আদর্শ ও পছন্দের পুরুষ।

রাজ্জাক ‘উজালা’, ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেনসহ’ দু’তিনটি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তার উপস্থিতি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হলেও তাঁকে যারাই দেখেছেন নিজের সঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করেছেন কিংবা নিজেকে রাজ্জাক ভাবতে শুরু করেছেন। চুল কাটা থেকে শুরু করে গায়ের পোশাকটি পর্যন্ত রাজ্জাক রাজ্জাক একটা ভাবের জন্ম দিয়েছে।

আমার আরো একটি সৌভাগ্যের কথা বলি। রাজ্জাক তখন টেলিভিশনে ঘরোয়া নামের একটা সিরিয়ালে অভিনয় করতেন যার প্রযোজক ছিলেন জামান আলী খান (অভিনেত্রী আজমেরী জামান রেশমার স্বামী এবং সংবাদ পাঠক রাহবার খানের বাবা)। ওই সিরিয়ালের শুটিং করতে যাওয়ার পথে আমি রাজ্জাককে নিয়ে গিয়েছিলাম দিলু রোডের একটি বাড়িতে। যেখানে নায়িকা কবরী থাকতেন। কবরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। আমাদের সংগে ফটোগ্রাফার হিসেবে ছিলেন আব্দুল মালেক, গ্রীণ রোডে তার একটা স্টুডিও ছিল, বাসা ছিল মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় মাটির মসজিদের সামনে। মালেক সাহেব ফটো শ্যুট করলেন। সিকোয়েন্স সাজানো হয়েছিল এইরকম নায়িকা কবরীর টিভি সেটটি নষ্ট হয়ে গেছে, রাজ্জাক তা সারিয়ে দিচ্ছেন। এই ফটো শ্যুটেও রাজ্জাকের পরনে ছিল লাল গেঞ্জি। যদিও ছবি ছাপা হয়েছিল সাদা কালোয় তবে এদেশের যুবসমাজের মধ্যে এই গেঞ্জি (টি-শার্ট) এর  প্রচলন এমনভাবে হয়েছিল যে একে টি-শার্ট না বলে সবাই রাজ্জাক টি-শার্ট বলত। একইভাবে রাজ্জাকের আরেকটি পোশাক ছোট-বড় সকলের মধ্যেই বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সেটা হলো কলারওয়ালা পাঞ্জাবি। এই পাঞ্জাবি রাজ্জাক পড়েছিলেন তার সুপার ডুপার হিট ‘রংবাজ’ ছবিতে, যেই ছবির পরিচালক ছিলেন জহিরুল হক।

রাজ্জাক পশ্চিমবাংলা থেকে পূর্ববাংলায় এসেছিলেন এটা ইতিহাস, রাজ্জাক জহির রায়হানের হাত ধরে নায়ক হয়েছিলেন এটাও ইতিহাস, সুভাষ দত্ত, কাজী জহির, মুস্তাফিজ, মিতা এমন অনেক নামি-দামি নির্মাতার ছবিতে অভিনয় করেছিলেন এটাও ইতিহাস, কবরীর সঙ্গে জুটি বেঁধে রহমান-শবনম জুটিকে পেছনে ফেলে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছেন এটাও ইতিহাস, নায়ক প্রযোজকের পাশাপাশি ‘অনন্ত প্রেম’, ‘চাঁপা ডাঙ্গা বউয়ের’ মতো অনেক ছবি নির্মাণ করে পরিচালক হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়েছেন এটাও ইতিহাস, এদেশে প্রথম নায়ক হিসেবে শত ছবি পূর্ণ করার পর সকল নায়করা মিলে তাকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন এটাও ইতিহাস, নিজের সুযোগ্য কন্যা ও পুত্রদের চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দিয়ে তারকা বানিয়েছেন এটাও ইতিহাস। সবচেয়ে বড় ইতিহাস একজন মানুষ রাজ্জাক নায়ক রাজ্জাক থেকে নায়করাজ রাজ্জাক হয়েছেন এবং সেই নায়করাজ রাজ্জাককে আজ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই মহানায়ক হিসেবে মাথায় তুলে রেখেছেন। তার বলা, তার চলা, তার ভঙ্গি, তার আকর্ষণ সবার কাছে সর্বসময় অনুকরণীয় ছিল, আছে এবং থাকবে।

জীবনের আয়নায় নায়করাজ

Razzak-Koboriনায়করাজ রাজ্জাক বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ প্রতীম এক অভিনেতার নাম। তার আসল নাম মো: আব্দুর রাজ্জাক। ডাকনাম রাজা। বাবা-মা আদর করে ডাকতেন রাজু বলে। চলচ্চিত্রে তিনি রাজ্জাক নামে সবার কাছে এক কিংবদন্তি অভিনেতা। রাজ্জাক নামের আগে নায়করাজ উপাধি দিয়েছেন অধুনালুপ্ত চলচ্চিত্র সাপ্তাহিক চিত্রালীর সম্পাদক, প্রয়াত বিশিষ্ট গীতি কবি, সংলাপ রচয়িতা ও কাহিনীকার আহমদ জামান চৌধুরী। নায়করাজের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতার টালিগঞ্জের নাগতলায়। বাবার নাম আকবর হোসেন, মায়ের নাম নেসারুন্নেসা। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে রাজ্জাক সবার ছোট। তার বাবার ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ব্যবসা।

আট কী নয় বছর বয়সে বাবাকে হারান নায়করাজ। মানুষ হয়েছেন বড় ভাই-বোনদের আদর যতেœ। ফুটবল খেলার প্রতি ছিল তাঁর প্রচÐ ঝোঁক। কলকাতার স্কুল ফুটবল এরিনায় গোলরক্ষক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। লেখাপড়া করেছেন কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে। এই স্কুলে সরস্বতী পূজার সময় প্রতি বছর নাটক মঞ্চস্থ হতো। সেখানে নিয়মিত অভিনয় করতেন তিনি। স্কুলে তার অভিনীত প্রথম মঞ্চ নাটক ‘বিদ্রোহী’। এই নাটকে তাঁর অভিনয় দেখে নাট্যগুরু পীযূষ বোস শিশুরঙ্গ সভায় সদস্য করে নেন রাজ্জাককে। তার পর থেকে একের পর এক নাটকে অভিনয় করতে থাকেন তিনি। সপ্তম শ্রেণি থেকে মেট্রিক পর্যন্ত প্রায় দুইশত নাটকে অভিনয় করেন রাজ্জাক।

মেট্রিক পাস করার পর রাজ্জাকের পরিবার নাটকে অভিনয় করাকে প্রথম দিকে মেনে নিতে পারেনি তার ভবিষ্যৎ-এর কথা চিন্তা করে। পরে মেজভাই আব্দুল গফুর পরিবারের সবাইকে বোঝানোর পর কেউ আর অভিনয়ে আপত্তি করেননি। ১৯৬২ সালের ২ মার্চ পরিবারের সিদ্ধান্তে রাজ্জাক বিয়ে করেন। তখন রাজ্জাকের ১৯ বছর বয়স। তাঁর স্ত্রীর নাম খায়রুন্নেসা ওরফে ল²ী। কলকাতার চলচ্চিত্র নগরী টালিগঞ্জ রাজ্জাকের বাড়ির একেবারে কাছাকাছি। তাই ছোটবেলা থেকে সেখানকার বাংলা চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ১৯৬১ সালে রাজ্জাকের গুরু পীযূষ বোস চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। মূলত তাঁর কারণে টালিগঞ্জের বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। তাঁর মধ্যে আছে রতনলাল বাঙালি, পংকতিলক, শিলালিপি, এতটুকু আশা ইত্যাদি। ১৯৬৪ সালে তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকার কমলাপুরের ঠাকুর পাড়ার একটি ছোট্ট ঘর ভাড়া নেন। এখান থেকে শুরু হয় তার ঢাকার চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কঠিন সংগ্রাম।